আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২১ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

কে প্রধান প্রতিপক্ষ?

কালীময় মৈত্র


সাম্প্রতিক বিধানসভা এবং তার আগের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণির বিদ্বজ্জন, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, অতিবাম সমর্থক, কিছু নেতাকর্মী, এবং সেইসঙ্গে সংবাদমাধ্যমের পরিচালন গোষ্ঠী সকলে একযোগে আকুল হয়েছেন। কারণ সরল, লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে একজন বামপন্থী প্রার্থীও পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত হতে পারেননি। বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা, প্রতিবেদন, দূরদর্শনে নিত্যনৈমিত্তিক অশান্ত তরজা ইত্যাদি ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁরা সময় খরচ করছেন এবং বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। এখন একটিমাত্র প্রশ্ন নিয়ে প্রচুর অক্ষর খরচ হচ্ছে এবং তা মূলত বামপন্থী দলগুলোর উদ্দেশ্যে। বিশেষ করে ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি'র লক্ষ্য। এই উৎসাহী মানুষদের মুখ্য দাবি, বামপন্থী নেতৃত্ব সর্বাগ্রে ঘোষণা করুক যে তাদের প্রথম এবং পয়লা নম্বর শত্রু কে। এখানে 'শত্রু' শব্দটি আদতে উপরোক্ত গোষ্ঠীর উৎসাহ বর্ধনে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাজনীতিতে শত্রু কথাটি উপযুক্ত নয়। তাই প্রশ্ন হচ্ছে বামপন্থী দলগুলোর কাছে কোন রাজনৈতিক শক্তি প্রধান প্রতিপক্ষ? বিজেপি না তৃণমূল? কেই বা দুই নম্বর? অর্থাৎ সমস্যা হল, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা শত্রু, যে নামেই সংজ্ঞায়িত করুন না কেন, বিরোধ প্রকাশের ক্ষেত্রে এদের আঙ্কিক মান নির্ধারণ করা নিয়ে।

আলোচনার শুরু এখান থেকেই। দেশজ বামপন্থী ভাবনায় বিজেপি আদ্যন্ত একটি চরম দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক দল। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের রাজনৈতিক শাখা এই দলটি। প্রাক স্বাধীনতার যুগে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ জাতীয় আন্দোলনের মূল ধারা থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন ছিল, হয়ত বা কৌশলগত কারণেই নিজেদের বিচ্ছিন্ন রেখেছিল। অধিকাংশ দেশবাসী যখন স্বাধীন ভারতবর্ষকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে কল্পনা করেছিলেন, তার বিপরীতমুখী চিন্তা ও দর্শন সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এই সাধারণতন্ত্রকে ধর্মভিত্তিক হিন্দু রাষ্ট্রের চেহারায় এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। প্রাক স্বাধীনতা যুগে দেশের মুক্তি আন্দোলনে অনেক সময় জাতীয় কংগ্রেসের মঞ্চে বামপন্থী দলগুলো লড়াই করছেন। সম্ভবত আরএসএস তখন থেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের তীব্র বিরোধিতায় দেশের স্বাধীনতার বদলে 'হিন্দুরাষ্ট্র' তকমা পেতেই বেশী আগ্রহী। বামপন্থী ভাবনায় এই ইতিহাস বহুচর্চিত এবং বহুল পঠিত।

