আরেক রকম ● নবম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২১ ● ১৬-৩০ পৌষ, ১৪২৭

সমসাময়িক

একুশের পদধ্বনি


জীবনে কোনোকিছুই একমাত্রিক ঘটে না। নদীর স্রোত যেমন পার ঘেঁষে ঘড়ির বিপরীতে চলে, জীবনও।

২০২০ শুরু হয়েছিল বিদ্রোহ বিক্ষোভ আর আন্দোলন দিয়ে। দিল্লির রাজপথ দখল করে নিয়েছিল জামিয়া মিলিয়া আর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। শাহিনবাগ জুড়ে ছিলেন মহিলারা, দাদিরা। জানুয়ারিতেই কেরলে ধরা পড়েছিল করোনা। কেন্দ্রীয় সরকার উদাসীন। ফেব্রুয়ারির ২৪-২৫ ট্রাম্পকে নিয়ে শত শত কোটি টাকা খরচ করে মোচ্ছব হল। ২৩-২৫ ফেব্রুয়ারি দিল্লি জুড়ে চলল সরকারি মদতে গণহত্যা। যাঁরা আক্রান্ত হলেন বা আক্রান্তদের পাশে ত্রাণ নিয়ে দাঁড়ালেন তাঁদের পুরে দেওয়া হল জেলে। মার্চ মাসে শুরু হল লকডাউনের নাটক। চার ঘন্টার নোটিশে দেশ জুড়ে লক ডাউন। লাখ লাখ শ্রমিক হাঁটতে শুরু করলেন। না খেয়ে, ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেলেন অনেক শ্রমিক। কেন্দ্রীয় সরকার নির্বিকার। ১৪ কোটি মানুষ কাজ হারালেন। বেতন ছাঁটাই হলো বহু মানুষের। নতুন নিয়োগ নেই। ডিএ বন্ধ। বন্ধ ইনক্রিমেন্ট। পিএম কেয়ার্সের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা তোলা হল। তার হিসেব নাই। সে-নিয়ে আন্দোলনও নাই। জাল ভেন্টিলেটর কেনা হল। মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। কোনো গণআন্দোলন গড়ে উঠল না। পশ্চিমবঙ্গ আমফান ঝড়ে বিপর্যস্ত হল। জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণার দাবি উঠল। হল না। সামাজিক সংগঠন, রাজ্য সরকার, বামপন্থী গণসংগঠন সাধ্যমতো ত্রাণ করেছে। ফলে এ-রাজ্যে না খেয়ে কেউ মারা যান নি। আমফানে দ্রুত ২০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ করা হয়েছে। তাতে দুর্নীতির বহু অভিযোগ। কিছু সুরাহাও হয়েছে।

এর মাঝে লোকসভা খুলেছে। প্রশ্নোত্তরের কোনো সুযোগ রাখা হয় নি। ত্রিশটির বেশি জনবিরোধী বিল পাশ করা হয়েছে। এরমধ্যে আছে শ্রম কোড বিল, কৃষি বিল, বিদ্যুৎ বিল। কৃষি বিল নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ হয়েছে। সে প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিয়েছেন পাঞ্জাব হরিয়ানার কৃষকেরা। তা দেখে দেশ জেগেছে। দলে দলে কৃষক যাচ্ছেন দিল্লি। দিল্লি কার্যত অবরুদ্ধ। এই লড়াইয়ে পশ্চিমবঙ্গে জন্মানো হান্নান মোল্লা সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এ-নিয়ে কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। লোকসভা রাজ্যসভার শীতকালীন অধিবেশন বন্ধ। অথচ বিহারে প্রধানমন্ত্রী ১৫ টির বেশি জনসভা করলেন। বিহারে বিজেপি জোট অল্পব্যবধানে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু তেজস্বী যাদবের নেতৃত্বে ধর্মের চেয়েও রুটি রুজির লড়াই বড়ো - এটা সামনে এসেছে।

পশ্চিমবঙ্গ আসাম কেরল তামিলনাডুতে সামনে নির্বাচন। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের ঢাক বেজেছে। ইডি সিবিআই আয়কর ব্যবহার করে তৃণমূল সিপিএম সিপিআই কংগ্রেস বিধায়ক ও নেতা কেনা শুরু হয়েছে। চলছে রোড শো-র প্রতিযোগিতা। অথচ লোকাল ট্রেন ভালোভাবে চালু হয় নি। স্কুল কলেজ বন্ধ। জিনিসপত্রের দাম সীমাহীন। মানুষের হাতে পয়সা নেই। কাজ নেই। টেট পরীক্ষার তালিকা দুর্নীতির অভিযোগে বাতিল করেছে কলকাতা হাইকোর্ট।

