আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২১ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

চারটি নতুন লেবার কোড এবং শ্রমিক স্বার্থ

কিংশুক সরকার


সাম্প্রতিক সময়ে চারটি নতুন লেবার কোডের প্রবর্তন করা হয়েছে। কোডগুলি নতুন হলেও যে শ্রম আইনগুলি নিয়ে এই নতুন লেবার কোড বানানো হল তা পুরানো। তবে অবশ্যই কোড তৈরি করার সময় বর্তমান আইনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে এই পরিবর্তনগুলি অধিকাংশ সময়ে শ্রমিক স্বার্থের পরিপন্থী। গত তিন দশকে উদার অর্থনীতি এবং বিশ্বায়নের ফলে সারা পৃথিবীতে শ্রমিকদের দর কষাকষির ক্ষমতাও অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। এই অবস্থায় শ্রম আইনের পুনর্বিন্যাস এবং নতুন চারটি লেবার কোডের প্রবর্তন আগামী সময়ে দেশের শ্রমের বাজারে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলতে চলেছে।

লেবার কোডের প্রণয়ন সর্বপরি শ্রম সংস্কারের একটি অংশ। শ্রম সংস্কার বিষয়টি গত প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন গণ মাধ্যমে চর্চার বিষয় হয়ে রয়েছে। বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের পর দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কারের মধ্যে শ্রম সংস্কারকে ধরা হয়েছে। মনে করা হয় উদার অর্থনৈতিক পরিবেশ এবং বিশ্বায়নের সাথে শ্রম সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। শ্রম সংস্কার ছাড়া অর্থনৈতিক সংস্কারের সুফল পুরোপুরি পাওয়া যাবে না, এই রকমই মনে করা হচ্ছে। এই রকম একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, বিশেষ করে নিয়োগকারী সংস্থা এবং কর্পোরেট দুনিয়া থেকে। শ্রম সংস্কারের বিষয়ে দুটি চিন্তাধারা উল্লেখ করা যায়। প্রথম চিন্তাধারা বহুল প্রচলিত যা মোটামুটি নিয়োগকারীদের ভাবনা চিন্তাকে গুরুত্ব দেয়।

নিয়োগকারী, বহুজাতিক এবং দেশীয় কর্পোরেট প্রতিনিধিরা মনে করেন শ্রম আইনের আমূল সংশোধন করা হলে বা কিছু অংশ বাদ দিলে আরও বেশি কর্মসংস্থান হবে। শ্রম আইনকে তারা আরও বেশিকর্মসংস্থানের অন্তরায় হিসাবে ধরেন। মালিকপক্ষ শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা চান। বাজারের গতিবিধি অনুযায়ী শ্রমিক নিয়োগ ঠিক করা হবে। কয়েকটি শ্রম আইনে যেমন শিল্প বিবাদ আইন ১৯৪৭-এ স্থায়ী শ্রমিক ছাঁটাই করার আগে সরকারী অনুমোদনের দরকার হয়। মালিকপক্ষ এইধরনের আইন যা শ্রমিকদের কিছুটা হলেও সুরক্ষা দেয়, সেগুলির কার্যকারিতা কমানোর জন্য শ্রম সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।

দ্বিতীয় চিন্তাধারা হল যারা বিশ্বাস করেন যে শ্রম আইন থাকা জরুরি কারণ মালিকপক্ষ সাধারণত শ্রমিকদের তাদের বিভিন্ন প্রাপ্তিগুলি থেকে বঞ্চিত করেন। শ্রমিকরা উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে যোগদান তাদের প্রাপ্তি সেই অনুযায়ী হওয়া উচিত। শ্রম আইনগুলিতে শ্রমিকদের স্বার্থ কিছুটা হলেও রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। শ্রমিক ইউনিয়নগুলিও শ্রম সংস্কার চায়, কিন্তু সেটা যেন শ্রমিক স্বার্থে হয়। বর্তমানে যেসব শ্রম আইন রয়েছে, সেগুলিতে যেইসব অধিকারের আইনি স্বীকৃতি রয়েছে, সেগুলি অনেক সংগ্রামের ফল। বেশ কিছু শ্রম আইন আর্ন্তজাতিক নীতিকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই শ্রম আইনগুলি থাকার যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে এমনই শ্রমিক ইউনিয়নগুলি মনে করে।

শ্রম সংস্কারের কিছু বিষয় নিয়ে অবশ্য কোনো বির্তক নেই। প্রথমত, অধিকাংশ শ্রম আইন পুরানো হয়ে গেছে। স্বাধীনতার সময়ে এই আইনগুলি প্রণয়ন করা হয়। বিশেষত ৫০ এবং ৬০- দশকের মধ্যেই এই আইনগুলির প্রণয়ন হয়। এখন সময়ের প্রেক্ষিতে এই আইনগুলি কিছুটা হলেও প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। এক্ষেত্রে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো বির্তক নেই, দ্বিতীয়ত শ্রম আইনের সংখ্যা বেশি হওয়ার জন্য নিয়োগকারী এবং শ্রমিক উভয়ের জন্যই অসুবিধের সৃষ্টি করে। একই বিষয়ের আইনগুলি এক জায়গাতে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা নিয়েও কোনো দ্বিমত নেই। তৃতীয়ত, গত তিন দশকে কাজের জগতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। কর্ম সংস্থানের রূপরেখা এবং কাজের পরিবেশের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। এই অবস্থায় শ্রম আইনগুলিকেও এই পরিবর্তনগুলির সাথে মানিয়ে নিয়ে সমসাময়িক করার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করা যাচ্ছিল।

