আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২১ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

এ পরবাসে...

স্থবির দাশগুপ্ত


“In the same way that the ‘war on terror’ led to a futile effort to end the threat to America by killing supposed terrorists one by one while neglecting the sociopolitical milieu that produced them, so too the new ‘war on disease’ isolated the microbe and ignored the terrain.”
- Alex de Waal.

জ্ঞানের চেয়ে আমাদের অজ্ঞানতার পরিধি যে অনেক বেশি সেকথা জানা। তাহলে সত্যকে কোথায় খুঁজে পাব - পুঁথিতে, না অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে? পুঁথির সঙ্গে সবসময় অভিজ্ঞতার মধুর মিলন ঘটতে চায় না; সব পুঁথি সমান গ্রাহ্যও না, সব অভিজ্ঞতাও না। তাহলে কী করা? অনেকে বলেন, যেসব পুঁথি পণ্ডিতদের আদর পেয়েছে, সেগুলোই ভাল, নিরাপদ। ভাল কারণ, এইসব পুঁথিতে নির্ভর করার মতো তথ্য থাকে, যুক্তির ধার থাকে। আর নিরাপদ কারণ, শিক্ষিত লোকজন সেই পুঁথিলব্ধ জ্ঞানের বিরুদ্ধে কথা বলবার আগে কয়েকবার ঢোঁক গিলবেন, তাই বচসার আপদ অন্তত কমবে।

কিন্তু বচসাকে আপদ বলা হবে কেন? বচসা ছাড়া কি সত্যের কাছাকাছি পৌঁছনো যায়? বচসাই জ্ঞানের কৃষিকাজ, বচসাইতো গণতন্ত্রের মূল্যবান শর্ত। অবশ্য সব বচসা সমান না। এথেন্স-এর লাইসিয়ামে যেসব বচসা চলত আর আমাদের চণ্ডীমণ্ডপে যা চলে, তা এক না। বা ধরা যাক, ইতিহাস বা বিজ্ঞানের সেমিনারে যে মাঞ্জা দেওয়া সুতোর কাটাকাটি চলে তার সঙ্গে কি আমাদের বিধানসভা বা লোকসভার তুলনা চলে? সেখানেও যুক্তি আর প্রতিযুক্তির বিরোধ চললে ভালই হত, তবে তেমন আর হয় না। আমরা অনেক বছর ধরে, অসীম পরিশ্রম করে, সেই বিতর্কসভা তুলেই দিয়েছি, প্রায়। এখন মেষনিনাদ শুনতে শুনতেই দিন যায়। অবশ্য দিনই শুধু যায়, জীবনের যাপনটা আর স্বাভাবিক থাকে না। তখন ভাবি, বচসা ছাড়া কি জীবন স্বাভাবিক থাকে? আবার ভাবি, স্বাভাবিক মানে?

এখন প্রায় সারা দুনিয়া জুড়ে গণতন্ত্রের আসর। গণতন্ত্র ব্যাপারটাকে আমরা বেশ সহজ সরল পাটিগণিত ধরে নিয়ে বলেছি, সংখ্যাগুরু যা ভাবে বা ভাবতে চায় তাই ঠিক, যথার্থ, অর্থাৎ স্বাভাবিক। তাহলে সংখ্যালঘুরা যাবে কোথায়? আমরা বলেছি, তারাও থাকবে, তারা কথা বলেও যাবে; বলতে-বলতে যদি কোনওদিন তারাই সংখ্যাগুরু হয়ে যায়, তখন সে-কথাই ঠিক বলে লোকে মানবে। এই যে ‘পরিবর্তন’-এর ডিগবাজি, এটা বেশ ভালই; সমাজ সচল থাকে, প্রাণবন্ত থাকে, গণতন্ত্রের মহিমাও বজায় থাকে। গণতন্ত্র মানে তো শুধু কাছাখোলা উল্লাস না, ‘পরমা যন্ত্রণা’ও বটে। আমরা তাই বলেছি, অপরাপর সিস্টেমের মধ্যে গণতন্ত্রই শ্রেষ্ঠ। আর শ্রেষ্ঠ বলেই তা সর্বত্র প্রয়োগযোগ্য, ইলেকশন কমিশন থেকে বিজ্ঞানসভা, পরিবার থেকে রাজ্যসভা, সর্বত্রই। মোট কথা, আমাদের দেখতে হবে, নিনাদের তীব্রতা কোনদিকে বেশি। ধরে নিতে হবে, সত্যের টানও সেদিকেই।

