আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২১ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

সাঁওতাল জীবন চর্চায় সঙ্গীত

কথাকলি মৌলিক


ভূমিকা

সাঁওতাল সংস্কৃতি এবং সঙ্গীত নিয়ে আলোচনার শুরুতে এরা কোন আর্থসামাজিক অবস্থার উপর দাঁড়িয়ে আছে, সে বিষয়ে একটু আলোকপাতের প্রয়োজন।

২০০১-এর জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ৯৫% সাঁওতাল গ্রামীণ এলাকায় থাকে। এদের মধ্যে ৫৩% কৃষি শ্রমিক। খুব সামান্য অংশই অফিস চাকুরে বা শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। রুক্ষ সময়ে অনেক কম বয়সী সাঁওতালই প্রতিবেশী জেলা বা রাজ্যে কৃষি শ্রমিক বা চুক্তি বদ্ধ কাজে যুক্ত হয়। যেখানে তারা শ্রম আইনের নিরাপত্তা তো দূরের কথা ন্যূনতম রোজগারটুকুও পায় না। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, সরকারি-আমলা, মহাজনরা এদের শোষণ করে। অনেক সময় শিশু ও মহিলা শ্রমিকরা যৌন নির্যাতনেরও শিকার হয়। এই সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে যে লড়াই চলছে তার প্রায় কিছুই প্রচারমাধ্যমে আসে না। সাঁওতালদের নিজস্ব একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং চিন্তাভাবনার জগত আছে (Baski, 2013)।

সাঁওতালদের জীবনধারণ পদ্ধতি, সামাজিক ইতিহাস, ভাষা, নৃত্য, সঙ্গীত ইত্যাদি সামাজিক বন্ধনের ক্ষেত্রে একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে।

সাঁওতালদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনও একটা ভিন্ন আঙ্গিকে হয়ে থাকে। এদের নির্দিষ্ট কোনো মন্দির নেই বা কোনোরকম মূর্তি পূজাও এরা করে না। প্রত্যেক গ্রামে একটা বড় শাল গাছের নীচে এরা যাবতীয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। এই জায়গাটিকে এরা বলে ‘জাহের থান’। প্রতিটি সাঁওতাল গ্রামেই একটি করে জাহের থান থাকে। এখানে সাঁওতালরা ‘মারাংবুরু’, ‘জাহের এরা’, ‘মারেকো’, ‘টুরুইকো’ নামের সব দেব দেবীর পুজো করে। হিন্দুরা যেমন আত্মায় বিশ্বাসী তেমনই সাঁওতালরা ‘বঙ্গায়’ ভীষণ বিশ্বাসী। এরা মনে করে বঙ্গাই এই পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে। এই অপার্থিব, অতিপ্রাকৃত শক্তির সঙ্গে তাদের একটা সম্পর্ক আছে বলে সাঁওতালরা মনে করে। তাদের বিশ্বাস এই আত্মা তাদের বাড়ি ঘর, গ্রাম, মাঠ, পাহাড়, অরণ্য, সবকিছুর মধ্যে সব সময় অবস্থান করছে। (Basu 2020).

সাঁওতাল সঙ্গীত

সঙ্গীত এবং নৃত্য সাঁওতাল সম্প্রদায়ের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। যেকোনো উৎসবে, তা সে বীজবপন বা চাষবাস, বিবাহ, শিশুর জন্ম সব অনুষ্ঠানেই সঙ্গীত বা নৃত্যের একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

সাঁওতাল জাতির গান তাদের জীবনের একটা প্রধান অঙ্গ। নিজেদের শ্রমের ভার লাঘব করার জন্য বা বিশ্রাম করার সময় সঙ্গীতচর্চা এদের একটা প্রধান অঙ্গ (সরকার, ২০০৫)। আবার কোনো ঘটনা এদের কাছে আশ্চর্য মনে হলে সেই বিষয় নিয়ে এরা গান বাঁধার চেষ্টা করে (সরকার, ২০০৫)। নিচে নমুনাস্বরূপ একটি গান দেওয়া হল, কোনো সাঁওতাল যার স্ত্রী মারা গেছে, বিরহে তারই গাওয়া গান -

