আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২১ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

করোনাকাল এবং ম্যালথাসের ভূত

গৌতম সরকার


সূচনাঃ

অষ্টাদশ শতাব্দীর একেবারে শেষে, ১৭৯৮ সালে, ম্যালথাস নামে এক ব্রিটিশ পাদ্রী 'অ্যান এসে অন দ্য প্রিন্সিপল অব পপুলেশন' নামক বইয়ে জনসংখ্যা তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, জনসংখ্যা যেখানে জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায় সেখানে খাদ্যশস্য বাড়ে গাণিতিক হারে। এই অবস্থা চলতে থাকলে তার অবশ্যম্ভাবী ফল হবে দূর্ভিক্ষ। অর্থাৎ প্রকৃতি তার নিজের মতো করে মানুষ এবং খাদ্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করবে। তাঁর মতে, "An ever-increasing population would continually strain society's ability to provide for itself. As a result, mankind was doomed to forever live in poverty." একটু অতীত ঘাঁটলে ম্যালথাস তত্ত্বের প্রতিপাদ্যটি প্রত্যয় হয়। আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রা ছিল দারিদ্র ক্লিষ্ট। কারিগরী কৌশলের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও যেটুকু জাতীয় উৎপাদন বাড়ত, সেই বৃদ্ধি মাথাপিছু উৎপাদন বৃদ্ধিতে পর্যবসিত না হওয়ার মূল কারণ ছিল জনসংখ্যা বৃদ্ধি। তাই ম্যালথাসের মত হল, খাদ্যাভাব এবং দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হল জন্ম নিয়ন্ত্রণ। আর জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে খাদ্যের অভাবে একসময় প্রচুর মানুষ মারা যাবে। নিজের দেশের মানুষদের জীবনযাপনের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, "It has appeared that from the inevitable laws of our nature, some human beings must suffer from want. These are the unhappy persons who, in the great lottery of life, have drawn a blank."

ম্যালথুসীয় ফাঁদ এবং ফাঁদ থেকে বেরোনোর উপায়ঃ

ম্যালথাসের মতে যে সমস্ত দেশ নিজেদের জনসংখ্যাকে কাম্য স্তরে রাখতে অপারগ হবে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তো হবেই না, উপরন্তু জীবনযাপনে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের অভাব, মহামারী, দুর্ভিক্ষনিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠবে। অর্থনীতির এই অবস্থাকে বলা হয় 'ম্যালথুসীয় ফাঁদ'। তিনি বিশ্বাস করতেন মানবজাতি উদাসীন হলে প্রকৃতি তার নিজের মতো করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার এই পদ্ধতিগুলিকে বলা হয়, চেক্স (checks)। এই চেক্স হল দুই প্রকারের- প্রিভেন্টিভ চেক্স (preventive checks) এবং পসিটিভ চেক্স (positive checks)। পসিটিভ চেক্স খুব বেদনাদায়ক, সেগুলো আসে 'ম্যালথুসীয়ান বিপর্যয়'-এর মধ্যে দিয়ে- যেমন, অপুষ্টিতজনিত মৃত্যু, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, খাদ্যাভাব, এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়। জনসংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেলে প্রকৃতি পসিটিভ চেকসের মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষা করবে। পসিটিভ চেকসের ক্রোধানল থেকে রক্ষা পেতে গেলে মানুষকে প্রিভেন্টিভ চেকসের রূপায়ণ ঘটাতেই হবে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অল্পবয়সে বিবাহ করা বন্ধ করতে হবে, জন্মনিয়ন্ত্রণের বিধিগুলি সুচারুভাবে পালন করতে হবে ইত্যাদি। তাই একমাত্র প্রিভেন্টিভ চেকসই পারবে পসিটিভ চেকসের যন্ত্রনা থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করতে।