এইভাবে দেখা আর ভাবাটাই এখন আমাদের অভ্যাস। কিন্তু মুশকিল এই যে, অভ্যাসটা মোটেই কাজের না, অন্তত ইতিহাসের বিচারে মোটেই না। ‘গড্ডলিকা প্রবাহ’ কথাটা সাধারণ জনজীবনে খেটে গেলেও বিজ্ঞানসভা, যেখানে সত্যের অনুসন্ধান চলতে থাকে, সেখানে খাটতে চায় না। বরং দেখা যায়, সত্যের অধিষ্ঠান সংখ্যালঘুদের অঞ্চলেই, অন্তত প্রাথমিকভাবে। সত্যের চলন অতি মন্থর, গ্যালিলেও থেকে সাম্প্রতিক ‘টেস্ট টিউব বেবি’ পর্যন্ত, ইতিহাসের পাতায় তার অজস্র প্রমাণ। কিন্তু প্রমাণ তো কী? আমরা বরং যার প্রচার বেশি, সমীহ করি তাকেই। মিথ্যার গতিবেগ সত্যের চেয়ে অনেক বেশি; সেজেগুজে জনসমক্ষে বেরতে সত্যের যত সময় লাগে ততদিনে মিথ্যা দুনিয়ার অর্ধেক চষে ফেলে। সেই প্রবল গতিই আমাদের আদরণীয়, শুভস্য শীঘ্রম! অথচ জ্ঞানতপস্বী বিজ্ঞানীদের কাছে শুভস্য ধৈর্যম! প্রচারের গতিবেগ, সংখ্যার মাহাত্ম্য, এসব নিয়ে তাঁরা নিরুত্তাপই থাকেন।

শুধু নিরুত্তাপ না, বিজ্ঞান গবেষণার যেসব নিয়মকানুন আর তরিকা সমৃদ্ধসভায় অনুমোদিত সেদিকেও অনেকের তেমন মনোযোগ থাকে না। আবিষ্কারের ইতিহাসে তার প্রমাণও অজস্র। সামান্য কিছু ছাড়া, বেশিরভাগ আবিষ্কারই প্রথাগত বিজ্ঞানের ব্যাকরণ অথবা সিলেবাস-সম্মত ধারাপাত মেনে ঘটেনি; ঘটেছে অপ্রত্যাশিত ঘটনাচক্রে, প্রতিষ্ঠিত নিয়মকে অগ্রাহ্য করে। দ্রষ্টব্য এই যে, তাতে বিজ্ঞানচর্চা আহত হয়নি; বরং অমন অমনোযোগিতায় বিজ্ঞানই আরও সমৃদ্ধ হয়েছে।এসব থেকে আমাদের মতো দরকচা মারা লোকজনের না হোক, বিজ্ঞানচর্চায় যাঁরা নতুন প্রজন্মের পথিক তাঁদের পক্ষে কিছু ভাবনার রসদ আছে। তা হল, বিজ্ঞান মানেই প্রশ্ন তোলা, মনে সংশয় জাগলে প্রথা, পুঁথি আর প্রতিষ্ঠানকেই যে বারবার কাঠগড়ায় তোলা উচিত, এই সারকথাটুকু আত্মস্থ করা। ‘পারদর্শীরা যে অজ্ঞ হতে পারেন এই বিশ্বাসের নামই বিজ্ঞান’।

