আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২১ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

দোহাই, গাল পাড়বেন না

শিমূল সেন


চোর কাকে বলে? কে নির্ণয় করে দেয় চোরের সামাজিক স্থানাঙ্ক? এইসব বদখত প্রশ্নই মনে জাঁকিয়ে বসছিল সম্প্রতি, সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের ধুন্ধুমার রাজনীতিনাট্য পরখ করতে করতে। তদন্তকর্তাদের রুদ্ধশ্বাস অভিযান আর উকিলি সওয়াল-জবাবের এমন বিনিদ্র স্মৃতি বোধহয় বাঙালির অভিজ্ঞানে খুব একটা নেই বিশেষ। আর, তার পিছু পিছু-ই, সমাজমাধ্যম ভেসে যাচ্ছিল গ্রেফতার-হওয়া অভিযুক্তদের ‘চোর’ বিশেষণে তেড়ে, নঞর্থে, দাগিয়ে দিয়ে। অনিয়ন্ত্রিত এই ব্যবহারে ক্রমশ আবছা হতে থাকে যে ‘চোর’ উপমানটি বস্তুত আইনি লব্জ, শাসকের বানানো ক্ষমতার ভাষা - তা নির্বিষ নয় মোটেও।

আরও অনেক কিছুর মতই, এমন চেতনারও পাঠ দিয়েছিলেন খোদ কার্ল মার্কস। সাল ১৮৪২। তরুণ মার্কসের তখনও ম্যানিফেস্টো লিখতে বাকি বছর ছয়েক, জার্মানিতে রুজু হল নতুন ফরমান, এখন থেকে সাম্রাজ্যের প্রতিটি অরণ্য গণ্য হবে অভিজাত পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে। ফলে, এর আগে যে গরিবগুর্বো মানুষগুলো জঙ্গলে যাতায়াতের পথে অবরেসবরে কুরিয়ে নিতেন ইতস্তত পড়ে-থাকা কাঠকুটো - সেই আদ্যন্ত স্বাভাবিক রেওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল আইনত। উদ্ভাবিত উকিলি বিশেষণে, তাঁরা বনে গেলেন আগমার্কা অপরাধীতে। ওঁর নিজের সম্পাদিত কাগজে, ক্রূর এই নির্দেশনামার বিরুদ্ধে, একের পর এক মোট পাঁচটা লেখা লিখে ফেললেন মার্কস, উন্মোচন করলেন চুরির গভীর সামাজিক কুলুজি। মার্কস দেখালেন চুরির নিহিত ঐতিহাসিকতাঃ যখন সমাজে বৈষম্য তীব্র, বেকারি তুঙ্গে, মজুরি কম, কিংবা তুমুল শীত পড়েছে - জঙ্গলে তথাকথিত ‘অনুপ্রবেশ’-এর বহর বেড়ে যায় সেই সব আপৎকালীন মুহূর্তেই - অর্থনৈতিক বৈষম্যের সঙ্গে মিশে যায় চৌর্যবৃত্তি। অনূদিত ইংরিজিতে, 'ডিবেটস অন থেফট অফ উডস' নামে মার্কসের ওই পাঁচ নিবন্ধের নির্যাস সপাটে বিদ্ধ করে ‘চুরি’-নামক ক্রিয়াটির প্রচলিত উকিলি দ্যোতনাকেই। প্রসঙ্গত, আইন বিষয়টাই যে শ্রেণিস্বার্থ-রক্ষার ছুতোবিশেষ - এমন সিদ্ধান্তে সে’দিন পৌঁছেছিলেন নিবন্ধকার।

এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে পাল্টাঃ চুরিরও কি শ্রেণিভেদ নেই? তৃণমূল কংগ্রেসের যে পাঁচ জনপ্রতিনিধি ক্ষমতার অপব্যবহার করে টাকা আত্মসাৎ করলেন বলে অভিযোগ, তাকে কি আর মেলানো যাবে দূরতম জার্মানির আঠেরো শতকের গরিব কাঠুরেদের সঙ্গে? সে তর্ক না-হয় রইল মুলতুবি, কিন্তু আরও মোদ্দায়, আজকের ভারতবর্ষে যে পুঁজিপতিরা অবাধে লুঠপাট করে চলেছেন শ্রম, মজুরি, কয়লাখনি, তৈলভাণ্ডার, অরণ্য কিংবা সমুদ্রবন্দর - চোরকে চোর বলিও না, এ-হেন মন্ত্রপূত আপ্তবাক্যে কি সেই সমস্ত কীর্তিকলাপ, যাকে সোজাসাপটা কাণ্ডজ্ঞানেই সাব্যস্ত করা যায় গূঢ় অপরাধ হিসেবে, তাকে আলগা বৈধতা দেওয়া হয় না? মাথায় রাখতে হবে, 'চোর' কথাটির উৎস লুকিয়ে রয়েছে 'সম্পত্তি' বস্তুটিতে - যে ব্যক্তি অবৈধ ভাবে পরস্বাপহরণ করে, সে-ই চোর। প্রুঁধোর স্লোগান ছিলঃ 'সম্পত্তি মাত্রেই চুরি,' আর তার উত্তরে মার্কসের জবাবি ছিলঃ সম্পত্তি কী? সম্পত্তি বলে কিছু কি হতে পারে, আদৌ? এক দিকে, পুঁজিতন্ত্র টিকেই রয়েছে বৃহত্তর ও অজানিত চুরি-র ওপরঃ উদ্বৃত্ত আহরণের তত্ত্বে, যা উৎপাদনের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় উৎপাদককে, পণ্যরতির ছুতোয় পণ্যকে করে তোলে স্বরাট ও স্বয়ম্ভূ, তৈরি করে ভুয়ো 'সম্পত্তি'র টিপসই। অন্য দিকে, সেই শ্রমশক্তিও ব্যক্তিগত নয়, সামূহিক। কাজেই সম্পত্তি বস্তুটিই আসলে কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তির মালিকানা নয় - যেমন নয় কাবেরী নদীর তেলের বেসিন কিংবা নিয়মগিরির কয়লাখনি, কিংবা তোয়ালে-মোড়া গুচ্ছ গুচ্ছ প্যাকেটবন্দি টাকা। উল্টো দিকে, 'চোর' উপমার ক্ষান্তিহীন আবৃত্তি থেকে থেকে মনে করায়, সম্পত্তি আছে - যা হয়ে ওঠে পণ্য-ভাসমান মধ্যবিত্তের স্বর, তার নাছোড় ও অনিবার্য অভিব্যক্তি। কাজেই, বুর্জোয়া সমাজ কাকে 'চোর' বলবে, তার একটা নিহিত জন্মদাগ রয়েছে - সেখানেই 'চোর' শব্দটি তার তাৎক্ষণিক অভিধার বাঁধা সরহদ্দ ছাড়ায়, হয়ে ওঠে কিছু কালো, ক্ষয়াটে ও গরিব চেহারার চিহ্নক - চোর বলতে তখন মনেও পড়ে না বিত্তবান পুঁজিপতিকে। এই লেখা সেই চিহ্নায়ন-প্রসূত, আরোপিত ব্যঞ্জনার বিরুদ্ধে।