ম্যালথাসের ভুলঃ

অর্থনীতির ছাত্র এবং শিক্ষক হিসেবে জীবনে বহুবার বহুজনের মুখে ম্যালথাসের তত্ত্বটিকে মজার খোরাক হতে দেখেছি। মত হল, চূড়ান্ত অপরিনামদর্শিতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল এই তত্ত্ব। এই তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য থমাস রবার্ট ম্যালথাসের দূরদর্শীহীনতার প্রচার ঘটায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যিই তো ওনার মৃত্যুর দুশো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর যদি বিশ্ব অর্থনীতির দিকে চোখ ফেরানো যায়, দেখা যাবে জনসংখ্যা ৮০০ মিলিয়ন থেকে বেড়ে প্রায় ৮ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে কিন্তু মাথাপিছু আয়ের সাথে সাথে জীবনযাত্রার মান অনেক গুণ বেড়ে গেছে। ম্যালথাস কল্পিত ফাঁদের কবলে এখন কোনো মানবসমাজ নেই বললে চলে। হ্যাঁ, এখনও খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ হয় বটে, তবে সেগুলো প্রায় সবটাই আয়ের অসম বন্টন কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ঘটে থাকে, খাদ্যশস্যের অপ্রতুলতার জন্য নয়। তাহলে ম্যালথাসের এত বড় ভুলটা হল কোথায়? উত্তরটা হলো- বিগত দুই শতক ধরে মানুষের জ্ঞান ও শিক্ষা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে একটার পর একটা বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে। যার ‘পসিটিভ এক্সটারনালিটি’ অতিরিক্ত জনসংখ্যার প্রাচীর টপকে মানুষের জীবনযাত্রার মান ম্যালথাসযুগীয় জীবনযাত্রার মানের তুলনায় বেশ কয়েকগুণ বর্ধিত করতে সক্ষম হয়েছে। ম্যালথাস স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি, উচ্চ ফলনশীল বীজ, উর্বরতা বৃদ্ধিকারী রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধ, নতুন নতুন কৃষি যন্ত্রপাতি, বিভিন্ন ধরনের ফসল, বহুফসলি জমি এবং আরও অনেক উপাদান এক খণ্ড জমি থেকে বহু মানুষের খাদ্য আহরণ করতে সক্ষম হবে এবং জমির উৎপাদনশীলতা বেশ কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় কৃষিতে আগের তুলনায় অনেক কম মানুষের যোগদান লাগবে।

করোনা কবলিত জীবন প্রশ্ন করে আমরা কি সত্যি সত্যিই ম্যালথুসিয়ান অভিশাপকে ডেকে আনছি?

আধুনিক জীবনের মোটো (motto) হল, 'গিভ মি মোর।' উন্নত বিজ্ঞান আর নব নব প্রযুক্তি আমাদের হাতে নিত্যনতুন বিনোদনবর্ধক জিনিসপত্র তুলে দিতে দিতে আমাদের চাহিদাকে লাগামছাড়া করে দিয়েছে, আমাদের লোভকে বাড়িয়ে দিয়েছে সহস্রগুন। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন সমগ্র মানবজাতিকে কাণ্ডজ্ঞানহীন করে তুলেছে। আমরা নির্বিচারে বনজঙ্গল কেটে বাড়িঘর-রাস্তা-জমি বানিয়েছি। কলকারখানা থেকে বিষাক্ত দূষিত ধোঁয়া বের করে বাতাস দূষিত করেছি, রাসায়নিক বর্জ্য জলাশয় দূষিত করেছে। যানবাহনের ধোঁয়া, ধুলো আকাশ-বাতাস কলুষিত করেছে, ঠান্ডা মেশিন নির্গত ক্লোরো-ফ্লুরো-কার্বন গ্যাস বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর খইয়ে দিয়ে পৃথ্বী বুকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি আসার পথ সুগম করে তুলছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা শেষ কয়েক দশকে ভয়ংকর ভাবে বেড়ে গেছে। 'গ্লোবাল ওয়ার্মিং' মাত্রা ছাড়া হয়ে যাওয়ায় সমুদ্রকে এখন এতটাই তাপ শোষণ করতে হচ্ছে ( সামগ্রিক উষ্ণায়নের ৯৩ শতাংশ) যেটা অতীতে অকল্পনীয় ছিল। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রের জলতল এক থেকে দুমিটার বৃদ্ধি পাবে। সমগ্র বিশ্বের প্রায় কুড়ি শতাংশ মানুষ সমুদ্রতীর থেকে তিরিশ কিলোমিটারের মধ্যে বাস করেন। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ এই জলবৃদ্ধির কারণে বাস্তুচ্যুত হবে। আমরা এই সবকিছু অবগত আছি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে পরিবেশ বাঁচানোর নামে বহু ওয়ার্কশপ, সেমিনার, মিটিং হচ্ছে। দেশে দেশে বহু কমিটি তৈরি হচ্ছে, একাধিক চুক্তিপত্রে সই হচ্ছে, তার পরেও আমরা যথেচ্ছভাবে পরিবেশ, পরিবেশের সম্পদ ধ্বংস করে চলেছি।