ওরাং আরে মা ইঞা আপা।
রাচা রেমা আতো হও।
ওকা রেব মেদা ইঞ যদা।
ইঞ রেয়া দায়া বাড়ে সেনাতামখান।
রেঞে কইড় মেদা যদ মে।

এর বাংলা অর্থ হল,
ঘরেতে মা বাপ।
অঙ্গনাতে গায়ের লোক।
কথায় চোখের জল আমি মুছেদি।
আমার জন্য দয়া তোমার আছে তো।
ঘুরে দেখ চোখের জল মুছে দে।

আরেকটি গান যেখানে সূর্য গ্রহণ কেন হয় তা বোঝানো হয়েছে -

মারাঙ বুরুরে দুসেৎ বেরোইলে কানায়
হারা লতার লতা তে
মানেওয়া হড়কো বেরোইলে কানায়
মানাওয়া মায়া জালাতে
চাদবঙা জনমে জনমে হইরি এনায়।

গানটির অর্থ হল ভগবান সূর্য দোসাৎ জাতির নিকট হইতে এক মুঠো ধান ধার করে সাঁওতালদের দেন। ভগবান সূর্যের এই ধার শোধ না করতে পারার জন্য দোসাৎজাতির কর্তা সূর্য দেবকে কখনো কখনো পীড়ন করেন এবং তাঁর তেজ কমিয়ে নেন। সেই জন্য সূর্য গ্রহণ হয়।

সাঁওতালি ভাষাতে বীরগান নামে একরকম গান প্রচলিত আছে। সাঁওতালি ভাষাতে ‘বীর’ শব্দটির অর্থ জঙ্গল। বছরের মধ্যে দুই একবার যখন এরা শিকারে যায় তখন গভীর জঙ্গলের মধ্যে পুরুষেরা এই গান গেয়ে থাকে। এই দলে কখনো মেয়েরা বা অল্প বয়সী ছেলেরা থাকে না। মদ্য পান করে এই গান গাইলে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়। (মজুমদার, ২০০৫)

যেমন -

গাডা নাড়ে নাড়েতে, তিরিয়ো বদন রে নালম,নরং,
ধীরি মাগাড় রে, দাঃক দ বদন রে নালম বডে।

অর্থ -
ওরে বদন, নদীর ধারে বাঁশি বাজিওনা, পাথরের তলায় যে জল রয়ছে তাকে ঘুলিয়ে তোলা কি উচিৎ বদন। বদন বলতে একজন পুরুষকে বোঝানো হয়েছে।

সাঁওতালি গানে বাংলা কথার ব্যবহারও পাওয়া যায়। যেমন নিচের এই ছেলে ঘুম পারানো গানটিতে আছে। (সরকার, ২০০৫)

চেতাঙ দিসম ক্ষন হেয় একালা কয়লার যুগি
মাসে মাবাঙ কহ কয়দে ইমাই সে
কোলে আছে সোনের বঁধু কয়দে ইমাই মে

অর্থ -

উপর থেকে আসছে ভিক্ষুক যোগী
দিয়ে দে বড় বঁধু ভিক্ষা দিয়ে দে
কোলে আছে সনার খোকা ভিক্ষা দিয়ে দে।

আরেকটি গান -

জজ-দ জইনা ঝামকা ঝাকুর
নুলে-দ জইনা থোপা থোপা;
নুলে জমদ পেড়া সেন্নালেপে,
নাপে-মা ঞেল্ তে ডৗডিমা ঘাট রে,
পেরেঃচ কান্তাপেড়াঞ বৗগিয়াদাঃ।

অর্থ -
তেঁতুল ফল ঝামকা-ঝুকুর-ঝুকুর ঝুলছে, থোকায় আম ফলেছে- আম খেতে আমাদের ওদিকে যেও , বন্ধু। তোমাদের দেখে জল নেবার বালু-খোরা ডোবার ঘাটে ভরা কলশি ফেলে দিয়ে এসেছি, সখা।

