আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২১ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছি

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী


২০২১-এ যদি কলম ধরতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিংবা ল্যাপটপের কি প্যাড, তাহলে ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে’ লিখে ফেলার পরেই হয়তো দশবার ভাবতেন তিনি। অপশন খুঁজতেন। দ্বিতীয় শব্দেই যে একটা মস্ত বড় গন্ডগোল করে ফেলেছেন। জুতসই শব্দ খুঁজে না পেলে হয়তো কাগজটা দলা পাকিয়ে ফেলে দিতেন ওয়েস্ট বিনে। কিংবা ব্যাকস্পেস মারতেন উন্মত্তের মতো। এসব ছোঁয়াছুঁয়ি যে চলবে না আর।

যে স্পর্শ এতদিন ধরে শুধু উষ্ণতার কথা বলত, সেই স্পর্শের কথা বললেই এ যুগের দুনিয়া কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। ইংরিজি কোনও শব্দে কিউ অক্ষরের পাশে যেমন অবধারিতভাবে ইউ অক্ষরটা আসে, ঠিক তেমনভাবে ‘কনটাক্ট’ কথাটা উচ্চারিত হলেই যেন ‘লেস’ কথাটা পর্দা ফাঁক করে উঁকি মারে আজকাল। কনটাক্টলেস। এ পৃথিবীতে আর যাই থাকুক না কেন, স্পর্শ নেই কোনও। এতদিন ধরে যে পণ্য কিংবা পরিষেবার বিজ্ঞাপন আরও ভাল স্পর্শের কথা বলে কলার তুলত, তারাই আজ বিনা স্পর্শের বিপণন করতে ইঁদুরদৌড়ে শামিল। ব্যাঙ্কিং হোক কিংবা অনলাইনে ডেলিভারি, রেস্তোরাঁয় খাবার পরিবেশন করা হোক অথবা হোটেলের আতিথেয়তা, সবকিছুর আগেই বসে পড়েছে কনটাক্টলেস শব্দটা। মানে যা চাইবেন তাই পাবেন, শুধু স্পর্শটুকু ছাড়া। পাওয়া যাবে আদর, স্পর্শহীন।

পারস্পরিক নৈকট্যের ভিত যেভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তা সহজে যাওয়ার নয়। কনজিউমার বিহেবিয়ার বলে যে মার্কেটিং টুলটি বিপণনকর্তাদের কাছে বড্ড বেশি প্রিয়, তাতে সম্পৃক্ত হয়েছে ‘ওকে ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছি’-র মতো কয়েকটা লাইন। নিউ নর্মালের পথে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলা পৃথিবী বলছে, এবারে ক্রমশ করতে হবে সবই, স্পর্শহীন। বদলেছে বিজ্ঞাপন। যেখানে সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে বাধ্যতামূলকভাবে জুড়ে যাচ্ছে ‘কনটাক্টলেস’ শব্দটি। মজার ব্যাপার হল, যে স্পর্শহীন পরিষেবাগুলো শুরু হয়ে গিয়েছিল কোভিডের থাবা বসার আগেই, এই বাজারে তার সুফল মিলছে সবচেয়ে বেশি। কনটাক্টলেস ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের কথাই ধরা যাক। চিপ বসানো কার্ডের উন্নততর সংস্করণ হল এই কনটাক্টলেস কার্ড। এই কার্ডের যে বিজ্ঞাপন কোভিডকালের আগে আরও বেশি এনক্রিপশন কিংবা গোপনীয়তার কথা বলত, সেখানে আজ মিশেছে ব্যবহারকারীদের স্পর্শহীন রাখার বিপণনের সুবর্ণ সুযোগ। হাল আমলের কনকাক্টলেস কার্ডের বিজ্ঞাপনগুলো সব বৈশিষ্ট্যকে পিছনে ফেলে রেখে আরও বেশি টাচ-ফ্রি থাকারই কথা বলে। দোকানের পিওএস মেশিনে ছোঁয়াতে হয় না, ক্যাশিয়ারের হাতে কার্ড দিতে হয় না, নিজের শুদ্ধ কার্ড নিজের ‘শুদ্ধ’ হাতেই থাকে - এমন চটকে ক্রমশ ভরে উঠছে কনটাক্টলেস কার্ডের বিজ্ঞাপন। কার্ডটিকে শুধুমাত্র স্পর্শহীন করার জন্য আপগ্রেডেশনের দিকে ঝুঁকছেন বহু মানুষ। যে কার্ডের এক্ষুনি দরকার ছিল না কোনও, যেচে তার বরাত দিচ্ছেন। আর এর ফলে ব্যাঙ্কের ঝুলি ক্রমশ ভরে উঠছে বিশ্বজুড়ে।