মানুষের এই যথেচ্ছারিতার প্রথমভাগ থেকে প্রকৃতি বিভিন্নভাবে আমাদের সতর্ক করার চেষ্টা করে গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উত্থানে প্রমত্ত মানুষ সে সব সতর্কতা গ্রাহ্য করেনি। উন্নত দেশগুলোতে জনবৃদ্ধির হার 'রিপ্লেসমেন্ট রেট'-এর (পরিবার পিছু ২.১ টি সন্তান) নিচে অবস্থান করলেও সমগ্র বিশ্বের গড় বৃদ্ধি এই রেটের অনেকটাই ওপরে। অন্যতম গরিব প্রদেশ সাব-সাহারান আফ্রিকাতে এখনও নারী প্রতি ৫.১ জন শিশুর জন্ম হয়। ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ডিভিশনের মতে, এই হারে বাড়তে থাকল এই শতকের মধ্যভাগে জনসংখ্যা বেড়ে হবে প্রায় ৯.২ বিলিয়ন। আজকে গোটা দুনিয়া জুড়ে চলতে থাকা করোনা প্যান্ডেমিকে আমরা থমকে গেছি। কিন্তু এর আগে বহুবার মহামারী, অতিমারীর রূপ ধরে প্রকৃতির সতর্কবার্তা কি আমাদের কাছে আসেনি? এসেছে, কিন্তু আমরা কানে তুলিনি। থোড়াই কেয়ার ভাব দেখিয়ে আরও বেশি করে ভোগসাগরে ডুব দিয়েছি। ম্যালথাস তত্ত্ব বার বার প্লেগ, স্মলপক্স, ফ্লু ইত্যাদি মহামারীর মধ্যে দিয়ে নিজ বিশ্বাস প্রতিপাদ্য করার চেষ্টা করে গেছে,কিন্তু যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সমস্ত রোগ মুষ্টিমেয় কিছু অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তাই হারিয়ে যাওয়া ভুলতে থাকা ম্যালথাসকে স্মরণ করার কোনো চেষ্টা আমরা করিনি। 'ব্ল্যাক ডেথ'-এর কথা আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। ইউরোপব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই রোগ মাত্র দুবছরে সমগ্র ইউরোপের জনসংখ্যা ২-৩ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছিল। তারপর ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া একটার পর একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ! এসবকিছুই তো ম্যালথাসের ভাষায় 'পসিটিভ চেকস'। মানব সভ্যতা প্রতিরোধমূলক নিয়ন্ত্রণ (preventive checks) গ্রহণ করতে পারেনি বা সচেতন ভাবে চেষ্টা করেনি তাইতো গত দুই শতাব্দী ধরে প্রকৃতিকে একের পর এক যুদ্ধ, মহামারী, দুর্ভিক্ষের মতো ঘটনাগুলি ঘটাতে হয়েছে। আর যেহেতু এই সমস্ত পসিটিভ চেকসের ব্যাপ্তি একটা সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তাই আমরা সেটাকে পসিটিভ চেকস বলে গন্যই করিনি। আমরা আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপর একশো শতাংশের বেশি ভরসা রেখেছি, বিশ্বাস করেছি যা কিছু বিপদই আসুকনা কেন, আমাদের উন্নত বিজ্ঞান তুড়ি মেরে তার সমাধান সূত্র বের করে দেবে। আরে বাবা! আমরা মহাকাশে মানুষ পাঠাচ্ছি, মঙ্গল, শুক্রে স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছি, প্রতিদিন উন্নত থেকে উন্নততর যুদ্ধাস্ত্র বানাচ্ছি, ঘরে বসে সুইচ টিপে একটা দেশকে ধ্বংস করে দেওয়ার মারণ যন্ত্র আমাদের হাতে, আর কোথাকার কোন এক পাদ্রী দুশো কুড়িবছর আগে কি এক মন্ত্র আওরে গেছে, ("জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে আর খাদ্যশস্যের বৃদ্ধি ঘরে গাণিতিক হারে। এভাবে চলতে থাকলে খাদ্যের অভাব প্রাকৃতিক নিয়মে জনবৃদ্ধির হারকে কমিয়ে দেবে।"), সেই তত্ত্বকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকতে হবে! ম্যালথাসকে সমর্থন করে 'ওয়ার্ল্ড ওয়াচ ইনস্টিটিউট'-এর ১৯৯৫ সালের রিপোর্টে লেস্টার ব্রাউন জানিয়েছেন, "Scores of countries with rapid population growth- among them Iran, Egypt, Ethiopia, Nigeria, and Mexico - will find themselves facing huge food deficits in the years ahead." পল এহরলিখ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা,১৯৬৮ সালে ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন ১৯৭০ সালে এক ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হবে মানবজাতি। তার সেই ভবিষ্যৎ বাণী সেই সময়ের জন্য মেলেনি। গত দেড় বছর ধরে একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের ভয়ে কাঁপতে থাকা বিশ্ববাসী ভয় পাচ্ছে এহরলিখ কি সময়টা গুলিয়ে ফেলেছিলেন। ভাবের ঘরে চুরি করার সময় আর নেই। স্বীকার করতেই হবে 'কোভিড-১৯ অতিমারী' আমাদের জন্য ফাইনাল 'ওয়েক আপ' কল'।

