আরেক রকম ● নবম বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২১ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৮

প্রবন্ধ

যে পথে বাংলাদেশ

স্বপন ভট্টাচার্য


১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার সময় সে দেশে জনসমষ্টির ২৩.১ শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু যার সিংহভাগই হিন্দু। ২০১১ সালের জনগণনার তথ্যানুযায়ী তা চল্লিশ বছরে নেমে দাঁড়িয়েছিল ৯.৬ শতাংশে। বাংলাদেশের ধর্মীয় মানচিত্রে এখন ৮.৫ শতাংশ হিন্দু, ০.৬ বৌদ্ধ এবং ০.৩ শতাংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ছাড়াও সে দেশে ১.৮ শতাংশ মানুষ জনজাতির আওতাভুক্ত। মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে এদের বাস এবং এরা প্রধানতঃ চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরা গোষ্ঠীভুক্ত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষ। সরকার ২৭টি ‘এথনিক গ্রুপ’-এর অস্তিত্ব মানলেও এদের ইন্ডিজেনাস অর্থাৎ আদিবাসী তকমা দিতে রাজি হয়নি। সে দেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা প্রধানত সুন্নী মুসলমান, তবে এরা ছাড়াও আছে শিয়া মুসলিমরা এবং আহমদিয়া সম্প্রদায় যারা নিজেদের মুসলমান হিসেবে পরিচিতি চাইলেও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় তা মনে করে না, সুতরাং এরাও সদর্থেই সংখ্যালঘু। এছাড়া ঢাকা শহর সহ দেশের অন্যান্য জেলায় ছড়িয়ে থাকা ১১৩টি ক্যাম্পে বসবাস তিন লক্ষ ‘বিহারী’ অবাঙালি মুসলমানের যারা বিহার থেকে ১৯৪৭-এর ভারত বিভাজনের পর স্বেচ্ছায় পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামাবাদকে সমর্থন করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর এদের মধ্যে যারা পশ্চিমে পালাতে পারেনি তাদের ভাগ্য পাকিস্তানের পরাজয়ের ও আত্মসমর্পনের পরে এদেশের শরনার্থী শিবিরে বাঁধা পড়েছে এবং এদেরও সংখ্যালঘু গণ্য করা যায়।

‘মাইনরিটি ওয়াচ’ - যারা সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘু মানুষের অবস্থা নিয়ে কাজ করে থাকে, তাদের মতে মেজরিটারিয়ান রাজনীতির সুবিধা হতে পারে এমন কিছু উপাদান ১৯৭২-এ প্রবর্তিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে ছিল। (১) সংবিধানের ১ নম্বর ধারায় ‘ইউনিটারি ষ্টেট’ ঘোষণা এবং ৬ নম্বর ধারায় রাষ্ট্রকে ‘বেঙ্গলি নেশন’ রূপে চিহ্নিত করা এবং ৯ নম্বর ধারায় ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’কে দেশের ঐক্য এবং সংহতির উৎস বলে ঘোষণা করায় বাংলাদেশকে ‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের’ রাষ্ট্র বলতে এদের কিছু অসুবিধে আছে বলে মনে হয়। মাইনরিটি ওয়াচের মতে বাংলাদেশে ৪৫ রকমের ভাষাগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী আছে এবং চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীরা আছে যারা indegenous বা আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃত নয় বলে তাদের এই সংবিধানবলে অবহেলিত থাকার একটা সম্ভাবনা থেকেই গিয়েছিল।