কথাগুলো পুরনোই; তবু নতুন করে মনে পড়ে, এক-একটা সংকটকালে নতুন করে ভাবতে হয়। এখন চলছে তেমনই এক সংকটকাল, করোনাসংকট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে বলেছে, জনস্বাস্থ্যের সংকট; বিচিত্র রাষ্ট্রের অতি বিচিত্র অধিনায়করাও সে-কথার প্রতিধ্বনি করেছে, পারিষদবর্গও বলেছে ‘তার শতগুণ’। কিন্তু জনস্বাস্থ্য মানে কি চিকিৎসা, সাজানো-গোছানো হাসপাতাল, নাকি কোমরের মাপ, রক্তে কোলেস্টেরল আর শর্করার পরিমাণ, নাকি শরীরে জীবাণুর সন্ধান? এ সব তো বাহ্য; বরং জনস্বাস্থ্য মানে আসলে জনমানুষের চেতনা, তার অধিকার, কৃষ্টি, তার জীবনযাপনের সুলুক। তাই দুনিয়া জুড়ে জনস্বাস্থ্যের সংকট মানে, দুনিয়া জুড়ে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতিরই সংকট। সব মিলিয়ে, সংকট আসলে সমাজবিজ্ঞানের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেকথা বলেনি; সেও তো একটা প্রতিষ্ঠান মাত্র। তার মানে, এ এক বহুমুখী সংকট। কেমন বহুমুখী তা গত দেড় বছরে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

অথচ যা ভাববার মতো কথা তা হল, কোনও বিজাতীয় ভাইরাস এই সংকট তৈরি করেনি। সংকট জন্ম নিয়েছে ভাইরাস নিয়ে আমাদের প্রতিক্রিয়ায়। এক যুগসন্ধিক্ষণে আমরা শুনলাম, এই ভাইরাস মরণের দূত; ওই ভয়াবহ আবির্ভাবের বার্তা শুনেই আমরা সন্ত্রস্ত হয়েছি। যারা ওই দুঃসংবাদ শোনালো তাদের হাতে পরিসংখ্যান ছিল; তাই আমরা একে অপরকে সন্ত্রস্ত করার যুক্তি খুঁজে পেয়েছি, গেল গেল রব তুলতে আমাদের বাধেনি। কিন্তু পরিসংখ্যানও এক বিজ্ঞান, সেই অঞ্চলে ভাড়াটেদের সঙ্গে জ্ঞাননিষ্ঠদেরও বাস; তাঁরা অচিরেই অন্য হিসেবপত্র দাখিল করে দেখালেন, সংক্রমণ অতিরিক্ত ছড়িয়েছে ঠিকই, তবে শতাংশের হিসেবে তার মারণ ক্ষমতা তেমন অতিরিক্ত না। তাঁদের হিসেবগুলো অগ্রাহ্য করা কঠিন। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বুলেটিনে এই তথ্যও ঝোলানো থাকল। তারও বয়েস হয়েছে, সবসময় ছেলেমানুষি তাকে মানায় না। তাই তুম্মো থাক, আম্মো থাকি! শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।

কিন্তু আমাদের মনে শান্তি নেই, কেননা তার পর থেকে বিচিত্র, অলীক কুনাট্য আমরা দেখতেই থাকলাম, দেখতে বাধ্য হলাম। একটা অতি-সংক্রমণ ঘটে গেলে কী কী করা যায়, শ্বাসতন্ত্রীয় ভাইরাসের সঙ্গে কীভাবে বোঝাপড়া করা যায়, কীসে হিতে বিপরীত হতে পারে তার সমূহ বিবরণ, অভিজ্ঞতা বিজ্ঞানী সমাজের কাছে ছিল, চিকিৎসক সমাজের অধীত বিদ্যাতেও। অথচ আমরা সবিষ্ময়ে দেখলাম, শুনলাম যে, এমন ‘নভেল’ কুকাণ্ড নাকি আগে কোনওদিন ঘটেনি; তাই পুরনো পাঠ পরিত্যাজ্য, এখন শুরু হবে নতুন পাঠ। জানলাম, এই নতুন পাঠ কম্পিউটার থেকে জাত, তাই হাতে গরম, কঠোর কঠিন বিজ্ঞান। এও জেনে ফেললাম যে, এখন চলছে ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের’ যুগ; এই যুগে যা যা ব্যতিক্রম বলে এতকাল ভাবতাম তাই হয়ে যাবে অতি স্বাভাবিক, ‘নিউ নর্মাল’। অতএব লকডাউন, মুখোশ, পারস্পরিক দূরত্ব, ডিজিটাল বাল্যশিক্ষা, ইত্যাদি সবই এখন ‘নর্মাল’।

