আরেক রকম ● নবম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২১ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

রাষ্ট্রের গর্হিত নজরদারি


বেশ কিছু বছর আগে, মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের প্রাক্তন কর্মী তথা তাদের ইন্টারনেটের মাধ্যমে গুপ্তচরবৃত্তির তথ্যের প্রকাশক, এডওয়ার্ড স্নোডেন একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে প্রযুক্তি নিজে থেকে পিছু হটতে পারে না। কিন্তু তাকে যদি সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে সেই প্রযুক্তিই একদিন বৃহৎ কর্পোরেট রাষ্ট্রের জন্ম দেবে, যার নখাগ্রে রাখা থাকবে নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবন, গতিবিধি, জীবনের গোপন অধ্যায়, রাজনৈতিক মতবাদের সমস্ত তথ্য। কে এই প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করবে ও সামলাবে? সামলাবার দায়িত্ব সরকার, তার রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রশাসন এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক কাঠামোর সমস্ত স্তরের আধিকারিকদের। স্নোডেনের সেই সাক্ষাৎকার আজ দৈববাণী রূপে প্রতিভাত হচ্ছে, যখন পেগাসাস সফটওয়ার বাজারে চলে এসেছে, জর্জ অরওয়েল কথিত সেই ১৯৮৪-র রাষ্ট্রব্যবস্থার ভূত নরেন্দ্র মোদীদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে।

সতেরোটি সংবাদ সংস্থার তদন্তমূলক সাংবাদিকেরা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে একযোগে তদন্ত চালিয়ে যেটুকু ব্রেক করেছেন, সেই চাঞ্চল্যকর তথ্য ইতিমধ্যেই খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। ইজরায়েলের একটি নজরদারি ফার্ম, এনএসও গ্রুপ, যারা পেগাসাস সফটওয়ারটি তৈরি করেছে, তাদের থেকে বেশ কিছু রাষ্ট্র সেই সফটওয়ার কিনেছে এই শর্তে যে এটাকে ব্যবহার করে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করবে না এবং শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদ ও অপরাধ দমনে এর ব্যবহার হবে। শর্তাবলী রক্ষিত যে হয়নি, অন্তত ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সহজেই বোঝা যায়, কিন্তু সেই প্রসঙ্গ পরে। তার আগে অন্তত এটুকুর উল্লেখ থাকুক যে এনএসও সাফাই দেবার সময়ে তাদের পক্ষে বক্তব্য রেখেছিল যে শুধুমাত্র সেই সব দেশকেই এই সফটওয়ার দেওয়া হয়েছে যাদের মানবাধিকারের ইতিহাস সন্তোষজনক। ভারত বাদে কোন কোন দেশকে তারা বিক্রি করেছে? সৌদি আরব, বাহরিন, মেক্সিকো এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহী। এই সব দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে যত কম বলা যায় ততই ভাল। এবং এনএসও-র অসাড় বাগাড়ম্বরের চেহারা বোঝাতে এই একটা তথ্যই যথেষ্ট।

তদন্তের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই দেশের সরকারগুলি প্রায় পঞ্চাশ হাজার ফোন নম্বর সরবরাহ করেছে যাদের ওপর নজরদারি চালানো হচ্ছে বা হবে। এদের মধ্যে প্রায় এক হাজার নম্বর ভারতের। সত্যিই এই নম্বরগুলো হ্যাক হয়েছে কি না তা বোঝা যাবে সব ফোন পরীক্ষা করবার পর। আপাতত কয়েকটা পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে তাদের মধ্যে পেগাসাস ঢুকে পড়েছে। এই ফোন নম্বরগুলো কি অপরাধী ও সন্ত্রাসবাদীদের? না। নম্বরগুলো মূলত বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাদের, সাংবাদিকদের, আইনজীবীর, অ্যাক্টিভিস্ট, এনজিও কর্মী, বুদ্ধিজীবি, ব্যবসায়ী, নির্বাচন কমিশনের অন্যতম কমিশনার তথা সদস্য, বিদেশি কূটনীতিবিদ, ক্যাবিনেট মন্ত্রীরা ও তাঁদের পরিবার, এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের। বিজেপির উদ্দেশ্য কোনওকালেই খুব অস্পষ্ট ছিল না। হিন্দু রাইখ গঠনে যারা প্রধান বাধা, তাদের যেন তেন প্রকারে সরিয়ে দিতে অথবা দমন করতে হবে। এবং এই কাজে যত নিচে নামা যায় ও যত ভয়ংকর হওয়া যায়, পিছপা হবেন না মোদী বা অমিত শাহ। এখনও তাঁদের পোষা মিডিয়া ও সাংবাদিককুল আক্রমণ শানিয়ে যাচ্ছে বিরোধী দল ও বুদ্ধিজীবিদের দিকে, যাঁরা পেগাসাস কাণ্ডে সরব হয়েছেন।