এসব শুনে ডাক্তারবাবুরা মুচকি হেসে বলেন, ‘কোন স্পর্শে যে আসলে বিপদ আর কোন স্পর্শে নয় - এই বিষয়টাই বেমালুম গুলিয়ে ফেলেছে আম-আদমি। ’সংগঠিত খুচরো বিপনির যে ক্রেতা পুরো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরটি ঘুরে এলেন দিব্যি, শেলফ থেকে কম করে একশটি সামগ্রী নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলেন, মাস্কটা নামিয়ে বাজারে সদ্য আসা সাবানের গন্ধ শুঁকলেন, কুটকুট করায় হাতটা স্যানিটাইজ না করে ভাল করে রগড়ে নিলেন চোখ, তিনিই বিলিং কাউন্টারে গিয়ে পয়সা মেটানোর সময় কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা দোকানের প্রতিনিধিকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘আপনাদের পিওএস মেশিনটা কনটাক্টলেস তো?’ সন্তোষজনক উত্তর না পাওয়ায় ট্রলিভরা সামগ্রী হেলায় সরিয়ে রেখে দোকান থেকে গটগট করে বেরিয়ে গিয়েছেন, এমন মানুষও দেখার সৌভাগ্য হয়েছে গত কয়েক মাসে। ঝটিতি উধাও হওয়া এক ক্রেতাকে কৌতুহলবশত জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘স্যার এত কষ্ট করে বাজার করলেন, শুধু কনকাক্টলেস বিলিং মেশিন না থাকার জন্য সব বাতিল করে দিলেন? যত্ন করে সাজানো শপিং কার্টকে এত হেলাফেলা?’ উত্তর এসেছিল, ‘স্যানিটাইজেশন নিয়ে আপনি বোঝেন কি হে? ওই কার্ড মেশিনে কত লোক হাত দিয়ে খুটখুট করে পিন মেরেছে জানেন? যদি কারও করোনা থাকে!’ একটু থেমে বললেন, ‘এটিএমে যাব। টাকা তুলতে হবে।’ ভদ্রলোকের হাতে কিন্তু গ্লাভস ছিল না। মাস্কটা ততক্ষণে নেমে গিয়েছিল নাকের অনেক নিচে। কনটাক্টলেস কার্ডের গুণগান শোনার পরে এক চিকিৎসককে বলতে শুনেছিলাম, ‘স্পর্শহীন কার্ডের ম্যাজিকের পরে মেশিন থেকে রোল করা যে কাগজে রিসিপ্টটি বেরিয়ে আসছে চটজলদি, তার মধ্যে যে ভাইরাস নেই, এর প্রমাণ কই? মেশিন থেকে বেরোনো কাগজও তো বিলিং কাউন্টারের প্রতিনিধিই এগিয়ে দিচ্ছেন। কতজনের হাতে গ্লাভস থাকে?’