সে তারা যাই বলুক না কেন, এই সংবিধানে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুত্ববাদের সরীসৃপটিকে সংহত রাখার প্রয়াস নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তাই ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেননি তিনি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সমানাধিকার, মানবতাবোধ এবং সামাজিক ন্যায় সুনিশ্চিত করার (in order to ensure for the people of Bangladesh equality, human dignity and social justice) আশ্বাস এই সংশয়ও দূরে রাখতে পেরেছিল যে স্বাধীন বাংলাদেশে পরধর্ম পালনে এবং পরমত পোষণে কোনো বাধা আসতে পারে। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সময় বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা ছিল, কিন্তু কোনো জাতীয় ধর্ম ছিল না। ১৯৭২-এর সংবিধানে ১২ নম্বর ধারায় বর্জন বা elimination সুনিশ্চিত করা হল - ‘communalism in all its forms; the granting by the state of political status in favour of any religion; the abuse of religion for political purposes; any discrimination against or persecution of persons practising a particular religion’ - সমস্ত রূপের সমস্ত ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, কোনো ধর্মকেই রাজনৈতিক মর্যাদাদান, ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিক সুবিধালাভের চেষ্টা এবং যে কোনো ধর্ম পালনের জন্য কোনো নাগরিককে কাঠগড়ায় তোলার বিরুদ্ধে লড়বার হাতিয়ার ছিল এই সংবিধান।

ধর্মের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছিল, সুতরাং উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনা স্বাধীনতাপূর্ব পাকিস্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মুছে যায়নি, তবে পূর্ব পাকিস্তান যাত্রা শুরুই করেছিল একটা তুলনামূলক সুবিধা নিয়ে। সেখানে প্রায় সব মানুষ বাংলা ভাষাভাষী, ফলে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুত্বের চেনা ডিসকোর্স এখানে সহজে খেটে যেতে পারেনি। বিভাজনপূর্ব কালের অত দাঙ্গা বা রক্তপাতের পরেও পূর্বের ২২ শতাংশেরও বেশি হিন্দু, প্রতিবেশীদের উপর ভরসা রেখে থেকে গিয়েছিল সেখানে। ধর্ম নয়, ভাষার বন্ধন ছিল সে ভরসার পিলসুজ। ইসলামাবাদের শাসকরা এই ভাষাবন্ধনকে ভয় পেত বলেই ধর্মকে বাহন করতে শুরু করেছিল প্রথম থেকেই। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে একদিকে যেমন রাজনীতি হয়ে দাঁড়াল কনফ্রন্টেশনাল - সংঘর্ষময়, উল্টোদিকে তেমনই বাড়তে শুরু করল সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন। শত্রু সম্পত্তি আইন তথা অর্ডার এতে বাড়তি ইন্ধন জুগিয়েছিল। দুঃখের কথা, স্বাধীনতা অর্জনের পরেও এই আইনই হয়ে উঠেছিল সংখ্যালঘু পীড়নের প্রধান হাতিয়ার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বরকত এই বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। (২) অধ্যাপক বরকত দেখিয়েছেন পূর্বতন এনিমি প্রপার্টি তথা ভেস্টেড প্রপার্টি অ্যাক্ট-এর বলে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম দুটি সরকারের আমলে বাংলাদেশের হিন্দুদের হাতে থাকা জমির ৫৩ শতাংশ হস্তান্তরিত হয়ে যায়। ২০০০ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে এই আইনে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু পরিবারের সংখ্যা ৯ লক্ষ ২৫ হাজার। এদের মধ্যে চাষযোগ্য জমি হারিয়েছিল ৭ লক্ষ ৪৮ হাজার পরিবার।

এই জমির মোট পরিমাণ ৬৬৪০ বর্গ কিলোমিটার। এই হিসেব স্বাধীনতা উত্তরকালের। অধ্যাপক বরকতের তথ্য অনুযায়ী এই জমি দখলের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার (১৯৭২-৭৫) এবং তার পরবর্তী বিএনপি সরকারের (১৯৭৬-৮০) আমলে আর হস্তান্তরিত জমি পৌঁছেছে যাদের হাতে তারা দেশের মাত্র ০.৪ শতাংশ লোক অর্থাৎ দেশের ৯৯.৬ শতাংশ লোকের আদতে এতে কোনো অংশীদারিত্ব নেই। সব দেশেই কাঠি নাড়ায় কেউ কেউ নিজের স্বার্থে আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ক্রীড়নকের ভুমিকা পালন করে মাত্র, এতে তাদের কোনো প্রত্যক্ষ লাভ হবার নয় বুঝেও করে। বরকত সাহেব দেখিয়েছেন, ১৯৪৮ থেকে শুরু করে এই আইনের বলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ৭৫ শতাংশ হিন্দু সংখ্যালঘুর জমি বেহাত হয়ে গেছে। হাসিনা সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে এই আইন বাতিল করলে পরিস্থিতির যে স্থিতাবস্থায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা তৈরি হয় তার প্রায়োগিক নিদর্শন খুব একটা নেই। সুতরাং জমি দখল এবং সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হল প্রথম এবং প্রধান প্রণোদনা যা সংখ্যালঘু পীড়নের জন্য দায়ী বলে বিবেচিত হতে পারে।

