আরেক রকম ● নবম বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২১ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৮

সমসাময়িক

কাশ্মীর ভালো নেই


কাশ্মীর আবার সংবাদের শিরোনামে। কাশ্মীরে জঙ্গি হানা আবার বেড়েছে। অক্টোবর মাসের শুরু থেকে কাশ্মীরে যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, যেমন কাশ্মীরি পণ্ডিত, শিখ এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে কাশ্মীরের ইসলামি সাম্প্রদায়িক জঙ্গিরা। এই মৃত্যুর কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। এই মৃত্যুর কোনো রাজনৈতিক সমর্থন থাকতে পারে না। কাশ্মীর উপত্যকায় শত সমস্যার পরেও যতটুকু কাশ্মীরিয়াত বেঁচে আছে, যা কিছু ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের পক্ষে অবস্থান করছে, জঙ্গিদের এই নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা কাশ্মীরিদের এই ঐতিহ্যকেই ধ্বংস করতে চায়। এই জঙ্গিরা কোনোভাবেই কাশ্মীরের মানুষের ভালো চায় না। কারণ এই হত্যাগুলির ফলে আবারো দেশজুড়ে কাশ্মীরি মানুষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু হয়েছে। এই মৃত্যুকে অজুহাত করে দেশ তথা এই উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। অনেকেই মনে করছেন বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর আক্রমণ এবং ত্রিপুরাতে তার প্রতিক্রিয়ায় মুসলমান সমাজের উপর আক্রমণ কাশ্মীরের ঘটনার সঙ্গে একই সূত্রে গাঁথা। অতএব, কাশ্মীরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণকে দেখতে হবে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে বাড়তে থাকা ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির আস্ফালনের সঙ্গে। ঠিক এই কারণেই প্রগতিশীল শক্তির কর্তব্য কাশ্মীরের সংখ্যালঘু মানুষের পাশে দাঁড়ানো।

সংখ্যালঘু মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই সংকল্প নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জোরালো প্রশ্ন তুলতে হবে কেন্দ্রীয় সরকার তথা মোদী-শাহের রাজনীতি নিয়ে। ২০১৬ সালে দেশে নোটবন্দী করা হল। বলা হল এর ফলে নাকি কাশ্মীরে উগ্রপন্থা শেষ হয়ে যাবে। টিভি চ্যানেলে বসে অশিক্ষিত অর্বাচীন বিজেপি-র ভৃত্য সাংবাদিকরা এই সব তত্ত্ব শুনিয়ে মানুষকে বোঝালেন নোট বাতিলের পক্ষে থাকতে। কিন্তু তথ্য কী বলছে? ২০১৬ সালে কাশ্মীরে উগ্রপন্থার বলি হয়েছিলেন ১১২ জন মানুষ যাদের মধ্যে ১৪ জন সাধারণ নাগরিক। ২০১৭ সালে তা বেড়ে হয় যথাক্রমে ১৬৩ এবং ৫৪। আবার ২০১৮ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয় যথাক্রমে ২০৬ এবং ৮৬। অর্থাৎ কাশ্মীরে উগ্রপন্থা নোট বাতিলের মাধ্যমে খতম করে দেওয়া গেছে, এটি একটি আষাঢ়ে গপ্প ছাড়া আর কিছু নয়। তারপরে ২০১৯ সালে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল করে রাজ্যটিকে দ্বিখণ্ডিত করে তার রাজ্যের মর্যাদাও কেড়ে নেওয়া হল। লাগাতার কাশ্মীরে কার্ফু, ইন্টারনেট বাতিল, ইত্যাদি নীতি বলবত করা হল। তবু, উগ্রপন্থার সংখ্যা কমলেও, তা নির্মূল হয়নি। বরং ২০২০ এবং ২০২১ সালে তা আবার ঊর্ধ্বমুখী। বোঝাই যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের কাশ্মীর সংক্রান্ত নীতি উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে সুদৃঢ় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।