সমীক্ষা বলে, গৃহবন্দি থাকাটাই ভবিতব্য ধরে নিয়ে বহু মানুষ অনলাইন শপিংয়ের দিকে ঝুঁকছেন ক্রমশ। যাঁরা অফিসের প্রয়োজনে টুকটাক বেরোচ্ছেনও, বাজারমুখো হতে চাইছেন না সহজে। যে কারণগুলোর জন্য অনলাইন শপিংয়ের প্রতি মানুষের মোহ উথলে উঠছে ফোয়ারার জলের মতো, তার মধ্যে অন্যতম কারণ হল কনটাক্টলেস ডেলিভারি। অনলাইন বাজারের নানা সংস্থা এই শব্দ দুটো ক্রমাগত প্রচার করে আমাদের মাথার সার্কিট বোর্ডে ঢুকিয়ে দিতে সফল হয়েছে ইতিমধ্যেই। বিজ্ঞাপনে আমরা যারা মজে গিয়েছি, স্পর্শহীন ডেলিভারির সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করলে তাদের মধ্যে অধিকাংশই অবশ্য আমতা আমতা করব। আধুনিক সাপ্লাই চেনের বই বলে, স্পর্শহীন ডেলিভারির আসল মানে হল, সংস্থার ডেলিভারি বয় ক্রেতার বাড়ির দোরগোড়ায় এসে সামগ্রীগুলো নামিয়ে রেখে তার ছবি তুলে কাস্টমারকে অ্যাপমারফৎ জানাবেন। প্রয়োজন হলে ফোনও করতে পারেন। ক্রেতা জিনিসগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে অ্যাপমারফৎই জানিয়ে দেবেন প্রাপ্তিসংবাদ। এভাবে জিনিস ডেলিভারি করা হলে নাকি সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকে। ফলে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা কমে। দিনকয়েক আগে এক অনলাইন মুদির দোকান থেকে যখন আমাদের বাড়িতে ডেলিভারি করতে আসা হয়, দরজা খোলার পরে দেখেছিলাম, সিঁড়ির সামনে ফেলে রাখা একগাদা জুতো আর হাওয়াই চটির উপরে সাজিয়ে রাখা রয়েছে আমার সাধের চাল ডাল সাবান ডিওডোরেন্ট। বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ঘাম মুছছেন ওই প্রখ্যাত সংস্থার ডেলিভারি বয়। শুধিয়েছিলাম, ‘হাতে হাতে দিতে পারলেন না? শেষ পর্যন্ত জুতোর ওপর?’ উত্তর এসেছিল, ‘হাতে দেওয়ার নিয়ম নেই স্যার। কোম্পানি এসওপি ভায়োলেট করা হয়ে যাবে।’ হাতের থেকে যে জুতোয় ভাইরাস কম থাকে তা নিয়ে ‘বোধিলাভ’ হয়েছিল সেদিন। এক বন্ধুকে বলতে শুনেছিলাম, ‘যে ছেলেটা কষ্ট করে ১০ কেজির চালের বস্তা আর ৫ কেজির আটার প্যাকেটটা সিঁড়ি ভেঙে আমার তিনতলার ফ্ল্যাটে এসে দিয়ে গেল, তাকে যে এক গ্লাস জল খেতে দেব তারও উপায় নেই এখন। কোম্পানির নর্মস ভাঙা হয়।’ সম্পূর্ণ লকডাউনের মধ্যে আপৎকালীন কিছু ওষুধ বাড়িতে ডেলিভারি হওয়ার পরে আমার সত্তরোর্ধ্ব এক জেঠিমা, ডেলিভারি বয়ের চিবুক ছুঁয়ে, মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, ‘বাঁচালে বাবা। আরেকটু দেরি হলেই হয়তো খুব খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারত লোকটার।’ ডেলিভারি দিতে আসা ছেলেটি এই ঘটনায় খুব ভয় পেয়ে যায়। ভদ্রমহিলাকে হাত জোড় করে বলেছিল, ‘যদি ফিডব্যাক দেন, এই আশীর্বাদের কথা লিখবেন না প্লিজ। আমার চাকরি চলে যাবে।’ অনলাইন বিপণির কর্তাদের অবশ্য বুদ্ধি ভালই। ডেলিভারি বয়দের খুশি করার জন্য আগে থেকে পেমেন্ট করার সময়ই মূল অঙ্কের সঙ্গে সেখানে যোগ করে দেওয়া যাচ্ছে টিপস্। তৃষ্ণার থেকে টিপস্ যে অনেক বেশি সেফ। ক্রেতাদের দেওয়া এই অতিরিক্ত অর্থের কতটুকু শেষ পর্যন্ত দিন রাত এক করে খেটে চলা এই ছেলেদের পকেটে যায়, তা নিয়ে অবশ্য ইদানীং প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন অনেকে।