যুবক মার্কস মনে করেছিলেন যে চোরের একটা নিহিত শ্রেণিচরিত্র রয়েছে, এবং তা আদ্যন্ত রাজনৈতিক। অবশ্য জীবনভর তাদের প্রতি রাজনৈতিক সহানুভূতিতে থিতু থাকতে পারেননি তিনি। বেশ কিছু দশক পর, তাঁর লুই নেপোলিয়নের আঠেরোই ব্রুমেয়ার বইতে মার্কস জারি করলেন অমোঘ সংশোধনী। চোরের মধ্যে কি নিহিত রয়েছে কোনও বিপ্লবী সম্ভাবনা? মার্কসের পরিণত বয়েসের উত্তর এল নেতিবাচক। দা-কাটা বর্গের হিসেবে, এই মার্কস মনে করেন, চোর ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রলেতারিয়েত নয় - সে চরিত্রগত ভাবে লুম্পেন, ফলশ্রুতিতে, সে প্রতিনিধিত্ব করে এমন এক সম্প্রদায়ের, যে প্রতিক্রিয়াশীল, এবং যথাযথ শ্রেণিচেতনা-লুপ্ত; যার কাজ স্রেফ উঞ্ছ চেটে দিন গুজরান। অতঃপর, পরিণত পুঁজিবাদী সমাজের শিল্পশ্রমিক-সুলভ বিপ্লবমনস্কতার ন্যূনতম প্রত্যাশিত নয় তার কাছে - যার এক মাত্র বাহক, গ্রাম থেকে শহরে পাড়ি জমানো সাবেক ভূমিহীন মজুর তথা শিল্প-কারখানার শ্রমিক। সে মার্কস যা-ই বলে থাকুন না কেন, মার্কসপন্থী বিদ্বৎমহলে অবশ্য চোরের অনুরণন থামেনি একশো বছর পরেও। মার্কসবাদী ইতিহাসবিদ ই পি টমসনের 'হুইগস অ্যান্ড হান্টারস' বইয়ের জবানিতে যেমন উঠে এসেছিল আঠেরো শতকের ইংল্যান্ডের রাজপরিবার আর অভিজাতদের ব্যক্তিগত জমিতে কী ভাবে অবাধে চলে ‘অনুপ্রবেশ’, তার একটা আখ্যান। দেখিয়েছিলেন থমসন - চুরি নেহাত সোজাসাপটা ‘অপরাধ’ নয়, তার রয়েছে একটা নিহিত শ্রেণিচরিত্র। আঠেরো শতকের ইংল্যান্ড-সমাজে, মাছ-ধরা, কাঠকয়লা-সংগ্রহ, ছত্রাক-জোগাড় কিংবা অগুনতি হরিণ শিকারের মত ছুটকো ঘটনায় মূর্ত হয়ে ওঠে সেই অন্তর্লীন শ্রেণিদ্বন্দ্ব; শেষ পর্যন্ত নিজেদের ‘সম্পত্তি’ বাঁচাতে হস্তক্ষেপ করতে হয় শাসকদের - আঠেরো শতকে জারি হয় ব্ল্যাক অ্যাক্ট। অতঃপর, এ’ বইয়ে থমসন শেখাবেন তাঁর পাঠককে - চুরির মত ঘটনাকে পড়তে হলে তাকে দেখতে হবে মরাল ইকোনমি-র আলোয়, নৈতিকতার দৃষ্টিতে, অভ্যস্ত পলিটিকাল ইকোনমি-র বাঁধা চশমা মুলতুবি রেখে। অর্থাৎ,  আইন-আদালতের বাঁধা রাষ্ট্র-প্রণোদিত কেতাবি সংজ্ঞার বাইরে, চোরকে জরিপ করতে হবে এথিক্যালি।

থমসনীয় ক্রিটিকের উজ্জ্বলতম ওয়ারিশ, নিঃসন্দেহে, মার্কসবাদী ইতিহাসবিদ এরিক হবসবম। সামন্তশাসিত সমাজে, কৃষিভিত্তিক ব্যবস্থায়, চুরি কীভাবে বয়ে আনত বৃহত্তর কোনও রাজনৈতিক তাৎপর্য - হবসবম এঁকেছিলেন তারই একটা নকশা, ওঁর 'দ্য প্রিমিটিভ রেবেলস' বইয়ে। এমনিতে, লেনিনীয় পাঠ-মোতাবেক, কৃষকচৈতন্য নেহাত প্রাক-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াশীল সত্তা - অনিবার্যত, ধরে নেওয়া হয় যে আগামীর সম্ভাব্য বিপ্লবে কৃষকের কোনও সচেতন কর্তৃত্ব থাকবে না। ক্লাসিকাল এই ছক মোটেই বাতিল করেননি হবসবম তাঁর লেখায়। তাঁরও মতঃ কৃষিসমাজে চুরির মত এ’ ধরনের খণ্ড-বিচ্ছিন্ন ঘটনাপুঞ্জ কখনওই উঠে আসে না কোনও সচেতন মতাদর্শ, স্বচ্ছ লক্ষ্য কিংবা স্পষ্টতর সাংগঠনিক বোঝাপড়া থেকে। তবুও, লেখেন হবসবম - সামন্তসমাজে চুরি, ছিনতাই বা ডাকাতি গোছের ঘটনাগুলি আদতে এক অর্থে শ্রেণিসংগ্রামের অনিবার্য পূর্বসূত্র-বিশেষ। বস্তুত এ’ এক মস্ত কুলুজি - যেখানে ডাকাতি, মিলেনারিয়ান আন্দোলন কিংবা বিক্ষিপ্ত দাঙ্গা-হুজ্জুত, আদতে, সমাসন্ন বয়ঃপ্রাপ্ত বিপ্লবী রাজনীতির পূর্বপট রচনা করে। হবসবমীয় ব্যাখ্যান অনুযায়ী থেকে-থেকে মনে পড়বে দাপুটে ডাকাত রবিনহুডের বৃত্তান্ত, যে কি-না বড়লোকের সর্বস্ব লুট করে বিলিয়ে দিত তার প্রান্তিক সহযোদ্ধাদের। হবসবমের 'ব্যান্ডিটস' বইটির পৃষ্ঠাগুলিতেও হানা জমায় পল্লির ভূমিহারা চাষি কিংবা সেনাবাহিনী-পালানো সৈনিক - যারা কি-না ‘সোশ্যাল ব্যান্ডিট্রি’, অর্থাৎ কৌম দস্যুতার প্রচ্ছদে থেকে-থেকে ঘটিয়ে ফেলেছিল আস্ত শ্রেণিযুদ্ধের অজানিত মহড়া।