আমাদের অবশ্য কম্পিউটারে আপত্তি নেই, সে তো প্রযুক্তির সন্তান আর প্রযুক্তিও বিজ্ঞানের সন্তান। নতুন শিক্ষায় অবগাহনেও আমাদের আলস্য নেই; কিন্তু শিক্ষা আর বিজ্ঞানের মূল কথাই যে প্রশ্ন, তার কী হবে? দেখা গেল, চারদিক থেকে প্রশ্ন গজিয়ে উঠছে, নানান প্রশ্ন, নানান সন্দেহ, নানান তর্ক। ভাইরাসটা কি সত্যিই প্রাকৃতিক, কী তার উৎস, কে তার বাহন... নাকি কোনও গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে তৈরি, লৌহকপাট থেকে অসাবধানতায় বেরিয়ে আসা? কীসে এই ভাইরাস এত ‘নভেল’? তার জিনচরিত্রে, জিন-এর কাঠামোয়? জিন-কাঠামোয় অদলবদল কি ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা? অমন দুর্ঘটনায় সত্যিই কতজন বিপদে পড়েন, তারা কারা, কেন? এর বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার শক্তি আমাদের শরীরে নেই? তাহলে বাকিরা পার পেয়ে যায় কেন, কীভাবে? আত্মরক্ষার কবচগুলো ধারণ করলে যে জনমানুষের সংকট আরও বাড়ে, অসাম্যও আকাশচুম্বী হয়ে যায়; তাতে কি ‘জনস্বাস্থ্য’ আরও সজীব হয়, না নির্জীব?

‘নতুন’ ভাইরাসের চিকিৎসাই বা অমন এলোমেলো, অগোছালো হয়ে গেল কেন? আমাদের চিকিৎসকদল কি অমনই অনভিজ্ঞ? জনস্বাস্থ্যের সংকটে জনস্বাস্থ্যবিদরা নিখোঁজ রইলেন, নব নব উন্মেষশালিনী প্রতিভার জন্ম ঘটে গেল; তাঁরা এমন এমন ক্ষণজন্মা যে, তাঁদের নিত্যনতুন প্রসবকাণ্ডে জনমানুষ দিশেহারা। ছাপোষা মানুষজন ভাইরাসের আকৃতি দেখলেন, জিন বুঝলেন, যাদুকরী অঙ্কের মহিমা শুনতে শুনতে কাছাখোলা হয়ে গেলেন। শুধু ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারলেন না, ‘পাগলা মোষে করলে তাড়া কেমন করে...’! বরং মুখোশ পরে শ্বাসতন্ত্রীয় ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচা যায়, এমন আজগুবি তথ্যের বিরুদ্ধে কাণ্ডজ্ঞান খাটাতে গিয়ে তাঁদের মন আরও প্রশ্নবাচী। সামনে পিছনে আর দুই পাশের পারস্পরিক দূরত্ব যে সামাজিক বৈষম্য, ঘৃণা, ছুতমার্গের নবজন্ম দিল তা দেখে তাঁরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অথচ বলা হল, এগুলোই নাকি বিজ্ঞান। তাহলে জনজীবনে সন্ত্রাস গড়ে তোলাই কি বিজ্ঞানের কাজ?

একথা ঠিক যে, বিজ্ঞানের উপাদানগুলো, বিজ্ঞান থেকে পাওয়া ধারণাগুলো জনমানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়। আধুনিক ইতিহাসে তার প্রমাণ যথেষ্ট। সেই প্রমাণগুলোই ক্রমশ আরও সবল, আরও প্রবল হয়ে উঠছে। যে-পদ্ধতিতে ‘কোভিড’ রোগনির্ণয় চলছে তা যে নির্ভরযোগ্য না সেকথা দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোই জানিয়েছিল। সংক্রমণ আর ব্যাধি যে এক কথা না তা ডাক্তারির বুনিয়াদি পাঠ; উপসর্গহীন মানুষের উপর রোগনির্ণয়ের পদ্ধতি ব্যবহার করা অন্যায্য, সেকথাও পাঠ্য বইয়ের উপদেশ। কিন্তু একটিমাত্র ভাইরাসের স্পর্ধায় আর তজ্জনিত কোলাহলে আধুনিক ডাক্তারি বিজ্ঞানের কয়েকশো বছরের অর্জিত অভিজ্ঞতা আর উপদেশগুলো সটান নিভৃতাবাসে চলে গেল কী করে, কেন? এই প্রশ্নগুলো উঠবে না? প্রশ্ন না উঠলে কীসের বিজ্ঞানচর্চা? সেই চর্চা থেকে এখন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে গেল যে, বিজ্ঞান দুই প্রকার - গণবিজ্ঞান আর কর্পোরেট বিজ্ঞান! দ্বিতীয়টির সরব হুহুঙ্কারে প্রথমটি নির্বাসিত হয়েছে, অথবা নিজভূমে পরবাসী।