হাতের ছোঁয়ার মাধুর্য্যে মধুরতর হত যে পরিষেবা, তার মধ্যে অন্যতম হল রেস্তোরাঁ। পছন্দের রেস্তোরাঁয় গিয়ে টেবিল বেছে বসার পর সেখানকার কোনও কর্মী আন্তরিকভাবে মেনুকার্ডটি এগিয়ে দেবেন - এতদিন পর্যন্ত এটাই ছিল চেনা রীতি। এই চিরাচরিত নিয়মকে গিলে খেয়েছে নয়া নিয়ম। বাহারি নাম কনটাক্টলেস ডাইনিং এক্সপেরিয়েন্স। রেস্তোরাঁয় যাওয়ার পর মেনুকার্ডের বদলে স্ক্যান করে নিতে হবে একটি বা একাধিক কিউআর কোড। মোবাইলের পর্দায় চটজলদি ফুটে উঠবে মেনু। রোবটের মতো অর্ডার দিতে হবে। কিছুক্ষণ পরে ওয়েটারমশাই রোবটেরই মতো খাবারগুলো টেবিলে রেখে দিয়ে চলে যাবেন। সার্ভ করে নিতে হবে নিজেকেই। বিল মেটানোর সময় ফের আলাদা কোনও কিউআর কোড। সম্প্রতি এমন নয়া কায়দায় খেয়েদেয়ে পয়সা মেটানোর পরে দেখি, ওয়েটারমশাই কিছু না বলা বাণী নিয়ে চেয়ে আছেন আমার দিকে। পঞ্চাশটি টাকা বের করে ওঁর হাতে দিতে যাই। আঁতকে ওঠেন উনি। আমি বললাম, ‘না নিলে কি আর করা যাবে? আমি তবে চলি।’ ছেলেটি যতটা সম্ভব গলা নামিয়ে বলেছিল, ‘পেটিএম করে দিন না স্যার, প্লিজ।’ জীবনে প্রথমবারের জন্য ই-ওয়ালেটের মাধ্যমে টিপ দিয়েছিলাম কাউকে। বোঝা উচিত ছিল, কনটাক্টলেস এক্সপেরিয়েন্সের মধ্যে হয়তো এটাও পড়ে। তবে দুনিয়াজুড়ে খাদ্যরসিকেরা বলছেন, ‘রেস্তোরাঁয় গিয়েও যদি খাবারটা পরিবেশন করে নিতে হয় নিজেকেই, তাহলে আনন্দের অধিকাংশই মাটি।’ পৃথিবীর বহু রেস্তোরাঁ তাদের খাবারের গুণের জন্য যতটা সুনাম কুড়িয়েছে, খ্যাতি এসেছে তাদের পরিবেশনের কৌশলের জন্যও। স্পর্শহীন পরিষেবা এমন আশা-আকাঙ্খা-শখ-আহ্লাদে যে কয়েক গ্যালন জল ঢেলে দিয়েছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

সমীক্ষা বলছে, যাঁদের পাঁচতারা হোটেল ছুটি কাটানোর সাধ রয়েছে, সাধ্যও, তাঁদের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষই চাইছেন হোটেলের অভিজ্ঞতা হোক যতটা সম্ভব স্পর্শবিহীন। ফলে সাবেকিয়ানা নিয়ে গর্ব করে আসা বিশ্বের বহু প্রাসাদোপম হোটেল তাদের পরিষেবার খোলনলচে বদলে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। হোটেল মালিকরা বুঝতে পেরেছেন, স্পর্শহীন পরিষেবার কাছে স-স্পর্শ সাবেকি পরিষেবা দশ গোল খাবে। ফলে, বলা যায়, পুরো হোটেলটিই তাঁরা ঢুকিয়ে দিয়েছেন অ্যাপে। হোটেলে প্রবেশ করার পর আর রিসেপশানে গিয়ে চাবি নেওয়ার দরকার নেই। ঘরের নম্বর বাতলে দেবে অ্যাপ। কারও স্পর্শের তোয়াক্কা না করেই সোজা চলে যাওয়া যাবে ঘরের সামনে। অ্যাপের ডিজিটাল সিকিওরিটির কলকব্জায় ঘরের দরজা খোলা যাবে স্পর্শহীনভাবে। ঘরে ঢুকলেই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে জ্বলে উঠবে আলো, চালু হয়ে যাবে এসি। কত তাপমাত্রার ঘর আপনার পছন্দ তা আগে থেকেই জেনে নিয়েছে অ্যাপ। ওই অ্যাপ দিয়েই চালু করা যাবে দেওয়ালে লাগানো বিরাট স্মার্ট টিভি। বিয়ার খেতে ইচ্ছে করছে? ঘরের মধ্যে রাখা গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট কিংবা আমাজন আলেক্সার কাছে ভয়েস কমান্ড দিলেই কিছুক্ষণের মধ্যে দরজার সামনে হাজির হয়ে যাবে পছন্দের পানীয়। বেশ কিছু হোটেল এ কাজে ইতিমধ্যেই নিয়োগ করে ফেলেছে রোবট। ওদের কাজই হল, বিভিন্ন ঘর থেকে টুকটাক উড়ে আসা অর্ডার সার্ভ করা। খাবারদাবারের অর্ডারও সহজে দিয়ে দেওয়া যাচ্ছে অ্যাপে। কোনও পর্যটক হোটেলে থেকে গেলেন তিন চারটি দিন, কিন্তু এক-দুজন ছাড়া হোটেলের কোনও কর্মীরই মুখদর্শন করার প্রয়োজন পড়ল না, এমন ঘটনা বহুক্ষেত্রে ঘটছে। চেক-আউটের সময় অ্যাপের কল্যাণেই ধেয়ে আসা বিল কার্ডে মিটিয়ে, ফিডব্যাক সেকশনে ‘অসাম এক্সপেরিয়েন্স’ লিখে তাঁরা বেরিয়ে পড়ছেন পরের গন্তব্যে।

