আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২১ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৮

প্রবন্ধ

উত্তরবঙ্গ রাজ্য গঠনের প্রস্তাব ও বাস্তবতা

সুখবিলাস বর্মা


পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ভাগ করে উত্তরবঙ্গ নতুন রাজ্য সৃষ্টির ভাবনা নিয়ে হুজুগ নতুন কিছু নয়। এই ধরণের হুজুগ নিয়ে মাঝে মাঝেই খবরের কাগজ ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমে রাজ্য সরব হয়ে ওঠে। কিছুদিন আগে এই আওয়াজ নতুন করে সারা রাজ্যে সামান্য হলেও কিছুটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিষয়টি নিয়ে তাই খানিকটা হলেও আলোচনা জরুরি হয়ে পড়েছে।

প্রথমে উত্তরবঙ্গের ভৌগোলিক অবস্থান নিয়ে কিছু কথা। কলকাতা থেকে বহু দূরে গঙ্গা/ভাগিরথীর অপর পারে মালদা থেকে শুরু এই জনপদের অবস্থান-বর্তমান মালদা, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, দার্জিলিং, কালিম্পং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কুচবিহার-এই আটটি জেলা নিয়ে গঠিত জনপদ উত্তরবঙ্গ নামে পরিচিত। উত্তরবঙ্গ আলাদা রাজ্যের ধারণায় উক্ত জনপদ নিয়ে গঠিত রাজ্যকেই বোঝায়। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কেন্দ্রস্থল কলকাতা থেকে দূরে অবস্থিত এই জনপদ নিজ বৈশিষ্ট্যে আকর্ষণীয়। পাহাড় দুয়ারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জঙ্গল বাঁশবন-বাদারের সৌন্দর্য, এলাকার নদীগুলির বিশিষ্টতা-পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসা নদীগুলির বর্ষাকালীন রুদ্রমূর্তি এবং গ্রীষ্মশেষে সেগুলিরই প্রায়-শুষ্ক অবস্থা এবং তারই ফলশ্রুতিতে নদীগুলির বিস্তৃত চর ভূমি - সব মিলিয়ে সমগ্র এলাকা অনির্বচনীয় সৌন্দর্যমণ্ডিত। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে এলাকা মনোমুগ্ধকর সবুজ বনভুমি ও জলজঙ্গল প্রকৃতির অপূর্ব সুষমায় মহিমান্বিত। বিশালকায় শালসেগুনের বন মানুষকে বার বার নতুন করে আকৃষ্ট করেছে। পাহাড় ও তরাই-দুয়ারের উঁচুনিচু জমি ও জলবায়ুর সুযোগ নিয়ে এলাকায় বিস্তার লাভ করেছে অসংখ্য চা বাগান। হাল আমলে চা বাগান কোচবিহার-জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি-উত্তর দিনাজপুরের সমতল ভূমির বিস্তৃত এলাকা দখল করেছে। যে জমি আগে ধান পাট সর্ষে বেগুন চাষে ব্যবহৃত হত আজ সেগুলির অনেক অংশই চা বাগানে পরিণত। এই বাগানগুলি থেকে চা পাতা তুলে বাইরের ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করা হয়। ফ্যাক্টরির ঝামেলামুক্ত এই বাগানগুলি নানা সমস্যা সত্ত্বেও পুরনো অনেক বাগানের তুলনায় রমরমিয়ে চলছে। এলাকার সুস্নিগ্ধ জলবায়ু, পাহাড় পর্বত, জলজঙ্গল, চা বাগানের মনোরম দৃশ্য এই সব কিছুর সমন্বয়ে এখানে গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্পের উপযুক্ত পরিকাঠামো। Home-stay তো এখন খুবই জনপ্রিয়। Tea, Timber, Tourism-তিন 'T' কে তাই উত্তরবঙ্গের, বিশেষ করে তরাই-দুয়ারের মানুষের জীবিকার অন্যতম প্রধান উৎস গণ্য করা হয়। অনেকে এর সঙ্গে আর একটি 'T' যুক্ত করেন Tobacco, কারণ ব্যাপকভাবে তামাক চাষ পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র কোচবিহার-জলপাইগুড়ি জেলাতেই হয়।