মূলত এই কারণেই স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে জাতীয় কংগ্রেস ও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা নিয়ে তুলনামূলকভাবে অধিক আলোচনা হয়। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর থেকেই ভারতের চলমান রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জাতীয় কংগ্রেস ও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি - মূলত এই দুই শক্তি প্রাধান্য বিস্তার করে। এদের পরস্পরবিরোধী মতাদর্শ রাজনৈতিক দর্শনের স্বীকৃতি পায়। এই দ্বন্দ্বে কিছুদিনের মধ্যেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করে শাসক কংগ্রেস। দ্বন্দ্বের স্বাভাবিক নিয়মেই তাদের বিরোধী শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করে বামপন্থীরা। অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমর্থক জাতীয় কংগ্রেস দল পন্ডিত জহরলাল-এর নেতৃত্বে দেশের রাজনৈতিক পরিসরে ডানঘেঁষা মধ্যপন্থী অবস্থান নেয়। এদের বিপরীতে দেশের বিভিন্ন অংশে জনতা বা অন্যান্য সমাজবাদী ভাবনার দল ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে এখানে আমরা মূলত বামেদের নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি। কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, বিহার, এই সব জায়গাতেই বিভিন্ন নামে কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হওয়ার পর ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) তাদের শ্রমিক সংগঠন সিটু, ছাত্র সংগঠন এসএফআই, এবং অন্যান্য গণসংগঠনের মাধ্যমে ভারতীয় রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষ করে দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ-আসাম-ত্রিপুরার বাস্তুচ্যুত অসহায় মানুষ তাদের দুর্ভাগ্যের জন্য জাতীয় কংগ্রেসকে দায়ী মনে করায় বামেদের জনপ্রিয়তা এইসময় অটুট ছিল। এই বিপুল অংশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও বঞ্চনাকে সংগঠিত করে বামপন্থী আন্দোলনের একটি ধারা পূর্বের এই রাজ্যগুলিকে ভিত্তি করে সারা ভারতে বেশ শক্তিশালী হয়েছিল। পশ্চিম ভারতেও উদ্বাস্তু সমস্যা ছিল, কিন্তু বামপন্থীরা খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি সেখানে। যদিও পাঞ্জাব এবং রাজস্থানে কয়েকটি অঞ্চলে তারা গরীব মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে আজও যথেষ্ট পরিচিত।

গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষ থেকেই (পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর ১৯৬৪ সালে মৃত্যুর পর) জাতীয় কংগ্রেসের ক্রমশ দুর্বল হওয়া শুরু। পরিচিতি সত্তা এবং জাত্যাভিমানের রাজনীতি কংগ্রেসের পরিসর দখল করতে শুরু করে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। তামিলনাড়ুতে এআইডিএমকে, ডিএমকে, অন্ধ্রে তেলেগু দেশম, উত্তর ভারতে সমাজবাদী দল, লোকদল, বহুজন সমাজ পার্টি ইত্যাদি বিভিন্ন নামে কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ নেতৃত্ব বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করে। কিন্তু কোন একটি বিশেষ দলের সারা ভারতে প্রভাব বিস্তার করার মতো শক্তি, মতাদর্শ, বা কর্মসূচি ছিল না। অবশ্যই সম্ভাবনা ছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র নেতৃত্বে সমস্ত বামপন্থী দলগুলো এক হয়ে নিজেদের বিস্তার করার। কিন্তু সম্ভাব্য সুযোগকে বাম নেতারা বাস্তবে রূপায়ণ করতে পারেননি। সেই ইতিহাসের বিশ্লেষণ এই প্রতিবেদনে প্রাসঙ্গিক, কিন্তু ভাবনার গভীর পথে চলে গেলে শত্রু চিহ্নিতকরণের আলগা আলোচনায় পৌঁছতে বহু দেরি হয়ে যাবে। অন্যদিকে নিজেদের সম্ভাবনাকে ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের পথে নিয়ে যাচ্ছিল আরএসএস। তাদের রাজনৈতিক সংগঠন কখনও জনসংঘ, কখনও হিন্দু মহাসভা এরকম বিভিন্ন ছাতার তলায় এক হয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছিল দেশ জুড়ে। সর্বশেষ জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে যখন কংগ্রেস বিরোধী আন্দোলন জরুরি অবস্থা জারির বিরুদ্ধে সারা ভারতবর্ষের তীব্র আকার ধারণ করেছে, তখন জনতা দলের মঞ্চে আগামীর বিজেপি নেতাদের আত্মপ্রকাশ। ১৯৭৭ সালে মোরারজি দেশাই-এর নেতৃত্বে প্রথম অকংগ্রেসী সরকার গঠন। সেখানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় অটল বিহারি বাজপেয়ী (বিদেশ দপ্তর) এবং লালকৃষ্ণ আদবাণী (তথ্য প্রচার) অংশগ্রহণ করেছিলেন। লক্ষ্য করে দেখুন, সর্বভারতীয় কংগ্রেস বিরোধী মঞ্চে বামপন্থীদের অংশগ্রহণ করার মত সুযোগ তৈরি হওয়া অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সেই সময়ের বাম নেতারা সেই ধরনের কোনো ভাবনা গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছিলেন বলে মনে হয় না।