তবে শ্রম সংস্কারের দাবি প্রধানত মালিকপক্ষ থেকেই করা হয়েছে। তবে মালিকপক্ষ সেভাবে শ্রম সংস্কারের রূপরেখা চেয়েছে, শ্রমিক ইউনিয়নগুলি সর্বদা সেটার বিরোধিতা করেছে। খুব সহজ কথায় প্রকাশ করলে মালিকপক্ষ শ্রমের বাজারকে আরও নমনীয় করতে চেয়েছে। বাজারের প্রয়োজন মতো শ্রমিক নিয়োগের স্বাধীনতা চেয়েছে। এক্ষেত্রে বলা যায় তেমন কোনো বড়ো শ্রম সংস্কার ছাড়াই গত তিন-চার দশকে শ্রমের বাজার চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের সংখ্যাক্রমাগত বেড়েছে আর স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে কমেছে।

শ্রম আইনের বাস্তবে কতটা প্রয়োগ করা গেছে সেই নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। আইন প্রণয়নের সময় যেসব শ্রমিক স্বার্থের কথা ভাবা হয়েছিল বাস্তবে তা অনেক ক্ষেত্রেই রক্ষা করা যায়নি। এর পেছনে শ্রমের বাজারে পারস্পরিক চাহিদা-যোগানের পার্থক্য বড়ো ভূমিকা পালন করেছে। দেশের শ্রমের বাজারে চাহিদার তুলনায় যোগান অনেক বেশি। এই অতিরিক্ত যোগান মজুরির উপর নিম্নমুখী চাপ তৈরি করে। এই অবস্থায় ন্যূনতম মজুরি আইন প্রণয়ন করাই মুশকিল হয়ে পড়ে। বাজার মজুরি ন্যূনতম মজুরি থেকে অনেক নিচে চলে যাওয়ার জন্য শ্রমিকরা কাজ পেলেও ন্যূনতম জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়ে। শ্রমিকরা কাজ পেলেও দারিদ্র সীমার উপরে উঠতে পারে না। শ্রমের বাজারের অবস্থা শ্রম আইনের কার্যকারিতার উপর বড়ো প্রভাব ফেলে।

শ্রমের বাজারে চাহিদা-যোগানের পার্থক্য ছাড়াও, শিল্প এবং সেবা ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণে কর্মসংস্থান না হওয়ার জন্য কৃষি ক্ষেত্রের উদ্বৃত্ত শ্রমিকরা কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। গত দুই দশকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বেশ ভালো হওয়ার পরও কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে গেছে। গ্রাম থেকে শহরে মানুষ কর্মসংস্থানের আশায় গেলেও অনেক ক্ষেত্রেই তাদের হতাশ হতে হয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য কোনোভাবে এই মানুষগুলি শহরের অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিজেদের জীবনযাপনের উপায় খুঁজে নিয়েছে। ফলস্বরূপ, অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে মোট শ্রমিক সংখ্যার ৯০ শতাংশের বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শ্রমের বাজারে চাহিদা-যোগানের অসাম্য আর কর্মসংস্থানের অভাব এই দুইয়ের যাতাকলে শ্রমিক শ্রেণির দর কষাকষির ক্ষমতা ক্রমাগত কমতে থাকে। ট্রেড ইউনিয়নগুলির সদস্য সংখ্যা গত দুই দশকে কমতে থেকেছে। অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থেকেছে। স্থাযী শ্রমিক নিয়োগের বদলে নানাভাবে শ্রমিক চুক্তির মাধ্যমে নিয়োগ হতে শুরু করে। এর সালে ১৯৯১ সালে শুরু হওয়া আর্থিক উদারীকরণ পরে মালিক পক্ষের দিক থেকে শ্রম সংস্কারের দাবি জোরালো হতে থাকে। মালিকপক্ষ শ্রম সংস্কারের নামে আসলে শ্রম আইনগুলিকে আরও বেশি শিথিল করার জন্য বিভিন্ন ত্রিপাক্ষিক স্তরে জোরালো দাবি করতে থাকে। এর সাথে সার্বিক চর্চার মাধ্যমে এই ধারণা তৈরি করা হয় যে শ্রম আইনের শিথিলতা জরুরি কর্মসংস্থানের বৃদ্ধির জন্য। গত দশকের শুরুর দিকে শ্রম আইনের প্রণয়নের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষকে সুবিধা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় যা EoDB (Ease of Doing Business) নামে পরিচিত। বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে এই বিষয়ে প্রতিযোগিতাও শুরু হয়। EoDB সূচকে প্রথমের দিকে স্থান পাওয়ার জন্য রাজ্যগুলি চেষ্টা চালাতে থাকে।

