আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২১ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৮

সমসাময়িক

দেশভাগের বিভীষিকা


ভারতের ৭৫-তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে দেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে ১৪ আগস্ট 'দেশভাগ বিভীষিকা দিবস' পালন করা হবে, দেশের মানুষকে সেই ভয়াবহ দিনগুলিতে যারা সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন তাদের স্মরণ করতে বলা হয়েছে। নিঃসন্দেহে দেশভাগ ভারতের ইতিহাসের এমন একটি অধ্যায় যার ব্যথা-বেদনা-ঘৃণা-দাঙ্গা মানুষের মনে প্রোথিত হয়ে আছে, যাকে কেন্দ্র করে আজও আবর্তিত হয় ভারত তথা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনীতি। কিন্তু পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের দিন দেশভাগ বিভীষিকার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী যে আসলে নিজের রাজনৈতিক চাল চালছেন সেই কথা বোঝা দরকার।

আবেগ মথিত গলায় দেশভাগ নিয়ে যারা বক্তৃতা করছেন, তাঁরা বোধহয় ভুলে গেছেন যে ভারত ভাগ হয়নি। ভাগ হয়েছিল পাঞ্জাব ও বঙ্গ। যেই দুটি প্রদেশ ব্রিটিশ সরকারের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল, যাওয়ার আগে সেই দুই প্রদেশের বুকের উপর শানিত ছুরি দিয়ে বিভাজন করে দিয়ে যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। নিশ্চিতভাবেই কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনীতি তথা হিন্দু মহাসভার উগ্র সাম্প্রদায়িকতা সেই সময়ের বাতাবরণকে বিষাক্ত করে তোলে। তবু, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শেষ ব্রহ্মাস্ত্র ছিল বঙ্গ ও পাঞ্জাবকে ভাগ করার নীতি। তাই দেশভাগ নিয়ে যখন প্রধানমন্ত্রী আবেগমথিত বক্তব্য রাখছেন তখন কিছু তেতো সত্য আমাদের স্মরণ করা আবশ্যিক।

প্রথম, পাকিস্তানের দাবি মুসলিম লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে ১৯৪০ সালে। কিন্তু মুসলিম লীগ প্রদত্ত দ্বিজাতি তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার প্রায় কুড়ি বছর আগেই হিন্দুত্ব রাজনীতির জনক সাভারকার পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন যে, হিন্দু ও মুসলমান দুটি আলাদা জাতি যারা একসঙ্গে থাকতে পারে না। পরবর্তীকালে, ১৯৪৩ সালে ‘মহান’ সাভারকার বলেন যে, জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের সঙ্গে তার কোনো বিবাদ নেই। তিনি মনে করেন যে হিন্দু ও মুসলমান আলাদা ‘নেশন’। এই সূত্র ধরেই বঙ্গে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী লাগাতার প্রচার করতে থাকেন বঙ্গ ভাগ করার জন্য। শরৎ বসু এবং ফজলুল হকের প্রস্তাবিত ঐক্যবদ্ধ বঙ্গ দেশের প্রস্তাব এই হিন্দুত্ববাদীদের তরফে কোনো কল্কে পায়নি। হিন্দুত্ব রাজনীতি ও মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ফলেই দেশভাগ হয়। পাঞ্জাবের এপারে ওপারে, বাংলার এপারে ওপারে অসংখ্য পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গা বিধ্বস্ত মানুষের পাশে, উদ্বাস্তু মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য শ্যামাপ্রসাদ এবং তাঁর হিন্দুত্ববাদী সাঙ্গপাঙ্গদের টিকির দেখাও পাওয়া যায়নি। উদ্বাস্তু মানুষের পাশে দাঁড়ায় বামপন্থীরা যারা দুই ধরনের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে গেছে স্বাধীনতার আগে থেকেই। অতএব, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি দেশভাগের বিভীষিকার কথা স্মরণ করতে চান তবে নিজের আদর্শ মহান নেতা সাভারকারের দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে মুখ খুলুন। কিন্তু তা তিনি করতে পারবেন না কারণ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রচারক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একই ভাবধারায় দীক্ষিত।

ইতিহাসের পাতা ছেড়ে আসা যাক বর্তমানের মাটিতে। বিজেপি তথা মোদী সরকার আসলে দেশের মধ্যে আবার দেশভাগের রাজনীতিকেই নিয়ে এসেছেন। অসমে এনআরসি করে সেখানকার মুসলমানদের তাড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল আরএসএস-বিজেপি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়া ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু। যেই উদ্বাস্তুদের জন্য মোদী চোখের জল ফেলেন, বা যেই দেশভাগের যন্ত্রণার কথা তিনি সবাইকে স্মরণ করতে বলছেন, স্বাধীন ভারতে আসলে মানুষকে ভাগ করে কয়েক লক্ষ মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার রাজনীতি করছে মোদী তথা বিজেপি।