অর্থাৎ জাতীয় কংগ্রেস ক্রমশ দুর্বলতর হচ্ছিল। সেই পরিসর জাতীয় স্তরে দখল করার মত দায়িত্ব এবং ক্ষমতা কোনো দল দেখাতে পারেনি। এইখানেই নিজেদের জায়গা তৈরি করছিল আরএসএস। তারা শুধুমাত্র এক দুটি রাজ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে গোটা উত্তর ভারতে সংগঠিত করছিল নিজেদের। এইসময় সারা ভারতব্যাপী প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ তাদের সামনে উপস্থিত হল রামমন্দির-অযোধ্যা বিষয়টিকে কেন্দ্র করে। এই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল ১৯৮৪ সালে ক্ষমতায় আসা রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার, রামলালা বিগ্রহে পুজোর অনুমতি দিয়ে। সুযোগ কাজে লাগিয়ে আশি সালে শুরু হওয়া দল চুরাশিতে দুটি আসন পেয়ে লোকসভায় তাদের যাত্রা শুরু করল। জরুরি অবস্থার সময় জনতা দলের আন্দোলন ছিল গণতন্ত্র রক্ষার ভাবনায়। সেখানে জাতপাতের রাজনীতি তলায় তলায় ঢুকে পড়েছিল, কিন্তু তা প্রত্যক্ষ ছিল না। বিজেপি সেই ফাঁকা জায়গাটা দখল করল। মানুষের রুটি-রুজি সংক্রান্ত আন্দোলনের কোনো ইতিহাস ছাড়াই, শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত বিজেপি এগিয়ে চলল ক্ষমতা দখলে লক্ষ্যে। মনে রাখতে হবে, এইসময় কিন্তু কংগ্রেস বিরোধী সরকারকে একযোগে সমর্থন করেছিল বিজেপি এবং বামপন্থীরা। তারপর ১৯৯৬-তে ১৩ দিন, এবং ১৯৯৮-তে ১৩ মাসের সরকার। এরপর সবসময় ভারতের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি। আজকের দিনে রাজনৈতিক বিস্তার এবং প্রভাবে বিজেপি অপ্রতিরোধ্য। একটি রাজনৈতিক সমীকরণের কথা এখানে বলতেই হবে। তার প্রত্যক্ষ চলরাশি সম্প্রদায় পরিচিতি এবং জাতপাতের রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল। সেখান থেকেই শুরু হল বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং তারপর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ইতিহাস। সেইসঙ্গে একই সময়ে পরোক্ষভাবে বিজেপিকে শক্তিশালী এবং বাম ভাবনাকে ক্ষয়িষ্ণু করতে শুরু করল মনমোহন সিংয়ের উদারনীতির প্রবর্তন। এটিকে একেবারে এড়িয়ে যাওয়াও সঠিক হবে না।