এই প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালে নতুন চারটি লেবার কোড প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২৯ শ্রম আইনকে চারটি কোডের মধ্যে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হয়। এই চারটি কোড হল - শ্রম, সামাজিক সুরক্ষা, শিল্প সম্পর্ক এবং কাজের সুরক্ষা এবং পরিবেশ। এর মধ্য়ে মজুরি কোড ২০১৯ সালে আইনে পরিণত হয়। বাকী তিনটি কোড ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আইনে পরিণত হয়। বর্তমানে এই চারটি কোডের রুল বা নিয়মাবলী তৈরির কাজ চলছে। মনে করা হয়েছিল চলতি বছরের এপ্রিলে এই চারটি নতুন কোড কার্যকরী করা হবে। তবে রাজ্যগুলি এখনও নিয়মাবলী তৈরির কাজ শেষ করে উঠতে পারিনি, তাই আপাতত কোডগুলি কার্ষকরী করা হলো না। নিয়মাবলী তৈরির কাজ শেষ হলেই কোডগুলির প্রণয়ন শুরু হবে।

এখন দেখা যেতে পারে এই চারটি নতুন লেবার কোডে শ্রমিকদের স্বার্থ কতটা রক্ষা করা গেছে। প্রথমে মজুরি কোড ২০১৯ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। মজুরি কোডের একটি ভালো দিক হচ্ছে এই কোডে যে ন্যূনতম মজুরির কথা বলা হয়েছে সেটি সমস্ত পেশার শ্রমিকদের জন্য লাগু হবে। বর্তমানে ন্যূনতম মজুরি পেশাভিত্তিক ঘোষণা করা হয়ে থাকে। নতুন কোডে পেশাভিত্তিক ঘোষণা আর বাধ্যতামূলক রইল না। সমস্ত পেশার শ্রমিকই ন্যূনতম মজুরির সুবিধা পাবেন। সময়ে মজুরি দেওয়ার বাধ্যবাধকতা, বোনাস ইত্যাদির বর্তমান আইনি ব্যবস্থাকে নতুন কোডে বহাল রাখা হয়েছে। সম কাজের জন্য স্ত্রী-পুরুষ সমান মজুরির পাওয়ার আইনি স্বীকৃতিও নতুন কোডে রাখা হয়েছে। এগুলি মজুরি কোডের ভালো দিক। তবে বেশ কয়েকটি বিষয় আছে এই মজুরি কোডে যেখানে শ্রমিক স্বার্থ খর্ব হতে পারে।

কাজের সময় এখনকার মতো দিনে ৮ ঘন্টাই রাখা হয়েছে। কিন্তু সব মিলিয়ে নিয়োগকারী একজন শ্রমিককে কর্মক্ষেত্রে ১২ ঘন্টা পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে। এর ফলে একটা সম্ভাবনা থেকেই যায় যে, যেখানে তিনটে শিফটে কাজ হয় সেখানে দুটো শিফটেই কাজ হয়ে যাবে। ন্যূনতম মজুরি ৮ ঘন্টা ধরে ধার্য করা হয়। কিন্তু এই মজুরি কোডের অপব্যবহারে এমন হতেই পারে যে শ্রমিককে ৮ ঘন্টার বদলে ১২ ঘন্টা কর্ম ক্ষেত্রে অতিবাহিত করতে হতে পারে।

ন্যূনতম মজুরি ধার্য করার ক্ষেত্রে ২৭০০ ক্যালরিকে ন্যূনতম প্রয়োজন মনে করা হয়েছে। ন্যূনতম মজুরি একটি পরিবার ভিত্তিক ধারণা এবং এক্ষেত্রে চারজন সদস্যের পরিবার অনুমান করা হয়েছে। কিন্তু মজুরি হিসেব করার সময় ৪-এর বদলে পরিবার কে ৩ ধরা হয় কারণ স্ত্রী এবং ২টি বাচ্চার ক্যালরির প্রয়োজন পুরুষের তুলনায় কম ধরা হয়। পুরুষের জন্য ১ ধরা হলেও মহিলার জন্য ৮ ধরা হয়। কিন্তু মহিলার জন্য এই কম ধরার পেছনে কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ দর্শানো হয়নি। এই বিষয়কে অবশ্যই লিঙ্গ বৈষম্য ধরা যেতে পারে। বর্তমানেও এই প্রথা চলছে। আশা করা হয়েছিল নতুন মজুরি কাজের এই অবস্থার সংশোধন হবে কিন্তু সেটা হয়নি। মজুরি ধার্য করার ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য পরোক্ষভাবে রয়েই গেছে।