বিশ্ববাসী শঙ্কিত এই বুঝি ম্যালথাসের তত্ত্ব সত্যি হয়ে উঠল

ম্যালথাস খুব স্পষ্টভাবে বলে গিয়েছিলেন, মানুষ যদি জনবৃদ্ধি প্রতিরোধে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে মহামারী, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনসংখ্যা কমানোর অস্ত্র নিজ হাতে তুলে নেবে। আজ কোভিড-১৯ সারা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুলীলা চালাচ্ছে দেখে আমরা ভয় পাচ্ছি, এদিক ওদিক কান পাতলে, চোখ রাখলে সেই বৃদ্ধ পাদ্রীর নাম শুনতে পাচ্ছি, তাঁর তত্ত্বে বর্ণিত ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি প্রমাণিত হতে চলেছে কিনা এই আশঙ্কায় কিছু দীর্ঘশ্বাসও কানে এসে পৌঁছচ্ছে। দেশে- বিদেশে এই বিষয়ের ওপর নিশ্চয়ই বিস্তর ওয়েবিনারও সংঘটিত হয়ে চলেছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে, তবে ম্যালথাস বর্ণিত তত্ত্বটি এর আগেও বহুবার আমাদের চেতনার দরজায় কড়া নেড়েছে। কিন্তু হয় আমরা সেই আওয়াজ শুনিনি বা শুনলেও ইচ্ছে করে দরজা খুলে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াইনি। ইতিহাস খুঁড়ে দেখলেই বোঝা যাবে একাধিক ঘটনা এই তত্ত্বকে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষে সমর্থন জানাচ্ছে। ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপ ও এশিয়ায় মহামারীর আকার ধারণ করেছিল 'দ্য ব্ল্যাক ডেথ অব বুবনিক'। দুই মহাদেশের প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল ইঁদুর এবং কালো মাছি বাহিত এই রোগে। ১৪২০ সালে রোম সাক্ষী থেকেছে 'ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ'-এর। আবার ঠিক একশো বছর পর ১৫২০ সালে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছিল 'স্মল পক্স'। এরপর ধারাবাহিক ভাবে ১৬২০ সালে মহামারী 'মে ফ্লাওয়ার', ১৬২৯ সালে 'গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন', ১৭২০ সালে ফ্রান্সে ঘটে যাওয়া 'গ্রেট প্লেগ অব মার্সেই' কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল।

