আরেক রকম ● নবম বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২১ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৮

সমসাময়িক

আধিপত্যবাদী আগ্রাসন


শারদোৎসবের প্রাক মুহূর্তে ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক নির্দেশিকা জারি করে জানায় যে আন্তর্জাতিক সীমানার পঞ্চাশ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বা বিএসএফের এক্তিয়ারে আনা হচ্ছে। এত দিনের নিয়ম অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা থেকে ১৫ কিলোমিটার ভিতর পর্যন্ত বিএসএফের টহল দেওয়ার কথা। সেই পরিধি বাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব ও অসমে আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত কাজ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী অর্থাৎ বিএসএফকে।

বিএসএফের টহলদারীর এলাকা সম্প্রসারণ সংক্রান্ত নির্দেশিকা জারির সঙ্গে সঙ্গেই পঞ্জাব সরকার প্রতিবাদ জানিয়েছে। সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে নস্যাৎ করে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের আধিপত্যবাদী আচরণের নিন্দা করে পঞ্জাব সরকার অবিলম্বে এই নির্দেশিকা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। অসম সরকার স্বাভাবিকভাবেই এই ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। সেখানে তো দাপটের সঙ্গে ডাবল ইঞ্জিনের সরকার চলছে।

বিজ্ঞপ্তি জারির দু' সপ্তাহ পর উৎসবে মাতোয়ারা রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর উত্তর বঙ্গ সফরের সময় খেয়াল হয় কেন্দ্রের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা দরকার। কাজেই প্রধানমন্ত্রীকে তিনি প্রতিবাদ পত্র পাঠিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে এভাবে সীমান্তে সীমান্তে ঝগড়া লাগানোর চেষ্টা চলছে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ভুটান, নেপাল এবং বাংলাদেশের সম্পর্ক ভাল। কেন ঝগড়া হবে। তাঁর মতে এ-সব করে কেন্দ্র ক্ষমতা হাতাতে চাইছে।

তবে তিনি পথে নেমে এই বিজ্ঞপ্তির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাননি। সম্ভবত গোয়া, ত্রিপুরা, উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যগুলিতে দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ এই বিজ্ঞপ্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন করার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে একটি প্রতিবাদ পত্র প্রেরণ করে দায়মুক্ত থাকতে চেয়েছেন।

নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের আন্তর্জাতিক সীমান্ত ২১৬৪.৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ। এ রাজ্যের আয়তন ৮৮,৭৫২ বর্গ কিলোমিটার। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত মানতে হলে ধরে নিতে হবে, সেই আয়তনের মধ্যে প্রায় ৩২,৪০০ বর্গ কিলোমিটার অর্থাৎ রাজ্যের ৩৭% এলাকাই বিএসএফের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। এটা নিশ্চিতরূপে রাজ্যের প্রশাসনিক ক্ষমতা এবং রাজ্য পুলিশের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ। সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যের আইন মোতাবেক নিজের রাজ্যের আইনশৃংখলা রক্ষা করা ও যে কোনো অপরাধের তদন্ত করার অধিকার রাজ্য পুলিশের রয়েছে। সংবিধানের সপ্তম তফসিলও তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টও স্পষ্ট করে দিয়েছে, কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করে রাজ্যের নাগরিক এবং পুলিশি ক্ষমতা খর্ব করা যায় না। কিন্তু কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএসএফের ক্ষমতা বেড়ে গেলে ১১টি জেলা এবং রাজ্যের ৩৭ শতাংশ এলাকায় রাজ্য পুলিশের ক্ষমতা খর্ব হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের কিছু দিন পরেই ১৯৬৫-র পয়লা ডিসেম্বর সীমান্ত রক্ষী বাহিনী অর্থাৎ বিএসএফ গড়ে তোলা হয়। পরে ১৯৬৮-তে সংসদে বিএসএফ অ্যাক্ট পাস হওয়ার পর বাহিনীটি বৈধতা পায়। আইনটি প্রণয়নের সময় সংসদে ঘোষণা করা হয়েছিল যে মূলতঃ ভারত পাকিস্তানের মধ্যবর্তী সীমান্তে প্রহরা দেওয়ার জন্য বিএসএফ তৈরি করা হয়েছে। পরে বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতীয় সীমান্ত পাহারা দেওয়ার কাজ বিএসএফের উপর বর্তায়। ফলে ত্রিপুরা, মিজোরাম, অসম, পশ্চিমবঙ্গ ও পঞ্জাবের সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ মোতায়েন করা হয়। অন্যান্য কেন্দ্রীয় সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনীর (অসম রাইফেলস্, সশস্ত্র সীমা বল, ইন্ডো টিবেটান বর্ডার পুলিশ, সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স ইত্যাদি) সদস্যদের বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করার আইনত কোনও সুযোগ নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীন এই আধাসামরিক বাহিনীতে আড়াই লক্ষ সশস্ত্র নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োজিত রয়েছেন। ২০২১-২২ আর্থিক বর্ষে বিএসএফের জন্য প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছে। এই মুহূর্তে বিএসএফ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অসামরিক সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী।

