আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২১ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

রামগড় কংগ্রেস স্যুভেনির - একটি ঐতিহাসিক দলিল

রজত রায়


একটা বইয়ের প্রথম পাতা খুলে সূচিপত্রে যদি প্রথম নামটা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তার পরেই মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং অন্যান্য লেখকের মধ্যে আচার্য্য জে বি কৃপালনী, পট্টভি সীতারামাইয়া, জে বি হাথি সিং, ভগবান দাস, হুমায়ুন কবির এবং আরও অনেকের লেখা পাওয়া যায়, তা হলে কেমন অনুভুতি হয়? তার সঙ্গে যদি সেই বইয়ে রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, এম এন রায়, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহরু, সরোজিনী নাইডু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল প্রমুখের ফটো থাকে, সেই সঙ্গে নন্দলাল বসুর আঁকা মহাত্মা গান্ধীর ঐতিহাসিক ডান্ডি মার্চের পাতাজোড়া রঙিন ছবি থাকে? আর এ সবই প্রকাশিত হয় যখন এই নেতারা সবাই জীবিত (দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন বাদে), তখন? সর্বোপরি, সেই বইয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত লেখাগুলি থেকে যখন ভারতের এক যুগসন্ধিক্ষণের ইঙ্গিত মেলে? নিঃসন্দেহে এমন একটি বই একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসাবেই গণ্য হবে। এমনই ঐতিহাসিক দলিল জাতীয় কংগ্রেসের ১৯৪০ সালে অনুষ্ঠিত রামগড় অধিবেশন উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনির বইটি।

চিত্র ১: সুভ্যেনিরের সূচীপত্র

মনে রাখতে হবে, কংগ্রেসের ওই রামগড় অধিবেশন এমন একটা সময় হয়েছিল, যখন ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে গিয়েছে। ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। সেই দিনই ভারতের তদানীন্তন বড়লাট লর্ড লিনলিথগো একতরফা বিবৃতি দিয়ে ঘোষণা করেন যে এই যুদ্ধে ব্রিটিশ ও ভারত জার্মানির বিরুদ্ধে অংশ গ্রহণ করছে। এই ঘোষণার আগে ব্রিটিশ শাসকরা ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের (বিশেষ করে কংগ্রেস, মুসলিম লিগ প্রভৃতির) সঙ্গে কোনও আলোচনাই করার প্রয়োজন বোধ করেননি। ফলে, কংগ্রেসও তার তীব্র প্রতিবাদ করে এবং কংগ্রেস ওয়র্কিং কমিটি ব্রিটিশ শাসকের কাছে লিখিতভাবে জানতে চায়, ব্রিটেনের এই যুদ্ধে অভীষ্ট লক্ষ্য কী? বিশেষ করে, জার্মানি ও ইতালির আগ্রাসী আক্রমণ থেকে ইউরোপের গণতান্ত্রিক মানুষকে বাঁচানোর মহান আদর্শের কথা বলা হলেও ভারতের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটেনের ভাবনা কী, সেটা স্পষ্ট করে বলা হোক। তবে এটা ঠিক যে গান্ধীজির নেতৃত্বে কংগ্রেস বুঝতে পারছিল যে ভারতের স্বাধীনতা লাভের বিরাট সুযোগ এসে গিয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে দুটি গুরুতর সমস্যায় কংগ্রেস তখন সঙ্কটাপন্ন। একদিকে, জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ দেশকে ভাগ করে পাকিস্তান আদায়ের লক্ষ্যে উঠেপড়ে লেগেছে। ফলে, দেশে সাম্প্রদায়িক বিভাজন এক বিশাল সমস্যা হয়ে উঠছে। অন্যদিকে, ১৯৩৯ সালেই নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে দল থেকে বহিষ্কারকে কেন্দ্র করে কংগ্রেসের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব বিরাট আকার নিয়েছে। সব মিলিয়ে কংগ্রেস তখন নানা দিক থেকেই দ্বিধাগ্রস্ত।