ভারতের বামপন্থী দলগুলোর নেতৃত্বে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) গত শতাব্দীর ন'য়ের দশকের প্রথম ভাগে থেকেই বিজেপির দ্রুতগতিতে উত্থানে অশনি সংকেত দেখেছিল। কিন্তু সর্বভারতীয় নেতৃত্বের দৃঢ়তার অভাব, এবং সর্বোপরি ১৯৯৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী পদের সুযোগকে প্রত্যাখ্যান করার 'ঐতিহাসিক ভুল' আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বাম রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতার প্রেক্ষিতে হারাকিরি বললে ভুল হবে না। সব মিলিয়ে ভারতবর্ষের প্রবহমান রাজনৈতিক ধারায় (জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যপন্থী এবং আধা পুঁজিবাদী রাজনীতি আর বামপন্থীদের সংসদীয় জনগণতন্ত্র) জোর ধাক্কা লাগল নব্বুইয়ের দশকে। ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত সফলভাবে চলল বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ সরকার। জাতীয় কংগ্রেস হীনবল হল। আসলে যেটা নজর এড়িয়ে গেল, কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা ছাড়া বাকি দেশে বামপন্থী রাজনীতি খুব তাড়াতাড়ি পিছিয়ে যেতে শুরু করল। প্রভাব কমতে শুরু করল নির্বাচনী ভোট শতাংশে। সেই ফাঁকা জায়গায় বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের সঙ্গে পরিচিতিসত্ত্বা এবং জাতিস্বত্ত্বার ভিত্তিতে নির্বাচনী জোট গঠনে সফল হতে শুরু করল বিজেপি।

পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা এবং ত্রিপুরায় (ছোট রাজ্য হলেও) বামপন্থী শক্তির প্রভাব নিয়ে গত সহস্রাব্দের আগে-পরে কোন সন্দেহই ছিল না। সেইকারণেই জাতপাত এবং পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতি খুব সহজে এখানে জায়গা করে নিতে পারেনি। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট বিরোধিতার জায়গায় ক্রমাগত নিজেদের দুর্বল করে ফেলেছিল কংগ্রেস। ফলে সেই সুযোগ অন্যান্য বামবিরোধী দলগুলি নেবেই। হয়ত অন্তর্দ্বন্দ্ব অনুঘটক, কিন্তু আদতে সেই কৌশলেই জাতীয় কংগ্রেসের একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে গঠন করল তৃণমূল কংগ্রেস। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল প্রতিষ্ঠার পেছনে আরএসএসের কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল কিনা তা অবশ্যই জানা নেই। তবে দুই দশকের সুদীর্ঘ শাসনের ফলে একটি প্রতিষ্ঠান বিরোধী শক্তি এ রাজ্যে সংহত হওয়ার চেষ্টা করছিল তা বলাই বাহুল্য। গণতন্ত্রে এমনটাই দস্তুর। রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ছোটখাটো বিবাদ মেনে নিয়েও একত্রিত হচ্ছিল। সেখানে সাম্প্রদায়িক ভাবনা থেকে পরিচিতি সত্ত্বার অধিকারী, জাতপাতের রাজনীতির সমর্থক থেকে অতিবাম আন্দোলনকারী - সকলেই একটি মঞ্চ গঠনের চেষ্টায় উৎসাহী। এর মধ্যে রাজ্যের তৃণমূল দল কেন্দ্রের বাজপেয়ী সরকারে যোগ দেওয়ায় পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হল। এখানে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা। বামফ্রন্ট সরকারের যে কোনো ভুল ছিল না এমনটা নয়। কিন্তু জনমানসে তাদের অধিকাংশ সদর্থক কাজকে আড়াল করে প্রতিপদে জনবিরোধী প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে চলল লম্বা দশক ধরে। এখানে দেশী-বিদেশী বহুজাতিক শিল্পপতিদের কায়েমি স্বার্থের বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে। এর সুযোগ নিল বিজেপি, যাদের প্রধান শত্রু বামপন্থীরা। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ঘোষিত সুশীল সমাজ এবং অতিবাম রাজনৈতিক শক্তি প্রত্যক্ষভাবে তৃণমূলকে সমর্থন করায় বামফ্রন্টের সুদীর্ঘ শাসনের সদর্থক পরিবর্তনকে জনমানসের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করা অনেক সহজ হল। ২০০১-এ সফল না হলেও, প্রতিষ্ঠান বিরোধীরা এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পেরেছিল ২০১১-তে। অবশ্য এর মধ্যে বামফ্রন্টের আদর্শচ্যুতির কথাও আনতে হবে, মানতে হবে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে কৌশলগত ভুল। আদর্শের গোলমালে বামেদের অনেক নেতাই তো আজকে তৃণমূল বা বিজেপির সংগঠক। আর কৌশলগত ভুল করা অনেক শীর্ষ নেতৃত্ব এখনও পদাসীন। চর্বিতচর্বণ হলেও আবার মনে করানো দরকার যে বামফ্রন্ট সরকার উৎখাতের জন্য জাতীয় কংগ্রেস এবং বিজেপি উভয়েরই যথেষ্ট মদত ছিল। এর সঙ্গে যোগ্য সংগত করেছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী) কয়েকটি দীর্ঘমেয়াদী ভ্রান্ত রণকৌশল, যা শুরু হয়েছিল ১৯৯৬-তে ঐতিহাসিক ভুল দিয়ে। হয়তো কংগ্রেস এখন দেশজুড়ে নিজেদের বিপদ দেখে অনুধাবন করতে পারছে যে শক্তিশালী বামফ্রন্ট তাদের কাছে ২০০৪ সালের নির্বাচনের পর কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