মজুরি কোডে আরেকটি বিষয় সরাসরি উল্লেখ করা থাকলে, দেশের শ্রমের বাজারের বেশ কিছু বৈষম্য একসাথে দূর করা যেত,'সমান কাজের জন্য সমান মজুরি'- এই বিষয়ের সরাসরি উল্লেখ থাকলে মালিকপক্ষের অস্থায়ী অসংগঠিত শ্রমিক নেওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যেত। নিয়োগকারীরা অসংগঠিত, অস্থায়ী শ্রমিক নেন, কারণ তাদের জন্য ব্যয় কম হয়। স্থায়ী শ্রমিকের খরচ অসংগঠিত অস্থায়ী শ্রমিকের খরচ থেকে অনেকটাই বেশিকারণ স্থায়ী শ্রমিকদরে ক্ষেত্রে বেশ কিছু শ্রম আইন প্রযোজ্য হয়, যেটা অসংগঠিত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে হয় না। শ্রমিকের ব্যয় কমানোর জন্যেই সাধারণত মালিকপক্ষ অসংগঠিত শ্রমিক নিয়োজন করেন। কিন্তু সমকাজের জন্য সমান মজুরির সরাসরি উল্লেখ থাকলে নিয়োগকারীদের অস্থায়ী অসংগঠিত শ্রমিক নেওয়ার আর্থিক বা অন্য কোনোযৌক্তিকতা থাকত না। নতুন কোডে আশা করা হয়েছিল সমস্ত ধরনের শ্রমিকদের কাজ অনুযায়ী সমান মজুরি পাওয়ার অধিকার দেওয়া হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক সময়ের রায় সমান কাজের সমান মজুরি দেওয়াকে স্বীকৃতিও দেয়। কিন্তু নতুন মজুরি কোডে প্রত্যক্ষভাবে এই বিষয়ের অন্তর্ভুক্তিকরণ হয়নি।

সামাজিক সুরক্ষা কোড ২০২০-তে বর্তমানে থাকা নয়টি সামাজিক সুরক্ষা আইনকে একসাথে আনা হয়েছে। বর্তমানে যে সামাজিক সুরক্ষা আইন রয়েছে যেমন প্রভিডেন্ড ফান্ড, ই-এস আই, গ্রাচুইটি বা মাতৃত্বকালীন সুবিধার আইন সব-ই সংগঠিত ক্ষেত্রে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, যেসব সংস্থায় ১০ বা তার বেশী শ্রমিক/কর্মচারী রয়েছেন, এই আইনগুলি শুধু সেখানেই প্রযোজ্য। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা সামাজিক সুরক্ষার আইনি সুবিধা প্রায় পায় না বললেই চলে। বাস্তবে অসংগঠিত শ্রমিকদের সংজ্ঞা ঠিক করা হয় সামাজিক সুরক্ষা পাওয়া না পাওয়ার ভিত্তিতে।যেই শ্রমিক সামাজিক সুরক্ষা পায়, তাদের সংগঠিত ক্ষেত্রের মনে করা হয়। বাকি যারা এই সুবিধা পান না, তাদের অসংগঠিত ক্ষেত্রের ধরা হয়ে থাকে।

সংগঠিত অসংগঠিত শ্রমিকের এই পার্থক্য নতুন সামাজিক সুরক্ষা কোডে বিদ্যমান। প্রভিডেন্ড ফান্ড, মাতৃত্বকালীন সুবিধা এবং গ্র্যাচুইটির ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষা শুধুমাত্র সংগঠিত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। ইএসআই-এর সুবিধা কিছুটা সার্বজনীন করা হয়েছে। মালিকপক্ষ এবং ইউনিয়ন চাইলে ছোট সংস্থার জন্যও ইএসআই-এর সুবিধা দেওয়া হবে। নতুন সামাজিক সুরক্ষা কোডে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের একটা চেষ্টা করা হয়েছে। অসংগঠিত শ্রমিকদের কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা প্রণীত পোর্টালে অনলাইন নথিভুক্তকরণের কথা বলা হয়েছে। অসংগঠিত শ্রমিকরা নিজেরাই স্ব-ঘোষণার মাধ্যমে নথিভুক্ত হতে পারেন। এক্ষেত্রে আধার কার্ড থাকা বাধ্যতামূলক। অসংগঠিত শ্রমিকদের একটা বড় অংশ স্বনিয়োজিত পেশার সাথে যুক্ত। তাদেরকে এই নথিভুক্তকরণের আওতায় আনা হয়েছে।

অসংগঠিত শ্রমিকের কিছু সামাজিক সুরক্ষা যেমন পেনশন, মৃত্যুকালীন সাহায্য, মাতৃত্বকালীন সুবিধা এগুলি কেন্দ্রীয় সরকার প্রদান করবে। বাকি সামাজিক সুরক্ষা যেমন কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, প্রভিডেন্ড ফান্ড, চিকিৎসা এবং শিক্ষাজনিত সাহায্য, অন্তেষ্টির জন্য খরচ ইত্যাদি রাজ্য সরকারের দ্বারা দেওয়া হবে। অর্থাৎ একজন অসংগঠিত শ্রমিকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সেই শ্রমিক যদি কেন্দ্রীয় পোর্টালে না নথিভুক্ত করে তাহলে সামাজিক সুরক্ষার কিছু অংশ কেন্দ্রীয় সরকার এবং কিছু অংশ রাজ্য সরকারের কাছ থেকে পাবে।