জনবিন্যাসের দিক থেকেও এই এলাকা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। অস্ট্রিক, তিব্বতি-চীন, দ্রাবিড়, ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভারতের চার ভাষা পরিবারের মানুষই বাস করেন এখানে, যদিও তিব্বতি-চীন পরিবারভুক্ত মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীর অন্তর্গত রাজবংশীরাই এখানে একক সংখ্যাধিক্য। অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নেপালি(গোর্খা), ভুটিয়া, তামাং, লেপচা, লিম্বু, মেচ, রাভা, ওঁরাও, মুণ্ডা, সাঁওতাল, মালপাহাড়ি, খরিয়া, খেরিয়া, মধেসিয়া, জুগি, পান, পলিয়া, খেন, দেশী, নস্যসেখ (ধর্মান্তরিত রাজবংশী)। এদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি। তাছাড়াও তরাই-দুয়ারের আদিবাসীদের নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে হিন্দি-রাজবংশী-নেপালি সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে সাদরি বা সাদনি ভাষা। জাতিগত ও ভাষাগত এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ উত্তরবঙ্গের তরাই-দুয়ার অঞ্চলকে তাই বলা হয় মিনি-ভারতবর্ষ।

রাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকেও উত্তরবঙ্গের ঐ একই রকম বৈচিত্র্য। প্রথমেই শুরু করা যাক পূর্বদিক অর্থাৎ কোচবিহার থেকে, যে জনপদটি ছিল প্রাচীন প্রাগজ্যোতিষপুর ও কামরূপের অংশ। পরবর্তীতে এর পূর্বভাগ আসামের এবং পশ্চিমভাগ কোচবিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। কামরূপের ছিল গর্ব করার মতো নিজস্ব ইতিহাস, নৃতত্ত্ব ও ভাষা বৈশিষ্ট্য। কামরূপের রাজা ভগদত্ত মহাভারত যুগের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরব পক্ষের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন এবং সেই যুদ্ধে তিনি হাতির যোগান দিয়েছিলেন বলে খ্যাতি রয়েছে। সপ্তম শতাব্দীতে কনৌজের হর্ষবর্ধন এবং বাংলার শশাঙ্কের সমসাময়িক কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মন আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে পশ্চিমে করতোয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় রাজত্ব করেছিলেন। ভাস্করবর্মণের রাজত্ব কালেই চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন-সাঙ্গ্ কামরূপ ভ্রমণে এসে এখানকার ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, জনগোষ্ঠী ও তাদের ভাষা সাহিত্য সম্পর্কে মুল্যবান তথ্য রেখে গেছেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে এই অঞ্চলের নাম ছিল 'কামতা' এবং রাজার উপাধি ছিল 'কামতেশ্বর'। বেশ কিছু সময়ের জন্য এই এলাকা ছিল ভূঁইয়াদের দখলে। একটি এলাকার দখলে ছিলেন হারিয়া মন্ডল। তাঁর পুত্র বিশু ওরফে বিশ্বসিংহ ভূঁইয়াদের দখলে থাকা এলাকাগুলি নিজ দখলে নিয়ে এসে একটি সমন্বিত রাজ্যের রূপ দেন ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে ১৫১০ থেকে ১৫১৫-এর মধ্যে। রাজবংশের নাম হয় কোচ-রাজবংশী। পন্ডিতদের মতে, হারিয়া মন্ডল-বিশুরা আদিতে ছিলেন কোচ। সংস্কৃতায়ন মাধ্যমে তাঁরা হন রাজবংশী। তাই তাঁদের বংশ কোচ-রাজবংশী। এই রাজবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতি ছিলেন নরনারায়ণ। তিনি তাঁর ছোট ভাই চিলা রায় ওরফে শুক্লধ্বজের সহায়তায় সম্পূর্ণ জনপদ নিজ দখলে নিয়ে এসে কোচবিহার নামে একটি শক্তিশালী রাজ্য গঠন করেন। চিলা রায় পৃথিবীর সর্বকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের অন্যতম বলে স্বীকৃত। কোচবিহার ছিল সমগ্র পূর্বভারতে সবচেয়ে বড় রাজন্যশাসিত বা সামন্ত রাজ্য, যেখানে এই বংশের রাজারা ভারত স্বাধীনতার পরেও ১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছেন, স্বাধীন ভারতের সঙ্গে রাজ্যটির সংযুক্তির আগে পর্যন্ত।