বিএসএফ অ্যাক্ট প্রণয়নের সময় সংসদীয় আলোচনায় বলা হয়েছিল যে সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত মানুষের জন্য নিরাপত্তার পরিবেশ গড়ে তোলাই বিএসএফের মূল লক্ষ্য। পরবর্তী সময়ে বিএসএফ এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কতটুকু সাফল্য অর্জন করেছে তা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। সীমান্ত এলাকায় মাদক কারবার, গরু চালান, সীমান্তকেন্দ্রিক অন্যান্য অনেক সমস্যা সমাধানে বিএসএফের ভূমিকা নিয়ে অনেক সময়েই প্রশ্ন ওঠে। বিএসএফ সীমান্ত এলাকার মানুষের মধ্যে আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে কিনা তা নিয়েও অনেক অভিযোগ ও পালটা অভিযোগ মাঝেমধ্যেই উচ্চকন্ঠে উচ্চারিত হয়।

এতদিন আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা থেকে ১৫ কিলোমিটার ভিতর পর্যন্ত বিএসএফ টহল দেওয়ার দায়িত্ব পালন করত। সাম্প্রতিক বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সেই পরিধি বাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্জাব ও অসমে আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত কাজ করার ক্ষমতা দেওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত ছোঁয়া অন্ততঃ এগারোটি জেলায় কার্যতঃ বিএসএফের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পঞ্জাবের ছয়টি জেলারও একই অবস্থা। অসমের চারটি জেলা একই পরিস্থিতির সম্মুখীন।

পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে রাজ্যের উত্তর ও দক্ষিণ অংশের মধ্যবর্তী উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় কার্যতঃ বিএসএফের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ভৌগোলিক পরিস্থিতির সুবাদে রাজ্যের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের মধ্যবর্তী এলাকার অধিকাংশে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে প্রশাসনিক সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে। সর্বোপরি সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী এই আধিপত্যবাদী প্রকল্প।

এহেন আগ্রাসী প্রকল্পের পরীক্ষা গত জুলাইয়ে শুরু হয়েছিল। অসম মিজোরাম সীমান্ত এলাকায় দুই রাজ্যের পুলিশ মুখোমুখি সশস্ত্র সঙ্ঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। অসমের পুলিশ মিজোরাম সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে। মিজোরাম সরকারও পালটা অভিযোগ হানে। বেশ কয়েকদিন সীমান্ত এলাকা জুড়ে তোলপাড় চলতে থাকে। পুলিশ সহ বেশকিছু সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। অনেকেই আহত। সেই আবহে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দুই রাজ্যের প্রতিনিধিদের দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়ে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়। এবং দুটি রাজ্যই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সমাধান সূত্র বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়। অবিশ্যি মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কোথায়! দুই রাজ্যেই তো ডাবল ইঞ্জিনের সরকার। অতএব অসম মিজোরাম সীমান্তর ১৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকা বিএসএফের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়।

মাত্র দু'মাস ধরে পরীক্ষা চালিয়ে পর্যবেক্ষণের পর মোটামুটি সন্তোষজনক ফল পাওয়ায় এবার তিনটি রাজ্যের আন্তর্জাতিক সীমান্ত এলাকায় তা প্রয়োগ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেশের সংবিধান লঙ্ঘনের প্রক্রিয়া শুরু হতে চলেছে। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার জন্য এই ভয়ঙ্কর আধিপত্যবাদী আগ্রাসী বিজ্ঞপ্তির বিরোধিতা করা প্রয়োজন। সংবিধান স্বীকৃত প্রশাসনিক পরিকাঠামো ধ্বংস করার এই প্রক্রিয়া প্রতিহত করতে না পারলে দেশের গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।