১৮২০ সালে ভারতে ইয়েলো ফিভার এবং কলেরায় প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়। এর আবার একশো বছর পর ১৯২০ সালে স্পেনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পরে 'স্প্যানিশ ফ্লু'। তার উপর দুটো বিশ্ব যুদ্ধ, এই সবগুলিই ছিল 'পসিটিভ চেকস'। প্রকৃতি এবার নিজের মতো 'রাস্টিকেট' পর্ব চালাতে শুরু করেছে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আবার ঠিক একশো বছর আসা এই ভয়ানক কোভিড প্যান্ডেমিক। এরপরও আমরা চোখ বুজে থাকলে ভবিষ্যতে মানবজাতির অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হবে সেবিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিই যে শেষ কথা নয়, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল 'কোভিড-১৯' প্যান্ডেমিক। তানাহলে এতগুলো ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়ে যাওয়ার পরও মানুষ কেন এত সন্ত্রস্ত! কেন ভ্যাকসিনের দুটো ডোজ নেওয়ার পরও মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, এমনকি মৃত্যু মুখেও পতিত হচ্ছে! প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনও ম্যালথাসের তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে তাঁর বিখ্যাত মতবাদ, 'দ্য থিওরি অব ইভলিউশন বাই ন্যাচারাল সিলেকশন' প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অথচ আমরা সচেতনভাবে ম্যালথাসকে নিয়ে হাসি তামাশা করে তাঁর দেখিয়ে দেওয়া 'অর্থনৈতিক ফাঁদ'কে বেমালুম অস্বীকার করে ভোগসাগরে গলা ডুবিয়ে নিজেদের সমস্ত অপকর্মের দায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ঘাড়ে চাপিয়ে আরামকেদারায় বসে পা নাচাতে নাচাতে দুধ-চিনি ছাড়া কালো কফিতে তুফান তুলছি।

অতিমারী প্রতি মুহূর্তে শেখাচ্ছে পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র যে দেশের হাতে আছে সেই দেশ সর্বপরাক্রম নয়, শক্তিমান হল সেই দেশ যার হাতে যথেষ্ট পরিমাণে ডাক্তার, নার্স, হাসপাতাল আছে। চিকিৎসক, গবেষণাগার, অর্থাৎ চিকিৎসার উপযুক্ত পরিকাঠামো এবং করোনা মোকাবিলায় শক্তিশালী ভ্যাকসিন এখন একটা দেশের শক্তি ও সমৃদ্ধির সূচক। আবার একবার প্রমাণিত হল প্রকৃতির চেয়ে বড় কেউ নয়। ক্ষমতার গর্বে গরিয়ান প্রথম বিশ্বের দেশগুলি আজ শামুকের গর্তে মুখ লুকিয়েছে। এতদিনকার উন্নাসিক মানবসমাজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর বিশ্বাস হারিয়েছে। তাই কোনো দেশের বিজ্ঞানীরাই বলতে পারছেননা আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন কতটা নিরাপদ, সেকারণেই অ্যান্টিডোট নেওয়ার পরও তাঁরা মুখে মাস্ক পরে সামাজিক দূরত্ব পালন করতে বলছেন।

এবার শেষবারের মত ভাবার সময় এসেছে। এরপরও সচেতন না হলে মানবসভ্যতা কালের নিয়মে অতলে বিলীন হবে। ফসিল ফিউয়েলের ভাঁড়ার ইতিমধ্যে শূন্য, এই জ্বালানি সর্বোত্তম দূষণ সৃষ্টি করে। তাই আগামী দিনে দূষণহীন সৌরশক্তি, বায়ু শক্তি, নদীর স্রোতবাহী শক্তি, এবং বিজ্ঞানসম্মত সঠিক প্রক্রিয়ায় পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারের উপর নির্ভর করতে হবে। আমাদের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস এমনভাবে বদলে ফেলতে হবে যাতে শয়নে-স্বপনে-জাগরণে কম শক্তিক্ষয় ঘটে। তাই আগামী দিনে আমাদের প্রযুক্তিকে সেদিকেই চালিত করতে হবে যেখানে বিজ্ঞান আমাদের নতুন উপায়ে প্রাকৃতিক সম্পদকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করতে শেখাবে, কখনোই নতুন নতুন উপায়ে প্রকৃতি ও পরিবেশকে নিরন্তর শোষণ করতে শেখাবে না।