এখানে সংযুক্তি নিয়ে কিছু আলোচনা বিশেষভাবে প্রয়োজন। পরাধীন ভারতে ছিল ১৪টি ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশ এবং প্রায় ৫৭৫টি রাজন্যশাসিত ছোট বড় রাজ্য, যারা নানাধরনের সুযোগসুবিধা সহ রাজ্য শাসন করতেন। সেইসব রাজ্যকে স্বাধীন ভারতের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত করা যায়, সে সম্পর্কে রাজন্যবর্গের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণের বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল States Ministryর মন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল এবং মন্ত্রকের সচিব ভি পি মেননের উপর। এঁরা দুজন সেই দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে একটি Instrument of Accession এবং একটি Standstill Agreement তৈরি করেন। এই দুটি দলিলে সই করার ব্যাপারে প্রথমদিকে কিছু কিছু রাজা, নবাব, বাদশাহ দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও ১৫ই আগস্টের মধ্যে প্রায় সবাই সই করেছেন। দেশের বড় বড় রাজা-মহারাজা-নবাব এবং বিশেষ করে আত্মীয় রাজন্যবর্গকে সই করতে দেখার পর কোচবিহার মহারাজা সই করতে দ্বিধা করেননি। তাছাড়া তিনি নিজেও বুঝেছিলেন যে এতেই সবার মঙ্গল, যে কথা তিনি বিধান রায়কে লেখা চিঠিতে প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৯ই আগস্ট তিনি Instrument of Accession সই করেন। এর পর আইন কানুন নিয়ম বিধির সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা পূরণের পর Merger Agreement সই হয় ২৮শে আগস্ট, ১৯৪৯। পরে ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১লা জানুয়ারি ১৯৫০ থেকে কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করা হয় জেলার মর্যাদা দিয়ে।

কোচবিহার নিয়ে এই ঘটনাপ্রবাহ যত সহজভাবে লেখা হল বাস্তবে তা গ্রহণ করা কিন্ত অত সহজ ছিল না। যে জনপদের প্রজাগণ প্রাগজ্যোতিষপুর, কামরূপ এবং কোচবিহার নামের সুবিখ্যাত রাজ্যের অধিবাসী হিসেবে গৌরব বোধ করতেন তাঁরা এখন একটি জেলার মানুষ। ইতিমধ্যে ১৮৬৯ সালে কোচবিহার রাজ্যের অন্তর্গত দুয়ারের বড় অংশ নিয়ে, বৈকুন্ঠপুর এলাকা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জলপাইগুড়ি জেলা। শুধু তাই নয়, এই এলাকাগুলির সার্বিক উন্নয়নের জন্য তেমন কোনও উদ্যোগও সরকার থেকে গ্রহণ করা হয়নি। সব কিছু মিলিয়ে এই রাজ্যের দেশীয় মানুষজন, যথা রাজবংশী, খেন, যুগী, নস্যসেখ নিজেদেরকে বঞ্চিত, নিপীড়িত, অবহেলিত মনে করতে শুরু করল। সঙ্গে যুক্ত হল কলকাতা ভিত্তিক শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত এবং রাজ্য প্রশাসনের মানুষদের এই এলাকার মানুষের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, তাঁদের ভাষা সাহিত্য ইত্যাদির প্রতি তাচ্ছিল্য-পূর্ণ মনোভাব। ফল, বিস্তৃত জনপদের মানুষ, বিশেষ করে দেশীয় জনগণ নিজেদেরকে বঞ্চিত, প্রতারিত, অবিচারের শিকার মনে করে, সৃষ্টি হয় রাজ্য প্রশাসনের প্রতি চরম বিরূপ মনোভাব। এই মনোভাবের প্রকাশ ও বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৭০-এর দশকে উত্তরখন্ড আন্দোলন রূপে। আন্দোলনের প্রধান বিষয় ছিল উত্তরবঙ্গের অনুন্নয়ন ও রাজ্য যুক্তফ্রন্ট সরকারের উদাসীনতা, বিশেষ করে তিস্তা প্রোজেক্টের সুষ্ঠু রূপায়ণে ঢিলেঢালা মনোভাব। অধিকন্তু উত্তরবঙ্গের জোতদার প্রমুখ দেশীয় জমির মালিকদের পক্ষে ক্ষতিকর সরকারের ভূমি সংস্কার নীতির রূপায়ণ। সরকারের তরফ থেকে কোনও গুরুত্ব না পাওয়ায় এই আন্দোলন ক্রমে সামাজিক-অর্থনৈতিক বিষয় থেকে রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। উত্তরখন্ড দল উত্তরবঙ্গের জন্য আলাদা রাজ্য দাবি করে বিধানসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কিন্তু ফল হয় খুবই খারাপ - দলের প্রধান কর্মস্থল ময়নাগুড়ি, ধুপগুড়ি, জলপাইগুড়ি এলাকার ৫টি বিধানসভা কেন্দ্রের কোথাও ৮ শতাংশের বেশি ভোট তাঁদের ঝুলিতে আসেনি। সাধারণের সমর্থন আদায় করতে না পেরে নিরাশ কর্মীরা ধীরে ধীরে দলত্যাগ করে এবং আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।