সামাজিক সুরক্ষা কোড ২০২০-তে অসংগঠিত শ্রমিকদের সাথে নিম্ন এবং প্লাটফর্ম শ্রমিকদের জন্য সামজিক সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। যেসব শ্রমিক অ্যাপ বা অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে কাজের সুযোগ পান সেইসব শ্রমিকরা এই বিশেষ শ্রেণির অংশ। উদাহরণস্বরূপ, উবের চালক, জোমাটো ডেলিভারি বয় এর কথা বলা যেতে পারে। এগুলি সবই নতুন ধরনের কর্মসংস্থান যেখানে বেশির ভাগ সময় মালিক শ্রমিক সম্পর্ক স্থাপন করা দূরূহ। গত এক দশকে এই ধরনের শ্রমিকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। সামাজিক সুরক্ষা কোডে এই শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কেন্দ্রীয় সরকার দেবে বলে বলা হয়েছে।

এক্ষেত্রে এটা বলা জরুরি যে প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক সুরক্ষা যেটা সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা পেয়ে থাকেন তার সাথে সরকারের দেওয়া সমাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে যা সাধারণত দেওয়া হয়ে থাকে তার গুণগত পার্থক্য আছে। প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক সুরক্ষা শ্রমিকের অধিকারের মধ্যে পড়ে। আর সরকার চালিত সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে অসংগঠিত শ্রমিকদের যে সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া হয়, সেটা অনেকটা সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রকল্পের মধ্যে পড়ে। শ্রমের অধিকার এবং সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে গুণগত পার্থক্য রয়েছে। যেমন মাতৃত্বকালীন সুবিধা মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা আইন (বা নতুন কোডে একটি অধ্যায়) অনুযায়ী ২৬ সপ্তাহের সবেতন ছুটি আরও কিছু সুবিধা দেওয়া হয়। আর অন্যদিকে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে যে মাতৃত্বকালীন সুবিধার কথা বলা হয়েছে সেখানে শ্রমিকরা কিছু আর্থিক সহায়তা পান।এই আর্থিক সহায়তা কখনই শ্রমিকের অধিকারের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে না। ২৬ সপ্তাহের সবেতন ছুটি কখনই কিছু আর্থিক সাহায্যের সাথে তুলনীয় নয়।

দেশের শ্রমিকের ৯০ শতাংশের বেশি অসংগঠিত ক্ষেত্রে রয়েছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক সুরক্ষা কেবলমাত্র সংগঠিত শ্রমিকরাই পান। আশা করা হয়েছিল যে নতুন সমাজিক সুরক্ষা কোডে সামাজিক সুরক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসাবে গণ্য করে সার্বজনীন করা হবে যাতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরাও এর সুবিধে পান। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা কোডে অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য সরকারী উদ্যোগে কিছু সামাজিক সুরক্ষার যাকে সামাজিক আর্থিক সাহায্য বলা যায় তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক সুরক্ষা অধরাই থেকে গেছে।

প্রশ্ন এটা থেকে যায় যে বিপুল সংখ্যক অসংগঠিত শ্রমিকদের (পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় ৪৫ কোটি) স্থায়ীভাবে সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা করা হয়েছে কিনা। এই বিষয়ে সামাজিক সুরক্ষা কোডে কিছু বলা হয়নি। আর্থিক প্রণিধানের বিষয়টি উহ্য থেকে গেছে। পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে ২০০৮ সালে অসংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার জন্য একটি আইন তৈরি হয়। সেই আইন অনুযায়ী রাজ্যগুলিকে সামাজিক সুরক্ষা বোর্ড তৈরি করা হয়েছে এবং গত ১২ বছরে এই বোর্ডগুলি থেকে অংসগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য কিছু কিছু সামাজিক সুরক্ষা আইনি সাহায্য হিসাবে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২০০৮ সালের এই আইনের দ্বারা খুব বেশি সংখ্যক শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা যায়নি। কিছুটা সাফল্য হয়ত নির্মাণ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে, কিন্তু সেক্ষেত্রে আলাদা আর্থিক উৎস ছিল। নির্মাণ ক্ষেত্রে বিশেষ সেস ধার্য কার আছে এবং সেস থেকে সংগৃহীত অর্থ থেকেই নির্মাণ শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও সেস সংগৃহীত অর্থ পুরোপুরি ব্যবহার করা যায়নি, এমনটি মনে করা হয়। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করেছে।