সাঁওতাল সমাজের অগ্রহায়ণ মাসে সরদার (গ্রামে তাদের গোষ্ঠীর যিনি প্রধান) তার বাড়ির সামনে করম গাছের জোড়া ডাল পুঁতে নাচ হয়। এই দুই ডালে যেমন বিচ্ছেদ নেই, তেমনি দুই সখীতে যেন কখনও বিচ্ছেদ না হয়, ‘কারাম ডাল’ পাতানোর সময় এই কামনা করা হয়। এই নিয়েও গান আছে। গানটি এই রকম -

কুড়ি কুড়ি লে রিয়ৌও এনা,
বৗইহৗড় বৗইহৗড় তে গৈ৺ঠা হালাঞ।
গাতেকুড়ি দকো মিতৗঞ কানা,
নাম দ কারাম ডৗরেম জারগোয়েনা।

অর্থ -
মেয়েতে মেয়েতে আমরা সব এসে জুটেছি, মাঠে মাঠে ঘুটে কুড়োতে সখীরা বলছে হ্যাঁ ভাই কারাম ডাল তুই যে আইবুড়ো হয়ে রইলি।

এই ভাবে নাচগানেই চাপা পড়ে যায় তাদের না পাওয়া আর বঞ্চনার ব্যথা বেদনা।মাঘ মাসের পয়লা তারিখে সাঁওতালরা ‘বাহা’ উৎসব পালন করে। সাধারণত বাঁশের বাঁশি এবং মাদল এই সঙ্গীত এবং নৃত্যের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়। (Chatterjee 2009)

শান্তিনিকেতনে ঘুরতে আসা কিছু মানুষ জনের এমন ভাবনা পরিলক্ষিত হয়, যেন এই ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, এই সাঁওতাল নৃত্য সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত না হলে। কিছু হোটেলও গজিয়ে উঠেছে যারা এইসব গোষ্ঠীদের নিয়ে তাদের লনে নাচ গানের আয়োজন করে।

শান্তিনিকেতন এবং বিশ্বভারতীর পরিমণ্ডলে, সাঁওতাল সমাজ কীভাবে নিজেদের সংস্কৃতিকে সম্পৃক্ত করেছিল এই বিষয়ে গবেষণামূলক কাজ করতে গিয়ে, প্রবীর চ্যাটার্জি দেখেছিলেন কীভাবে এদের নৃত্য সঙ্গীত ইত্যাদি বিষয় গুলি নিয়ে এক শ্রেণির সুযোগসন্ধানী মানুষ নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যবহার করে। তিনি বলেছেন -
In such an environment, these dances can neither be understood nor appreciated beacuse they lack their particular atmosphere and dignity. This is mostly sheer financial and cultural exploitation and therefore offends the pure traditions of Santiniketan. (Chatterjee 2009)

এখান থেকেই বোঝা যায় সাঁওতাল সংস্কৃতির মত একটি দেশজ গাম্ভীর্যপূর্ণ বিষয় কীভাবে ভুল পথে চালিত হচ্ছে যা রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের মূল ভাবনার পরিপন্থী এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে একেবারেই খাপ খায়না।

রবীন্দ্রনাথ এবং সাঁওতাল সমাজ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাঁওতাল জীবন যাত্রার পদ্ধতির মধ্যে এক ভিন্ন ধারার মাধুর্য খুঁজে পেয়েছিলেন। জমি চাষবাসের সঙ্গে তারা গান কবিতা নৃত্যকে একসূত্রে বেঁধেছিল, নিজেদের শিল্পকলাকে বাস্তবে জীবনজীবিকার সঙ্গে মিশিয়েছিল।এই বিষয়টাই, এদের শিল্পসংস্কৃতির প্রতি রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিলো। রবীন্দ্রনাথের ‘সাঁওতাল মেয়ে’ কবিতায় একজন সাঁওতাল মেয়ের কঠোর শ্রম, ফুলের মত জীবনটা দৈনন্দিন রুটি রুজির ব্যবস্থা করতেই কঠোর ত্যাগের মধ্যেই কেটে যায়।