বোঝাই যাচ্ছে, আজ নতুন সহস্রাব্দের দ্বিতীয় দশকে ভারতীয় রাজনীতিতে জাতীয় কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট প্রচন্ড বিপদের সম্মুখীন। সংসদীয় রাজনীতিতে অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে বামশক্তি। স্বাধীনতা পরবর্তী যুগের শুরু থেকে প্রবহমান দুটি রাজনৈতিক শক্তিই আজ হীনবল এবং নতুন দিশার সন্ধানে আকুল। কারণ দক্ষিণপন্থী এবং সামরিক জাতীয়তাবাদী শক্তি এর মধ্যেই তার অনেক সহযোগী তৈরি করেছে, ছদ্ম প্রতিপক্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে। এ মতে বিতর্ক থাকতেই পারে, তবে বিষয়টিকে বিশ্লেষণের এই পথটিই বাম বিরোধিতা এবং সংসদীয় নির্বাচনভিত্তিক রাজনীতিতে তাদের প্রায় অস্তিত্বহীন হওয়ার সবথেকে সহজবোধ্য উপায়। এখানে একটা বিধিসম্মত সতর্কীকরণ দিয়ে রাখা জরুরি যে ভোটের রাজনীতিতে না হলেও, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের লড়াইতে কিন্তু এখনও সারা দেশে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বামপন্থীরা। তবে এই লেখার মূল অংশ ভোটের হিসেবে। সেই নিরিখে এই মুহূর্তে দক্ষিণ ভারতে এআইডিএমকে, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা, অন্ধ্রে ওয়াইএসআর কংগ্রেস, তেলেঙ্গানায় টিআরএস, বিহারে জেডিইউ, আসামে জনগোষ্ঠীভিত্তিক বিভিন্ন শক্তি, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস এরা নির্বাচনী রাজনীতিতে সফল। এই দলগুলি একাধারে বিজেপির সহযোগী শক্তি এবং ছদ্ম প্রতিপক্ষ কিনা, সেই নিয়ে বিতর্ক সহজে মেটার নয়। এই যুক্তির পক্ষে উদাহরণ দিতে গেলে অবশ্যই বলতে হবে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার কথা। এই ধরনের রাজনীতির মাধ্যমে জনসাধারণের একটা বড় অংশকে বুঝিয়ে (বাম বক্তব্যে জনগণকে বিভ্রান্ত করে) বিজেপি তার উদ্দেশ্য সফল করতে পেরেছে। স্বাভাবিক নিয়মেই, তৃণমূলের সঙ্গে বিরোধকে জারি রাখার জন্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু তুলে আনা জরুরি। যেমন বিজেপির একটি অংশের উত্তরবঙ্গে আলাদা রাজ্যের দাবি তুলে ধরা এবং তৎক্ষণাৎ তৃণমূলের প্রতিবাদ। ত্রিপুরাতে বিজেপি বিরোধী শক্তি হিসেবে উঠে আসছে তৃণমূল। তার পেছনে একটা যুক্তি অবশ্যই থাকবে যে গুলিয়ে যাওয়া বিরোধী ভোটের সন্ধানে ত্রিপুরায় পাড়ি দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল। আবার পালটা যুক্তি বলবে যাতে বামপন্থীরা নির্মূল হয় তাই তৃণমূলকে ত্রিপুরাতে যত্ন করে নেমন্তন্ন করছে বিজেপি। সুতরাং এই চরম সংকটে বামপন্থীদের কাছে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে বিজেপি উঠে আসছে। কিন্তু সেখানেই দাঁড়ি টানলে মুশকিল, কারণ বিজেপির সহযোগী ছদ্মবেশী শক্তিও ক্রমাগত বামপন্থীদের গিলে ফেলার প্রক্রিয়ায় তৎপর।