এই অবস্থায় বিহারের রামগড়ে ১৯৪০ সালের মার্চে কংগ্রেসের অধিবেশনের আয়োজন হয়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে হলে মনে রাখতে হবে যে কংগ্রেস অধিবেশন চলাকালীনই অধিবেশনস্থলের কাছেই দল থেকে শাস্তিপ্রাপ্ত বিদ্রোহী নেতা সুভাষচন্দ্র বিশাল এক সম্মেলনের আয়োজন করেন। ওই সম্মেলেন থেকে কংগ্রেসকে ব্রিটিশের সঙ্গে কোনওরকম সমঝোতা না করার আহ্বান জানানো হয়। কংগ্রেসের মধ্যেকার যে অংশ ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় কোনও সহযোগিতা না করে স্বাধীনতা আদায়ের জন্য লড়াই চালাতে আগ্রহী ছিল, তারা সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে যেতে পা বাড়াতে শুরু করে। ওই মাসেই, অর্থাৎ ২৩শে মার্চ লাহোরে মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গ্রহণ করে। ফলে, একদিকে কংগ্রেসের মধ্যে সুভাষচন্দ্রকে কেন্দ্র করে ভাঙ্গন, অন্যদিকে দেশের সাম্প্রদায়িক বিভাজন চরম আকার নেওয়ায় কংগ্রেস নেতৃত্ব গভীর সঙ্কটে পড়ে যায়। এই অবস্থায় দলকে দিশা দিতে রামগড় অধিবেশনের আয়োজন যথেষ্ট গুরুত্বপুর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।

মনে রাখতে হবে, ১৯৩৯ সালের ২৯শে জানুয়ারি সুভাষচন্দ্র দ্বিতীয়বার কংগ্রেস সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। তিনি গান্ধীজির মনোনীত প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে হারান, যার ফলে ক্ষুব্ধ গান্ধীজি প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেন, পট্টভির পরাজয় আসলে তাঁরই পরাজয়। কিন্তু দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সভাপতিকে গান্ধীজি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। তাঁর অনুগত নেতারা সব কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে একযোগে পদত্যাগ করে অচলাবস্থা তৈরি করেন। কংগ্রেসের মধ্যে গান্ধীজি এবং অন্য রক্ষণশীল নেতাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার এম এন রায় তখন সুভাষচন্দ্রকে বলেন, গান্ধীজি তাঁর অসহযোগ আন্দোলনের কৌশল প্রয়োগ করে সুভাষচন্দ্রকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করছেন। বাস্তবিক, সুভাষচন্দ্র গান্ধীজি এবং নেহরুর সঙ্গে আলাদা আলাদা করে বসে দীর্ঘ বৈঠক করে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং ওই বছরের ২৯শে এপ্রিল কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। এর পরে তিনি কংগ্রেসের মধ্যে তাঁর অনুগামীদের নিয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক দল গঠন করেন। যদিও তখনও তিনি কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে রাজেন্দ্র প্রসাদকে সভাপতি করে কংগ্রেস গান্ধীজির পছন্দের লোকজনকে নিয়ে ওয়ার্কিং কমিটি তৈরি করে। জুন মাসে ওয়ার্কিং কমিটির একটি সিদ্ধান্ত সুভাষচন্দ্রকে দল থেকে বহিষ্কারের পথ সুগম করে। ওই প্রস্তাবে বলা হয়, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুমোদন ব্যতিরেকে কংগ্রেসের কেউ সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করতে পারবেন না। এ ভাবে দলের মধ্যে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করার প্রতিবাদে সুভাষচন্দ্র দেশের বিভিন্ন শহরে জনসভা করে কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেন। এর পরে ১৯৩৯ সালের আগস্ট মাসে কংগ্রেস তাঁকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তিন বছরের জন্য দলের কোনও স্তরের সাংগঠনিক পদে থাকার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যা কার্যত বহিষ্কারেরই নামান্তর।

বড়লাট লিনলিথগো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে ভারতকেও সঙ্গে টেনে নেওয়ার কথা ঘোষণা করার ছয়দিনের মধ্যে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ওয়ার্ধায় এক জরুরি বৈঠকে বসে। যদিও দল থেকে ততদিনে তিনি কার্যত বহিষ্কৃত, তবুও তিন দিনের ওই বৈঠকে সুভাষচন্দ্রকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হয়। ওই বৈঠকে সুভাষচন্দ্র ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করতে জোরদার অসহযোগ ও গণআন্দোলন শুরু করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি তখনই ওই পথে যেতে প্রস্তুত ছিল না। তারা বরং ব্রিটিশ সরকারের কাছে তাদের ওই যুদ্ধ থেকে কী লক্ষ্য অভীষ্ট সেটা স্পষ্ট করে জানাতে দাবি করে। ব্রিটিশ প্রশাসন অবশ্য তখনই এ নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু জানাতে চায়নি। বরং লিনলিথগো তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীতে কংগ্রেস সহ বিভিন্ন দলের আরও কয়েকজন সদস্য নিতে আগ্রহী বলে জানায়। একই সঙ্গে গান্ধীজি, সুভাষচন্দ্র সহ বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করে লিনলিথগো ব্রিটিশদের নীতির পক্ষে একটা মতৈক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করে, যা আদৌ সফল হয় না।