এই আন্দোলনকে অনুসরণ করে ১৯৮০র প্রথম দিকে শুরু হয় উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন উত্তরবঙ্গ তপশীলি জাতি ও আদিবাসী সংগঠন (উতজাস) প্রধানত শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। ছাত্র-ছাত্রীদের অনুদানের টাকা ঠিক সময়ে দেওয়া, সংরক্ষণ আইন ঠিকভাবে রূপায়ণ করা, উত্তরবঙ্গে জমির ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো, দুঃস্থ অনেক জাতিকে সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা ইত্যাদি ছিল তাদের প্রধান দাবি। এই সব দাবিতে ছাত্র আন্দোলন অনেক সময়েই জঙ্গি রূপ ধারণ করে। সেসব ঠেকানোর জন্য সরকারের তরফ থেকেও পুলিশ লাঠি, কাঁদানে গ্যাস এমনকি বন্দুকের গুলি ব্যবহার করা হয়। আন্দোলনের পক্ষ থেকে ক্ষীণস্বর উঠে আসে উত্তরবঙ্গ পৃথক রাজ্যের। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই নেতৃত্বে মতবিভেদ দেখা দেয় এবং সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ে। বর্তমানে উতজাস একটি নামকেওয়াস্তে সংগঠন।

উত্তরবঙ্গের এই আঞ্চলিক রাজনীতিতে একটা বড়সড় ঝাঁকুনি লক্ষ্য করা যায় ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি। ১৯৯৫ সালে কামতাপুর রাজ্যের সরাসরি দাবি নিয়ে গঠিত হল কামতাপুর পিপলস্ পার্টি। রাজ্যের সঙ্গে কামতাপুরি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছিল প্রধান দাবিগুলির অন্যতম। শুরু হল ভাষা নিয়ে এক খেলা। ইতিহাসের নজির অনুসরণ করে আন্দোলনকে ভাষা আন্দোলনের রূপ দেওয়ার জন্য ইতিহাস ও ভাষার ইতিহাসকে অনেকটা বিকৃত করে দাবিকে জোরালো করতে মরিয়া হয়ে উঠলেন আন্দোলনের নেতৃত্ব।

তাঁদের দাবি যে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর কথ্য ভাষার নাম 'রাজবংশী' নয়, কামতাপুরি। সুতরাং এই ভাষাকে 'কামতাপুরি' নামে স্বীকৃতি দিয়ে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে আসামের গোয়ালপাড়া এলাকা, নেপালের রাজবংশী অধ্যুষিত এলাকা, বিহারের পূর্ণিয়ার কিয়দংশ এবং বাংলাদেশের রাজবংশী অধ্যুষিত রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী এলাকা জুড়ে দিয়ে, অর্থাৎ 'কামতাপুরি' যেসব এলাকার মানুষের কথ্য ভাষা  সেই সমগ্র অঞ্চল নিয়ে গঠন করতে হবে 'কামতাপুর' রাজ্য। তাদের বক্তব্য, এই জনপদ কামরূপ-কোচবিহারের গৌরবময় ইতিহাস ভাষা সংস্কৃতি ঐতিহ্যের অধিকারী যেখানে রাজ্য গঠনের সব রকম উপাদানই রয়েছে। তাদের দাবি, কামতাপুরি বাংলা থেকে পৃথক ভাষা এবং রাজবংশীরা বাঙালি নয়। এই সব অবাস্তব দাবি নিয়ে আন্দোলন করার সূত্রে কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন (কেএলও) নাম নিয়ে তাদের একটি জঙ্গিমুখ আন্দোলন শুরু করে। কেএলও-র সদস্যেরা আসামের আসু, আবসু এবং ভুটানের জঙ্গিদের কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়ে ধ্বংসাত্মক জঙ্গি আন্দোলনে সামিল হয়। রাজ্য সরকার কেপিপি-কেএলও আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করে। শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড় এবং পুলিশী অত্যাচার। উত্তরখন্ডের মতো এই দলও ধুপগুড়ি-ময়নাগুড়ি সহ কয়েকটি বিধানসভা কেন্দ্রে নির্বাচনে লড়াই করে কিন্তু ফল একই রকম অর্থাৎ ৫%-৭% ভোট। এই দল বিভিন্ন সময়ে ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা, জেএমএম, এনসিপি দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলন করার চেষ্টা করে, কিন্তু ফলের কিছু হেরফের হয় না। অবশেষে দলের জঙ্গি নেত্রী মিতালি রায় তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করে ২০১৬ সালে ধুপগুড়ি বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন। দলের প্রধান অতুল রায়ও তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে গাঁটছড়া বাঁধেন। কয়েক মাস আগে তাঁর মৃত্যুতে ইতিমধ্যেই স্তিমিত কামতাপুর আন্দোলন এখন প্রায় অস্তিত্বহীন। দলের অপর অংশের নেতা নিখিল রায়-এর নেতৃত্বে দলের সলতে টিমটিম করে জ্বলছে।

