আরেক রকম ● নবম বর্ষ ষষ্ঠদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২১ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

সংসদীয় একনায়কতন্ত্র?


গণতন্ত্র মানে বিতর্কের পরিসর। চুয়াত্তর বছর আগে ভারতবর্ষ যখন স্বাধীনতা অর্জন করল, তখন রাষ্ট্রনায়কদের চিন্তায় এই পরিসরের প্রাধান্য ছিল, যাতে বহুমতের বিকাশ ঘটে, দ্বন্দ্ব ও সহাবস্থানের সংরাগে জীবন্ত হয়ে ওঠে আমাদের গণতন্ত্রের কাঠামো। সংসদীয় ব্যবস্থা ছিল এই বিতর্ক পরিসরের উচ্চতম স্থান, এবং যে কোনও বিল পাশ করাবার আগে সরকার ও বিরোধীদের তীব্রতম বাদানুবাদ বহু স্মরণীয় মুহূর্তের জন্ম দিয়েছে। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ফিরোজ গান্ধী থেকে শুরু করে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, কপিল সিব্বাল - বহু বিদগ্ধ পার্লামেন্টারিয়ান তাঁদের শাণিত যুক্তি, তথ্য ও মেধা দিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, যা ঋদ্ধ করেছে আমাদের গণতন্ত্রকে। আর বিজেপি এসে প্রথমেই এই গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে আক্রমণ করেছে। তারা চায় বিতর্কহীন থমথমে এক অন্ধকার একনায়কতন্ত্র, যেখানে প্রশ্ন করা নিষেধ। আর তাই সাম্প্রতিক বিল পাশ করাবার জন্য যেরকম ন্যক্কারজনক পদ্ধতির আশ্রয় তারা নিয়েছে, সেটার কারণটাও বিজেপির ফ্যাসিবাদী চরিত্রের মধ্যেই নিহিত আছে।

বাদল অধিবেশনে ঐক্যবদ্ধ বিরোধীদের বিক্ষোভের জেরে কার্যত স্তব্ধ ছিল সংসদের কর্মকাণ্ড। বারবার মুলতুবি হয়েছে অধিবেশন। প্রথম তিন সপ্তাহে কার্যত সেভাবে কাজই হয়নি। অথচ, এর মধ্যেই সংসদের দুই কক্ষ মিলিয়ে ২৭টি বিল পাশ করিয়ে নিয়েছে সরকার। যা চমকপ্রদ। বিরোধীদের অনুপস্থিতিতে কোনও আলোচনা ছাড়াই একপেশেভাবে স্রেফ ১০ মিনিটে একটি করে বিল পাশ করিয়ে নিচ্ছে কেন্দ্রের মোদি সরকার। লোকসভায় মাত্র ৭ দিন অধিবেশনের কাজ হওয়া সত্ত্বেও পাশ হয়েছে ১৫টি বিল। রাজ্যসভায় মাত্র ৮ দিন কাজ হওয়া সত্ত্বেও পাশ হয়েছে ১২টি বিল। হিসেবমতো, প্রতি সাত মিনিটে অথচ পেগাসাস-কাণ্ড নিয়ে সংসদের বাদল অধিবেশনের শুরু থেকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বিবৃতি বিরোধীরা দাবি করে এলেও মোদী-শাহের কেউই এক মিনিটের বিবৃতিও দেননি৷ এমনকী সংসদেও গরহাজির থেকেছেন৷ দেশের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা ছিল৷ পেগাসাস ও এনএসও ফোনে আড়ি পাতার ব্যবস্থা করেছে৷ বিচারপতি, সাংবাদিক, নেতাদের ফোনে আড়িপাতা হয়েছে৷ তা নিয়ে আলোচনা করতে দেয়নি সরকার। কৃষি আইন নিয়েও সংসদে আলোচনা চেয়েছিল বিরোধীরা, বিরোধীদের সেই দাবিকেও মান্যতা দেয়নি কেন্দ্র৷