এদিকে ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে রবীন্দ্রনাথ সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা তুলে নেওয়ার জন্য গান্ধীজিকে অনুরোধ করে ব্যর্থ হন। গান্ধীজি সি এফ এন্ড্রুজের মারফত জানিয়ে দেন যে বিষয়টি গুরুদেবের পক্ষে মেটানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট জটিল। একইসঙ্গে তিনি এটাও বলেন যে তিনি (রবীন্দ্রনাথ) যেন এটা বিশ্বাস করেন যে ওয়ার্কিং কমিটির কারও সুভাষচন্দ্রের প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ নেই। এটাও বলেন যে সুভাষচন্দ্র তাঁর কাছে পুত্রসম। এই পরিস্থিতিতে রামগড় কংগ্রেসের অধিবেশন যখন বসছে, তখনও সুভাষচন্দ্রের বিপুল জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখে স্যুভেনিরে আট পাতার একটি রিপোর্টকে জায়গা করে দেওয়া হয়। ১৯৩৯ শীর্ষক ওই রিপোর্টে সুভাষচন্দ্রকে দল থেকে বহিষ্কারের পক্ষে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ত্রিপুরি কংগ্রেসের সময় থেকেই কংগ্রেস সভাপতি (সুভাষচন্দ্র) ও মহাত্মাজীর মধ্যে মত পার্থক্য বেড়ে চলে। গান্ধীজি তো কংগ্রেস সভাপতিকে বলেই ছিলেন যে তিনি যেন তাঁর পছন্দমতো লোকজনকে নিয়ে ওয়ার্কিং কমিটি তৈরি করেন। তবে একটাই শর্ত, সেই কমিটিকে এআইসিসি-র অনুমোদন পেতে হবে। বলে রাখা ভালো, ত্রিপুরি কংগ্রেসের অধিবেশনে সর্দার প্যাটেলের আনা একটি প্রস্তাবে বলা হয় যে কংগ্রেস সভাপতিকে এআইসিসি-র সিদ্ধান্ত মেনে কাজ করতে হবে। প্রস্তাবটি নিয়ে ভোটাভুটি হলে কংগ্রেসের মধ্যেকার সোশ্যালিস্টরা ভোটদানে বিরত থাকে। ফলে, প্রস্তাবটি পাস হয়ে যায়। এর পরে কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে কাজ করা অসম্ভব বুঝে সুভাষচন্দ্র ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। ওই প্রস্তাব বা সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করেই রিপোর্টে বলা হয়েছে যে সুভাষবাবু ওই সাহসী পথে পা বাড়াতে চাননি। তিনি চাইছিলেন, সমঝোতা সূত্র হিসাবে উভয়পক্ষের সদস্যদের সমানভাবে নিয়ে ওয়ার্কিং কমিটি তৈরি করতে, যেখানে সাধারণ সম্পাদক হবেন তাঁর পছন্দের লোক। এ ছাড়া সুভাষবাবু আরও চাইছিলেন, ব্রিটিশ সরকারকে একটা চরমপত্রে ছয় মাস সময় দিয়ে তারপর দেশজুড়ে ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলন শুরু করা হোক। তাঁর দুটি প্রস্তাবই গান্ধীজির কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এর পরে কংগ্রেসের হাইকমান্ডের সঙ্গে সুভাষবাবুর কয়েক দফা বৈঠক হলেও কোনও ফল হয়নি। এরপরে কংগ্রেসের চলার পথ সুগম করতে সুভাষচন্দ্র সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। এই অবস্থায় দলের সবচেয়ে প্রবীণ প্রাক্তন সভাপতি হিসাবে সরোজিনী নাইডুকে অস্থায়ী ভাবে কংগ্রেস সভাপতি করা হয়। তারপরে এআইসিসি প্রথানুযায়ী নতুন সভাপতি হিসাবে রাজেন্দ্রপ্রসাদকে নির্বাচিত করে।

