আরেক রকম ● নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ পৌষ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

শিক্ষানীতিতে ভাষাশিক্ষা ও শিশুমন

কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়


মনে করা যাক একটি সুদৃশ্য রেস্টুরেন্টের খাদ্যতালিকায় নানা লোভনীয় পদগুলি দেখে আয়েশ করে বসে বাছাইয়ের মুহূর্তে জানা গেলো যে - আছে অনেক কিছুই, কিন্তু তার বেশির ভাগই আপনার বাছাইয়ের বাইরে! এমন পরিস্থিতিতে আমাদের যে কারোর মনের অবস্থা বর্ণনা বিশদে না করলেও চলে। যে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের দেখা মেলে বড়ো ছোটো বহু শহর ও শহরতলীতে, তার জনৈক শিক্ষকের সূত্রে একদা এমনই খানিক ধারণা হয়েছিল। এদের স্কুলগুলিতে সাধারণত ইংরাজী, হিন্দি বা সংস্কৃত ভাষার শিক্ষকের অভাব ঘটে না; যত সমস্যা বাংলা বা এই ধরনের ভাষার শিক্ষক পদগুলি ভর্তি করা নিয়ে। অগত্যা ছাত্র ছাত্রীদের উপায় থাকে না। এর ফলে বিশেষত পূর্ব ভারতের বাংলা, ওড়িয়া, অসমীয়া ইত্যাদি ভারতীয় ভাষার ভাষা-ভাষীদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা তো নয়ই, এমনকি এমন কোনো একটি বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে একটি বিষয়/পত্র হিসাবে মাতৃভাষাকে রাখার সুযোগও সীমিত হয়ে যায়।

সুধী পাঠকের মনে থাকতে পারে যে আশির দশকে বিদ্যালয় - শিক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন সরকার আনীত ভাষা নীতির পরিবর্তনের ফলে প্রাথমিক স্তরে শুধুমাত্র মাতৃ ভাষা স্থান পায় ও দ্বিতীয় ভাষা ইংরাজী বর্জিত হয়। এই নিবন্ধের সীমিত পরিসরে সেই সিদ্ধান্তের আলোচনায় না গিয়ে বিষয়টিকে কিছুটা বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখার চেষ্টা করা যাক। ইতিমধ্যে সেই ভাষা নীতির থেকে খানিক সরে এসে প্রাথমিক স্তরে ইংরাজী ভাষার পঠন-পাঠন শুরু হয়েছে, এমন কি কিছু সরকারী ও সরকারী সাহায্য প্রাপ্ত স্কুলে একটি করে ইংরাজী মাধ্যম সেকশনও খোলা হয়েছে। এই ধরনের সেকশনগুলি এরাজ্যে ছাড়াও কর্ণাটকের মতো কিছু রাজ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার এনেছে নয়া শিক্ষা নীতি NEP 2020-র মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক ধরনের বদলের সম্ভাবনা। এর ফলে বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে নানা ধরনের পরিবর্তনের সঙ্গে ভাষা শিক্ষার বিষয়টিও অনেক টা পরিবর্তিত হওয়ার আশঙ্কা। কথা হলো - এই বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকগুলি পক্ষ রয়েছেন এবং প্রত্যেকের সমস্যা ও অবস্থান ভিন্ন, যেমন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক মন্ডলী, অভিভাবক মন্ডলী, বিভিন্ন ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠী ইত্যাদি। কিন্তু যাকে কেন্দ্র করে এই সব কিছু সেই শিশু শিক্ষার্থীদের সুখ-দুঃখের কথা, অসহায় অবস্থার কথা সেভাবে কেউ খোঁজ করে না। হয়তো এযুগের বয়স্ক মানুষের ব্যস্ততা এমনই যে শিশুদের বিষয়টি যে পরিমাণ অভিনিবেশ ও সংবেদনশীলতা দাবি করে সেটা মেটাতে তাঁরা অক্ষম।

এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় নথির প্রসঙ্গে যাবার আগে আমাদের বাস্তব পরিস্থিতিটা যথাসম্ভব বোঝার চেষ্টা করা যাক। একান্ত পরিচিত পরিধির মধ্যে জনা চারেকের ঘটনা জানা গেলো যারা কথা বলতে শিখেছে দেরী করে - দুই বছর পেরিয়ে কিংবা তিন বছর বয়সে। সহজাত প্রবৃত্তির বশেই শিশুরা জন্মের পর থেকে কানে শোনা ধ্বনিকে অনুকরণের ফলে ধীরে ধীরে কথা বলতে শিখে যায়, সেই ভাষার রীতি বা ব্যাকরণ সম্বন্ধে কোন জ্ঞান ছাড়াই। এদের মধ্যে একটি সাঁওতাল শিশু জন্ম থেকেই প্রতিবেশী এক বাঙালী পরিবারে তাদের কথোপকথনের মধ্যেই বড়ো হবার পর, যখন সবে কথা বলতে শিখলো কেবল বাংলা ভাষাতেই কথা বলতো। এক দুই বছর পরে তার সাঁওতাল বাবা-মা তাকে জোর করে নিজেদের ভাষা শেখানোর চেষ্টা করতে শিশুর বাকরোধ ঘটে যায়। বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেন - শিশুটি যে বাংলা ভাষা রপ্ত করেছিলো তাই বলতে দিতে কোনো জবরদস্তি না করে। শিশুটি শিক্ষকের যত্নে পরে অনর্গল বলতে পারতো শুধুমাত্র বাংলা ভাষায়। বাকি তিন শিশুর দৃষ্টান্তে আসা যাক। এই তিনটি ছেলেমেয়ের শৈশবে একজন ছিল ব্রিটেনে, একজন মধ্য ভারতের এক শহরে ও তৃতীয় জন কলকাতারই এক পাঞ্জাবী অধ্যুষিত পাড়ায়। ফলে তারা বাড়ি ও বাইরে মাতৃভাষা বাংলা যত না শোনার সুযোগ পেত, তার থেকে বেশি ইংরাজী অথবা হিন্দি ভাষা কানে শুনত! দুই ভিন্ন রীতি ও ব্যাকরণের ভাষাগোষ্ঠীর কথোপকথনের মধ্যে পড়ে গিয়ে - সব মিলিয়ে এই তিন জনেরই কথা বলা স্বাভাবিক ছন্দে আসতে অন্য শিশুদের থেকে দেরী হয়। যে কোনো কারণেই হোক ব্রিটেনবাসী শিশুটি বর্তমানে মধ্যবয়সে পৌঁছলেও, আজ পর্যন্ত তাঁর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ ঘটে নি। প্রশ্ন উঠতে পারে তার হয়তো আরো ভিন্ন কোনো কারণ আছে। এই কয়টি দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে কোনো সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারা দুষ্কর, তবে এটা অনস্বীকার্য যে এই সমস্যাগুলির বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে। যাই হোক, এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নানা পরস্পর বিরোধী মত আছে এবং সেই চর্চা ও গবেষণার ধারাও সময়ের সঙ্গে দিক পরিবর্তন করেছে দেখা গেছে।

আমাদের দেশের বিভিন্ন শিক্ষা কমিশনও যার যার প্রতিবেদনে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান ও শিক্ষার্থীদের শৈশবে কয়েকটি শ্রেণি পর্যন্ত ভাষাশিক্ষাকে শুধুমাত্র মাতৃভাষাতে সীমিত রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন। কয়েকটি শ্রেণি উত্তীর্ণ হবার পর তবেই দ্বিতীয় ভাষা শিক্ষা শুরু করা কাম্য বলে তাঁরা মনে করেন। এই ধারাতেই উড়িষ্যার মতো অনেক রাজ্যে স্কুলগুলিতে প্রাদেশিক ওড়িয়া ভাষা শিক্ষা সব ভাষা ভাষীদের জন্য বাধ্যতামূলক হলেও, বহু বছর পর্যন্ত প্রায় সবার জন্য দ্বিতীয় ভাষা ইংরাজীর শিক্ষা শুরু হত চতুর্থ শ্রেণি থেকে। কম বেশি এমনই রীতি চালু আছে বর্তমানে বহু রাজ্য বোর্ডের বিদ্যালয় গুলিতে - যা দেখা যাবে সঙ্গের সারণী থেকে। যদিও ইংরাজী নিয়ে অভিভাবকদের চাপে অনেক রাজ্যের সরকারই এক ধরনের আপোষ রফার পথে যাচ্ছেন,মূলত ছাত্রদের সদলে বেসরকারী বা অন্য বোর্ডের স্কুলে চলে যাওয়া আটকানোর জন্য। যেমন উড়িষ্যা সরকার প্রথম শ্রেণি থেকে ‘‘স্পোকেন ইংলিশ’’ নামে একটি বিষয় চালু করতে যাচ্ছে সম্প্রতি - এমনটি উত্তরাখণ্ডের মতো আরো কিছু রাজ্যে আছে।