দ্বিতীয় প্রধান কারণ হল মুক্তিযুদ্ধ - বিরোধীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্বাসন। ১৯৭৫-এ শেখ মুজিবর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরবাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে পরিবর্তন এলো তার সব চেয়ে বড় প্রভাব পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণার উপরেই। রক্তপাতের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা এলে যে আনুপূর্বিক বদলের সম্ভাবনা সে দেশের জাতীয় চরিত্রে ঘটবে বলে আশা করা গিয়েছিল ঠিক তাই হল ১৯৭৭ সালে যখন জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সংবিধানের সেকুলার ভিত্তিটিকে বর্জন করা হল। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের থেকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের দিকে এই যাত্রা আরও সংহত ও জোরদার হল ১৯৮১-তে যখন জিয়ার হত্যাকাণ্ড ঘটে যাবার পরে হোসেইন মহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলেন। ১৯৮৮-তে এরশাদ ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় ধর্ম হিসাবে ঘোষণা করলেন।মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব রাজাকার, আল বদর, আল শামস হানাদাররা পাকিস্তানি বাহিনীকে সরাসরি সহায়তা করেছিল তাদের শাস্তির জন্য ১৯৭২ সালেই প্রবর্তিত হয় বাংলাদেশ কোলাবরেটরস অর্ডার চলতি কথায় ‘দালাল আইন’। মোট ৩৭,৪৭১ জনকে বন্দী করে বিচারের কাজ শুরু হয়। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে প্রায় তিন হাজার মামলা রুজু করা হয়। বিচারে প্রায় ৭০ শতাংশই মুক্তি পেয়ে যায় কেন না তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ৩০ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সাপেক্ষে যে কোনো দেশে মানবতার এবং সুবিচারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটি একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত যার তুলনীয় ক্ষমার নজির ইতিহাসে খুব বেশি পাওয়া যাবে না। রাষ্ট্রদ্রোহিতা, দস্যুবৃত্তি বা নারীধর্ষনের মত প্রমাণিত অপরাধের জন্য ৭৫২ জন সাজা পায়। এদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাবাসের শাস্তি পাওয়া অপরাধীরা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবার পর দালাল আইনটিই বাতিল হয় এবং আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্ত অনেকেই সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। তারা পুনরায় ফেরার সুযোগ পায় প্রেসিডেন্ট এরশাদের সময় এবং ধরাই যেতে পারে আওয়ামী লিগের প্রতিস্পর্ধী একটি শক্তি হিসেবেই তারা আমন্ত্রিত হয়ে থাকবে।

জামাতের প্রতিনিধিত্ব করে তারা নির্বাচনে অংশ নেয় ১৯৯৬ সালে এবং মাত্র তিনটি আসনে জিতে এলেও দেখা গেল তাদের পিছনে প্রায় নয় শতাংশ মানুষের জনসমর্থন আছে। ২০০১-এর সাধারণ নির্বাচনে দেশের চতুর্থ বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে উঠে আসে বাংলাদেশ জামাত-এ-ইসলামী পার্টি। মাত্র সাড়ে চার শতাংশ ভোট শেয়ার থাকলেও ১৭টি আসনে জেতে তারা। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চার দলের কোয়ালিশনের অংশ হিসেবে মন্ত্রীসভার কৃষিমন্ত্রী হন তৎকালীন জামাত প্রধান মতিউর রহমান নিজামী। এ হল সেই নিজামী যারবিরুদ্ধে পাকিস্তানী রাজাকার-আল বদর বাহিনীর মদতদাতা হিসাবে একাত্তরের মে মাসে পাবনায় হত্যা এবং নারী ধর্ষনের মত অভিযোগ ছিল [সমকাল, ২ নভেম্বর ২০১৪]।