অন্যদিকে, কাশ্মীরে সংবিধানের ৩৫এ ধারা বাতিল হওয়ার ফলে সেখানকার সংখ্যাগুরু মুসলমান সমাজের মধ্যে এই বার্তা গেছে যে তাদের জমি আগামীদিনে দখল করে নিতে পারে ভারতের হিন্দুরা। ডিলিমিটেশনের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভোটারদের সংখ্যার ভারসাম্য বদলে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক প্যাকেজের নামে মোদী এবং অমিত শাহ যেই সব বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান থেকে মদতপুষ্ট উগ্রপন্থীরা, বিশেষ করে আফগানিস্তানের তালিবানের শাসন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে, বলবান হয়েছে। তারা কাশ্মীরের সংখ্যালঘু হিন্দু এবং শিখ সম্প্রদায়ের মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করে, পালটা বার্তা দিতে চাইছে যে কাশ্মীর শুধুমাত্র মুসলমানদের স্থান। হিন্দু-মুসলাম-ভারত-পাকিস্তান এই চক্রবূহ্যে আটকা পড়ে গেছে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ, যা নিয়ে কোনো পক্ষই খুব বেশি চিন্তিত নয়। পাকিস্তান চায় কাশ্মীরে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। বিজেপি সরকার চায় কাশ্মীরে হিন্দু-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোক। এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিকভাবে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের কথা আপাতত আর কেউ বলে না। জোর যার কাশ্মীর তার। এহেন এক ধ্বংসাত্মক রাজনীতির সামনে অসহায়ের মতন মারা যায় কখনও সাধারণ মুসলমান কাশ্মীরি, কখনও শিখ, কখনও হিন্দু। রাজনীতির দাবা খেলায় এরা বোড়েও নয়। রাজারা খোশমেজাজে থাকে। দুই দেশেই কাশ্মীর নিয়ে উন্মাদনা ভোটের বাক্সে ফল দেয়। এই রাজনীতির থেকে আপাতত নিস্তার নেই।

বিশেষ করে দেশের বিরোধী পক্ষও যেখানে কাশ্মীরের প্রসঙ্গে মোটামুটি কেন্দ্রীয় সরকারের অমানবিক এবং অসাংবিধানিক নীতিকে প্রায় মেনেই নিয়েছে, সেখানে কাশ্মীরের সমস্যা আগামীদিনে কমবে না। সম্প্রতি দেশের গৃহমন্ত্রী কাশ্মীরে গিয়ে যেই কথা বলেছেন, তার থেকেই পরিষ্কার যে জাতীয়তাবাদের নামে সরকার মানুষের সমস্ত অধিকারকে খর্ব করতে বা তাকে বাতিল করতে রাজি আছে এবং এই প্রবণতার বিরুদ্ধে বিরোধী পক্ষের বিশেষ কোনো বক্তব্য নেই। কাশ্মীরে দাঁড়িয়ে অমিত শাহ বললেন যে উপত্যকায় দীর্ঘদিন ইন্টারনেট বন্ধ, লকডাউন, কার্ফু বলবত রেখে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করার সিদ্ধান্তের ফলে কাশ্মীরি মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে সরকার। কাশ্মীরিদের ভালোর জন্যই তাদের ঘরে আটক রেখে তাদের ভারতে অন্তর্ভুক্তির শর্ত সংবিধানের ৩৭০ ধারাকে বাতিল করা হল। এই উক্তি করার মধ্য দিয়ে অমিত শাহ এই বার্তাই দিলেন যে দেশে গণতন্ত্রের কোনো দাম নেই। দেশের মানুষ, বিশেষ করে কাশ্মীরের মানুষ তাদের ভালো মন্দ বোঝে না। তাই বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির পশুকে যেমন বন্দী রেখেই বাঁচানো সম্ভব হয়, তেমনি কাশ্মীরের মানুষকে বন্দী রেখেই তাদের বাঁচিয়েছে সরকার। প্রাচীন যুগে রাজা এবং পুরোহিতদের শাসনে সাধারণ মানুষের কোনো মতামত রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে কেউ মনে করেনি। একবিংশ শতাব্দীর ভারতে যেন সেই রাজারা ফিরে এসেছেন, যারা প্রজাদের একমাত্র ভাগ্যনিয়ন্ত্রক। দেশের প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল না হলেও অমিত শাহ-রা তাকে বহুদিন হল দেরাজে তুলে রেখে দিয়েছেন। দুঃখজনক এটাই যে এত বড় কথাটি অমিত শাহ কাশ্মীরে বলে এলেন কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো বিরোধীদল বিশেষ প্রতিবাদ জানালো না।

কাশ্মীরের মানুষকে যদি ভারত রাষ্ট্র এই বার্তাই দেয় যে তাদের কয়েদ রেখেই তাদের উন্নয়ন সম্ভব তবে সেই মানুষরা কেন ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে থাকতে চাইবেন? কাশ্মীরের মানুষকে তাদের সাংবিধানিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে, তাদেরকেও ভারতের গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে স্থাপন করলে তবেই কাশ্মীরের মানুষ ভারত রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়াবেন। তা না হলে, কাশ্মীরে অশান্তি বাড়বে, যার সুযোগ নিয়ে নিরীহ কাশ্মীরি পণ্ডিত এবং শিখ সংখ্যালঘুদের হত্যা করবে জঙ্গিরা। এই ভয়ানক চক্র থেকে কাশ্মীরকে বাঁচাতে সেখানে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত কেন্দ্রীয় সরকারের।