আবার উদ্বাস্তুদের ভোটের দিকে তাকিয়ে ২০১৯ সালে পাশ হল নতুন নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)। ভারতে যারা পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে এসে বহু বছর ধরে থাকছেন তাদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলছে না। কিন্তু নাগরিকত্ব পাওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে ধর্মকে তুলে এনে আসলে মোদী তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির তাসই খেলেছেন। সিএএ আইনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আগত মানুষ যারা হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, পার্সি ইত্যাদি ধর্মালম্বী তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে এই শর্তে যে তারা এই দেশগুলি থেকে ধার্মিক কারণে বিতাড়িত হয়েছেন। এই আইনে সুচারুভাবে ধর্মকে নাগরিকত্বের পূর্বশর্ত করা হয় এবং পরিষ্কারভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই আইন। আসল উদ্দেশ্য ছিল এনআরসি থেকে বাদ যাওয়া হিন্দুদের নাগরিকত্ব এই আইনের মাধ্যমে প্রদান করা। কিন্তু দেশজুড়ে প্রবল আন্দোলন শুরু হয় ধর্মনিরপেক্ষ দেশে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার বিরুদ্ধে।

অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের, বিশেষ করে মতুয়া সমাজকে বোঝানো হয় যে নিঃশর্ত নাগরিকত্ব তাদের দেওয়া হবে। কিন্তু আইনে কোনো নিঃশর্ত নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়নি। আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে আপনি ধার্মিক কারণে পড়শি দেশ থেকে বিতাড়িত। মোদী ও বিজেপি সরাসরি মতুয়া সমাজ এবং উদ্বাস্তু সমাজকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আইনের বিধি প্রকাশিত হলেই তাদের মিথ্যা ধরা পড়ে যাবে। তাই ২ বছর অতিক্রান্ত হলেও সিএএ আইনের বিধি তৈরি হয়নি। কবে হবে কেউ জানেও না।

অন্যদিকে, জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য যারা স্বাধীনতার সময় ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের অংশ হিসেবে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, সেই রাজ্যের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে একবিংশ শতাব্দীতে এক ভয়ানক বিভাজনের রাজনীতি চালায় মোদী সরকার। জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে ভেঙে তিন টুকরো করা হয় - কাশ্মীর, লাদাখ ও জম্মু - এই বিশাল ও ঐতিহ্যশালী রাজ্যের মর্যাদাও কেড়ে নেওয়া হয়। দিনের আলোয়, সংসদে দাঁড়িয়ে যারা একটি গোটা রাজ্যকে ভাগ করল, তাদের রাজ্য হওয়ার মর্যাদাটুকুও কেড়ে নিল, গোটা রাজ্যকে খোলা কারাগারে পর্যবসিত করল, অমানুষিক নিপীড়ন চালালো নিজের দেশবাসীর উপর তারা এখন নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে দেশভাগের যন্ত্রণাকে জাগিয়ে তুলতে চায়। আমাদের রাজ্যেও পুনরায় রাজ্যভাগ করার দাবি তুলছে বিজেপি সাংসদরা। আসলে এনআরসি-সিএএ, রাম মন্দির, জম্মু-কাশ্মীর ভাগ ইত্যাদি সমস্ত নীতির একটিই লক্ষ্য - মানুষের মধ্যে বিভাজন করে নির্বাচনী জয় হাসিল করা। দেশের মধ্যে দৈনিক মানুষকে ভাগ করে চলেছে মোদী।

১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টের মধ্যরাতে স্বাধীন ভারতের যাত্রা শুরু হয়েছিল এই প্রত্যয় নিয়ে যে মানুষের সাংবিধানিক সমানাধিকার থাকবে। মহাত্মা গান্ধীর হত্যা, ভয়াবহ সাম্প্রদায়িকতার পরিণতি দেখে ভারতবাসী যেন মনে মনে শপথ নিয়েছিল যে এই বিষাক্ত রাজনীতিকে দেশের মাটিতে আর কখনও জায়গা দেওয়া হবে না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে সেই সাম্প্রদায়িক দল যারা দেশভাগের প্রধান কাণ্ডারী, তারাই আজ দেশের মসনদে আসীন। দেশভাগের বিভীষিকাকে স্মরণ করে আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যকে সম্মান জানাতে আমাদের এখন প্রধান কাজ হওয়া উচিত মোদী সরকারকে দিল্লির মসনদ থেকে উৎখাত করা।