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে নিজামীকে কৃষিমন্ত্রী করে বেগম জিয়া কী বার্তা দিতে চেয়েছিলেন জানা নেই কিন্তু এর পরবর্তী তিনটি নির্বাচনে, যথাক্রমে ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮-তে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লিগ উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধি করেছে। ৩০০ আসনের জাতীয় সংসদে এককভাবে আওয়ামী লীগের আসনসংখ্যা ২৫৭ এবং প্রায় ৭৫ শতাংশ ভোট শেয়ার তাদের, কিন্তু তা সাম্প্রদায়িকতার বীজ নির্মূল করতে পারেনি। হাসিনা কঠোর হয়েছেন প্রতিশ্রুতি মত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি। নিজামীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে এবং জামাতের কর্মকর্তা আবদুল কাদের মোল্লা, মহম্মদ কামরুজ্জামান, আলি আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে বার্তা দিয়েছে ব্লগার অভিজিত রায়ের খুনে সামিল পাঁচ হত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে কিন্তু এরই পাশাপাশি ২০১৩ থেকে ২০১৬ এর মধ্যেকার সময় - পিরিয়ড অফ টার্বুলেন্স - উথাল পাথাল সময় বাংলাদেশ সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত কারণে বিশ্ববাসীর নজরে এসে পড়েছে। অভিজিত রায়, অনন্ত বিজয় দাস, ওয়াশিকুর রহমান, নিলয় চ্যাটার্জি, ফয়সল আরেফিন দীপন - তালিকা দীর্ঘ। মুক্তমনা মানুষ, ঈশ্বরবিশ্বাসী নয় এমন মানুষ, ভিন্নতর যৌনরুচির মানুষ সে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু যাই হোন না কেন আক্রমণের লক্ষ হয়েছে। ১লা জুলাই ২০১৬-তে সংঘটিত ঢাকার আর্টিসান কাফে হত্যাকাণ্ডর মত ইসলামিক স্টেট গোছের ভয়াবহতার মোকাবিলা করতে হয়েছে এই সরকারকে যে হামলায় বিদেশী নাগরিকও মারা পড়েছিল। মৌলবাদের যে স্পেস বাংলাদেশে তৈরি ছিল তা যে ক্রমশ বাড়ছে তা অস্বীকার করার চেষ্টা করছেন না সে দেশের বুদ্ধিজীবীরাও।

তৃতীয় কারণ হল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রভাব। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে আমেরিকান তালিবান যোদ্ধা ওয়াকার লিন্ড সিএনএন চ্যানেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলে যে আল কায়দা পরিচালিত আনসার ব্রিগেড, আফগানিস্তানে যার সদস্য ছিল সে, তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষী দলে বিভক্ত ছিলঃ বাংলা, পাকিস্তানি (উর্দু) এবং আরবী। (৩) যদি তার কথা সত্য হয় তাহলে ধরে নিতে হবে হয় বাংলাভাষী বাংলাদেশ অথবা ভারত অথবা রোহিঙ্গাদের এবং হয়ত বা এদের সকলেরই কৌমী প্রতিনিধিত্ব ছিল মৌলবাদী মুসলিম আন্দোলনে। তা যে আরো আগে থেকেই ছিল তার প্রমাণ মেলে এই সংবাদে যে ১৯৯৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘জিহাদ মুভমেন্ট অফ বাংলাদেশ’-এর নেতা ফজলুর রহমান আমেরিকার বিরুদ্ধে ‘হোলি ওয়ার’ ঘোষণাপত্রে বিন লাদেন, আল জোয়াহিরি এবং পাকিস্তানের শেখ মীর হামজার সঙ্গে যৌথভাবে সাক্ষরকারী ছিল। (৪) আমেরিকায় ৯/১১-এর ঘটনা যখন ঘটে বাংলাদেশ তখন নির্বাচনী প্রচারের মধ্যে ছিল। শেখ হাসিনা এবং বেগম জিয়া উভয়েই এই ঘটনার নিন্দা করেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষও আহত হয়েছিলেন কেন না অন্তত ৫০ জন বাংলাদেশী নাগরিকের জীবনহানি ঘটেছিল। বেগম জিয়া আল কায়দা জঙ্গিদের উপর আক্রমণ চালানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এয়ার স্পেস পর্যন্ত ব্যবহার করতে দিতে রাজি ছিলেন কিন্তু, জামাতের অবস্থান স্বতন্ত্রতর ছিল এবং তারা ‘আমেরিকার আগ্রাসনে নিহত’ আফগান নাগরিকদের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করার ডাক দিলে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে সাড়া দেন। অতএব, ২০০১-এর নির্বাচনে যে বেগম খালেদার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে এর মধ্যে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই কেন না জনসমর্থন ভীষণভাবেই আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে চলেছিল।