‘...ঝুড়ি নিয়ে বার বার সাঁওতাল মেয়ে যায় আসে
আমার মাটির ঘর খানা
আরম্ভ হয়েছে গড়া মজুর জুটেছে তার নানা।
আমি দেখি চেয়ে,
ঈষৎ সংকোচে ভাবি এ কিশোরী মেয়ে
পল্লীকোনে যে ঘরের তরে
করিয়াছে প্রস্ফুটিত দেহে ও অন্তরে
আমি তারে লাগিয়েছি কেনা কাজে করিতে মজুরি -
মূল্যে যার অসম্মান সেই শক্তি করি চুরি
পয়সা দিয়ে সিঁধ কাঠি।

সাঁওতাল মেয়ে ওই ঝুড়ি ভরে নিয়ে আসে মাটি।’ (রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতন, ৪ মাঘ ১৩৪১)
https://animikha.wordpress.com/2016/02/07/2979/

সাঁওতাল সঙ্গীতের সৃষ্টিতত্ত্ব

সাঁওতাল সঙ্গীতের সৃষ্টিতত্ত্বর ব্যাখ্যা করতে গেলে যে সঙ্গীতের ধরনের কথা বলা হয় তা হল করম। কিন্তু সাঁওতাল সঙ্গীতের আরও নানানরকম প্রকার ভেদ আছে। যেমন দাসে, ডন, শারে, ইত্যাদি (প্রসাদ ২০১৬)। ডন-এ সাঁওতাল সম্প্রদায় যে সঙ্গীত পরিবেশন করে তা মূলত বিবাহের সময়। গানের বিষয় বস্তু এরকমঃ একদম শুরুতে এই বিশ্ব কিন্তু দৃশ্যমান ছিল না। চারদিকে ছিল গাঢ় অন্ধকার আর কুয়াশায় ঢাকা। সূর্য যখন প্রচণ্ড রাগে আলোর দ্যুতি ছড়াল তখনই বিশ্বকে দেখা গেল। সেই সময় বিশ্বে আকাশ আর মহাসাগর ছাড়া কিছুই ছিল না। আকাশে ছিল সূর্য, চন্দ্র,‌ তারা। আর সাগরে ছিল কচ্ছপ, মাছ, কাঁকড়া ইত্যাদি জলজ প্রাণী। যখন ভগবান মানুষ সৃষ্টি করতে চাইলেন তখন প্রথমে দুইটি পাখি তৈরি করেছিলেন। সাঁওতালদের করম উৎসবে এই বিষয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। বাংলায় দুইটি সঙ্গীত এইরকম -

১) অনেক আগে,
সূর্য ছিল সাগরের উপরে আকাশে,
সূর্য রুষ্ট হল,
আধারের মধ্যে থেকে,
কুয়াশার মধ্যে থেকে,
তার ক্রোধই আলোর সৃষ্টি করলো।

২) জল উপরে,
আকাশের নীচে,
হাস আর হাসিন দুজনে কোথায় বসবে?
কোথায় নিদ্রা যাবে?
তারা ঈশ্বরের মাথায় বসবে এবং নিদ্রা যাবে

(Onkar Prasad-এর মূল ইংরেজি লেখা থেকে বাংলায় অনুদিত)

এইভাবে সাঁওতালদের বিভিন্ন সঙ্গীতে বারে বারেই পৃথিবীর সৃষ্টি এবং অস্তিত্তের কথা উঠে এসেছে। বিভিন্ন গানে তারা যে কাল নির্ঘণ্ট তৈরি করেছে তা অনেকটা এইরকম - প্রথমে সৃষ্টি হয় ‘সেরমা’ (আকাশ), ‘পৃথিমী’ (পৃথিবী) এবং ‘ডাক’ (জল)। দ্বিতীয়ত সৃষ্টি হয় মাছ বা পাখি। তৃতীয়ত ‘হে’ (বাতাস)। চতুর্থত ‘ডেয়ার’ (গাছ পালা)। পঞ্চমতও - ‘হাসা’ (ভূমি)। ষষ্টত - ‘হোর’ (মানুষ)। সপ্তমত - ‘সেঙ্গাল’ (আগুন)। (Prasad 2016)

