আরেক রকম ● নবম বর্ষ একবিংশ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২১ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ ও ত্রিপুরাঃ একই মুদ্রার দুই পিঠ


বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুর্গাপুজো বিষয়ক অশান্তি ও সেই সূত্রে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা, যার রেশ ত্রিপুরাতেও এসে পৌঁছল প্রত্যাশিতভাবেই, সেটা যে নির্মম সত্যি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে তা হল উপমহাদেশের রাজনীতি, ধর্ম ও পরিচিত্তিসত্তার উগ্র রূপটাকে তোষণ না করে এখনো সাবালক হয়ে উঠতে পারেনি। এখানে ধর্ম আর বন্দুক হাত ধরাধরি করে চলে এবং ত্রিশূল ও চাপাতি মিলে যায় এক বিন্দুতে এসে। এবং এই প্রসঙ্গে কোনো একটা দেশকে আলাদা করে দেখা উচিত হবে না কারণ, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান এমন সূত্রে গাঁথা যে বাংলাদেশে অস্থিরতা ঘটলে সেটা শুধু ভারতেই নয়, এমনকি পাকিস্তানেও প্রভাব ফেলে এবং আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সেখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। গত পঁচাত্তর বছর ধরে ঘৃণা, অবিশ্বাস ও বোঝাপড়ার অভাবের যে বীজ উপমহাদেশের রাজনীতিতে চারিয়ে দেওয়া হয়েছে তার থেকে আপাতত মুক্তি নেই।

এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে বাংলাদেশে মুসলিম মৌলবাদের সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এবং সেটা একদিনে নয়। সাংবিধানিক সংকট, পঁচাত্তরের আগের সংবিধানে ফিরে যাওয়া, এরশাদের সময়কার তাণ্ডব, পরবর্তীকালের বিএনপি-জামাত শাসনের সময়কার ভয়াবহ সংখ্যালঘুবিরোধী হিংসা, এই সমস্তকিছুই জমি প্রস্তুত করেছে আজকের বাংলাদেশের। সৌদি আরবের ডলারপুষ্ট যে সংগঠনগুলো দেশের ভেতরে ও বিদেশে বসে ক্রমাগত মৌলবাদী চিন্তার জমি তৈরি করে চলেছে, বাংলাদেশকে শরিয়তি শাসনের আওতায় আনতে চেয়ে যেভাবে অন্ধকার যুগের আবাহন করছে, তাদের ক্ষেত্রনির্মাণ বহু বছর ধরে হয়ে চলেছে এবং সমস্ত রাজনৈতিক দল তাদের মদত দিয়েছে। বিএনপি জমানাতে অগাধ ও অনর্গল যে হিংসাত্মক কার্যক্রমের ব্যাপারে আমরা সরব থাকি, আওয়ামী জমানাতে সেই হিংসা যখন গোপন ও চতুর ঠোঁটের আড়ালে তার দাঁত নখ লুকিয়ে ফেলে তখন তার কথা ভুলে যেতেই পারি, কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না যে একের পর এক ব্লগার হত্যা, সংখ্যালঘুদের জমি কেড়ে নেওয়া, পুজোমণ্ডপে অশান্তি - এ সমস্তই আওয়ামী লিগের শাসনকালেই ঘটেছে। আজ যে দুর্গাপুজোর অশান্তি নিয়ে গণমাধ্যমগুলি সরব হয়েছে তাদের অনেকেই এই সত্য জেনেও বহুদিন চোখ বুজে থেকেছে যে নিয়ম করে প্রতি বছর রংপুর, কুমিল্লাতে দুর্গাপ্রতিমা ভাঙা হয় মণ্ডপের ভেতরেই। এবার বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে বলে ব্যাপারগুলো সামনে আসছে, কিন্তু প্রত্যেক বছর নিয়ম করে 'কমিউনালিজম ওয়াচ' নামক সংগঠনটি, যারা উপমহাদেশে ধর্মীয় হিংসা ও অশান্তির সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে থাকে, তাদের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের এই খবরগুলো দিয়ে থাকে। এপারের বুদ্ধিজীবিরা যারা নীরব এই ভয়ে যে মুসলিম মৌলবাদকে নাম ধরে আক্রমণ করলে এপারে বিজেপির সুবিধে হয়ে যাবে, তাঁরা আসলে নীরব থেকেই বেশি করে বিজেপির সুবিধে করে দিচ্ছেন। কারণ হিন্দু মৌলবাদ তার সারজল মুসলিম মৌলবাদ থেকে সংগ্রহ করে এবং উলটোটাও সত্যি। তাই ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙা হলে তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশে, এবং বাংলাদেশে দুর্গামন্ডপে কোরান রাখা হলে ত্রিপুরাতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদ ভাঙে, মুসলিমদের দোকান লুঠ করে, রেশন দোকানে আগুন লাগিয়ে দেয়। ওপারে জামাত, হেফাজত, রাজাকার, আনসার বাংলা ইত্যাদি নানা নামের দল, এপারে তাদের যোগ্য সংগত দিচ্ছে আরএসএস, বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ।