এইভাবে কর্পোরেট বিজ্ঞানের যে মহাকাব্য রচিত হল তার কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম, আতংক। আতংকই এখন সর্বগ্রাসী। এই আতংককথার শেষ অঙ্কে এসেছে টিকার উপাখ্যান। যে-দাবিগুলো নিয়ে টিকার উদ্ভব তার সপক্ষে প্রমাণ নেই, তথ্য নেই। তাতে কী? বলা হল, প্রমাণ তৈরি হবে, তথ্য মজুত হবে; ততদিন মানুষের উপর টিকার ঢালাও যাচাইকর্ম চলবে। কিন্তু সে কি অনৈতিক না? কোনও রাষ্ট্রের হাতে শুধু টিকা কেন, কোনও মানুষের দেহের উপর কোনও ওষুধবিসুধেরই পরীক্ষানিরীক্ষার একচ্ছত্র অধিকার নেই; সেই অধিকার মানুষের নিজস্ব। হিটলারের জমানায় সেই অধিকার জাহান্নমে ছিল, তাই বন্দিদের উপর ভয়ংকর জিনচর্চার সমারোহ চলেছিল। কিন্তু তার পরে তো বিশ্বের বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসক সমাজ এই অধিকারের কথা ভেবেছেন, নিদান দিয়েছেন। আমরা তা ভুলতে যাব কেন? এই প্রশ্নের জবাবে বলা হল, ‘জরুরি’ অবস্থায়, ‘সীমিত’ আকারে যাচাইকর্ম চলুক।

অবস্থা কীসে এত জরুরি হল, আর সীমিত আকার মানেই বা কী? মরশুমি ফ্লু আমাদের বহুকালের চেনা; করোনা ভাইরাস তারই প্রতিবেশী। দংশন ক্ষমতা আর সংক্রমণ ক্ষমতায় তফাৎ থাকলেও, তুলনা যদি করতে হয় তাহলে এই দুই প্রতিবেশীর তুলনাই স্বাভাবিক। তাতে দেখা গেল, সংক্রমণ আর মৃত্যুর মাপকাঠি দিয়ে করোনার কপালে রাজটিকা এঁকে দেওয়ার পক্ষে তথ্য অপ্রতুল। সেই ঘাটতি কমাতে গিয়ে শুরু হল তথ্যের চাষ-আবাদ। এমনকী, রোগের সংজ্ঞা, মৃত্যুর কারণ নির্ধারণের নিয়মকানুন সবই বদলে গেল। একই সঙ্গে তুলনায় আনা হল গুটিবসন্ত, ইবোলা আর পোলিওকে। প্রথিতযশা আর জনচেতনার অভিভাবক ডাক্তাররাই অমন তুলনা টানলেন। আমরা ভাবতে বাধ্য হলাম, আলু আর আলুবোখরা, মাছ আর মাছরাঙা নিয়ে সুকুমার রায় কি ভুল বকেছিলেন! এই বিজ্ঞজনেরা কাণ্ডজ্ঞানকেও পরবাসে পাঠিয়ে, টিকার যাচাইকর্ম শুরু হতে না হতেই তার মহিমা প্রচার করে ফেললেন।