ফলস্বরূপ অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে, যা সংসদের সম্মানকে মিশিয়ে দিয়েছে ধুলোয়। সংসদের নিরাপত্তাকর্মী বা মার্শালরা রাজ্যসভা চেয়ারম্যানের আসন, সেক্রেটারি জেনারেলের চেয়ার ও রাজ্যসভার কর্মীদের টেবিল ঘিরে রেখেছেন। একেবারে দুর্গের প্রাচীরের মতো। পুরুষ ও মহিলা মার্শালদের সেই মানব-প্রাচীর ভেদ করে কোনও বিরোধী সাংসদ এগোতে পারছেন না। মার্শালদের সঙ্গে রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি চলছে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদদের। এমনকি মহিলাদের ওপরেও হামলা চালাচ্ছেন মার্শালরা। বিরোধীরা বিল, অন্যান্য কাগজপত্র ছিঁড়ে ওড়াচ্ছেন। মোদী সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠছে। বিরোধীরা অভিযোগ তুলছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মোদী সরকার গণতন্ত্রকে খুন করছে। রাজ্যসভায় মার্শাল নামিয়ে এভাবেই মোদী সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণের বিল পাশ করাল। ১১ আগস্ট সন্ধ্যায় সংসদে বিল পাশের কিছুক্ষণ আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বণিকসভা সিআইআইয়ের বার্ষিক সভায় বলেছেন যে স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রেও বেসরকারি সংস্থাকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমানো হচ্ছে, আর এই সব কঠিন সিদ্ধান্ত সম্ভব হচ্ছে, কারণ দেশ শিল্পমহলের উপরে ভরসা করে। মুসোলিনি বলেছিলেন, যে মুহূর্ত থেকে রাষ্ট্র আর কর্পোরেটকে আলাদা করা যায় না সেই মুহূর্ত থেকেই ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়। বিজেপির ফ্যাসিবাদ নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা ছিল না কিন্তু বিজেপি-ই যে কবে রাষ্ট্র হয়ে উঠল, তার খবর আমরা রাখিনি। ফলে সার্বিকভাবেই আমাদের দেশ এগিয়ে চলেছে ফ্যাসিবাদের দিকে।

প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে বিমা ক্ষেত্রেও আন্দোলন চলছে। বিল প্রত্যাহারের পাশাপাশি বিরোধীদের দাবি ছিল, এই বিল আলোচনার জন্য সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হোক। ডিএমকে সাংসদ তিরুচি শিবা সেই প্রস্তাব আনলেও তা খারিজ হয়ে যায়। ওয়াইএসআর কংগ্রেস, বিজু জনতা দল সাধারণত মোদী সরকারের পাশে থাকে। তারাও বিমা বিল সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি তুলেছিলেন। সরকার তাঁদের কথাতেও কান দেয়নি। এমনকি, সরকারের দিক থেকে বিরোধীদের কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। তাই সংসদের সম্পত্তি-রাজ্যসভার সিসিটিভি ফুটেজ, অভ্যন্তরীণ নথি ফাঁস করা হচ্ছে। সংসদের নিরাপত্তা কর্মীদের দিয়ে মিথ্যে অভিযোগপত্র লেখানো হচ্ছে। রাজ্যসভায় বহিরাগতদের মার্শাল হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। তারাই মহিলাদের উপর হামলা চালিয়েছে। এ যেন সংসদ নয়, এক মাফিয়া দলের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই চলছে।

মনে রাখতে হবে, গত বছরেও ঠিক একই কাজ করেছেন মোদী। বিরোধীদের প্রস্তাবিত বিল-বিষয়ক প্রশ্ন করবার জন্য যে সময় নির্ধারিত, তা সোজা বাতিল করে দিয়েছেন । ২০১৯ সালেও বিরোধীরা প্রশ্ন তুললে নরেন্দ্র মোদী সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে অন্য কথা বলতেন এবং দিনের কাজ গুটিয়ে ফেলতেন। অর্থাৎ, তাঁর নীরবতা, সংসদে অনুপস্থিতি ও নির্বিকারতা কোনও ব্যতিক্রম নয়, বরং তাঁর স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গীভাবে। সংসদে কতগুলো আইন তৈরি হল তা গুরূত্বপূর্ণ নয়, কেমনভাবে তৈরি হল, সেটাই বলে দেয় সরকারের চরিত্র কী।

সংসদীয় গণতন্ত্র আজ বিপন্ন, এটাই মোদ্দা কথা। এ নিয়ে বেশি তত্ত্ব কপচিয়ে লাভ নেই, কারণ অবহিত সকলেই দেখতে পাচ্ছেন বিজেপি কী করে চলেছে। এবং নিজেদের উদ্দেশ্য ঢেকে রাখতেও তারা খুব আগ্রহই নয়, কারণ সঙ্গে আছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ঔদ্ধত্য। এই পাহাড়প্রমাণ ‘অ্যারোগান্স’-কে ধাক্কা দিয়ে গুঁড়িয়ে দেবার জন্য দরকার বিরোধীদের ঐক্য, সংসদের ভেতরে ও বাইরে। বিজেপি যে দিকে দেশকে ঠেলছে, সেখানে একটাই উপায় পড়ে থাকে, কর্মসূচী নির্ভর দৃঢ় বিরোধী ঐক্য। কারণ প্রশ্নটা আজ শুধুমাত্র ডান বনাম বাম, পুঁজি বনাম সমাজ ইত্যাদির লড়াই নয়। গণতন্ত্র আদৌ থাকবে কী না, প্রশ্ন আজ সেখানে।