তদন্তে জানা যাচ্ছে ২০১৭ সালেই ভারত সরকার এনএসও-র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল, ঠিক যে সময়টায় নরেন্দ্র মোদী ও বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর উদ্বাহু গলাগলি এক অশনি সংকেতের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করছিল। দুই দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রপ্রধানের এহেন মিত্রতা তাঁদের রাষ্ট্রনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলে সেই অঙ্কও কষেছিলেন কেউ কেউ। যা দেখা যাচ্ছে, ভারতের ক্ষেত্রে সেই প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে সেই বছরেই ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বাজেট দশগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছিল, যার সিংহভাগ সাইবার সিকিওরিটিতে। ২০১৯-এ মোদির দ্বিতীয় জয়ের পর ইউএপিএ আইনকে সম্প্রসারিত করা হয়েছিল যাতে তার আওতায় শুধু 'দেশদ্রোহী' সংস্থাগুলিই নয়, সন্দেহভাজন ব্যক্তিরাও পড়েন। কারণ সহজবোধ্য। সংস্থার ফোন নম্বর হয় না, হয় আদতে ব্যক্তিদের নম্বর। তাই নজরদারি চালাতে গেলে সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইনের অভিমুখ ব্যক্তির দিকে ঘোরাতে হবে। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় যে ষোলজন অ্যাকটিভিস্ট, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাঁদের আটজনের নম্বর পেগাসাসের তালিকায় পাওয়া গেছে। এই নম্বরগুলিতে সত্যিই নজরদারি চালানো হয়েছিল কী না সেটা বলা এখনি সম্ভব নয় কারণ ফোনগুলো পুলিশের জিম্মায়। আবার ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, এই আটক ব্যক্তিদের মধ্যে দুজন, রোনা উইলসন ও সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, তাঁদের কম্পিউটার হ্যাক করে প্ররোচনামূলক সাক্ষ্যপ্রমাণ ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যাতে তাঁদের পরে অভিযুক্ত করতে পারা যায়। এই ঘটনার সঙ্গে পেগাসাসের যোগ আছে কী না কেউ জানে না, কারণ যে কোনো কদর্য কাজে হাত নোংরা করতে বিজেপি সবার আগে এগিয়ে এসেছে বারবার।

১৯৭২ সালের ১৭ই জুন ওয়াশিংটন শহরের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির হেডকোয়ার্টারের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছিল পাঁচজনের একটি দল, পুলিশ যাদের ছিনতাইবাজ ভেবে গ্রেপ্তার করে। পরে দেখা যায় এই পাঁচজনের মধ্যে চারজন ছিলেন প্রাক্তন সিআইএ কর্মী এবং পঞ্চমজন কাজ করতেন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের রাজনৈতিক প্রচারবিভাগে। আস্তে আস্তে জানা যায় ডেমোক্র্যাটিক দলের অন্যান্য অফিসেও এভাবে হানা দেবার চেষ্টা হয়েছিল একই সময়ে। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এফবিআই-কে নির্দেশ দেন যেন তদন্ত ধামাচাপা দেওয়া হয়, কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্টের দুই সাংবাদিক নিরলস প্রয়াসে খুঁড়ে আনেন চমকে দেওয়া তথ্য - ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডাল নামে যা পৃথিবীবিখ্যাত। নিক্সন বিরোধী দলগুলির ওপর নজরদারি চালাবার উদ্দেশ্যে এই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। ঘটনার প্রতিক্রিয়াতে তাঁর ইমপিচমেন্টের সম্মুখীন হবার উপক্রম হয়েছিল। নিক্সন পদত্যাগ করেন। পৃথিবীর গণতন্ত্রের ইতিহাসে ওয়াটারগেট একটা গুরূত্বপূর্ণ অধ্যায়।

এই ঘটনার পঞ্চাশ বছর হতে চলল। আজকের দুনিয়াতে ওয়াটারগেটের তুল্য অধ্যায়গুলো আরও নির্মম, আরও ভয়ংকর। নিক্সন যেটা করেছিলেন নিজের দল ও মুষ্টিমেয় কিছু প্রশাসনের সাহায্যে, নরেন্দ্র মোদী সেই আখ্যানের ভেতরেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, কূটনৈতিক কৌশল, দানবিক প্রযুক্তির হিমশীতল অধ্যায়গুলো যোগ করে ফেলেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন নজরদারি রাষ্ট্রের চেহারাকে। সবথেকে বড় কথা, নিক্সনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। মোদীর কিছুই হবে না। বিরোধীরা যতই ঐক্যবদ্ধ হন না কেন, বিজেপি আপাতত গণতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ স্তম্ভগুলোকে কিনে নিয়েছে। তাই কিছু জনস্বার্থ মামলা ও বিরোধীদের সংসদ কক্ষ ত্যাগের মত টোকেন প্রতিবাদ বাদে আর বিশেষ কিছু করা যাচ্ছে না এখনও, যাতে কেন্দ্রীয় সরকার বিপদে পড়ে।

তাই আপাতত শুরুর প্রশ্নটাই, যেটা স্নোডেন আমাদের সামনে রেখেছিলেন, গুরূত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। প্রযুক্তি নিজে থেকে পিছু হটবে না ঠিক কথা। কিন্তু তাকে যদি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা যায়, অথবা নিয়ন্ত্রণ না করতে চায় সরকার, আমরা কি সেই নতুন পৃথিবী দেখতে প্রস্তুত যেখানে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি নথিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে সরকারের রেকর্ডে? নাকি বিরোধী ও বিকল্প রাজনৈতিক স্বরগুলিকে আরও সংহত ও জোরদার করতে হবে, যাতে প্রযুক্তি থাকে রাজনীতি ও সমাজের নিয়ন্ত্রণে? ফ্র্যাংকেন্সটাইনের দানব আমাদের গিলে না খেয়ে ফেলে? যদি দ্বিতীয়টাই করতে হয়, সবার আগে বিজেপি সরকারকে ফেলে দিতে হবে। এটা দ্বর্থহীনভাবে বুঝে নিতে হবে যে বিজেপি গণতন্ত্রের শত্রু, এবং প্রযুক্তি হোক বা মন্দির, নিজেদের প্রয়োজনে সমস্ত কিছুকে মানবতার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। এই সরকারের ওপর মারণ আঘাত হানতে বিরোধীরা কতটা ঐক্যবদ্ধ, এবং তাঁদের সদিচ্ছাই বা কতটা, সেটা সময়ই বলবে।