পড়া না পারলে ঝুলপি ধরে টান মারতেন যে শুভজিৎস্যার, কিংবা ইচ্ছে হলেই আমাদের হাতের স্ক্রুগুলো ‘ঠিক’ করে দেওয়ার জন্য দু'আঙলের ফাঁকে পেন্সিল ঢুকিয়ে ‘হেঁইয়া’ বলে চাপ দিতেন যে হেডমাস্টারমশাই, এ যুগের স্পর্শবিহীন শিক্ষাদানে তাঁরা কতটা সাবলীল হতেন তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। শাস্তি দেওয়ার পরে স্টাফরুমে ডেকে নিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যেভাবে পড়াটা ফের বুঝিয়ে দিতেন পঙ্কজস্যার, আজকের কনটাক্টলেস, ভার্চুয়াল ক্লাসরুম তাঁদের সেই পরিসর দিত তো? আমাদের স্কুলজীবনের অধিকাংশ শিক্ষকই তো আজ সত্তরোর্ধ্ব। বেশ কয়েকজন প্রয়াতও। মনে হয়, এক অর্থে বেঁচে গিয়েছেন তাঁরা। ভূগোলের সমীরস্যারের কথা মনে পড়ে। পড়াতে পড়াতে গ্লোবের গায়ে হাত বোলাতেন সন্তানস্নেহে। জরাগ্রস্ত মানুষটি ক্রমশ জীর্ণ হয়ে গেলেও প্রিয় গ্লোবের গায়ে একটিও স্ক্র্যাচ পড়তে দেননি। সামনে মেলে ধরা বিরাট ম্যাপের গায়ে আলপনা আঁকার মতো যেভাবে তিনি বুঝিয়ে দিতেন গঙ্গা-গোদাবরীর গতিপথ, শিক্ষাদানের সেই আরাম হয়তো আজ তাঁরা ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে পেতেন না। আমাদের এই ধন্য দেশের এক বড় শতাংশের ছাত্রছাত্রী দিনের পর দিন অগুণতি ক্লাস মিস করে শুধুমাত্র স্মার্ট ফোনের অভাবে। কোনওমতে একটা ফোন যোগাড় করলেও দেখা যায়, ওই অঞ্চলে ইন্টারনেট অমিল। ফলে ক্লাসের পর অতিক্রান্ত হয় ক্লাস, স্কুলের প্রিয় স্যারেরা মোবাইলের পর্দায় শুধুই ‘বাফার’ করে যান। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার সারবত্তা এখানেই। কনটাক্টলেস ক্লাসরুম এভাবেই গড়ে তুলছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।