এখানে প্রশ্ন উঠবে যে কেন্দ্রে বিজেপি ও রাজ্যে তৃণমূলের শাসন ব্যবস্থার মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য আছে কি? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই দুই দলের মতাদর্শ এবং কর্মসূচির তুলনামূলক বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা তাই জরুরি। এই মুহূর্তে কেন্দ্রে এবং আমাদের রাজ্যে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে কয়েক লক্ষ পদ খালি। যদিও আপাতদৃষ্টিতে এ রাজ্যে বসে মনে হতে পারে যে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের তুলনায় তৃণমূলের জনমুখী কর্মসূচি এগিয়ে। এই জায়গাতেই হয়ত সমদূরত্বের তত্ত্ব ছেড়ে বিজেপি বিরোধিতাকে তীব্রতর করছে সিপিআই(এম)। কিন্তু তাতে কতটা রাজনৈতিক জমি ফিরে পাওয়া যাবে তা পরিষ্কার নয়। কর্মী নিয়োগ বাজারকে চাঙ্গা করে, কিন্তু পাড়ার ক্লাবকে টাকা দিলে তা সরাসরি ভোটে হস্তান্তর হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি কার্যকরী। এই সহজ সত্য যে জনগণ একেবারে বোঝেন না এমন নয়। কিন্তু সংবাদমাধ্যম, সুশীল সমাজ, প্রগতিশীল কবি-সাহিত্যিক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, অধ্যাপক-শিক্ষক এঁরা হয় সচেতনভাবে, অথবা ভাবের ঘরে চুরি করে বাম ভাবনায় তৃণমূলকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করেছেন সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে। সেই অঙ্কে সাধারণভাবে জাতীয় ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বামপন্থীদের প্রথম এবং প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপি। জনগণের সাদা চোখে বিজেপির মূল বিরোধী তৃণমূল আর বাম ভাবনায় তারা বিজেপির ছদ্ম প্রতিপক্ষ। সেই জায়গাতেই সমদূরত্ব নিয়ে এতো কচকচি। একই রসায়ন ত্রিপুরায় পৌঁছে বাম ভোটের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেললে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অনেকটা একই অঙ্কে পশ্চিমবঙ্গের সিপিআই(এম)-এর মতই উত্তরপ্রদেশে একই দশা হয়েছে কংগ্রেসের, এবং অনেক আগেই। সেখানে বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ সপা, বসপা। আর তারাও নিজেদের মধ্যে লড়াই করে বিজেপিকে যথেষ্ট স্বস্তি দিচ্ছে।