এগুলো বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উৎসবে ব্যাবহৃত হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ‘শরে’ খেতের ফসল ওঠার পরে উৎসবের সঙ্গীত। আবার ‘ডন’ বিবাহ উৎসবের সঙ্গীত। ‘বাহা’ উৎসবে গাওয়া হয় বাহা, ডন, লাগরে।

সাঁওতাল সঙ্গীতে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র

গানবাজনার অনুষঙ্গ হিসেবে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার সাঁওতাল সঙ্গীতে একটা ভিন্নমাত্রা যোগ করে। এই বাদ্যযন্ত্রগুলি সাঁওতাল জীবনের সঙ্গে জড়িত।

সাঁওতাল সমাজে বাদ্য যন্ত্র যেগুলি ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে আছে তিরিও, টমক, টামডাক, যুংকো, শিংগা, বাশি, চড়চড়ি, কড়তাল, ইত্যাদি। এই বাদ্যযন্ত্রগুলি জীবনের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গীত এবং নৃত্যে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্রের তালে ‘রু’ শব্দটি আসে। যেমন- বাহা রু, ডন রু, শরে রু, নৃত্যের ক্ষেত্রে শুরুর তালটা কে বলে রু-ইহপ, মাঝে নৃত্য চলতে থাকার সময় যে তাল তাকে এরা বলে রু-সালটি অথবা সারদি। যখন তাল পরিবর্তন হচ্ছে তখন বলা হয় রু-টরাও এবং একদম শেষে গিয়ে রু-মুসেট (Prasad 2016)।

‘ডন’এর মত কিছু সঙ্গীত অনেক বৈপরীত্যের সমাহার তৈরি করে। নারী -পুরুষের মত পৃথিবী - আকাশ, বায়ু - জল, বীজ - জমি, শুষ্ক - সিক্ত ইত্যাদির মত একটা ভাবনা জাগিয়ে তোলে। সাঁওতাল সমাজে প্রধানত তিনটি ধর্মীয়আচার অনুষ্ঠানে সঙ্গীত একটা পবিত্র বিষয় হয়ে বিরাজ করে। বাহা, ভান্দাম এবং দাসে এই তিনটি অনুষ্ঠানেই মূলতঃ সাঁওতাল সঙ্গীতের ভূমিকা বেশী। এদের সঙ্গীতই সাধারণত প্রকৃতি, মানুষ এবং বঙ্গা (আত্মা)র মধ্যে মেলবন্ধনের একটা মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। যার জন্য এই সঙ্গীতের প্রতি এই সমাজের বাইরেও বিভিন্ন সমাজের একটা আকর্ষণ বর্তমান। বর্তমানে সাঁওতাল সঙ্গীত, নৃত্য সহ আদিবাসী সংস্কৃতি একটা আন্তর্জাতিক চেহারা পেয়েছে। এই সঙ্গীত, নৃত্য নিয়ে বিভিন্ন গবেষকের আগ্রহ, গবেষণার পরিধি উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে (Prasad 2016)।

সাঁওতাল নৃত্য, সঙ্গীতে যে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয় তার আলাদা একটা ঐতিহ্য আছে। বাদ্যযন্ত্র গুলি এই সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির সঙ্গে একটা আলাদা মাত্রা যুক্ত করে। এই সঙ্গেই বাদ্যযন্ত্রগুলির প্রত্যেকটির একটি করে সংক্ষিপ্ত করে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হল। এর মধ্যে ১) ‘বানাম’ নামে একটি যন্ত্রের ব্যবহার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাঁওতাল ভাষায় ‘বানাম’ শব্দটি ‘বানা’ এবং ‘আম’ দুটি শব্দ যুক্ত করে সৃষ্টি । ‘বানা’ অর্থ নিজের দিকে আকর্ষিত করা। আর ‘আম’ শব্দটির অর্থ তুমি বা নিজে। পুরো অর্থটি হলো যা কিছু ভালো তাকে নিজের দিকে তোমার দিকে আকর্ষিত করা। বানাম বাদ্যযন্ত্র বিভিন্ন নামে দেখা যায় । টেন্দর বানাম, ধোদরো বানাম, হুকা বানাম ইত্যাদি । বিভিন্ন আকারে ও ডিজাইনে বানাম তৈরি হয়। (Basu 2020)