সারণীঃ
বিদ্যালয়ে যে শ্রেণি থেকে নানা রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে ইংরাজী পাঠ শুরু হয়

শ্রেণি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল
প্রথম শ্রেণি দিল্লী, গোয়া, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, জম্মু ও কাশ্মীর, ঝাড়খণ্ড, কর্ণাটক, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, অরুণাচল প্রদেশ, চণ্ডীগড়, ছত্তিশগড়, লাক্ষা দ্বীপ, মহারাষ্ট্র, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, মধ্য প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, পুদুচেরি, পাঞ্জাব, রাজস্থান, সিকিম, তামিলনাড়ু, ত্রিপুরা, অসম, বিহার
তৃতীয় শ্রেণি অন্ধ্র প্রদেশ, ওড়িশা। ৫ টি রাজ্যে - পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরাখণ্ড, ছত্তিশগড়, কেরালা ও উত্তর প্রদেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মৌখিক এবং তৃতীয় শ্রেণিতে লিখিত পঠনপাঠন।
পঞ্চম শ্রেণি গুজরাট, দাদরা ও নগর হাভেলী, দমন ও দিউ।

সূত্রঃ Teaching of English at primary level in Government school - NCERT (2012) [১]

সারস্বত সমাজের মধ্যে এক অদ্ভুত তীব্র মেরুকরণ দীর্ঘকাল ধরে লক্ষ্য করা যায়! এক পক্ষ মনে করেন ‘‘mother tongue fanatics’’ বা মাতৃভাষা পন্থীদের জন্যই গোটা ভারতবর্ষ বিশ্ব - অবস্থানে সর্বক্ষেত্রে এমন পিছিয়ে রয়েছে, ইংরাজী মাধ্যম শিক্ষা ছাড়া কোনো ভবিষ্যত নেই! অন্য পক্ষ মনে করেন - elitist obsession with English ভারতবর্ষের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মতো এমনটি বিশ্বের কোথাও নেই এবং এটিই হলো পশ্চাদপদ সিংহভাগ ভারতবাসীর শিক্ষার প্রাঙ্গণগুলি থেকে সভয়ে দূরে সরে থাকার প্রধান কারণ।

অনেকেরই হয়তো অভিজ্ঞতা আছে যে যেসব পরিবারগুলি থেকে প্রথম কোনো শিশু স্কুলে পড়তে যায় তাদের মূলত অসুবিধা হয় যে কয়েকটি বিষয়ে - তার একটি হলো ইংরাজী। এর থেকেই সূত্রপাত ঘটে ক্লাসে অনুত্তীর্ণ হওয়া ও স্কুল - পালানোর/ত্যাগ (Drop out) ইত্যাদি সমস্যা। যদিও বর্তমানে মধ্যাহ্ন ভোজের (mid-day meal) ইত্যাদির মাধ্যমে বহু দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরা বিদ্যালয়ে পড়তে আসে, কিন্তু শুধু তাদের উপস্থিতি নয় পঠন - পাঠনের উৎকর্ষ সাধন ও শিশুদের দক্ষতা বৃদ্ধি হল এক সার্বিক উদ্যোগের বিষয়।

