আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২১ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

বঙ্গবন্ধু ও ভারতীয় সংবাদমাধ্যম

গৌতম লাহিড়ী


ঢাকার ধানমন্ডির সরকারি বাসভবনে ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। সামরিক বাহিনীর কয়েকজন সরাসরি গুলি করে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুকে। তাঁর পরিবারের কোনো সদস্যকেই ছাড় দেয়নি হত্যাকারীরা।

ভোর রাতের এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের খবর অতি দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বাদ যায়নি পশ্চিমবাংলা তথা কলকাতা। স্বাধীনতা দিবসের সকালে আকাশবাণী প্রচারিত এই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদে শোকবিহ্বল এপার বাংলা। স্বাধীনতা দিবসের ছুটি থাকায় পরের দিন ১৬ই আগস্ট কোনও সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়নি। ১৭ই আগস্টের খবরের কাগজের পুরোটাই দখল করে নিল বঙ্গবন্ধুর হত্যা সংক্রান্ত যাবতীয় খবর।

কলকাতার সঙ্গে তো বঙ্গবন্ধুর অনেকদিনের সম্পর্ক। হয়তো সেই কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম সরকারি বিদেশ সফরের সময় তিনি কলকাতাকেই বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৭২-এর ৬ থেকে ৮ই ফেব্রুয়ারি তিনি কলকাতায় ছিলেন। ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে আয়োজিত হয় তাঁর গণসম্বর্ধনা। এই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য দিল্লি থেকে কলকাতায় চলে এলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এত বিশাল জনসমাবেশ সম্ভবত এর আগে কখনও হয়নি।

জনসম্বর্ধনার জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেনঃ 'ভারতের ঋণ বাংলাদেশ কোনদিন শোধ করতে পারবে না’ - ১৯৭২ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি 'আনন্দবাজার পত্রিকা'র শিরোনাম। সে দিন খবরের কাগজ বঙ্গবন্ধুময়, কারণ আগের দিন, ৬ই ফেব্রুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে রচিত হয়েছে ইতিহাস। রবিবার সকালে দমদম বিমানবন্দরে এসে নামলেন ইন্দিরা গান্ধী। তার কিছুক্ষণ পরেই ঢাকা থেকে এলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। রাজভবন পৌঁছনোর আগে দু’জনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তিতে পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন। বঙ্গবন্ধুর দু’দিনের সংক্ষিপ্ত কিন্তু আবেগদীপ্ত সফরের তুঙ্গস্পর্শী মুহূর্তটি অপেক্ষা করছিল বিকেলে ব্রিগেডের সভায়। ছুটির দিন, সকালে বৃষ্টিও হয়েছিল। তবু ব্রিগেডে লাখো মানুষের জনসমুদ্র, বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীকে দেখার ও শোনার আশায় উদ্বেল বাঙালির আবেগের বাঁধ না-মানা স্রোত। তাঁদের বক্তৃতার জন্য উঁচু করে বাঁধা হয়েছিল মঞ্চ, যাতে দূর থেকেও দেখা যায়। একটু দূরে আরও একটা মঞ্চ, সেখানে সমবেতকণ্ঠে দেশাত্মবোধক গান গাইলেন গায়ক-গায়িকারা - সরলা দেবীর লেখা ‘জয় যুগ আলোকময়’ দিয়ে শুরু, পরে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদের গান।

‘...আমার ভাই ও বোনেরা, আপনাদের জন্য আমি সাত কোটি বাঙালির পক্ষ থেকে শুভেচ্ছার বাণী বহন করে নিয়ে এসেছি, কৃতজ্ঞতার বাণী বহন করে নিয়ে এসেছি...’ - ব্রিগেডে ৬ই ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা কেবল এক সদ্য-স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ভাষণ মাত্র ছিল না, ছিল দুই দেশের, দুই বাংলার ভালবাসা ও সৌভ্রাত্রের ঋজু প্রতিষ্ঠা প্রয়াস। ‘যে জাতি মুক্তিপাগল, যে জাতি স্বাধীনতাকে ভালবাসে, সে জাতিকে বন্দুক কামান দিয়ে দাবাইয়া রাখা যায় না’ - বঙ্গবন্ধুর মুখে এ কথা শুনে হর্ষধ্বনি করেছিল কলকাতা। বার বার উচ্চারণ করেছেন রবীন্দ্র-উদ্ধৃতি, কখনও কৃতজ্ঞতা বোধে, কখনও স্বাধীন সার্বভৌম দেশ গড়ার পথে যাবতীয় রাজনৈতিক ক্ষুদ্রতা, কূটনৈতিক ষড়যন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতায়। তাঁর আবেগী সম্ভাষণে সে দিন উঠে এসেছিল তিতুমির থেকে মাস্টারদা সূর্য সেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু থেকে হুসেন শহিদ সুরাবর্দির কথা, বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতাস্পৃহা যাঁদের উত্তরাধিকার।

তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণেও সেদিন ধ্বনিত হয়েছিল স্বাধীনতা, সম্প্রীতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার, নতুন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অগ্রগমনে বন্ধুতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার। তারই প্রমাণ বঙ্গবন্ধুর এই সফরে কলকাতার রাজভবনে ইন্দিরা-মুজিব বৈঠক, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের উন্নয়ন, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত। সেনা প্রত্যাহারের তারিখ এর আগেই ১৯৭২ সালের ৩০শে জুন থেকে ৩১শে মার্চে এগিয়ে আসার কথা হয়েছিল, জানুয়ারিতে কারামুক্ত বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান থেকে লন্ডন-ফেরত দিল্লি হয়ে ঢাকা যাওয়ার সময়।