উত্তরবঙ্গের তরাই-দুয়ার-সমতল অঞ্চলে যখন উতজাস আন্দোলন বেশ কিছুটা প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে সেই সময়ে জনপদের উত্তরাংশে অবস্থিত দার্জিলিং পাহাড়ে সংঘটিত হয়েছিল সুবাস ঘিসিং-এর নেতৃত্বে গোর্খাল্যাণ্ড রাজ্যের দাবিতে গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রণ্ট-এর আন্দোলন। পাহাড়ের বৈশিষ্ট্য-ঐতিহ্য সম্পর্কে পরিষ্কার বক্তব্যের পশ্চাতে তাঁরা তুলে ধরেছেন দার্জিলিং-এর ইতিহাস ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি। দার্জিলিং-এর ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত নেপাল, ভুটান, সিকিমের ইতিহাস। ১৮১৫ সালে সম্পাদিত সুগৌলি চুক্তিতে নেপাল ৪০০০ বর্গ মাইল জমি ব্রিটিশ ভারতকে দেয়। ১৮১৭ সালে তিতল্যা চুক্তিতে সেই এলাকা চলে যায় সিকিমের রাজার হাতে। এই চুক্তির দশ বছর পরে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সিকিমের বিবাদের ফলে দার্জিলিং সহ সিকিমকে নেপাল ও ভুটানের মধ্যে ক্ষুদ্র রাজ্যে (buffer state) পরিণত করা হয়। পাহাড়ের জলবায়ু ব্রিটিশ সৈন্যের স্বাস্থ্যনিবাস তৈরির উপযুক্ত ভেবে গভর্নর জেনারেল সিকিমের কাছ থেকে ঐ এলাকা লীজ নিতে চাইলে সিকিমের রাজা বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য 'বৃহৎ রঙ্গিতের দক্ষিণ, বালাসর, কাহাইল ও ক্ষুদ্র রঙ্গিতের পূর্ব, এবং রংনো ও মহানদীর' সীমাভুক্ত সমগ্র এলাকা ব্রিটিশকে লীজ দেন ১৮৩৫ সালে।

দার্জিলিং-এর নির্মাতা বন্ধু নামে পরিচিত ডঃ ক্যাম্পবেল ১৮৪১ সালে কুমায়ুন থেকে চীনা চা-এর বীজ নিয়ে এসে দার্জিলিং-এ চাষ শুরু করে সফল হলে কালক্রমে সমগ্র এলাকায় চা বাগান গড়ে ওঠে। এভাবে চা বাগান গড়ে উঠতে দেখে সিকিমের রাজার ঈর্ষা ও হিংসা হয়। ঈর্ষাদগ্ধ রাজা সিকিমে ভ্রমণরত ডঃ ক্যাম্পবেল ও স্যার হুকারকে বন্দী করেন। তবে তাঁদের মুক্ত করার জন্য ব্রিটিশ সৈন্য রওনা হওয়ার খবর পাওয়া মাত্র বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়। ব্রিটিশরাজ কিন্তু ক্ষমা করে না; সমগ্র এলাকাটি ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে সিকিমকে আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করে।