উল্লেখ্য যে গবেষক ও বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করেন যে কোনো একটি ভাষা, বিশেষত মাতৃভাষাকে কোনো শিশু ভালো ভাবে আয়ত্ত করতে পারলে, তার ফলে অন্যান্য ভাষা আয়ত্ত করা অনেক টা সহজসাধ্য হবে। এখন একটি সূক্ষ্ম ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন উঠতে পারে যে-স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করা এবং তৃতীয় শ্রেণি থেকে শুরু করা শিশুদের মধ্যে ইংরাজী শিক্ষার মানের বা উৎকর্ষের তফাৎ হবে কিনা। কারণ এই দুই গোষ্ঠীর ছাত্র ছাত্রীদের ইংরাজীর সঙ্গে সংস্পর্শে থাকা তথা শিক্ষার কাল পর্ব থাকবে যথাক্রমে ১০ বছর ও ৮ বছর (মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত)। তবে এটা স্পষ্ট করে বলা ভালো যে - বর্তমান যুগের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়ের প্রতিটি শিশুরই ইংরাজী শিক্ষা দরকার। তার খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা চলতে পারে।

A new study performed at MIT suggests that children remain very skilled at learning the grammar of a new language much longer than expected - up to the age of 17 or 18. However, the study also found that it is nearly impossible for people to achieve proficiency similar to that of a native speaker unless they start learning a language by the age of 10.

অর্থাৎ মোদ্দা বিষয়টি হলো সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে শিশুর ১০ বছর বয়সের মধ্যে অন্য বা দ্বিতীয় ভাষা শিক্ষা শুরু করে দেওয়া কাম্য এই কারণে যে - তার থেকে বেশি বয়সে শুরু হলে ঐ ভাষাতে শিশুর দক্ষতা মাতৃভাষার তুল্য হবে না। [২]

এইবারে নয়া শিক্ষানীতির প্রসঙ্গ কিছুটা অবতারণা করা যাক। প্রসঙ্গত ১৯৭৬ সালে ৪২ নম্বর সংশোধনী র মাধ্যমে শিক্ষাকে যৌথ তালিকাভূক্ত করে ফেলা হয়েছে - অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের উভয়েরই ভূমিকা এক্ষেত্রে রয়েছে। ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে এই নয়া নীতি অন্তত কাগজে কলমে উদারতা ও রাজ্য প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বয়ং শিক্ষার্থীকেও অনেক স্বাধীনতা দিয়েছে। In a segment called ‘multi-lingualism, and power of language’, the new National Education Policy (NEP) says, ‘‘wherever possible, the medium of instruction until at least Grade 5, but preferably till Grade 8 and beyond, will be the home language/mother tongue/local language/regional language’’.

Thereafter, the home/local language shall continue to be taught as a language wherever possible. This will be followed by both public and private schools. [৩]

উপরে উল্লেখিত অংশে এই ভাষা নীতির মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়েছে মূলত তিনটি বিষয় নিয়ে - ১) মাতৃ ভাষা ২) সংশ্লিষ্ট প্রাদেশিক ভাষা ৩) আঞ্চলিক ভাষা।
 
এগুলি বিষয়ে আপাতদৃষ্টিতে বিশেষ আপত্তির কারণ চোখে পড়ে না। লক্ষ্যণীয় এই শিক্ষানীতি আপাতদৃষ্টিতে মাতৃ ভাষা এবং/অথবা প্রাদেশিক ভাষাকে একটু বেশি পরিসর ও গুরুত্ব দিতে চায় বলে বোধ হয়। ‘‘Since most of the learning happens in the mother tongue, we ensured that wherever possible, the medium of instruction until at least Grade 5, but preferably till Grade 8 and beyond, will be the home language/mother-tongue/local language/regional language,’’ tweeted HRD minister Ramesh Pokhariyal.Thereafter, the home/local language shall continue to be taught as a language wherever possible. This will be followed by both public and private schools.

এবারে মাতৃভাষার পাশাপাশি আরেকটি পছন্দ মতো ভারতীয় ভাষার কথাও বলা হয়েছে স্পষ্টভাবে, কিন্তু এই পছন্দের তালিকার ব্যাপারটি তেমন স্পষ্ট করে বলা হয় নি। সেই পর্বে আবার মাতৃভাষার ভূমিকাটি খানিক দুর্বল বা জলো করে দেওয়া হয়েছে হয়তো উপরিলিখিত ‘‘as a language wherever possible’’ অংশটিতে। তাহলে কি পছন্দ মতো ভাষার বিষয়টি প্রথম স্তবকে উল্লেখিত রেস্টুরেন্টে খাদ্য তালিকার মতো! সংবাদ সুত্র থেকে যা জানা যায় -

The choice of languages learnt will depend on the state and the students. However, it is mandatory for at least two of the three languages to be native to the country - one of which is most likely to be the local/regional language.