হবসবমের রাজনীতির থেকে আকাশসমান দূরত্ব, কিন্তু চৌর্যবৃত্তিকে তার রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা-সহ দেখেছেন অ্যানার্কিস্ট মার্কিনি রাজনীতি-তাত্ত্বিক জেমস স্কটও। স্কটের ব্যাখ্যা সেমিওলজিক্যাল, কাঠামোবাদী। ওঁর মতে - রাষ্ট্রীয় সরহদ্দের বাইরে-থাকা কৃষিসমাজ গোপনে হিংসার কথা লেখে - স্কটের তকমায়, ‘ইনফ্রাপলিটিক্স’ - ঠিক যেন আকাশের ভেতর জেগে থাকা অদৃশ্য বর্ণালী। মালয়েশিয়ার ধান-উৎপাদক একটি গ্রামে ক্ষেত্রসমীক্ষা চালিয়ে স্কট খেয়াল করেন যে প্রচলিত ও বোধ্য এলিট রাজনীতির সমস্ত তরিকাই গরহাজির সেখানে। না আছে মিছিল, সমিতি, ইস্তেহার; না রয়েছে দৃশ্যগ্রাহ্য কোনও বিক্ষোভ কিংবা সভা - অথচ, শ্রেণিসঞ্জাত ক্ষমতাবৈষম্য কম নেই এতটুকুও। তা হলে? আপাত চোখে দেখলে, হয়তো, ধরা দেবে এক প্রকার রাজনীতি-শূন্যতা। কিন্তু, স্কটের সন্ধানী চোখে সে’ নেহাতই ওপরতলের আপাতসত্য। স্কটের মন্তব্যঃ এখানেই জেগে ওঠে প্রতিরোধের সম্ভাব্য শিল্প কিংবা অক্ষমের আয়ুধ - যা আচমকা প্রকাশিত হয়ে পড়ে কেচ্ছা, গুজব, চুরি কিংবা শাসানির মত মামুলি নৈমিত্তিক ঘটনায়। স্কট দেখান, বহু ক্ষেত্রেই চুরির ব্যঞ্জনা লুকিয়ে থাকে দমন আর অধীনতার চেনা স্মারকগুলিকে বিপর্যস্ত করে দেওয়া, সর্বনেশে কোনও চোরাগোপ্তা আক্রমণে। এই প্রেক্ষিতে আমেরিকার দাসসমাজের কথা উল্লেখ করেছিলেন স্কট, যেখানে সরাসরি মালিকের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানানো ছিল অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ - অতএব, আড়ালে ও নিঃশব্দে মালিকের সম্পত্তি ছিনিয়ে নিতে পারা এক জন দাসের পক্ষে বিশেষ কৃতিত্বের! এমন ভাবেই, বশ্যতা-অধ্যুষিত দাসকুলে সম্পত্তি, আইন ও ক্ষমতাকে থেকে থেকে বুড়ো আঙুল দেখায় চোর।