সব মিলিয়ে এটা বলাই যায় যে আর্থিক অনুদান হিসাবে সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার যে চেষ্টা হয়েছিল ২০০৮ সালে তৈরি হওয়া আইন দিয়ে, তা খুব একটা সফল হয়নি। অধিকাংশ শ্রমিক এই সুরক্ষার বাইরে রয়ে গেছে, এমনকি যেখানে অর্থের কোনো অভাব ছিল না সেই নির্মাণ শিল্পের শ্রমিকদের পুরোপুরি সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হয় নি। ২০০৮ সালের এই আইনটি সামাজিক সুরক্ষা কোডে সম্পৃক্ত করা হয়েছে এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি একই নীতিতে প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু পূর্বের অভিজ্ঞতা মোটেই ভালো নয়। ভালো হত যদি অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্যও প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক সুরক্ষা দেওযা যেত এই নতুন কোডে। এর ফলে মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের পুনর্নবীকরণের সম্ভাবনা বাড়ত এবং সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার যে দায়িত্ব মালিক পক্ষের থাকে তা কিছু হলেও প্রতিষ্ঠা করা যেত। অসংগঠিত ক্ষেত্রের কিছুটা হলেও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি মিলত। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে সামাজিক সুরক্ষা কোড ২০২০-তে এই লক্ষ্য বাস্তব রূপ পায়নি।

শিল্প সম্পর্ক কোড ২০২০-তে বর্তমানের তিনটি শিল্প সম্পর্কিত আইনকে একত্রিত করা হয়েছে। এই কোডে বেশ কিছু বিষয় রয়েছে যার ফলে দেশের শ্রমের বাজারে আগামী সময়ে সূদুরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। মালিকপক্ষের শ্রম সংস্কারের বিষয়ে যে মূল দাবি শ্রমের বাজারে নিয়োগ সংক্রান্ত আইনি ব্যবস্থা আরও শিথিল করা, সেটি অনেকাংশে এই কোডে বাস্তবায়িত হয়েছে। মালিকপক্ষ বাজারের গতিবিধি অনুযায়ী শ্রমিক নিয়োজনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা চান। এই কোডে বলা হয়েছে যে, ২০০ জন শ্রমিক কাজ করেন এমন সংস্থায়, শ্রমিক ছাঁটাই বা সংস্থা বন্ধ করার জন্য সরকারের কাছ থেকে কোনো অনুমোদন লাগবে না। শুধুমাত্র যেসব সংস্থাতে ৩০০ বা তার বেশি শ্রমিক কাজ করেন সেই ক্ষেত্রেই এই অনুমোদন লাগবে। বর্তমান শিল্প সম্পর্ক আইনের নিরিখে অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা ১০০ বা তার বেশি শ্রমিক রয়েছেন এমন সংস্থার জন্য লাগু ছিল। নতুন কোডে সেই সংখ্যা ১০০ বেড়ে হল ৩০০। এর ফলে শ্রমের বাজার অনেকাংশেই নমনীয় হল যেটা মালিকপক্ষ চাইছিলেন। কাজের সুরক্ষা অনেকাংশে কমল।

একইভাবে সরকারী অনুমোদন প্রাপ্ত কর্মক্ষেত্রের নিয়মাবলীর প্রয়োজনীয়তা বর্তমানে ১০০ বা তার বেশি শ্রমিক যেখানে কাজ করেন সেখানে প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু নতুন কোডে সেটার পরিবর্তন করে ১০০ থেকে ৩০০ করা হয়েছে। এর ফলে ৩০০-এর কম শ্রমিক কাজ করেন এমন সংস্থার কর্মক্ষেত্রের নিয়মাবলীর ক্ষেত্রে আর কোনো সরকারী অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না। ২৯৯ জন কাজ করেন এমন সংস্থায় কোনো অনুমোদিত কাজের নিয়মাবলী থাকার প্রয়োজন থাকবে না। নিয়মাবলী না থাকলে সম্ভাবনা থেকে যায় যে শিল্প সংঘাতের ক্ষেত্রে শ্রমিক স্বার্থ বিঘ্নিত হবে। নিয়মাবলী অনেকাংশেই শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা করে। নিয়মাবলী না থাকলে মালিকপক্ষ নিজেদের ইচ্ছে মত নিয়ম বানিয়ে নেন। শিল্প সম্পর্কে ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা থেকে যায়।

নতুন শিল্প সম্পর্ক কোড ২০২০-তে ট্রেড ইউনিয়নের সামগ্রিক দর কষাকষির ক্ষমতার উপর যথেষ্ট রাশ টানার চেষ্টা করা হয়েছে। যদি ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যাকারখানায় কর্মরত শ্রমিকের ৫১ শতাংশ বা তার বেশি হয়, তাহলে সেই ট্রেড ইউনিয়নকেই একমাত্র দর কষাকষির এজেন্ট মানা হবে। অন্য ট্রেড ইউনিয়ন থাকলেও তারা মালিকপক্ষ বা ত্রিপাক্ষিক দর কষাকষিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এর ফলে ট্রেড ইউনিয়নগুলি সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কোনো একটি সংস্থায় ট্রেড ইউনিয়নের গঠন এবং বৃদ্ধি হতে সময় লাগে। প্রথমে ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা কম থাকে, ধীরে ধীরে যেমন সেই ইউনিয়নটি শ্রমিক স্বার্থে কাজ করে, তার সদস্য সংখ্যা সেই হারে বাড়ে, নতুন কোডে ৫১% সদস্য থাকলেই নিরঙ্কুশ যৌথ দর কষাকষিতে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে নতুন ইউনিয়ন উঠে আসতে অসুবিধের সম্মুখীন হবে। বর্তমানে যেসব অপেক্ষাকৃত বড় ট্রেড ইউনিয়ন আছে তাদের সুবিধে হবে। এমন সম্ভাবনাও থাকবে যেখানে মালিকপক্ষের মদতে তৈরি ট্রেড ইউনিয়ন তার আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হবে কারণ নতুন ট্রেড ইউনিয়ন যাদের সদস্য সংখ্যা কম তারা যৌথ দর কষাকষিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। সময়ের সাথে এই ছোট ট্রেড ইউনিয়নগুলির স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। উদার অ্রথনীতি, সাপ্লাই চেন, শ্রমের বাজারে ভারসাম্যহীনতা, ক্রমাগত জাতীয় আয়ে মজুরির অংশ কমা ইত্যাদি নানা কারণে ট্রেড ইউনিয়নগুলি গত তিন দশকে দুর্বল হয়েছে। নতুন শিল্প সম্পর্ক কোড ২০২০ এই প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করবে।