Although a statement issued by the Ministry of Education says that ‘‘no language will be imposed on any student’’, it is not clear to what extent a student will be able to choose a particular language. [৪]

শিশুর দিক থেকে দেখলে কচি বয়সেই তাকে বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে মাতৃভাষা ছাড়া আরো একটি ভারতীয় ভাষার (অহিন্দি ভাষী রাজ্যে খুব সম্ভবত হিন্দির) বোঝা বইতে হবে, সঙ্গে ইংরাজী তো আছেই। কারণ পেশার ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ইংরাজীর গুরুত্ব বেড়ে চলেছে।

Noting that some people had raised doubts over the global appeal of the new policy vis-a-vis use of English, he asked if countries like Japan, Germany, France, and Israel have lagged behind others just because they stuck to their mother tongue. ‘‘These arguments do not make any sense,’’ he said, stressing the importance of education in mother tongue in a ‘‘diverse’’ country like India with several regional languages. [৫]

মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীর উপরের উক্তি থেকেই সন্দেহের অবকাশ থাকে যে -
প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির অঘোষিত উদ্দেশ্য হলো এতকাল শিক্ষা, বিশেষত উচ্চ শিক্ষা ও পেশার ক্ষেত্রে ইংরাজী ভাষার যে গুরুত্ব ও বিস্তৃত পরিসর বজায় ছিল - তাকে নানাভাবে যথাসম্ভব সংকুচিত করে সেই শূন্য স্থানে ভারতীয় ভাষার (সম্ভবত হিন্দির) প্রসার ঘটানো। এর ফলে এই শিশুরা যে কীভাবে কতটা উপকৃত হবে সেটা বোঝা দুষ্কর! কিন্তু বাঙালী আমরা ‘‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাই।’’ ‘ভারতীয় ভাষা’ এই পরিভাষার আড়ালে বাস্তবে যদি সত্যিই ‘হিন্দি’ ভাষাটির প্রবল প্রচারের প্রয়াস ঘটে, তার ফলে বিদ্যালয় শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিসর ও বিকাশের ঘাটতির আশঙ্কা থাকতে পারে হয় ইংরাজী ভাষার, নয়তো বাংলা, ওড়িয়া ইত্যাদির মতো মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষার। অর্থনৈতিক কারণে ইংরাজী ভাষার প্রবল প্রতাপ খুব একটা হ্রাসের বাস্তব অবস্থা নেই সম্ভবত। সেক্ষেত্রে বিদ্যালয় শিক্ষা ও তার সংশ্লিষ্ট সর্বত্র হিন্দি বাদে অন্যান্য ভারতীয় ভাষার ভবিষ্যৎ কী যে হতে পারে বলা শক্ত! ইতিমধ্যেই তামিলনাড়ু, ওড়িশা র মতো কিছু রাজ্য সরকার কার্যত এই ভাষা নীতির বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন।

এই প্রসঙ্গে বহুভাষিক ব্রিটেনের একটি গবেষণাপত্রের থেকে প্রাসঙ্গিক বক্তব্য টুকু উল্লেখ করা যাক। ক্রমবর্ধমান দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে এটাই পর্যবেক্ষণ করা যায় - দ্বিভাষিক সমাজে বা সম্প্রদায়ে যদি একটি আধিপত্যকারী (dominant) ভাষা থাকে, তাহলে শিক্ষার্থী সেই ভাষাটির কথোপকথন শোনার সুযোগ বেশি পাওয়ার পরিণতিতে সেটিতেই তুলনায় দক্ষতা বেশি অর্জন করে। সংখ্যালঘু ভাষায় দক্ষতা লাভ অনেক টা নির্ভর করে শিক্ষার্থীর কর্ণকুহরে সেই ভাষার যোগানের সুবিধার ওপরে। ব্রিটেনে যে অঞ্চলে ইংরাজী ও ওয়েলস (Welsh) - এই দুই ভাষারই প্রচলন রয়েছে, সেখানে ইংরাজী ভাষাতেই দক্ষতা পরিলক্ষিত হয়েছে। [৬]