রিপোর্টে আরও বলা হয়, সুভাষচন্দ্র ইস্তফা দেওয়ার পরে এআইসিসির দুটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য বোম্বাইতে জনসভা করেন। তাঁর আপত্তি রাজ্যে রাজ্যে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করার ক্ষেত্রে হাইকমান্ডের অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা নিয়ে, এবং যে সব প্রদেশে কংগ্রসের সরকার রয়েছে, তাদের প্রদেশ কংগ্রেসের নির্দেশ মেনে চলা থেকে ছাড় দেওয়া নিয়ে। কিন্তু এআইসিসিতে এই সিদ্ধান্তগুলি বিপুল বহুমতে পাস হয়েছিল। তা সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্র তার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দেওয়ায় এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি তৈরি হয়। যদি দলের সর্বোচ্চ স্তরে গৃহীত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নিচুতলার কংগ্রেস কমিটি এবং কার্যকর্তাদের তরফে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে দেওয়া হয়, তা হলে বিশৃঙ্খলা অনিবার্য। যদি জেলা কংগ্রেস কমিটি প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, প্রদেশ প্রতিবাদে মুখর হয় এআইসিসি-র সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এবং এআইসিসি প্রতিবাদ করে তার প্রকাশ্য সমাবেশে গৃহীত সিদ্ধান্তের, তা হলে গোটা কংগ্রেস সংগঠনটাই ভেঙ্গে পড়বে, চরম নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে। সুভাষবাবুকে নিরস্ত করতে কংগ্রেস সভাপতি এই মর্মে চিঠি লিখলেও সুভাষবাবু তাতে সাড়া দেননি। এ দিকে প্রকাশ্যেই বিক্ষোভ প্রদর্শন চলতে থাকল। সব দিক বিবেচনা করে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে সুভাষবাবু দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ করেছেন। কংগ্রেসের একজন সদস্য হিসাবে তিনি কংগ্রেস সভাপতির নির্দেশ মানতে বাধ্য। কিন্তু তিনি না শোনায় তাঁকে বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতির পদ থেকে অপসারিত করার সঙ্গেই তিন বছরের জন্য সব রকম দলীয় পদ গ্রহণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হয়। হাইকমান্ডের এই ব্যাখ্যায় জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে কংগ্রেস সভাপতির নির্দেশ অমান্য করায় তাঁকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত করে শাস্তি দেওয়া ছাড়া কংগ্রেসের সামনে আর কোনও পথ খোলা ছিল না। যে প্রশ্নটা অনুক্ত থেকে গেল তা হল, সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন তাঁর বিরুদ্ধে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা প্রকাশ্যেই যে অসহযোগিতা শুরু করে তাঁকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেন, তা দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধ ছিল কিনা।

আট পাতার ওই রিপোর্টে সুভাষচন্দ্রকে বহিষ্কার করার প্রেক্ষিত প্রায় চার পাতা জুড়ে দেওয়ার কারণ সম্ভবত কংগ্রেস হাইকমান্ড ওই ঘটনার জেরে দলের মধ্যে কতখানি ভাঙ্গন ধরতে পারে তা নিয়ে যথেষ্ট আশঙ্কিত ছিলেন। একই সঙ্গে জিন্নার পাকিস্তান তৈরির চেষ্টায় অগ্রগতি (ওই মার্চেরই ২৩ তারিখ জিন্না লাহোরে মুসলিম লিগের জনসভা থেকে পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব পাস করাবেন।) নিয়েও যথেষ্ট শঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। এটাও স্বীকার করা হয়েছে যে বার বার চেষ্টা করেও কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি হিন্দু মুসলমানের বিভেদ দূর করতে ব্যর্থ হয়েছে। অগত্যা কংগ্রেস হাইকমান্ড মনে করছে যে একমাত্র সাংবিধানিক পরিষদ (Constituent Assembly) গঠন এবং সেখানে মুসলমানদের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্বের সুযোগ দিয়ে এই বিরোধ মেটানো সম্ভব।

রিপোর্টটির লেখক হিসাবে নাম দেওয়া হয়েছে সাদিক আলির। তাঁর পদ উল্লেখ করে জানানো হয়েছে যে তিনি এআইসিসি-র অফিস সেক্রেটারি। এখানেই খটকা লাগে। যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সঙ্কটের কথা ওই রিপোর্টে সবিস্তার আলোচনা করা হয়েছে, তা কোনও অফিস সেক্রেটারির দ্বারা লেখা আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়েই খটকা। মনে হয়, সাদিক আলিকে সামনে রেখে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির কোনও প্রবীণ সদস্য এই রিপোর্টটি লিখেছিলেন।

সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে গান্ধীজির মতপার্থক্যের একটা গুরুতর দিক ছিল, সুভাষচন্দ্র চাইছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে ব্রিটিশদের সঙ্গে কোনও সমঝোতা না করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটা সর্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দেওয়া হোক। গান্ধীজি তখনই তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু কংগ্রেসের সাধারণ সদস্য এবং দেশবাসীর একটা বড় অংশের মনে যে এরকমই একটা ইচ্ছা জাগরুক ছিল, তার ইঙ্গিত মেলে ওই স্যুভেনিরে আচার্য জে বি কৃপালনীর এক পাঁচ পৃষ্ঠার লেখা থেকে। 'Congress and the War Crisis' শীর্ষক ওই লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন যে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ঠিক দু'দিন পরেই বড়লাট লর্ড লিনলিথগো গান্ধীজিকে ডেকে বৈঠকে বসেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, উদ্ভুত পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তাঁর নৈতিক সমর্থন এবং তাঁর মাধ্যমে কংগ্রেস ও ভারতের সমর্থন আদায় করা। গান্ধীজি বৈঠকের পরে জানান যে তিনি বড়লাটের কাছে এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে তিনি কংগ্রেস বা দেশবাসীর প্রতিনিধি হিসাবে ওই বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন না। তিনি এটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন যে একজন মানবতাবাদী হিসাবে তিনি যুদ্ধ শুরু হওয়ায় উদ্বিগ্ন। তাঁর স্বাভাবিক সহানুভূতি মিত্রশক্তির পক্ষে হলেও তিনি যুযুধান কোনও পক্ষেরই ধ্বংস কামনা করেন না। তাঁর মতে, যুদ্ধে যদি ব্রিটেন ধ্বংস হয়ে যায় বা জার্মানি পর্যুদস্ত ও অপমানিত হয়, তা হলে ভারতের স্বাধীনতার কী মূল্য থাকবে?

গান্ধীজির মনোভাব ব্যক্ত করার পরেই কৃপালনী যু্দ্ধ ঘোষণার ছয় দিনের মাথায় ওয়ার্ধায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বিশেষ বৈঠকের প্রসঙ্গে আসেন। বৈঠকে ওয়ার্কিং কমিটিকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করার জন্য গান্ধীজি, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র, জয়প্রকাশ নারায়ন, নরেন্দ্র দেব প্রমুখকে কংগ্রেস সভাপতি আমন্ত্রণ জানান। জিন্নাকেও আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু জিন্না অন্যত্র ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে অনুপস্থিত থাকেন। বৈঠকের পরে ওয়ার্কিং কমিটির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে নাৎসি জার্মানির তরফে সাম্প্রতিক যে আগ্রাসন শুরু হয়েছে তার কড়া নিন্দা করা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারকে এটা বুঝতে হবে যে (ভারতের উপর) সহযোগিতার শর্ত উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। কারণ সহযোগিতা হয় সমানে সমানে। কংগ্রেস এটাও বলে যে তারা অবগত আছে যে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের ঘোষণানুযায়ী তারা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছে। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়েও তাদের যুদ্ধঘোষণার কারণ হিসাবে গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং ছোট ছোট দেশের স্বাধীনতার অধিকার রক্ষার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গিয়েছিল ওই ঘোষণাকারী দেশগুলি ভেঙ্গে পড়া অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্থ এলাকাগুলি নিজেদের মধ্যে গোপনে ভাগবাঁটোয়ারা করে নিতে ব্যস্ত ছিল। কংগ্রেসের বক্তব্য, যদি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি নিজেদের আগের অবস্থা অটুট রাখতে, বা উপনিবেশ ও অন্যান্য সুবিধা আদায় করার লক্ষ্যে যুদ্ধে যোগ দিয়ে থাকে, তা হলে তার সঙ্গে ভারতবাসীর কোনও সম্পর্ক থাকার কারণ নেই। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি মনে করে যদি গণতন্ত্র রক্ষার জন্যই এই যুদ্ধে ব্রিটেন অংশ নিয়ে থাকে, তা হলে তাকে সেই লক্ষ্যের সঙ্গে ভারতবাসীর গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের জন্য ভারতবাসীর তৈরি সংবিধান এবং কোনও বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়া এক স্বাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের জন্য ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে। সে জন্য ওয়ার্কিং কমিটি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে তাদের যুদ্ধের লক্ষ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণা, অর্থাৎ কী ভাবে তা ভারতের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হবে সেই মর্মে নির্দিষ্ট ঘোষণা জারি করতে দাবি জানায়।