ওদিকে বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আদালত বিচারবিভাগ নির্বাচন কমিশন আয়কর ইডি সিবিআই - কেন্দ্রীয় সরকারের অঙ্গুলি হেলনে চলছে বলে অভিযোগ।

শত শত সমাজকর্মীকে বিনা বিচারে বছরের পর বছর মিথ্যা অভিযোগে বন্দি করে রাখা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের শুনানির সময় নাই। বিজেপির কার্যত মুখপাত্র অর্ণব গোস্বামী একটি ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হতেই ১২ ঘন্টায় নজিরবিহীন শুনানি। অন্ধ্রপ্রদেশের ঘটনাও বিস্ময়কর। অন্ধ্রপ্রদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির এজলাসে বিজেপি ঘনিষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী রেড্ডির দুর্নীতির মামলার শুনানি চলছিল। রেড্ডি এ নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তদ্বির করেছিলেন। ৩০ ডিসেম্বর রাতারাতি দুই প্রধান বিচারপতিকে বদলি করা হয়েছে। এতে প্রশ্ন তুলেছে অন্ধ্র হাইকোর্ট ও তেলেঙ্গানা হাইকোর্ট। এ জিনিস ভারত নতুন দেখছে। দিল্লি দাঙ্গায় পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলায় দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি মুরলিধরকে রাতারাতি বদলি করা হয়েছিল। বিচারব্যবস্থার বদান্যতায়, বাবরি মসজিদের জমিতে রাম মন্দিরের ভূমি পূজা সমাপন হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মসজিদ ভেঙে গড়ে ওঠা মন্দিরের ভূমি পূজায় যজমানের ভূমিকায়। করোনা তখন মধ্যগগনে, সভা-সমাবেশ বন্ধ। কিন্তু তাতে মন্দিরের ভূমি পূজায় কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি।

এত খারাপের মাঝে আশার আলো দিল্লির রাজপথে লড়াকু কৃষক সমাজ। ৪০ জনের বেশি কৃষক ঠান্ডায় শহিদ। তবু হাল ছাড়েননি। পরিবার পরিজন নিয়ে তাঁবু খাটিয়ে লড়ছেন লড়াই। মানুষের আসল সমস্যা থেকে মুখ ঘোরাতে চলছে বাক্যের ফুলঝুড়ি। কথামৃত নয় কথাবিষ।

অমর্ত্য সেনকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে।বিরজু মহারাজসহ ৩০ জন‌ শিল্পীর সরকারি ঘর কেড়ে নেওয়া হচ্ছে দিল্লিতে।দেশে নাকি টাকা নেই। অথচ প্রধানমন্ত্রীর জন্য বিলাসবহুল বিমান কেনা হল ৮৪০০ কোটি টাকায়। দিল্লির কৃষি ভবন বিজ্ঞান ভবন ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে ২০৪০০ কোটি টাকায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, নতুন সংসদ ভবন গড়া হচ্ছে।

ওদিকে আওয়াজ তোলা হচ্ছে - এক দেশ এক নির্বাচন। আসলে এক দল এক নেতা একটাই ভোট। ভোট তো নয়, ভোটের নামে প্রহসন। তবু শেষ রক্ষা হচ্ছে না। ব্যালটে ভোট হলেই হারছে। কেরালায় পুর নির্বাচনে হেরেছে। রাজস্থানেও। কাশ্মীরেও জেলা নির্বাচনে বিপুলভাবে হেরেছে।

বিশ্ব স্তরেও দক্ষিণপন্থী শাসকদের ক্রমাগত স্বৈরাচার এবং নবউদারবাদী নীতি গ্রহণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে একত্রিত হচ্ছেন মানুষ। বলিভিয়ার নির্বাচনে বামপন্থীদের প্রবল জয়, চিলিতে পিনোচেত প্রবর্তিত সংবিধানের বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ, ভেনেজুয়েলায় বাম সরকারের পুনর্বার বিজয়ী হওয়া প্রমাণ করেছে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই থেমে যায়নি। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ট্রাম্পের হার এবং গদি না ছাড়ার তার অদম্য জেদ প্রমাণ করেছে দক্ষিণপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই যেমন আছে, তেমনি স্বৈরাচার বিশ্বের সর্বশক্তিশালী দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকেও নড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তাই আমাদের মতন দেশে ক্রমাগত এই শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে, নয়ত দেশের ভবিষ্যৎ প্রবল অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।

বিশ শুধু বিষ দেয়নি, লড়াইয়ের পদধ্বনিও শুনিয়েছে।
লড়াই না হয় মৃত্যু।
আত্মসমর্পণ নয় আন্দোলন।
একুশ তারই পদধ্বনি শোনাচ্ছে।