শিল্প সম্পর্ক কোড ২০২০-তে ধর্মঘট এবং লক-ডাউন করার জন্য নোটিশ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ধর্মঘট বা লক আউট করতে হলে ৬০ দিনের নোটিশ দিতে হবে। নোটিশ দেওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে ধর্মঘট বা লক-আউট করা যাবে না। এর ফলে আইন-সম্মত ধর্মঘট বা লক-আউট করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। ধর্মঘটের নোটিশ দিলে স্বভাবতই শালিশী বৈঠক শুরু হবে এবং শালিশী বৈঠক চলাকালীন ধর্মঘট বা লক-ডাউন আইন অনুযায়ী করা যায় না। বর্তমান আইনে অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্র ছাড়া, ধর্মঘট করার জন্য কোনো নোটিশ দিতে হয়না। নতুন কোড চালু হলে নোটিশ দেওয়া বাধ্যতামূলক হবে এবং আইনসম্মত ধর্মঘট করা সম্ভব হবে না। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ায় গত দুই দশকে ধর্মঘট অনেকটাই কমে গেছে। কিন্তু দিনের শেষে, যখন কোনো উপায় থাকে না, তখন ট্রেড ইউনিয়ন সাধারণত ধর্মঘটের দিকে যায়। নতুন কোড চালু হলে, ট্রে়ড ইউনিয়নগুলির কাছে এই শেষের সম্বল আর প্রায় থাকবে না বললেই চলে।

পেশাগত সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজের পরিবেশ সংক্রান্ত কোড ২০২০তে বর্তমানের ১৩টি শ্রম আইনকে একত্রিত করা হয়েছে। এই কোডে সমস্ত সংস্থার, সংগঠিত এবং অসংগঠিত, বাধ্যতামূলক নথিভুক্তকরণের কথা বলা হয়েছে।

সেই সঙ্গে সমস্ত শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দেওয়াও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফ্যাক্টরিতে রাতের শিফটে শর্ত সাপেক্ষে মহিলা শ্রমিক নিয়োগের অধিকার দেওয়া হয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকের সংস্থার সম্প্রসারণ করা হয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিক বর্তমানের শ্রম আইন অনুযায়ী তারাই যারা কনট্রাক্টরের মাধ্যমে অন্য রাজ্যে কাজ করতে যায়। এই সংক্রান্ত আইনটি সত্তর দশকের। সেই সময়ের পর মাইগ্রেশনের গতি প্রকৃতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এখন পরিযায়ী শ্রমিকরা প্রধানত নিজেরাই অন্য রাজ্যে কাজ করতে যান। অনেকক্ষেত্রে তারা শিল্প বা সার্ভিস সেক্টরে কাজ না পেয়ে স্বনিয়োজিত ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক কাজে লিপ্ত হন। এই সমস্ত পরিযায়ী শ্রমিকরাই গত বছর কোভিডের কারণে হওয়া লক ডাউনের সময় অশেষ কষ্টের মধ্যে পড়েছিলেন। জীবিকা তো হারিয়েছিলেন তার সাথে সাথে তাদের ঘরে ফিরে যেতে হয়েছিল। পরিযায়ী শ্রমিকদের কাছে শহরে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় বাড়ি ভাড়া দেওয়ার টাকা ছিল না। পরিযায়ী শ্রমিকরা গণবন্টন ব্যবস্থার সুবিধাও পাননি। সরকারের কাছে পরিযায়ী শ্রমিকদের কোনো গ্রহণযোগ্য পরিসংখ্যানও ছিল না। এই সব কিছু থেকে শিক্ষা নিয়ে এই নতুন কোডে পরিযায়ী শ্রমিকের সংজ্ঞার সম্প্রসারণ করা হয়েছে এবং তাদের জন্য এই নতুন পোর্টালে অনলাইন নথিভুক্তকরণের কথাও বলা হয়েছে।