বলা বাহুল্য, ব্রিটিশ শাসকরা কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির ওই দাবির উত্তরে কোনও নির্দিষ্ট অঙ্গীকার করে না। বরং গান্ধীজি, সুভাষচন্দ্র থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, এমনকি বিভিন্ন করদ রাজ্যের প্রমুখদের সঙ্গেও বড়লাট আলাদা আলাদা বৈঠক করতে থাকেন। কংগ্রেস যে ব্রিটিশদের এহেন আচরণে যথেষ্ট বিরক্ত তা বুঝিয়ে দিয়ে কৃপালনী লিখেছেন, বড়লাট ইতিমধ্যেই ৫২ জন ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেছেন এবং এখন কংগ্রেসের দাবি এড়াতে বলছেন যে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন মতামত পাওয়ার কারণে একটা নির্দিষ্ট কোনও সমাধানসূত্র মিলছে না। এরপর বড়লাটের তরফে যে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়, তাতে সাফ বলা হয় যুদ্ধ শেষ হলে তারপর ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নটি ব্রিটিশ সরকার বিবেচনা করতে পারে। আরও জানিয়ে দেওয়া হয় যে ব্রিটেন কোনও আর্থিক বা আনুষঙ্গিক লাভের জন্য যুদ্ধে নামেনি। এই যুদ্ধে ব্রিটেনের লক্ষ্য সত্যিকারের শান্তি ফিরে পাওয়া। অর্থাৎ, এর মধ্যে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার অবসান, গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি প্রশ্ন আসেই না। উপরন্তু, যুদ্ধে ভারতের পূর্ণ সহযোগিতা পাওয়ার জন্য বড়লাট তাঁর একটি পরামর্শদাতা কমিটি তৈরি করার প্রস্তাব দেন। তাতে কংগ্রেস, মুসলিম লিগ থেকে শুরু করে ভারতীয় রাজা মহারাজাদের প্রতিনিধিকে জায়গা করে দেওয়ার কথা বলা হয়। এক কথায়, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির দাবিকে সরাসরি খারিজ করা হয়। বড়লাটের অবস্থান জানার পরে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ১৯৩৯ সালের ১৯-২৩ নভেম্বর এলাহাবাদে বৈঠকে বসে। সেখানে আলোচনার পরে কংগ্রেস সভাপতি বড়লাটকে লিখিতভাবে জানান, ভারতের স্বাধীনতা সম্পর্কিত প্রশ্নে এবং সংবিধান রচনার জন্য একটি সংবিধান সভা গঠন করার প্রশ্নে বড়লাটের ঘোষণা একেবারেই সন্তোষজনক নয়। কংগ্রেস প্রস্তাবিত সংবিধান সভার সদস্যদের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক ভারতবাসীর ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। ব্রিটিশরা মুসলমানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা বিভ্রান্তিকর কথা বলে আসল নৈতিক প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় কংগ্রেস ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন জারি রাখতে বাধ্য হচ্ছে। এখানে দুটি জিনিস লক্ষ্যণীয়। প্রথমত, ব্রিটিশদের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের হুমকি দিল ঠিকই, কিন্তু ব্রিটিশদের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আগেই সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিকে এই পথে যেতে বলেছিল। গান্ধীজির সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের বিরোধও মুখ্যতঃ এই বিষয়কে কেন্দ্র করেই। দ্বিতীয়ত, ভারতের স্বাধীনতার জন্য কংগ্রেসের দাবি ব্রিটেন সরাসরি খারিজ করায় কংগ্রেসের পক্ষে রাস্তায় নেমে বিরোধিতা করা ছাড়া আর কোনও সম্মানজনক পথ খোলা রইল না। অর্থাৎ, ১৯৪২ সালের আগস্টে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বীজও তখনই বপন করা হল।