চা বাগান এবং এলাকার জলবায়ুগত অবস্থানের সুযোগ নিয়ে দার্জিলিং উন্নয়নের পথে এগোতে থাকে। আশপাশের নানা জায়গা থেকে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মানুষের আগমনে এলাকার জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৮৫০ সালেই দার্জিলিং মিউনিসিপ্যালিটি স্থাপিত হয়। এলাকার রাজনৈতিক অবস্থান বারবার পরিবর্তিত হয় - অনিয়ন্ত্রিত, নিয়ন্ত্রিত, তপসিলভুক্ত, আংশিক সংযোজিত এলাকা ইত্যাদি নামে। স্বাধীন ভারতে এলাকার অবস্থান কি হবে সে সম্পর্কে ছিল নানা জল্পনা। স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে মুসলিম লীগের নেতৃবর্গ দার্জিলিংকে পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। স্বাধীনতার সময়ে দার্জিলিং টাউন হলে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ে। কিন্তু ১৯শে আগস্ট থেকে সেই পতাকার স্থান নেয় ভারতের তেরঙ্গা। উল্লিখিত ভৌগোলিক রাজনৈতিক অবস্থান ও তজ্জনিত ঘটনাবলী দার্জিলিং-এর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতিকে ক্রমশ জটিল করে তোলে। ইতিমধ্যে ১৯১৭ সালে গঠিত হিল্ মেন'স অ্যাসোসিয়েশন দার্জিলিঙের জন্য পৃথক প্রশাসনের দাবি জানিয়েছিল। নেপালি ওরফে গোর্খারা মাঝে মাঝেই এই ধরনের নানা সংস্থার মাধ্যমে তাঁদের অভাব অভিযোগ দাবিদাওয়া পেশ করতেন। তবে সেই সব অভাব অভিযোগ দাবিদাওয়া নিয়ে বড় কোন ঘটনা ঘটেনি।

কিন্তু সুবাস ঘিসিং-এর নেতৃত্বে গোর্খাল্যাণ্ড রাজ্যের দাবিতে গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রণ্ট (জীএনএলএফ)-এর আন্দোলন ১৯৮০-র দশকে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন সব সময়ে শান্তিপূর্ণ থাকেনি। হরতাল, বন্ধ, সামাজিক বন্ধ, লাগাতার হরতাল-বন্ধ ইত্যাদির ফলে পাহাড়ের পরিবেশ ক্রমেই অশান্ত হয়ে ওঠে। ১৯৮৬র শরতে আন্দোলনে এল নতুন মোড়। হরতাল, বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে চলল লুঠ, অগ্নি সংযোগ, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস, সরকারি অফিসে আক্রমণ ইত্যাদি। শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। পাহাড়ের জীবন প্রায় স্তব্ধ। সুবাস ঘিসিং-এর প্রতি, রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনের প্রতি পাহাড়ের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে অবস্থা প্রশাসনের প্রায় আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। সেই অবস্থায় প্রশাসনের পক্ষে নমনীয় হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

চলল বৈঠকের পর বৈঠক, দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক। অবশেষে সুবাস ঘিসিং-এর সভাপতিত্বে স্বশাসিত সংস্থা দার্জিলিং হিল কাউন্সিল গঠনের সিদ্ধান্তে হয় সমঝোতা। এই সংস্থাকে পাহাড়ের প্রশাসনের এবং উন্নয়নের অনেক দায়িত্ব দেওয়া হল। হিল কাউন্সিল পাহাড়ে বহু কাজ করল। কিন্তু ঘিসিং-এর কাজের ধরনে একনায়কতন্ত্র দেখা দিলে তাঁর নিকট সঙ্গীরা অসন্তুষ্ট হয়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা নামে নতুন দল তৈরি করে ঘিসিংকে তাড়িয়ে দিল। স্বশাসিত সংস্থার নাম পরিবর্তন করে ২০১১ সালে তৈরি হল বিমল গুরুং-এর নেতৃত্বে গোর্খাল্যাণ্ড টেরিটরিয়াল এ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জীটিএ)। কিছুদিনের মধ্যেই নেতৃত্বে শুরু হল ঝগড়া বিবাদ। নতুন নেতা হল বিনয় তামাং। পাহাড়ের মানুষের একতায় ভাঙন দেখা দিল। নেতারা এখন রাজ্যের দাবি ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড় হয়ে অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত।