২) তিরিওঃ সাতটি ছিদ্রের বাঁশের তৈরি বাঁশি। এটি সাঁওতালদের খুবই প্রিয় বাদ্যযন্ত্র।

তিরিও (Source:https://srpbypst.blogspot.com/2012/06/traditional-music-instruments-of.html)

৩) ধোদরো-বানামঃ একটি মাত্র কাঠের তৈরি। মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গা তৈরি করে পশু চামড়া দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। একে বলে বেলি (ল্যাক), এর উপরে থাকে ব্রিজ (সাদাম), চেস্ট (করম), নেক (হটক) এবং হেড (বহক)। এ ছাড়াও ফেটবানাম নামেও একরকম বাদ্যযন্ত্র আছে এতে তিনটি বা চারটি ধাতব তার থাকে।

ধোদরো-বানাম (Source: https://galeriemakara.com/gallerie/dhodro-banam/)

৪) টামডাকঃ একে মাদলও বলা হয়। দু'মুখো ড্রাম, পোড়ামাটি দিয়ে তৈরি এবং চামরা দিয়ে ঢাকা। ডান এবং বাম দু'হাতেই বাজানো হয়।

টামডাক (Source: https://srpbypst.blogspot.com/2012/06/traditional-music-instruments-of.html)

৫) টমকঃ পাতলা ধাতব পাত দিয়ে তৈরি হয়। চামড়ায় ঢাকা। একজোড়া কাঠি দিয়ে বাজানো হয়।

টমক (Source:https://www.santhaliupdate.com/2018/11/tamak-tumdah-santali-music-symbols.html)

৬) জুনকোঃ পায়ের ঘুঙুর। ধাতু দিয়ে তৈরি ছোটো ছোটো ঘণ্টার মত। নাচের তালে তালে সুন্দর ছন্দে বাজে।

৭) শিঙ্গাঃ S অক্ষরের মত, তামার পাত দিয়ে তৈরি। ফুঁ দিয়ে হাওয়ার সাহায্যে বাজানো হয়। (Baski 2012)

শিঙ্গা (Source: https://kherwalsantal.blogspot.com/2011/10/santali-musical-instruments.html)

৮) সিফাংঃ এটা লম্বা বাঁশি, একধরনের বাঁশ থেকে তৈরি হয়। ২৭ থেকে ২৯ ইঞ্চি লম্বা এই বাঁশিতে ৫টা ছিদ্র থাকে। সাধারণত বিবাহ উৎসব সহ বিভিন্ন উৎসবে এই বাঁশি বাজান হয়।

সিফাং (Source: https://app.emaze.com/@AORORFFQT#4)

৯) সেরজাঃ এটা হার্পের মতো একধরনের যন্ত্র যেখানে তিনটে তার থাকে। এই যন্ত্রগুলি একধরনের কাঠ থেকে তৈরি হয়। এর নীচের দিকটা ফাঁকা থাকে এবং কিছুটা অংশ ছাগলের চামড়া দিয়ে ঢাকা থাকে। এই যন্ত্র বিবাহ উৎসব, বইসাগু এবং দোমাসি উৎসবে ব্যবহৃত হয়।

সেরজা (Source: https://hathai.org/product/serja-boro-traditional-musical-instrument/)

১০) জোঠাঃ জোঠাকে ইংরেজিতে কিম্বল বলা হয়। যন্ত্রটি একটা বেসিন এর মত দেখতে হয়। এটা জোড়ায় বাজাতে হয়। খেরাই পূজা, বইসাগু, দোমাসি উৎসবে এই যন্ত্র ব্যবহৃত হয়।