বিদ্রোহের আদি চিহ্ন লুকিয়ে থাকে বশ্যতাকে থোড়াই কেয়ার-করা এই মনোভঙ্গিতেই - এমনটা জানিয়েছিলেন ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ, যার থেকে ভাবনার বহু সুতো টানেন স্কট-ও। গুহ-র মহাগ্রন্থ 'এলেমেন্টরি অ্যাসপেক্টস অফ পিজ্যান্ট ইন্সারজেন্সি'-র দ্বিতীয় অধ্যায় খুঁড়লে, ভারতীয় অতীতের আর্কাইভে রাজনৈতিক প্রতিরোধ হিসেবে চুরির এমন অজস্র, অগুনতি সাক্ষ্য মিলবে। গুহ এবং স্কট, দু’জনেরই বক্তব্য - ক্ষমতার পাশা উল্টে-দেওয়া এই একরোখা তাগিদকে কেবল আসন্ন ‘মূল’ বিপ্লবের অ-রাজনৈতিক কোনও প্রতীতি হিসেবে দেখা ভুল। এলেমেন্টরি অ্যাসপেক্টস-এ গুহ দেখান, পাবনা, হুল, বারাসত... ঔপনিবেশিক শাসকের বয়ান জুড়ে উনিশ শতকের অগুনতি কৃষক অভ্যুত্থান নিয়েই চুরি বা ডাকাতির বিবরণ লেখা পাতার পর পাতা! খিদে আর অপমানে জারিত গ্রামের কৃষক, জমিদার-বেনিয়া-পুলিশ-নিয়ন্ত্রিত বৈষম্যকে, আক্রমণ করে। এমনকী এক জায়গায় গুহ এ-ও দেখান, চুরি করে জেলে যেতে পারলে কিছু দানাপানি জুটবে - এই আশাতেও মাঝেসাঝে ঘটত ছিনতাই। আর, বিদ্রোহ বাড়তে বাড়তে, এই তরিকায়, স্কটের বাক্য ধার করলেঃ বাঁধ ছাপিয়ে যখন উপচে যায় জল, অমোঘ পরিণামে শাসকের থেকে জোটে দণ্ড। আইনি সংহিতা তখন নির্ধারণ করে দেয় স্টেজে আসীন চরিত্র ঠিক কী বলবে, এবং কতটুকু।

ব্যাপারটা এমন নয় যে চুরি-কে অনিবার্য অপরাধ হিসেবে দেখানোর এই চলটুকু সবে দু'শো বছরের হকিকত, নেহাতই ব্রিটিশের অবদান। স্মৃতিশাস্ত্রর আমল থেকে, ভারতবর্ষের ক্ষমতাকাঠামো যুগে যুগে চোরকে এমন ভাবেই দেখেছে। সমর সেনের প্রয়াণের পর তাঁর স্মৃতিতে একটি নিবন্ধ সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন অশোক মিত্র। দ্য ট্রুথ ইউনাইটস (সুবর্ণরেখা, ১৯৮৫) নামের সেই সংকলনে অন্যতম দ্যুতিময় লেখাটি রণজিৎবাবুরই - গ্রহণের মত নিত্যঘটমান মহাজাগতিক বিস্ময়কে সাবঅলটার্ন ইতিহাস-লিখনে গ্রথিত-করে, সেই লেখার ফাঁকে-ফাঁকে তিনি এনেছিলেন চুরি-র রেফারেন্স। প্রসঙ্গক্রমে, সেই লেখাতেই, আর্য-প্রযোজিত কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় ডোমের সামাজিক অবস্থান নিয়ে বলতে গিয়ে গুহ স্মরণ করেন এক প্রজন্মের বর্ষীয়ান ইতিহাসবিদ, ডি ডি কোসাম্বিকেঃ ‘সামাজিক স্তরবিন্যাসের একেবারে নিচু ধাপে দেখি সেই সব আদিবাসী গোষ্ঠীকে, যারা এখনও খাদ্য সংগ্রহের পর্যায়ে আছে। পারিপার্শ্বিক সমাজে খাদ্য উৎপাদনই স্বাভাবিক পর্যায়। সুতরাং এমন সব নিম্নতম জাতির খাদ্য সংগ্রহ সাধারণত ভিক্ষাবৃত্তি বা চৌর্যবৃত্তির চেহারা নেয়।’ এই পুনরুক্তির অব্যবহিত পরেই গুহর তরফে এল টিপ্পনীঃ ‘যে সমাজ কৃষিব্যবস্থায় নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে পাচ্ছে, সেখানে এমন মানুষকে ভাবা হত প্রান্তিক...। মনুর সময়েও এরা সমাজের আইনশৃঙ্খলার পক্ষে বিপদ গণ্য হত। ...ঔপনিবেশিক শাসকের ভাষায় এরা অপরাধপ্রবণ উপজাতি।’ (অনুবাদ, রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়/রুশতী সেন) এথনোগ্রাফি-অনুসন্ধিৎসু ব্রিটিশ আমলাতন্ত্র, পুলিশ ও বিচারবিভাগ কী ভাবে চোর শনাক্তকরণের মাধ্যমে একটা আস্ত উপজাতিকে অপরাধী সাব্যস্ত করত, সে কথা এলেমেন্টরি অ্যাসপেক্টস-এও রয়েছে সবিশদ। ওই সূত্রায়ন-মোতাবেক, সাঁওতাল আর ভিল মাত্রেই সব প্রাক্-নিষ্পন্ন ‘ক্রিমিনাল ডেকোইট’।