সোমবার ৭ই ফেব্রুয়ারি কলকাতা প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধুর সম্বর্ধনা সভা। এই সভায় তিনি ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলেন যে ভারতের সাংবাদিকরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানের সৈন্যদের নৃশংস অত্যাচারের খবর সংগ্ৰহ করে প্রচার করার জন্যই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন দেশের সমর্থন পাওয়া সম্ভব হয়।

কলকাতার কলেজে পড়াশোনার সময়ই সংবাদপত্রের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রথম পরিচয়। হয়তো সেই সময় থেকেই তিনি ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক 'ইত্তেহাদ' পত্রিকার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। পরে দৈনিক 'ইত্তেহাদ' পত্রিকা ঢাকায় স্থানান্তরিত হলে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মানিক মিয়ার হাতে তুলে দেন সম্পাদনার দায়িত্ব।

'আনন্দবাজার পত্রিকা' ১৯শে অগস্ট, ১৯৭৫ ভারতীয় সাংসদ প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সীকে উদ্ধৃত করে একটি সংবাদে জানায় যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যা প্রমাণ করে দিয়েছে যে পাশ্চাত্যের দেশগুলি এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দারা ভারতীয় উপমহাদেশে কত সক্রিয়। আসলে তিনি পরোক্ষভাবে সেই দেশগুলোর দিকে ইঙ্গিত করেন যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের দিকে সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদে সারা ভারতে অসংখ্য সভা-সমাবেশ মিছিল আয়োজিত হয়। দিল্লির এক প্রতিবাদ সভায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও প্রবীণ সাংসদ ভূপেশ গুপ্ত সরাসরি পাশ্চাত্যের বড়ো দেশগুলির গোয়েন্দাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হানেন। তাঁর মতে পাশ্চাত্যের গোয়েন্দারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের মদত দিয়েছে। পরে প্রমাণিত হয় যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের অনেকেই পাশ্চাত্যের অনেক দেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ বারংবার তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেও কাজের কাজ হয়নি।

কলকাতার 'যুগান্তর' পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয় যে ঢাকায় নিযুক্ত কোনো এক বিদেশি দূতাবাস সরাসরি বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে যুক্ত। এই অভিযোগ ওঠার পর কলকাতায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট জেনারেল তাঁর উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে 'যুগান্তর' পত্রিকায় একটি কড়া প্রতিবাদপত্র পাঠায়। 'যুগান্তর' পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে পড়ে গিয়ে অন্যভাবে বিষয়টি সামলে নেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বিষয়টি ভালো চোখে মেনে নেয়নি। ১৯৭৫-এর অক্টোবরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াই বি চ্যবন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সচিব হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সম্ভবত বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছিল। কারণ, সাক্ষাৎকারের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে যে বিবৃতি জারি করা হয় তাতে লেখা ছিল - 'বিদেশ সচিবের প্রশ্নের উত্তরে চ্যবন জানিয়েছেন যে এই ষড়যন্ত্রের বিষয়ে ভারতের কাছে কোনো আগাম খবর ছিল না।'

বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর উদ্বেগের বিষয়টি সর্বজনবিদিত। বঙ্গবন্ধুর হত্যার কয়েক মাস আগে ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা বিভাগের (র) প্রধান রামেশ্বর নাথ কাও ঢাকায় গিয়ে এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন। বঙ্গবন্ধু অবিশ্যি এই সতর্কবার্তাকে গুরুত্ব না দিয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেন - 'আমার সন্তানরা আমায় হত্যা করবে না।' বঙ্গবন্ধু দেশবাসীকে সন্তান বলেই সম্বোধন করতে অভ্যস্ত ছিলেন।

এরপর অবিশ্যি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর হত্যা নিয়ে আর কোনো বিশদ আলোচনা হয়নি। ইদানিং বেশ কয়েকজন গবেষক এ বিষয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব অনিল গোস্বামী ঢাকা সফরের সময় জানান বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত যে দু'জন ভারতে লুকিয়ে আছে বলে জানানো হয়েছে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের মধ্যে পাঁচজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। সাতজন বিভিন্ন দেশে লুকিয়ে আছে। এদের মধ্যে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন এবং আব্দুল মাজেদ ভারতের কোথাও লুকিয়ে আছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু কোনোভাবেই তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র সচিবকে ভারতীয় স্বরাষ্ট্র সচিব জানিয়েছিলেন যে খোঁজ চলছে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ধারণা ছিল যে শেখ মুজিবুর রহমানকে খুন করলেই বাংলাদেশে আবার সাবেক জমানা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। কিন্তু তাদের জানা ছিল না যে বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের মধ্যে যে স্বাধীনতার স্পৃহা প্রজ্জ্বলিত করে দিয়ে গেছেন তা আর কোনোভাবেই উৎখাত করা যাবে না। আজও ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশে 'জাতীয় শোক দিবস' হিসেবেই বিবেচিত। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির সময়ও বাংলাদেশের মানুষ সশ্রদ্ধ চিত্তে বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় শোক দিবসকে স্মরণ করে।