১১) থোরখাঃ এটিও একধরনের বাঁশ দিয়ে তৈরি যন্ত্র। একটা বাঁশের টুকরোকে মাঝখান দিয়ে লম্বালম্বি চিরে দুহাতে ধরে বাজাতে হয়। প্রায় আড়াই থেকে তিন ফুট লম্বা হয়।

১২) জাব-খ্রিংঃ এটাও কাঠের তৈরি বাদ্যযন্ত্র গোলাকার ধাতব পাত দিয়ে মোরা থাকে। বাজানর সময় কাঠ এবং ধাতু দুইয়ে মিলে একটা অদ্ভুত সুর তৈরি করে। সাধারণত বিবাহ, বইসাগু, দোমাসি উৎসবে বাজানো হয়।

জোঠা, থোরখা, জাব-খ্রিং (Source: https://thebodotribe.blogspot.com/2016/04/traditional-musical-instrument-of-bodos.html

১৩) খামঃ এটা সাড়ে তিন থেকে চার ইঞ্চি লম্বাএ বং আড়াই থেকে তিন ইঞ্চি চওড়া একটি বাদ্যযন্ত্র। কাঠের তৈরি এই যন্ত্রের দুই দিক হরিণ অথবা ছাগলের চামড়া দিয়ে ঢাকা থাকে। যন্ত্রটি খেরাই এবং গর্জা পূজায় বাজানো হয়।

খাম (Source: http://otrosmundos.es/Open/Cordofonos/Laud_Sen_Kham)

১৪) গনগোনাঃ এই যন্ত্রও বাঁশের তৈরি। লম্বায় ৬ থেকে ৭ ইঞ্চি হয় এবং চওড়ায় ১/২ ইঞ্চি থেকে ৩/৪ ইঞ্চি হয়। এই যন্ত্র মহিলা এবং মেয়েরা বইসাগু এবং দোমাসি উৎসবে বাজায়। (Brahma, Mandal, Gajurel, Singh, Rethy 2015)

গনগোনা (Source: https://en.wikipedia.org/wiki/Gogona)

সাঁওতালরা অরণ্যের অধিকার ফিরে পেতে চায় সব সময়। এদের পূর্ব পুরুষ এই অরণ্যেই টিকে থেকেছে, বেড়ে উঠেছে। বর্তমান প্রজন্মও তাই। এখানে বিদ্যালয় আছে কিন্তু আদিবাসী ছেলে মেয়েরা শিক্ষা পায় না। এরা হাসপাতাল খুলেছে কিন্তু আদিবাসীরা চিকিৎসা পায় না। দু'টাকা কেজি দরে চাল তাও মাসে এক সপ্তাহের বেশি যায় না। এরা বেঁচে থাকতে চায় অরণ্যের উপর। চাহিদা এদের খুবই কম। আদিবাসী গোষ্ঠী গুলির মধ্যে আমরা শুধু মাত্র সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে আলোচনাটা সীমাবদ্ধ রাখলাম। সংবিধানে এদের জন্য নানা রকম রক্ষা কবচের কথা বলা থাকলেও বা এদের আর্থ সামাজিক অবস্থা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে নানাবিধ পরিকল্পনার কথা বলা হলেও কাজের কাজ খুব একটা কিছু হয়নি। তবুও ভেতরের যন্ত্রণা সহ্য করেও নিজেদের সঙ্গীত, নৃত্যকে সাথী করে প্রতিদিনকার জীবন যুদ্ধে এরা লড়াই করে যাচ্ছে যেটা সত্যিই শিক্ষণীয়।

The Santhals combined the tilling of the earth as farmers with poetry, songs, and dance. Through this blending of the practical work for food and livelihood with the fulfillment of one’s artistic needs, life receives a fullness which it otherwise would lack. The farmer’s life, by itself, is monotonous. But when it is mirrored, symbolized, and interpreted through poetry and dance, farming becomes a primeval activity of archetypal importance (Chatterjee 2009)