অবশ্য, অধীনতা আর দমনের এই যুগ্ম ছক তন্নিষ্ঠ বাঙালি পাঠকের পরিচিত। রবীন্দ্রকবিতায়, মালকিন আর ভৃত্যের সংলাপ-অনুযায়ী, চাকর মাত্রেই অনিবার্য চোর, থুড়ি, অপরাধী। মনে নেই, - ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর’? অশোক মিত্রের কথা এসেছিল একটু আগেই। আজ থেকে বছর দশেক আগে, ২০১২ সালে, আনন্দবাজার পত্রিকা-র পাতায় অশোকবাবু কলম শানিয়ে বৈশ্যায়ন-আকীর্ণ সমসময়ের প্রতিবাদে লিখেছিলেন একটি উত্তর-সম্পাদকীয়, এই গুণ্ডাভোগ্য বসুন্ধরাই কি আমরা চেয়েছিলাম? লেখার ভেতর কোনও এক বাক্যে প্রয়োগ করেছিলেন ‘চুরিচামারি’র মত কথ্য বাংলা শব্দ (লিঙ্কঃ http://archives.anandabazar.com/archive/1120829/29edit5.html)। গর্হিত প্রয়োগ, এক দিক থেকে ভাবলে। প্রত্যাশিত ভাবেই চিঠি এসেছিল, পত্রলেখক যেখানে অনুযোগ জানিয়েছিলেন কার্যতঃ চামারির মত স্বাভাবিক পেশাদারি জাত-পরিচয়কে কদর্থে ব্যবহার করে, কেন গুলিয়ে দেওয়া হবে চুরি-র মত ঘৃণ্য জীবিকার সঙ্গে? (লিঙ্কঃ http://archives.anandabazar.com/archive/1120822/22edit3.html) হক কথা। একই সঙ্গে, আজ কেবল ভাবতে ইচ্ছে করে, চামারির মত জাত ও পেশাভিত্তিক বংশানুক্রমিক সম্প্রদায়কে কদর্থে না নেওয়ার পাশাপাশি, চুরি-কে গাল-পাড়া অভ্যস্ত ভদ্রলোকি জবানটিকেও প্রশ্ন করলে, তার দিকেও পালটা বর্শামুখ শানানো থাকলে - তা কি নিতান্তই অসঙ্গত?

‘চোর’ বলে কাকে? এই বিসমিল্লার মোদ্দা উত্তরঃ গৃহীত বস্তুতে অধিকার নেই যার। ‘অধিকার’ বলে কাকে? কোন ক্ষমতা স্থির করে দেয় অধিকারের সংজ্ঞার্থ? বামপন্থী দৃষ্টিকোণে ভাবলে প্রশ্নটা জটিল, কিঞ্চিৎ অস্বস্তিদায়ক-ও বটে। ভাববার সময় হয়ে এসেছে - ‘চোর’ মর্মে অবিশ্রাম গালি-দেওয়ার নিত্য অভ্যেসে ক্ষরিত হয় কোন মধ্যবিত্তি, কোন ভদ্রলোকি বামপন্থা? ওই বদখত শ্রেণিহাস্যের অন্তরালে ঘাপটি মারে ক্ষমতার কোন নির্দিষ্ট বয়ান? উপমানের চতুর আশ্রয়ে, বৈদ্যুতিন মাধ্যমের শ্রেণি-আকীর্ণ পরিমণ্ডলে, থেকে থেকে এ’ কোন দৈবঘোষণা ভেসে আসেঃ দুর্নীতি মানেই যেখানে চুরি, আর দুর্নীতিগ্রস্ত মাত্রেই আবশ্যিক, নিপাট, অবধারিত অপরাধী?

তা হলে কি জনপ্রতিনিধিকে ঘুষ নিতে দেখলে চেঁচিয়ে উঠব না? রেগে যাব না? আলবাত চ্যাঁচাব। রাগব। ঝাঁঝিয়ে উঠব। মেরুদণ্ড উঁচিয়ে, নাগরিক হিসেবেই বলব, পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন তিনি। দুর্নীতিগ্রস্তকে মুখের ওপর বলব, 'আপনি দুর্নীতিগ্রস্ত'। কেবল, এইটুকু যে, গাল পাড়ব না। চোর বলে গাল পাড়ব না, শ্রেণি-সচেতন। দোহাই।