চতুর্থ কারণ হিসেবে ভারতবিরোধী জনমানসিকতার কথা বলতেই হয়। ইন্দিরা গান্ধীর সক্রিয়তা, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা এ সব কিছু গৌণ হয়ে আসতে শুরু করেছিল পাকিস্তানপন্থীরা পুনর্বাসিত হবার পরে এবং ১৯৯২-এর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা তাতে প্রয়োজনীয় ইন্ধন জুগিয়েছে। তদুপরি, বিজেপি সরকারের ভাবমূর্তিটি প্রতিবেশী দেশের চোখে মুসলিমবান্ধব নয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের সখ্য কূটনৈতিকতার আলোকে দেখবে সে দেশের সাধারণ মানুষ, এমন বাতাবরণ সৃষ্টির প্রয়াস রয়েছে কিনা তা সময় বলবে তবে শেখ হাসিনা এসব সত্ত্বেও তাঁর ভারতবান্ধব অবস্থানে সুনিয়ন্ত্রিত ভারসাম্য রেখে চলেছেন। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা বোঝা গেছিল যখন নরেন্দ্র মোদী এই ২০২১’এই বাংলাদেশ সফরে গেলে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে এবং অন্ততপক্ষে ১০ জন মানুষ প্রাণ হারান।

পঞ্চম কারণ হল সে দেশের ভিতর ও বাইরে সক্রিয় পশ্চাতমুখী শক্তি। একটি অগ্রসরমান, লিবারেল, মুসলিম নেশন থেকে একটি অনুদার, ধর্মভিত্তিক, পিছিয়ে পড়া মুসলিম নেশনের দিকে যাত্রা শুরু করুক বাংলাদেশ এমন শক্তি সে দেশের ভিতর থেকে এবং বাইরে থেকে মদত পেয়ে চলেছে। ৩০০ আসনের জাতীয় সংসদে এককভাবে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা ২৫৭ এবং প্রায় ৭৫ শতাংশ ভোট শেয়ার তাদের কিন্তু তা সাম্প্রদায়িকতার বীজ নির্মূল করতে পারেনি। তবু একথা বলতেই হয় যে, সংখ্যাগুরুবাদের সেই ধারণার সঙ্গে লিবারেল মুসলিম নেশনের ধারণার লড়াই এখনও যে জারি রয়েছে আশার কথা সেটাই নয়তো বাংলাদেশ হয়ত ইতিমধ্যেই পিছনে হাঁটতে শুরু করতে পারতো। ১৯৭১-এ, বাংলাদেশের জন্মের সময়, পশ্চিম পাকিস্তান ছিল পূর্বের তুলনায় ৭০ শতাংশ ধনশালী দেশ আর আজ বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদযাপন করছে, তখন জিডিপি’র মাপে সে পাকিস্তানের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বেশি সম্পদশালী তো বটেই এমনকি জনপ্রতি রোজগারের নিরিখে একজন বাংলাদেশীর অবস্থা একজন ভারতীয়ের তুলনায় ভালো। অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন তুলছেন কীভাবে এখনও ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা) অথবা সিভেটস (কলম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা) মত আন্তর্জাতিক ফোরামের বাইরে এমনকি জি-২০ গোষ্ঠীর বাইরে বাংলাদেশকে না রাখা সম্ভব হচ্ছে এখনও?