তবে এই নতুন কোডের প্রধান অসুবিধে হল এই কোড সেইসব সংস্থার জন্য প্রজোয্য হবে যেখানে ১০ বা তার বেশি শ্রমিক কাজ করেন। এর অর্থ হল যেখানে ১০-এর কম শ্রমিক কাজ করেন সেখানে সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজের পরিবেশের ব্যাপারে কোনো আইনের অনুশাসন থাকবে না, এর ফলে ছোট সংস্থাতে কর্মরত শ্রমিকদের কর্মস্থলে সুরক্ষার বিষয়টি প্রশ্ন চিহ্নের মুখে পড়বে। কর্মস্থলে কাজের সুরক্ষার বিষয়টি একটি মৌলিক অধিকার। কতজন শ্রমিক একটি সংস্থাতে কাজ করেন তার উপর সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজের পরিবেশের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আইনি সুরক্ষার সম্পর্ক থাকার কথা নয়। এইসব বিষয়ে আইনি অনুশাসন সার্বজনীন হওয়া উচিত। কিন্তু এই নতুন কোডে প্রায় সমস্ত, অসংগঠিত ক্ষেত্রের সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজের পরিবেশ সংক্রান্ত আইনি অনুশাসন অনুপস্থিত থাকছে।

এই কোডে ফ্যাক্টরির সংজ্ঞার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয় এমন ফ্যাক্টরিতে ১০ বা তার বেশি শ্রমিক নিয়োজিত হলেই সেটি আইনের আওতায় আসে। এই নতুন কোডে এটি ১০ থেকে বাড়িয়ে ২০ করা হয়েছে। এর ফলে ছোট ফ্যাক্টরিগুলিতে এই কোড লাগু হবে না। ঠিকা শ্রমিকের ক্ষেত্রেও আইনি সুরক্ষাকে শিথিল করা হয়েছে এই নতুন কোডে। ২০ বা তার বেশি শ্রমিক কাজ করলে ঠিকা শ্রমিক আইন বর্তমানে প্রজোয্য হয়। এই নতুন কোডে এই সংখ্যা ২০ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়েছে। এর ফলে ঠিকা শ্রমিকদের একটা বড়ো অংশ আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে।

এই নতুন কোডে ১৩টি বর্তমান আইনে একত্রিত করা হলেও, এই আইনগুলির মধ্যে সঠিক যোগসূত্র স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। অনেক বিষয় নিয়মাবলী তৈরির উপর ছেড়ে রাখা হয়েছে। এর ফলে সম্ভাবনা থেকে যায় যে বিভিন্ন রাজ্য বিভিন্নভাবে নিয়মাবলী বানাবে। ফলে পরিযায়ী শ্রমিক এক কাজের জন্য এক থেকে অন্য রাজ্যে গেলে তাদের বিভিন্ন ধরনের আইনি ব্যবস্থার মধ্যে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে এই মৌলিক বিষয়ের উপর কোড আর বেশিনির্দিষ্ট করে বললে শ্রমিকরা উপকৃত হতো।

সব মিলিয়ে এই চারটি নতুন লেবার কোডে এমন বেশ কিছু বিষয় রয়েছে যা শ্রমিক স্বার্থের বিরোধী। মালিকপক্ষ শ্রম যেভাবে চাইছিলেন খানিকটা সেই ভাবেই এই চার লেবার কোড প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনি এবং প্রশাসনিক সুবিধা যা মালিকপক্ষের স্বাধীনতা বাড়াবে সেইরকম ভাবেই কোডের প্রণয়ন করা গেছে। গত দশকের শুরুতে যে EoDB (Ease of Doing Business) দিয়ে প্রক্রিয়ার শুরু হয়েছিল এই চারটি কোড প্রণয়নের মধ্যে তার অনেকটাই বাস্তবায়িত হল। এটা অস্বীকার্য যে বর্তমানের অনেক শ্রম আইন আর যুগোপযোগী নয়। প্রয়োজনের তুলনায় সংখ্যায় অনেক বেশি শ্রম আইন থাকার জন্য শ্রমিক এবং মালিকপক্ষ উভয়েরই অসুবিধে হচ্ছিল। এই অবস্থায় শ্রম আইনের সংস্কার জরুরি ছিল। কিন্তু চারটি কোডে ২০০ টি আইনকে একত্রিত করে তাদের যুগপোযোগী করার চেষ্টা করা হলেও, অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

কাজের সময় বাড়ানো না হলেও কর্মক্ষেত্র শ্রমিকদের অনেকটা সময় পর্যন্ত ধরে রাখার আরও বেশি স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। সরকারি অনুমোদিত নিয়মাবলী রাখার প্রয়োজনীয়তাও শিথিল করা হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ দর কষাকষির অধিকারের উপর বাধা আরোপ করা হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা সার্বজনীন করার চেষ্টা পুরোপুরি সফল হয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক সুরক্ষা শুধুমাত্র সংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য রয়ে গেছে। সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজের পরিবেশ ইত্যাদি মৌলিক অধিকারগুলিও শুধুমাত্র সংগঠিত ক্ষেত্রের জন্যই প্রযোজ্য হবে। এই চার লেবার কোডে সার্বিক শ্রমিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্থ হল।