এক সমাজতাত্ত্বিককে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলতে শুনেছিলাম, ‘সামাজিকভাবে নিউক্লিয়ার হয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে স্পর্শের তলানি তাও পড়ে ছিল যতটুকু, গত দেড় বছর সেটাকেও নিংড়ে নিয়ে ছিবড়ে করে দিল। আর মাত্র কয়েকটা বছর। টাচ-ফ্রি বেঁচে থাকার আসল মূল্য দেবে সমাজ। ’কয়েকটা প্রশ্ন তাঁরা ছুঁড়ে দিয়েছেন। বলছেন, ‘ক্লাস ওয়ানের যে কয়েক কোটি শিশু বছর দেড়েক বন্ধুদের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হল, তারা সামাজিকভাবে আরও অনেক পিছিয়ে পড়ল না তো?’ পাশাপাশি কয়েকজনের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নামই তো সমাজ। স্ক্রিন-ক্লাসঘরে পড়া শুনতে বাধ্য হচ্ছে যে খুদেরা, সহপাঠীদের সঙ্গে একসাথে টিফিন ভাগ করে খাওয়ার মজা থেকে তারা রয়ে গেল সহস্র যোজন দূরে। সামাজিকতার, অন্যের সঙ্গে ভাগ করে বাঁচার শিক্ষার সহজপাঠ তো এভাবেই শুরু হয়। অনেকেই বলছেন, দুষ্টুমি-খুনসুটির মতো কিছু আনন্দ-শব্দও হয়তো ক্রমশ হারিয়ে যাবে শিশুদের অভিধান থেকে। কালকের বড়দের আজকের ভিতের মধ্যে শুধু লেপ্টে আছে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া স্বার্থ। এই ভিতের জন্যেই কোভিডকাল কেটে গেলেও আগামী দিনগুলোয় হয়তো সমাজের স্পর্শ এড়িয়েই বেঁচে থাকবে ওরা। চলতি সময় শিক্ষা দিয়েছে, একা বেঁচে থাকার মধ্যেই অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য!

শহরের অভিজাত এলাকার কোটি টাকার বাড়িতে ঘর হারানো মানুষের মতো টাচ-ফ্রি হয়ে বেঁচে আছেন যে একাকী বৃদ্ধ বৃদ্ধারা, কোভিড-সময় তাঁদের জীবনকে আরও বেশি করে স্পর্শহীন করে দিয়েছে। মাসের শুরুতে তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে উপচে পড়ে ডলার-পাউন্ড ভাঙানো টাকা। ওই অর্থে বাড়ি হয়তো চকচকে হয়ে ওঠে। অন্দরমহলে ও অন্তরমহলে তা পোড়োবাড়িই থাকে। সপ্তাহখানেক আগের কথা। সল্টলেকের এক অশীতিপর বৃদ্ধা চোখের জল মুছতে মুছতে বলেছিলেন, ‘ছোটনকে বহুবার বলেছি, আমার আর টাকার দরকার নেই বাবা। দরকার তোকে। এবার ফিরে আয়। বিলেত তো অনেক হল। আগে বছরে শুধু একবার আসত, এক সপ্তাহের জন্য। এই মড়ক আমার থেকে সেই দিনগুলোও কেড়ে নিল। ছোটন আর আসবে না।’ ড্রয়িং রুমে লাগানো শৌখিন ঝাড়বাতির দিকে তিনি তাকিয়ে ছিলেন শূন্য চোখে। ঝলমলে আলোর নিচে জমকালো সোফায় বসে বলছিলেন, ‘চারদিকটা খুব অন্ধকার লাগে বাবা।’

এমন টুকরো টুকরো বহু কোলাজ তৈরি হচ্ছে আমাদের চারপাশে। এই অন্ধকারের শেষ কোথায়, তার উত্তর আপাতত অজানা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুনভাবে বেঁচে থাকার যে নয়া সিলেবাস তৈরি হচ্ছে, তাকে জাপ্টে থাকবে শুধু সুরক্ষাবিধি। কালো সময়ের পরে ক্রমশ আলো দেখা যাবে যখন, শেষ মাস্কটা হয়তো আমরা খুলে ফেলে, আগুনে জ্বালিয়ে, ফেলে দেব দূরে।

তার মধ্যে অবশ্য সবার মুখেই ট্যাটুর মতো এঁটে থাকবে ঠান্ডা মুখোশ।