রামগড় কংগ্রেসের স্যুভেনিরটি যে একটি ঐতিহাসিক দলিল তা তার পাতায় পাতায় স্পষ্ট। তবুও এর মধ্যে একটি জিনিস আলাদা করে উল্লেখের অপেক্ষা রাথে। তা হল, বইটিতে ফটোর নির্বাচন। শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের একটি পাতাজোড়া ফটো বাঁদিকের পাতায়, এবং ডানদিকের পাতায় তাঁর একটি ইংরেজি কবিতা। কবির নিজের হাতে লেখা কবিতার ফটোকপি। কবিতাটা একনজরে পড়লে বোঝা যায়, ওটি বহুপরিচিত এবং গান্ধীজির খুবই প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবানুবাদ মাত্র। যার শুরু হয়েছে এইভাবে -
Let then desert thee
who are thine own
be not dismayed.
The tree of the hope may wither
and the fruit lost,
be not dismayed.
Even if overtaken by dark night
in the middle of thy path
walk on.
Even if thou failest in thine efforts
to light the lamp
be not dismayed.
Never go baffled in despair
if gates are shut against thee;
and if they refuse to yield to thy knocks,
be not despaired.

চিত্র ২: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার ছবি

শেষে রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতের স্বাক্ষরের সঙ্গেই লেখা রচনাকাল Feb.10, 1940. এক মাস পরেই রামগড় কংগ্রেস শুরু হবে। আর আগেই বলা হয়েছে যে দেশ ও জাতির কী সঙ্কটজনক সময়ে কংগ্রেস ওই অধিবেশনের আয়োজন করেছিল। প্রত্যক্ষ রাজনীতির সংস্রবে না থাকলেও রবীন্দ্রনাথ দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন ছিলেন। এ কথা এখন নিশ্চিত করে বলা কঠিন, কংগ্রেস অধিবেশনের প্রাক্কালে গান্ধীজির 'গুরুদেব'-এর কাছ থেকে কংগ্রেস আশীর্বচন প্রার্থনা করায় রবীন্দ্রনাথ ভেবেচিন্তেই এই কবিতাটি লিখেছিলেন কিনা। তবে কবিতার মর্মবাণী যে গান্ধীজি এবং তাঁর সহযোগীদের প্রতিই উদ্দিষ্ট ছিল, এমনটা মনে করা খুব একটা বাড়াবাড়ি কল্পনা নয়। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও ফটোর পরেই রয়েছে গান্ধীজির ছবি, সঙ্গে এক লাইনের শুভেচ্ছা - আশা করি (স্যুভেনির) এর প্রকাশ শিক্ষনীয় হবে ও কাজে আসবে। এর পরে তদানীন্তন কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এবং বিদায়ী সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের ছবি। তারপরেই সুভাষচন্দ্রের ছবি, সঙ্গে ক্যাপশনে লেখা ১৯৩৯ সালের কংগ্রেস সভাপতি। সুভাষচন্দ্রের আরও একটি ছবি রয়েছে নেহরুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতায় ব্যস্ত। সুভাষচন্দ্রের যদি দুটি ছবি থাকে, তা হলে গান্ধীজির রয়েছে মোট তিনটি। একটি জিন্নার সঙ্গে, অপরটি সীমান্ত গান্ধীর সঙ্গে। এ ছাড়া নন্দলাল বসুর আঁকা বিখ্যাত রঙীন চিত্র "গান্ধীজির ডান্ডি মার্চ"। নেহরুরও আরও ছবি রয়েছে। একটি তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে, অপরটি এম এন রায়ের সঙ্গে। কিন্তু প্রশ্ন হল, দল থেকে মাত্র গত বছরেই বহিষ্কৃত হওয়ার পরেও কংগ্রেস অধিবেশনের স্যুভেনিরে সুভাষচন্দ্রের একাধিক ছবি গুরুত্ব দিয়ে ছাপার কারণ কী? তার আগে ওয়ার্কিং কমিটির ওয়ার্ধা বৈঠকেও 'বহিষ্কৃত' সুভাষচন্দ্রকে বিশেষ আমন্ত্রিত হিসাবে ডেকে আনার কারণই বা কী? আগেই বলেছি, সাদিক আলির বকলমে কংগ্রেস হাই কমান্ড এই স্যুভেনিরে সুভাষচন্দ্রের বহিষ্কারের প্রেক্ষাপট নিয়ে যে দীর্ঘ ব্যাখ্যান পেশ করেছে, তাতে যেন অনেকটাই কৈফিয়তের সুর ধরা পড়ে। ভোটের আগে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের তরফে প্রকাশ্যেই সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রচারে নামা, গান্ধীজির প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে হারিয়ে কংগ্রেস সভাপতি পদে সুভাষচন্দ্রের নির্বাচনকে প্রকাশ্যেই মেনে নিতে অস্বীকার করা এবং তাঁর ইঙ্গিতে অনুগামীদের একসঙ্গে (নেহরু বাদে। তিনি ওই স্রোতে গা ভাসাতে চাননি, কিন্তু পরে আলাদা করে ইস্তফা দেন।) ওয়ার্কিং কমিটি থেকে ইস্তফা দিয়ে সরে দাঁড়ানো, নির্বাচিত সভাপতিকে কাজ করতে না দিয়ে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা - এ সবের মধ্যে একটা অনৈতিকতা লক্ষিত হচ্ছিল। অথচ গান্ধীজি সারাজীবন নৈতিকতাকে যাবতীয় কর্মের ঊর্ধ্বে স্থাপন করে দেখতে এবং দেখাতে তন্নিষ্ঠ। সম্ভবত, তাই দল থেকে সুভাষচন্দ্রের অপসারণের প্রক্রিয়ায় জড়িত অনৈতিকতার দায় কিছুটা লঘু করতেই সম্ভবত দল থেকে 'বহিষ্কৃত' সুভাষচন্দ্রকে রামগড় কংগ্রেস উপলক্ষে প্রকাশিত এই স্যুভেনিরে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া। হয়তো ভাবা হয়েছিল যে অন্তত কংগ্রেসের মধ্যে সুভাষচন্দ্রের জনপ্রিয়তা যেন হাইকমান্ডের সুভাষ বিরোধিতার সঙ্গে সংঘাতের জন্ম না দেয়। সব মিলিয়ে এই বই নিছক একটি স্যুভেনির নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক দলিল বলেই গণ্য হবে।