মুশকিল হল, এক পক্ষের মৌলবাদকে তীব্র বিরোধিতা করব আর অন্য পক্ষের মৌলবাদ বিষয়ে নীরবতা রাখব, এভাবে হয় না। উদারনীতিক বুদ্ধিজীবিরা কিছুটা অস্বস্তিতে, এপার বাংলায় মুসলিম মৌলবাদ নিয়ে কিছু বললে তার সুযোগ বিজেপি নিতে পারে। অনেকে আবার বাংলাদেশের ঘটনার পেছনে আরএসএসের হাত খুঁজে বার করতে মরিয়া, যাতে এরকম কিছু আবিষ্কার করলে তীব্রকণ্ঠে প্রতিবাদ করতে সুবিধে হয়! একইভাবে বিজেপিও যেভাবে কুমিল্লা নিয়ে প্রচার করে চলেছে, ত্রিপুরা নিয়ে নীরব। এই দুই পক্ষের অবস্থানই সমস্যাজনক ও বিপদ ডেকে আনবে। মুসলিম মৌলবাদ নিয়ে যত বেশি নীরব থাকা হবে, বিজেপি সেটা নিয়ে তত বেশি প্রচার করে এবং তথাকথিত তোষণের দিকে আঙুল তুলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের কাছে তত বেশি সহানুভূতি আদায় করবে, বিশেষত সেই সব মানুষের কাছে যাঁরা নিম্নবর্গের, দরিদ্র, বাংলাদেশে মুসলিম মৌলবাদের হাতে নিপীড়িত হয়ে এদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন।

ঠিক একইভাবে এ কথাও ভুললে চলবে না যে অন্তত ভারতবর্ষে হিন্দু মৌলবাদ প্রধান বিপদ, ধারে ও ভারে মুসলিম মৌলবাদ কখনও তার সমকক্ষ নয়। হিন্দু মৌলবাদীরা আজ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। দেশের সংবিধানকে ধ্বংস করে তারা ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপন করতে চায়। অতএব, ত্রিপুরাতে মৌলবাদীদের তাণ্ডব, উত্তরপ্রদেশে গোরক্ষক বাহিনীর হিংসা, মুক্তচিন্তার উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা এই সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে, তীব্র স্বরে এই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মুখর হতে হবে। একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা কতটা সফল তার মানদণ্ড হল তার সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে সে কতটা নিরাপত্তা দিতে পারছে। এবং এই মানদণ্ডে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারত ও বাংলাদেশ দুই রাষ্ট্রই শোচনীয়ভাবে পর্যুদস্ত, পাকিস্তানের কথা তো বাদই দেওয়া গেল।

এই প্রসঙ্গেই বলতে হয়, একটা সরকার বা একটা রাষ্ট্র শুধু গণতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক বিধিপ্রদত্ত হলেই তার সব দায় শেষ হয়ে যায় না। ভারত ও বাংলাদেশ দুজনেই খাতায় কলমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়েও ধর্মীয় মৌলবাদের আঁতুড়ঘর, তার কারণ সরকারের ব্যর্থতা অথবা ইচ্ছাকৃত উদাসীনতা। সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয় না - লালুপ্রসাদ যাদবের এই উক্তি এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। এই হিংসাগুলো হয় কারণ এর পেছনে সরকারের উস্কানি থাকে, তারা এগুলো থেকে ডিভিডেন্ড নেয়। ধর্মীয় হিংসা ও দাঙ্গা ঠেকাতে গেলে শুধুমাত্র মানুষের সদিচ্ছাই যে শেষ কথা নয় তা বারবার আমাদের দেখিয়ে গিয়েছে বাবরি থেকে আসানসোলের সাম্প্রতিক দাঙ্গা। দেখিয়েছে যে প্রশাসনিক দৃঢ়তা, স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতা, এবং একইসঙ্গে সরকারের মৌলনীতি, এই দুইয়ের মেলবন্ধন না ঘটলে ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রতিহত করা যায় না। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের সুদীর্ঘ সময়ে কোনও দাঙ্গা যে হয়নি, সেই বিরল কৃতিত্বের কারণ একক ব্যক্তির সদিচ্ছা ছিল না, বরং সরকারের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে দৃঢ়ভাবে অনুসরণ ও প্রশাসনকে সেই অভিমুখে চালনা করা ছিল। সেই নীতির অভাব ভারত ও বাংলাদেশে এই মুহূর্তে বিশেষভাবে লক্ষিত হচ্ছে। নাহলে দুই বিপরীতধর্মী মৌলবাদ একে অপরের থেকে সারজল নিয়ে পুষ্ট হতে পারে না।

তাহলে এই সমস্যার সমাধান কী? সমাধান একটাই, রাজনীতিকে ধর্মের কবল থেকে বার করে আনা, ধর্মনিরপেক্ষতার মৌল সাংবিধানিক নীতিকে লাগু করা। কথাগুলো ক্লিশে হলেও এর বাইরে আর কিছু নেই কারণ এই মুহূর্তে ধর্মনিরপেক্ষতাও এক প্রকার শ্রেণি লড়াই, যেহেতু বাংলাদেশে এক গরীব প্রান্তিক হিন্দু, গরীব মুসলমানের থেকে বেশি বিপন্ন, এবং ভারতে গরীব মুসলমান, গরীব হিন্দুর থেকেও বেশি বিপন্ন। এই পরিচিতির প্রশ্নকে স্বীকার করেই তাকে যদি অতিক্রম করে যেতে হয়, তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শগুলোকে শ্রেণির ইস্যুর সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হবে। বাম গণতান্ত্রিক দলগুলোর ভূমিকা এক্ষেত্রে অপরিসীম। বাংলাদেশ ও ভারতে তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে সরব হয়েছেন, রাস্তায় নেমেছেন বামপন্থীরাই। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট নয়। সরকারের উপর চাপ বাড়িয়ে তাকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধানের নীতির পথে দৃঢ় রাখাটাও বিরোধী রাজনীতির কাজ। সেটাও বামপন্থীদেরই সর্বাগ্রে করতে হবে।