যে কোনো রাষ্ট্রের গণতন্ত্র রক্ষার চারটি স্তম্ভের মধ্যে প্রথম তিনটি স্তম্ভ অবশ্যই থাকে নির্বাচিত সরকারের দখলে। তখন শেষ আশ্রয়স্থল চতুর্থ স্তম্ভ। কিন্তু ব্যবসায়িক কারণে সেই সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষতাও অনিশ্চিত। আর আমজনতার সামনে সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে ইতিহাস গুলিয়ে দেওয়াটা সবচেয়ে সহজ। সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে মিথ্যাকে সত্যে রূপান্তরিত করে দুই মূল প্রতিপক্ষের স্বার্থে ইতিবাচক প্রচার জনগণকে প্রভাবিত (বামেরা বলবেন বিভ্রান্ত) করবেই। অর্থাৎ পুঁজির কাছে সংবাদমাধ্যমের আত্মসমর্পণ আজকের ভারতীয় বামপন্থীদের সবথেকে বড় সমস্যা। শত্রু চিহ্নিতকরণ থেকে মান নির্ধারণ সবটাই যদি প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং তার দোসর ছদ্মবেশী প্রতিপক্ষ নির্ধারণ করে দেয়, তখন লড়াইয়ের পথ হয় অনেক বেশি কঠিন। আর দ্বিধাহীনভাবে বলতেই হবে এই জায়গাটা তৈরি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন বিভিন্ন বামপন্থী নেতৃত্ব। আজ তাই নবীন এবং দক্ষ নেতানেত্রীদের সামনে আসা ছাড়া অস্তিত্ব রক্ষা প্রায় অসম্ভব। বাম সমর্থকদের কাছে এখন ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়ক-এর কথায়, "বামপন্থার ভবিষ্যৎ আছে কি নেই সেটা বড় কথা নয়। বামপন্থা ছাড়া ভারতবর্ষের যে কোনো ভবিষ্যৎ নেই এটাই সবচেয়ে বড় কথা।" বাম বিরোধী রাষ্ট্রশক্তি তাদের নিজস্ব কৌশলে মানুষকে ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চাইছে। কারণ তারা জানে ইতিহাস মানুষকে সঠিক পথে চলার দিশা দেখায়। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং দার্শনিক হাওয়ার্ড জিনের বক্তব্য, "ইতিহাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস না জানলে বিষয়টা এমন দাঁড়াবে যেন আপনি গতকাল মাত্র জন্মেছেন। ক্ষমতায় থাকা শাসক তখন যা খুশি বোঝাবে, কিন্তু তার সত্যতা যাচাই করার আর সুযোগ থাকবে না।"

দেশের প্রধানমন্ত্রী আর আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জনসমক্ষে যে কথাগুলি বলছেন, তার আশু ইতিহাসভিত্তিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বামপন্থী চিন্তাবিদদের কাছে শত্রুর সংজ্ঞায়ন এবং তুলনা একমাত্র কর্মসূচি হতে পারে না। এতে উন্নয়নের রাজনীতির জন্যে সময় কমে যায়। তাই আপাতত এই অগভীর প্রশ্নের উত্তরে বলা যেতে পারে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ একটিই, যারা বামপন্থী ভাবনায় অবিশ্বাসী। এতে দোষের কিছু নেই, কিন্তু তারা যে প্রতিপক্ষ এতে কোন ধন্দ নেই। গোদা বাম ভাষায় বললে, এই মুহূর্তে প্রতিপক্ষ চরম প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং তাদের দোসর জনমোহিনী আধা এবং অতিবাম শক্তির জোট। আবার তারাই কিনা বিভিন্ন রূপে ভাগ হয়ে প্রধান প্রতিপক্ষ খোঁজার নিদান দিচ্ছে। সেই ফাঁদে কি পা দিতেই হবে?