এমন মহাকাব্যের রচনা হল কেন, কীভাবে? তা নিয়ে বচসার চেষ্টা আছে, কিন্তু তা স্থায়ী হতে পারে না; কোনও অদৃশ্য, অপরিমেয় শক্তিধরের অন্তর্জালি কারসাজিতে বচসা নিমেষে স্তব্ধ হয়ে যায়, কঠোর নজরদারি চলে। এও ‘নিউ নর্মাল’ - পোষাকি নাম, কর্পোরেট সেন্সরশিপ। এ অবশ্য নতুন না। যা কিছু জনমনে ঘৃণার সঞ্চার করে, দেশের প্রতিরক্ষার পক্ষে বিপজ্জনক হয়, জনস্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে, সেই দুষ্কাণ্ড নিষিদ্ধ করে দেওয়া যায়। শক্তিধরের সেই হক আছে। কিন্তু কথা হল, এগুলো যদি দুষ্কাণ্ড হয় তাহলে একই কারণে শক্তিধরকেও অভিযুক্ত করার হক জনমানুষের আছে। গণতন্ত্রে সবচেয়ে বড় হক তো তারই। তার সংশয়, প্রশ্ন আর অভিযোগ নিষিদ্ধ হয়ে গেলে গণতন্ত্র কোন গুহাগহ্বরে? এই পরিস্থিতিতে আর এক অবধারিত প্রশ্ন, তাহলে সরকার চালায় কারা? নাগরিকরা, নাকি কর্পোরেট?

এই ‘নিউ নর্মাল’ যাপনকাব্যের রচয়িতা কর্পোরেট সাম্রাজ্যই, কখনও দৃশ্যমান কখনও অদৃশ্য। কর্পোরেট স্বাস্থ্যবিজ্ঞানই পারিবারিক চিকিৎসকদের অন্ত্যেষ্টি সেরেছে; তাঁরা জীয়মান থাকলে ভাইরাসের আতংক ছড়াত না, হাহাকারের প্লাবন ঘটত না। কর্পোরেট স্বাস্থ্য পরিষেবাই চিকিৎসাকে পুরোপুরি হাসপাতালমুখী করে দিয়েছে; এই ব্যবস্থাই নতুন নতুন অসুখের জন্ম দেয়। কর্পোরেট স্বাস্থ্যনীতিই গণবিজ্ঞানের কালজয়ী, জবরদস্ত যুক্তিগুলোকে বিদায় জানিয়েছে। আমরা এখন আপাদমস্তক তারই অধীনে; শিক্ষানীতি, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি আর রাজনীতির প্যাঁচপয়জার তারই নির্দেশে, তারই তর্জনীর ঈশারায় চলে। যেভাবে, যে-কারণেই হোক আমাদের পরিশীলিত, ‘বোদ্ধা’, ‘ভদ্র’সমাজ এখন তারই পদতলে, হেঁটমুণ্ড, ঊর্ধপদ। অসংগঠিত মজুরের দল, কলেজে না-পড়া, পারিশ্রমিকহীন শ্রমিকের দল যাঁরা দেশের উৎপাদনের অন্তত পঞ্চাশ শতাংশের অংশীদার, তাঁরা বিলীয়মান, কেননা করোনা তাঁদেরকে চায় না! উৎপাদনের নতুন নিয়মকানুন তৈরি হবে।

কোথায় পড়েছিলাম, জমিদার তার ভাগচাষীকে বলছে, জানিস, আমি তোকে সিকনির মতো আছাড় মারতে পারি! কর্পোরেট একই কথা বলে, তবে অমন প্রাকৃত ভাষায় না। সে বলে, হয় আমার কোলে বস নইলে তুমি পাতকী; কোলে রাখা না-রাখা অবশ্য আমার মর্জি। তারই মর্জি মেনে আমরা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধে’ নামলাম। তারপর শুনছি, টিকাকরণ পুরো না-হলে যুদ্ধে জয় আসবে না। তার মানে, আতংকের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। বললাম, শ্বাসতন্ত্রীয় ‘আরএনএ’ ভাইরাস কি টিকাকে রেয়াৎ করে? শুনলাম, চোপ, যুদ্ধ চলছে! তারপর শুনি, আজকের বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির নাকি এমন বিদ্যুৎগতি যে, দশ বছরের কাজ দশ মাসে করে ফেলতে পারে! এভাবেই নাকি নতুন টিকার আবির্ভাব, তাই তা নমস্য। কিন্তু বায়োলজির তো নিজস্ব চরিত্র, নিজস্ব গতিধারা আর গতিবেগ থাকে, তার কী হবে? নয় মাস দশ দিনের কৃৎকর্তব্য কি নয় দিনে সেরে ফেলা যাবে? উত্তরে অপার নীরবতা।