কোচবিহার নিয়ে আলোচনা আগেই করেছি। ১৯৯৮ সালে কোচবিহারে শুরু গ্রেটার কুচবেহার আন্দোলন-মূল দাবি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কোচবিহার সামন্ত রাজ্যের সংযুক্তি চুক্তির প্রকৃত রূপায়ণ। প্রধানত রাজপরিবারের নিকট আত্মীয়দের দ্বারা সৃষ্ট সংস্থা গ্রেটার কুচবেহার পিপলস্ এ্যাসোসিয়েশন (জীসিপিএ) ১৯৯৮তে জেলা শাসকের কাছে এবং ২০০০ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে দাবিপত্র পেশ করে। জীসিপিএ-র প্রধান বক্তব্য যে ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় জোর করে কোচবিহারকে রাজ্যের একটি জেলায় পরিণত করেছেন। ১৯৪৯ সালের ২৮শে আগস্ট ৯টি ধারার Merger Agreement সই করে রাজ্যকে শাসন করার সমস্ত ক্ষমতা কোচবিহার মহারাজা ভারত সরকারের হাতে তুলে দিয়েছেন এই সত্য জীসিপিএ নেতৃবৃন্দ মানতে নারাজ। তাঁরা এই সত্যও মানতে চান না যে ঐ সংযুক্তি পত্রে রাজ্যের প্রজাদের সম্পর্কে কোনো কথাই ছিল না। ইতিমধ্যে সংস্থার নেতৃত্ব দখল করে কতিপয় সুযোগ সন্ধানী। অযৌক্তিক দাবি নিয়ে তাদের আন্দোলন এক সময়ে জঙ্গি রূপ ধারণ করে। শুরু হয় পুলিশী তৎপরতা। নানা ভাগে বিভক্ত সংস্থার একাংশের নেতা বংশীবদন রায় সঙ্গীদের সহ জেলে বন্দী হয়, অপরাংশের নেতা স্বঘোষিত মহারাজা অনন্ত মহারাজ আসাম পালিয়ে যায়। ২০১১ সালে রাজ্যে পরিবর্তিত তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বন্দীমুক্তি নীতিতে বংশীবদন ছাড়া পায় এবং কালক্রমে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে। কোচবিহার ও আসামের নানা সভাসমিতিতে সাধারণ রাজবংশী মানুষকে ভাঁওতা দিয়ে প্রচুর টাকা সংগ্রহ করে অনন্ত মহারাজ কোচবিহারে প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করে। আসামেও বাড়ি রয়েছে তার। এই হল গ্রেটার কুচবেহার আন্দোলনের ইতিবৃত্ত।

উপরে বর্ণিত আন্দোলনের ইতিহাস থেকে পরিষ্কার যে একমাত্র সুবাস ঘিসিং-এর জীএনএলএফ আন্দোলন ছাড়া বাকিগুলি শুধু হৈ চৈ করেছে, কাজের কাজ কিছু হয়নি। জিএনএলএফ স্বশাসিত সংস্থা আদায় করতে পেরেছে প্রধানত ঘিসিং-এর নেতৃত্বগুণে - তাঁর নিষ্ঠা, সততা ও সাংগঠনিক ক্ষমতার গুণে। অন্য আন্দোলনগুলি অযৌক্তিকতা ও নেতৃত্বের দুর্বলতায় খুব সামান্যই প্রভাব ফেলতে পেরেছে।

আসলে, একটি বিষয় আমাদের পরিষ্কার মনে রাখা প্রয়োজন যে 'উত্তরবঙ্গ রাজ্য' এই ধারণাটাই অবাস্তব। উত্তরবঙ্গের যে এলাকা নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম তার বাইরে তিনটি জেলা রয়েছে। মালদহের অর্থাৎ গৌড়ের ঐতিহ্যের কথা সবার জানা। এক সময়ের বাংলার রাজধানী, পাল বংশ, সেন বংশ, লক্ষণাবতী, এমনকি হুসেন শাহের গৌরব কম কোথায়? তাই মালদহের মানুষের ভাবাবেগ তাদের নিজস্ব সম্পদের প্রতি, গৌরবের প্রতি। একই ভাবে দুই দিনাজপুরের নিজস্ব ঐতিহ্য পৌণ্ড্রবর্ধন/বরেন্দ্রভূমি, বাণগড়। বরিন্দ এলাকার রাজবংশী, পান, পলিয়া, দেশি নির্বিশেষে সকলের আন্তরিক ভাবাবেগ তাই বরেন্দ্রভুমি-মহাস্থানগড়-গৌড়ের প্রতি যতটা, কামরূপ-কামতা-কোচবিহার, গোর্খাল্যাণ্ডের প্রতি ততটা নয়। সেজন্যই উল্লিখিত আন্দোলনগুলি নিয়ে এই তিন জেলার মানুষ নির্বিকার, তারা কোনো সমর্থন জানায়নি। তাছাড়া প্রতিটি আন্দোলন হয়েছে প্রত্যেক গোষ্ঠীর নিজস্ব বিষয়সূচি নিয়ে - একে অপরকে কেউই সাহায্য করেনি।