উপসংহার

আজকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আদিবাসী এবং সাঁওতাল সমাজের শিল্প সংস্কৃতির প্রভাব শহুরে জীবন যাত্রায় যথেষ্ট ছাপ ফেলেছে। সাঁওতাল নাচের অনুসঙ্গে নির্মিত দুটি বিখ্যাত ছবি সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ এবং ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্ক গপ্প’ সম্পর্কে কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন ‘আদিবাসী সমাজের নাচের মধ্যে নিজেকে জুড়ে নেওয়ার ছবি এই দুই প্রধান পরিচালকের হাত ধরেই আমরা পেয়েছি’(মানিকদার চিঠি দেবযানীকে, সংকলক - দেবযানী রায়, আনন্দবাজার পত্রিকা, পুস্তক পরিচয়, ২৯.০২.২০২০)

এই পাওয়াও আমাদের কাছে অনেক পাওয়া। এই ক্ষেত্রটা কিন্তু খুব সহজ ছিল না। শিক্ষা সংস্কৃতি থেকে বহু দূরে থাকা একটা সমাজ কীভাবে নিজেদের চেতনার মানকে ঘষে মেজে এই জায়গায় উন্নীত করতে পারে, সেটাও একটা গবেষণার বিষয়। এই বিশেষ সংস্কৃতি, সঙ্গীত, নৃত্য ধারাকে কীভাবে বিশ্বের দরবারে একটা মহিমান্বিত স্থানে প্রতিষ্ঠা করা যায় তার চেষ্টা এই সমাজের মানুষজন এবং এর বাইরে থাকা আমরা যারা আছি তারা সকলে মিলে একটা চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আমার মনে হয় সাঁওতাল সঙ্গীতের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি, তাদের সঙ্গীতে বাদ্য যন্ত্রের ব্যবহারিক দিক নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে। ভবিষ্যতে সেই গবেষণা নানা দিক থেকে প্রসার লাভ করবে। আসল কথা এই শিল্প কলাকে বাঁচিয়ে রাখতে নিরন্তর প্রয়াস জারি রাখতে হবে।
 

তথ্যসূত্রঃ

● আনন্দবাজার পত্রিকা, পুস্তক পরিচয়, ২৯.০২.২০২০, মানিকদার চিঠি দেবযানীকে, সংকলক - দেবযানী রায়।
● Gouri Basu, 2020 ‘Banam’ Santhal Folklore he Banam. Eastern Zonal Cultural Centre Kolkata.
● Boro Baski, 13.5.2013, Santal Worries ● https://www.dandc.eu/en/article/young-generation-indias-adivasis-struggles-tough-problems-other-youth-do-not-have. Accessed on 6.6.2020.
● Dr. Prabir Chatterjee, April 12 2009, Santals and Santiniketan.
● https://www.mail-archive.com/jharkhand@yahoogroups.co.in/msg04356.html. Accessed on 8.6.2020.
● Dipankar Ghosh, January 2005, Bangla Samayikpatre Adibashikatha. Sarasilal Sarkar (Santali Gan), Santosh Chandra Majumder (Santali Gan).
● Jahnovi Brahma, Tribeni Mandal, P. Gajurel, B. Singh, P. Rethy. Traditional Knowledge of Musical Instruments Used by the Bodo Tribes of North east India. 2015
● Onkar Prasad, Musical Cosmology of Santal.
● Rabindranath Tagore, সাঁওতালি মেয়ে (TheSanthal Girl) Santiniketan, 18th January 1935.
● https://animikha.wordpress.com/2016/02/07/2979/
● Traditionl music instruments of the Santals at the Museum of Santal Culture - West Bengal.
https://indiantribalheritage.org/?p=6529#:~:text=closely%20with%20them-,Traditional%20music%20instruments%20of%20the%20Santals%20at,of%20Santal%20Culture%20%E2%80%93%20West%20Bengal&text=*%20Tirio%3A%20The%20instrument%20most%20favoured,symbols%20of%20love%20and%20seduction.


কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ শ্রী তপন মৌলিক মহাশয় এবং অধ্যাপক শ্রী অভিজিৎ গুহ মহাশয়ের কাছে।