ভরসা পেয়ে বললাম, নতুন প্রযুক্তি যে অনন্য তা মানি; কিন্তু এখানে প্রযুক্তির চমৎকারী কোথায়? বরং করোনার জিনটিকা আবিষ্কারের পিছনে যে অন্তত দশ বছরের নিরলস, ব্যর্থ পরিশ্রম ছিল, পশুদের উপর পরীক্ষার ফলাফল যে ভয়ংকর ছিল, সেকথা সর্বসমক্ষে জানানো হল না কেন? শুনলাম, চোপ, যুদ্ধ চলছে, তাই তুমি নিষিদ্ধ! তারপর শুনলাম, হিসেব বলছে, টিকার কার্যকারিতা অভাবনীয়। কিন্তু ওই হিসেব তো আপেক্ষিক সংখ্যার কথা বলে; তাকে চরম সংখ্যায় অনুবাদ করলে যে কিছুই দাঁড়ায় না, তার বেলা? একজনকে করোনামুক্ত রাখতে যে দুশো থেকে আটশো জনকে টিকাগ্রস্ত করতে হবে, সেই হিসেবটা? টিকার নিরাপত্তা বুঝতে যে কয়েক বছরের প্রতীক্ষা, তা কি অদরকার? ...এইসব বচসা চলতে থাকলে অন্তত বিজ্ঞানচর্চা আরও ঋদ্ধ হতে পারত। কিন্তু সে-গুড়ে বালি। বরং তার উত্তরে আসে বিদ্রুপ... আপনি সমরাঞ্চলে সংশয় ছড়াচ্ছেন!

আমরা জানি, বিদ্রুপ করা কোনও কঠিন কাজই না, তার জন্য প্রতিভা লাগে না, শিক্ষাদীক্ষাও না; একটু মাথামোটা হলেই তা করা যায়। এও আমাদের জানা যে, কর্পোরেট প্রশ্রয়পুষ্ট সরকার অচিরেই তার স্বাতন্ত্র্য হারায়; তারপর শুধু তার ঠোঁটই নড়ে, মস্তিষ্ক নিরেট হয়ে যায়। আর আমরাও দ্বিতীয়বার পরাধীন হয়ে যাই। সেই স্তিমিত দীপালোকে, তখন শুরু হয় আমাদের দুশ্চিন্তিত পায়চারী। আমরা ভাবতে থাকি, একটা ভাইরাস কীভাবে দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলকে এক বিন্দুতে, এক লাইনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল? দেশপ্রেম? তখন মনে পড়ে, এ হল সংকটের মহিমা। এমন মহিমা নতুন না; নব্বুইয়ের দশকের গোড়ায় যখন নব উদারনীতিবাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হচ্ছিল, তখনও এরা কেউ কোনও প্রতিবাদ জানায়নি... প্রবল দেশপ্রেম! আর যারা কর্পোরেটের বিরুদ্ধে প্রশ্নপ্রবণ তারা কি দেশপ্রেমিক না? তাহলে ভাবতেই হয়, এই সংকট সত্যি কতটা প্রাকৃতিক!

এইভাবে এক বিপুল নির্মাণকাণ্ড চলছে। ডিজিটাল বা কম্পিউটার তার প্রধান উপাদান। তার আগমণে আমরা উচ্ছ্বসিত হয়ে একদিন ভেবেছিলাম, আলাদীনের দৈত্যকে পেয়ে গেছি, এখন যা চাই তাই পাব! তখন ভেবে উঠতে পারিনি যে, দৈত্য শুধু দিতেই আসে না, নিতেও আসে; নিতে নিতে আমাদের সর্বস্বান্ত করে দেয়, কাণ্ডজ্ঞান সমেত। হাতে থাকে শুধু ‘সভ্যতার ছিন্ন পত্রাবলী’। তাই আমরা আজকাল যুদ্ধের বিউগিল শুনে অতি-চঞ্চল হয়ে উঠি; ভাবি না যে, ‘যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা, যুদ্ধ মানেই আমার প্রতি তোমার অবহেলা’! এখন আর আমরা বুঝে উঠতে পারি না যে, জনস্বাস্থ্য মানে আসলে সমাজবিজ্ঞান; আর তা এমন কোনও পদার্থবিজ্ঞান না যে, গাছ থেকে আপেল শুধু মাটিতেই পড়বে। বরং সে এমন চলন পটীয়সী যে, তাকে বুঝতে গেলে দুয়ার খুলে বাইরে তাকাতে হয়। আমরা সেই ‘দুয়ার খুলে দেখিনি, ওই একটি পরমাদ ছিল’!