আমাদের যাবতীয় জাতীয় ও প্রাদেশিক নীতিতে অন্য সব কিছুর তুলনায় সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া উচিত দেশের শিশুদের সার্বিক বিকাশের বিষয়টি। অথচ সব থেকে মজার ও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো - যে শিশুর ভাষাশিক্ষা নিয়ে এত কথা ও মতান্তর, তার থেকে একবারও কেউ জানার আগ্রহ বোধ করে না যে - কিসে তার সুবিধা-অসুবিধা বা কেমন তার পছন্দ! শিশুদের নিয়ে আমাদের লোক দেখানো উৎসব ও আদিখ্যেতা র কোনো বিরাম নেই। অথচ কত দ্রুত শিশুরা নিজেদের শৈশবকে হারিয়ে ফেললো - বলা ভালো ওদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হলো। নিম্নবিত্ত, দরিদ্র পরিবারের শিশুদের দীর্ঘকালই শৈশব না থাকার কারণ হলো বাল্যকালেই শিশু শ্রমিকে পরিণত হওয়া অথবা আড়কাঠিদের হাত ধরে ভিনদেশে, ভিনরাজ্যে চালান হয়ে যাওয়া। এর পিছনের মূল কারণ তীব্র দারিদ্র্য, অপর দিকে শিশু চালানকারিদের কাঁচা টাকার প্রলোভন!

এসব সত্বেও অসহায় দরিদ্র পরিবারের যে কয়টি শিশু কোনোভাবে তাও বজায় থাকে, তাদের অবস্থা তবু স্বচ্ছল উচ্চবিত্ত শিশুদের থেকে একদিক ভালো। কারণ তাদের শৈশব, স্বাধীনতা কিছুটা অবশিষ্ট আছে, যেটা সমাজের বাকি অংশে একেবারেই নেই। আমাদের যুগে স্কুল থেকে ফিরে কখনো বা ফেরার পথেই ব্যাগ রেখে দল বেঁধে খেলতে নেমে যাওয়ার যে রেওয়াজ ছিল - সেটি তো সম্পূর্ণ ভাবে নষ্ট হয়েছে। প্রথমত টিউটরদের পিছনে প্রায় সারা দিন দৌড়াতে দৌড়াতে ছোটদের হাতে কোনো সময় নেই, ছেলেমানুষী নেই, দ্বিতীয়ত খেলার মাঠ গুলিও লোপাট - কিছু ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদের সৌজন্যে। এখন কিছু শিশু যে সব নাচ গান বা খেলার স্কুল বা ক্লাবে যায়, তার কাছে সেটা আরেকটি স্কুলের বোঝা - কোনো স্বতস্ফূর্ততা, বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ার সুযোগ নেই! তাই এই প্রজন্মের ছোটদের বন্ধু প্রায় নেই বললেই চলে, সবাই প্রতিযোগী! বহু যুগের ওপারে একটু তাকানো যাক। আগে কি সত্যি স্বর্ণযুগ ছিলো, কোনোই অনাচার ছিলো না! সেকালের শিশুরা যদি বলার সুযোগ পেতো তাহলে জানা যেতো - মোটেই এমনটা নয়। মা - বাবা ও বড়রা সাধারণ ভাবে ছোটদের প্রতি যত্নশীল হলেও, বিপরীত ঘটনার চিত্রও ছিল প্রচুর।

এর পরে আসা যাক আজকের ছাত্র ও কিশোরদের দিকে। সব চেয়ে বড় প্রশ্ন হল- এদের শৈশবের অস্তিত্বই যেন বিপন্ন। আগেকার দিনে কিছু অকালপক্ক শিশু বাদে তাদের ছেলেমানুষীর সুযোগ মিলতো অনেক বয়স পর্যন্ত- ছিল তাদের নিজস্ব জগত। কিন্তু এখন তারা সমবয়সী সঙ্গীদের পায় না- বেশির ভাগ সময়ে থাকে বড়দের মধ্যে, উপরন্তু নানা টিভি চ্যানেল ও স্মার্ট ফোনের সুবাদে ছোটদের কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো সম্পূর্ণ। এখনকার বড়দের কাছে এদের আস্কারা বা প্রশ্রয় মেলে প্রচুর; কিন্তু প্রকৃত স্নেহ-আদর মেলে না!