প্রশ্ন ওঠে - এটাই যদি হয় বাস্তব অবস্থা, তবে মাঝে মাঝেই আলাদা রাজ্যের এই ধুয়া ওঠে কেন? উত্তরবঙ্গ নিয়ে সাম্প্রতিক কালে খবরে আসা আলিপুরদুয়ারের সাংসদ জন বারলার দাবি কি তবে কোন নতুন ছক? জন বারলা বিজেপি দলের একজন গুরুত্বহীন নেতা। বানারহাটের লখিপাড়া চা বাগানের কর্মী। ২০০৯-১০ সালে অখিল ভারতীয় আদিবাসী বিকাশ পরিষদের দুয়ার-তেরাই আঞ্চলিক ইউনিটের সভাপতি জন বারলা ২০১১ সালে আদিবাসী স্বার্থ বিরোধী কাজের জন্য সংস্থার সভাপতি পদ ও প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে অপসারিত হন। এমন মহান চরিত্রের এই নেতা আজ উত্তরবঙ্গ নিয়ে কাঁদুনি গাইছেন। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে আদিবাসী এক সাংসদের এমন ব্যক্তিত্বকে কাজে লাগিয়ে বিজেপির নতুন ছক কষা, হাওয়া গরম রাখার প্রচেষ্টা। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে পর্যুদস্ত হলেও উত্তরবঙ্গের মানুষকে ধোঁকা দিয়ে, তাদের জন্য নানা প্রকল্পের ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেশ কয়েকটি আসন দল দখল করেছে। সুতরাং হাওয়া গরম রাখতে হবে। এই দল বেশ ছক কেটেই এগোচ্ছে বলে মনে হয়। ইতিমধ্যে কামতাপুরি সমর্থকের কিছু মানুষ বিজেপিতে যোগদান করে আসাম থেকে কলকাঠি নাড়ছে। কেএলও নেতা জীবন সিংহ সম্প্রতি সিডি প্রকাশ করে যে ধরনের বক্তব্য রেখেছে তাতে বিজেপির নতুন ছক অনেকটাই পরিষ্কার। বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে নির্বাচনী কর্মসূচির ফাঁকে আসামের কোন একস্থানে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে থাকা গ্রেটার কুচবেহার আন্দোলনের নেতা অনন্ত মহারাজের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহের সাক্ষাৎকার কোন শুভ কাজের ইঙ্গিত দেয়? সুতরাং, সাধু সাবধান।

সব কিছুর মধ্যে এটা তো সত্যি যে উত্তরবঙ্গের সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যে রয়েছে নানা দুঃখ যন্ত্রণার অনুভূতি। এই অনুভূতি বিশেষ করে তপশীলি ও আদিবাসীদের মধ্যে। রাজ্যের কোনও সরকারই এদের সর্বাত্মক উন্নয়নের জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বর্তমান সরকারও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য কয়েকটি উন্নয়ন বোর্ড তৈরি করে বছরে কিছু পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছে। ক'জনের কতো এলাকার উন্নয়ন হয়েছে এই সব বোর্ডের কাজে? সরকারের নীতি পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা খতিয়ে দেখা দরকার। বিভিন্ন রাজ্যের তপশীলি ও আদিবাসী বিভাগের বাৎসরিক বাজেট বরাদ্দ ও খরচের সঙ্গে এই রাজ্যের বরাদ্দ ও খরচের তুলনা করলেই পরিষ্কার বোঝা যাবে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে এবং কি আমাদের করনীয়। রাজ্য সরকার কি সে পথে হাঁটবে?