তবু মনে হয়, এই অমানিশার শেষ আছে। কোনও বীরের অপেক্ষায় থাকা আমাদের মুদ্রাদোষ। অথচ, ‘দুর্ভাগা সেই দেশ, যে-দেশে বীরের মর্যাদা নেই!’ - এই আক্ষেপ শুনে গ্যালিলেও বলেছিলেন, ‘না, দুর্ভাগা সেই দেশ, যে-দেশে বীরের দরকার হয়!’ নেতা আসে, নেতা যায়; প্রযুক্তি আসে, প্রযুক্তি যায়। কোনও বীরপুঙ্গব এদের নিয়তি নির্ধারণ করে না, করে নিরবিচ্ছিন্ন জনমানুষ। জনমানুষ জানে, কর্পোরেট যা কিছু নিষিদ্ধ করে দেয় আসলে তাই যথার্থ। তাই আজকের এই ‘ছিন্নভিন্ন অস্তিত্বের ক্লিষ্টগতি ভঙ্গী’ সম্বল করেও মাঝে মাঝে মনে হয়, একবার... শুধু একবার যদি সমস্বরে বলতে পারতাম, ‘ঝড় হয়ে গেছে কাল রজনীতে রজনীগন্ধাবনে’; এখন মিথ্যার সদম্ভ দাপট। তাই সত্যের দোহাই, ‘চলে এসো ঘরে পরবাসী’!

______________________________

দোহাইঃ
• Alex de Waal. Polity, New Pandemics, Old Politics: Two Hundred Years of War on Disease and its Alternatives. 1st Ed, April, 2021.
• Amitav Banerjee. Editorial. Science in the time of corona: That uneasy feeling.

https://www.mjdrdypv.org/article.asp?issn=2589-8302;year=2021;volume=14;issue=2;spage=115;epage=116;aulast=Banerjee
• Baruch Vainshelboim. Facemasks in the COVID-19 era: A health hypothesis. Medical Hypotheses 146 (2021) 110411
• Daniel Briggs, Anthony Ellis, Anthony Lloyd, Luke Telford. New hope or old futures in disguise? Neoliberalism, the Covid-19 pandemic and the possibility for social change. International Journal of Sociology and Social Policy. November 2020.
• Fiona Godlee, editor in chief, British Medical Journal. Covid 19: We need a full open independent investigation into its origins. BMJ 2021;374:n1721.

http://dx.doi.org/10.1136/bmj.n1721
• Giorgio Agamben. Where Are We Now? The Epidemic as Politics. Translated by Valeria Dani. Eris. Ebook, April, 2021.
• Harald Walach, Rainer J. Klement and WouterAukema. The Safety of COVID-19 Vaccinations—We Should Rethink the Policy. Vaccines 2021, 9, 693.

https:// doi.org/10.3390/vaccines9070693
• J.P.A. Ioannidis, S. Cripps and M.A. Tanner, Forecasting for COVID-19 has failed. International Journal of Forecasting (2020).
https://doi.org/10.1016/j.ijforecast.2020.08.004
• John PA Ioannidis. Editorial. Coronavirus disease 2019: the harms of exaggerated information and non-evidence-based measures. European Journal of Clinical Investigation. First published: 19 March 2020.
https://doi.org/10.1111/eci.13222 Citations: 106.
• Martin,Brian.2021.“CovidInformationStruggles.”SocialEpistemology. Review andReplyCollective10(7):16-26.

https://wp.me/p1Bfg0-60H
• Peter Doshi. Covid-19 vaccines: In the rush for regulatory approval, do we need more data? BMJ, 2021;373:n1244.
• Shane Neilson MD. The surgical mask is a bad fit for risk reduction. CMAJ, May 17, 2016, 188(8)
• মোগলবাটি। মঙ্গল সোম। সেরিবান। জানুয়ারি, ২০১৭।