তাকে বোঝার বা সাহচর্য দেবার মতো বন্ধু কেউ নেই!এর থেকে আসে একাকিত্ব, অবসাদ, মাদকাসক্তি, এমন কি অপরাধ-প্রবণতাও- যার মধ্যে আত্মঘাতী প্রবণতা। কিন্তু এমনটা হবার মোটেই কথা ছিল না- যে স্নেহভাজন কিশোরের মানসিক চাহিদার জন্য নানা বয়সের নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য দরকার বেশি, তার বদলে দামী দামী উপহার দিয়ে লাভ নেই। নির্জীব পণ্য কখনো মানুষের, এমন কি গৃহপালিত প্রাণীরও বিকল্প হতে পারে না। কিন্তু আমাদের অতি আধুনিক জীবনযাত্রা আমাদের এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে - টাকা বা জিনিস দেয়া যাবে, কিন্তু সময় দেয়া যাবে না।

এর সঙ্গে বাড়তি বোঝা রয়েছে শিক্ষা ক্ষেত্রে সফল হবার তাগিদ- ভালো ফল করতে হবে, ভালো স্কুল-কলেজে ভর্তি হতে হবে, পেশাজীবনে সফল হতে হবে। এই সাফল্যের ইঁদুর-দৌড়ের আর শেষ নেই ।এর জন্য যে মানসিক চাপ ও উদ্বেগ তার কমবেশি শিকার ছাত্ররা, সঙ্গে বাবা মা-রাও। তার জন্য মানসিক রোগ ও অন্যান্য সমস্যাও এদেশে কম নয়। সমাজে ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্যের সঙ্গে এক অশুভ প্রতিযোগিতার দুর্ভোগের সম্মুখীন আজকের যুবসমাজ- কারণ বাড়তি টাকার ফি জমা দিয়ে অনেক নামী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তি করার রেওয়াজ চালু হয়েছে বেশ কিছুদিন। আমাদের যুগে স্কুলে ধনী নির্ধন সবার সঙ্গে মিলে মিশে বড়ো হবার যে রীতি - বিলিতি স্কুলের যুগে তো অচল । শিক্ষাসহ সমাজের সব কিছুই বাণিজ্যে পরিণত হবার ফলে চাকা যে অশুভ দিকে ঘুরেছে - তার গতি উল্টোদিকে ঘোরানো যে কিভাবে সম্ভব এটাই বড়ো প্রশ্ন! এদেশের জটিল ভাষা-সমস্যা নিয়ে বর্তমান নিবন্ধকারের এক প্রশ্নের উত্তরে ভূতপূর্ব কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ডঃ প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্র যে উত্তর দিয়েছিলেন সেইটি উল্লেখ করে ইতি টানা যাক। ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি কলকাতার একটি সভামঞ্চ [৭] থেকে বিদায়কালে ভারতীয় ভাষাগুলি সম্বন্ধে তিনি বলেন - এখন দরকার হলো বেশি বেশি করে এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনুবাদের কাজ করা।

তথ্যসূত্রঃ
১) Teaching of English at primary level in Government school - NCERT (2012).
২) “Cognitive scientists define critical period for learning language study shows children remain adept learners until the age of 17 or 18”, Anne Trafton, MIT News Office Publication Date: May 1, 2018.
৩) National Education Policy 2020, Ministry of Human Resources Development, Govt. of India.
৪) The Quint.
৫) New Education Policy Based on Equity, Quality, Accessibility: HRD Minister Ramesh Pokhriyal’s speech at the inaugural session of Amity University’s two-day conference, (Ref: News 18)
৬) VIRGINIA C. MUELLER GATHERCOLE & ENLLI MON THOMAS, “Bilingual first-language development: Dominant language takeover, threatened minority language take-up”.
৭) National Conference 1996, Akhil Bhartiya Bhasha Sahitya Sammelan, Bangla Academy, Kolkata.