এ আলোচনার উপসংহার টানতে হবেই এবার। যে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে এত কান্ড ঘটে গেল এ লেখা শেষ করার আগে সেই প্রসঙ্গ একটু ছুঁয়ে যেতেই হচ্ছে। দূর্গাপূজাকেই একটা সামাজিক আস্থার মাপকাঠি করা যায় কিনা দেখতে গিয়ে পরিসংখ্যান পেলাম ২০১৭ সালে সে দেশে ২৯ হাজার ৭৪টি মন্ডপে প্রতিমার পূজা হয়েছিল। মাত্র এক বছর পরেই ২০১৮-তেই সেই সংখ্যা প্রায় ৩৪ হাজারে পৌঁছায়। সরকারে এবং মানুষে আস্থা ছাড়া এই হাজার পাঁচেক পূজা একটি মাত্র বছরে নতুন করে পত্তন হওয়া এপার বাংলাতেও বিরল মনে হয়। আমরা এই বঙ্গে পূজা উপলক্ষে সরকারি খয়রাত দেখে আসছি কিন্তু খুব কম লোকই জানি বাংলাদেশে প্রতিটি পূজা কমিটিকে চাল এবং নগদ টাকা দিয়ে সাহায্য করার নজির রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওয়াজেদ। নেত্রীর প্রতি আস্থা এবং মানবতায় বিশ্বাসী সাধারণ ধর্মপ্রাণ সৌভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী সহনাগরিকের প্রতি বিশ্বাস - এগুলি বড় পুঁজি সে দেশের হিন্দুদের। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা অন্তত রাষ্ট্রীয় স্তরে এবং বিচারব্যবস্থায় ছাড় পাবে না তার অনেক অভিপ্রায় চিনতে ভুল হবার নয়। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারাটি ফিরে এসেছে। জাতীয় ধর্মের বিধানটিও বাতিল করতে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু নির্বাচন বড় বালাই। আর দু’বছর পরেই সেদেশে নির্বাচন। ভয় হয় আগামী দিনে হিন্দুদের হয়ত আরো অনেক উথাল পাথাল সময়ের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্রমশ যতই উজ্জ্বল হতে থাকবে ততই ভিতর এবং বাইরে থেকে তা চুর্ণ করার চেষ্টা জারি থাকবে। তাই, মানুষ নেতৃত্বের স্পষ্ট উচ্চারণ শুনতে চায়। অভিজিত রায়ের স্ত্রী বন্যা আহমেদকে আক্ষেপ করতে শুনি অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং সহ-আক্রান্ত হওয়া সত্বেও না সরকার না প্রসিকিউশন - কেউ নাকি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগই করেননি [প্রথম আলো, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১]। সুতরাং, সরকারের কিছু বাধ্যবাধকতা আছে বোঝা যায় যেগুলোকে সঙ্গী করে হাঁটতে গেলে দড়ির উপর দিয়েই হাঁটতে হয়। তার প্রভাবমুক্ত থাকা সে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পক্ষে কতদূর সম্ভব সে দিকে নজর রয়েছে সারা বিশ্বের। আমাদের ভয় করে এই ভেবেও যে মৌলবাদ ধর্মে ধর্মে যতই বিভেদ তৈরি করুক, সেখানে প্রতিস্পর্ধীরা একে অন্যের থেকে রসদ আহরণ করে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভারতেও মৌলবাদীদের কাছে পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা তুরুপের তাস। আফগানিস্তানে তালিবানি শাসন কায়েম হবার পরে তা পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে অনুমান করা যায়। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, নারীশক্তির বিকাশ এবং বিশ্বনাগরিক হয়ে ওঠার স্বপ্ন - এই নিয়ে এগোচ্ছে আজকের বাংলাদেশ। তার যাত্রাপথ মসৃণ না হোক, লক্ষচ্যুত না হয়ে পড়ে বাংলাদেশ এ আমদের সবার কামনা।


সূত্রঃ
১। https://minorityrights.org/Bangladesh
২। Abul Barkat (2001) An Inquiry Into Causes and Consequences of Deprivation of Hindu Minorities in Bangladesh Through the Vested Property Act: Framework for a Realistic Solution. PRIP Publications
৩। Bertil Linter (2001) https://www.satp.org/satporgtp/publication/faultlines/volume14/article1.htm
৪। ঐ