পুনশ্চঃ এই স্যুভেনিরে আরও নানা বিষয়ে লেখা রয়েছে। যেমন দেশের জনজাতির জীবনযাপন প্রসঙ্গে একাধিক লেখা। তার মধ্যে ছোটনাগপুরের (রামগড়ও তার মধ্যে পড়ে) বিভিন্ন জনজাতির পরিচয়, তাদের গান ইত্যাদির বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। তেমনই বীরসা মুণ্ডাকে নিয়ে একটি আলাদা লেখা। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য, কংগ্রেসের ১৯৩৮ সালে গঠিত জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনের কাজকর্মের অগ্রগতি নিয়ে একটি রিপোর্ট।

দেখাই যাচ্ছে, এখনকার মতো তখনও স্যুভেনিরের প্রকাশনা বিজ্ঞাপননির্ভর ছিল। রামগড় কংগ্রেসের স্যুভেনিরেও অজস্র বিজ্ঞাপন। তবে টাটা স্টিলের মতো বড় শিল্পসংস্থার বিজ্ঞাপন নামমাত্র। বেশির ভাগ বিজ্ঞাপনই কলকাতার ছোট বড় প্রতিষ্ঠানের, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বীমা কোম্পানি (যেমন, ওরিয়েন্টাল, অন্ধ্র ইনস্যুরেন্স, ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ইত্যাদি), বেসরকারি ব্যাঙ্ক (যেমন, নাথ ব্যাঙ্ক লিমিটেড, ক্যালকাটা ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক, ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গল, ব্যাঙ্ক অব বরোদা) রয়েছে। আর রয়েছে বেঙ্গল ল্যাম্প, বেঙ্গল পটারিজ, হাওড়া দাশনগরের দ্য ইন্ডিয়া মেশিনারি কোম্পানি, ক্যালকাটা কেমিক্যালের মার্গো সাবান, লিলি বার্লির বিজ্ঞাপনে আবার রামগড় কংগ্রেসে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে এটা খেলে তাঁদের স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে। তবে এদের সবাইকে ছাপিয়ে গেছে হিমানী স্নো ও সাবানের বিজ্ঞাপন। পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনে সরোজিনী নাইডু, জওহরলাল নেহরু এবং জে এন সেনগুপ্তের সচিত্র বাণী রয়েছে। নেতারা জানিয়েছেন, ওই স্নো ও সাবান মেখে তাঁদের খুবই ভালো লেগেছে।