আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২১ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

মায়ানমারের শরণার্থী নীতি নিয়ে দ্বিচারিতায় ভারতের কূটনীতি

গৌতম লাহিড়ী


বিদেশ নীতি নিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের দোলাচল হাঁসজারুর মতোই কাল্পনিক মনে হবে। অনেক বিষয়ের মধ্যে দোলাচল প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে তথাকথিত 'শরণার্থী' নীতি নিয়ে। এই দ্বিচারিতা ফাঁস হয়ে গিয়েছে সম্প্রতি মায়ানমারের 'চিন' প্রদেশ থেকে মিজোরামে হাজার হাজার শরণার্থী আশ্রয় নেওয়ার ঘটনায়। তাঁদের মধ্যে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা বিচ্যুত আং সান সুচী-র ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি-র (এনএলডি) সমর্থক রাজনৈতিক নেতা তথা মুখ্যমন্ত্রী নিজেও রয়েছেন। অথচ এঁদের বিষয়ে ভারত সরকার নীরব। উপেক্ষা করছেন সামরিক শাসকের অত্যাচারে জর্জরিত দলে দলে উত্তরপূর্ব রাজ্যে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনার। কারণ - ভারত সরকারের মতে এঁরা মুসলিম। অথচ সকলেই মুসলিম নন। বেশিরভাগ খ্রিস্টান।

বাংলার বিধানসভা ভোটের সময়ে বিজেপি বাংলাদেশি 'অনুপ্রবেশকারীদের' সঙ্গে মায়ানমারের রোহিঙ্গাদেরও বিতাড়নে মুখর ছিল। শুধু বাংলায় নয় জাতীয় স্তরেও রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে বিজেপি সরকার সুপ্রীম কোর্টেও বিতাড়নের পক্ষে সওয়াল করেছে। স্বয়ং সলিসিটার জেনারেল তুষার মেহতা সুপ্রীম কোর্টে সওয়াল করতে গিয়ে বলেন, "ভারত বিশ্বের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের রাজধানী নয়। যেদিন মায়ানমার সরকার এঁদের চিহ্নিত করবে সেইদিনই ভারত সরকার এঁদের ফেরত পাঠাবে রাখাইন প্রদেশে।"

বিজেপি সরকার এবং তাঁদের সহযোগী হিন্দুত্ববাদী সব ধরনের সংস্থাই রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে মুখর। একমাত্র কারণ রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই মুসলিম। সকল রোহিঙ্গাই কিন্তু মুসলিম নয়। হিন্দু রোহিঙ্গাও আছেন। সংখ্যায় মুসলিমদের তুলনায় কম। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কক্সবাজারে বিশ্বের বৃহত্তম উদ্বাস্তু শিবির রোহিঙ্গাদের। টেকনাফে গিয়ে দেখেছি রোহিঙ্গাদের বৌদ্ধ এবং হিন্দু মন্দিরও রয়েছে। এঁদের বাংলাদেশ সরকার বিগত প্রায় পাঁচ বছর ধরে আশ্রয় দিয়েছে। সংখ্যাটা দশ লক্ষের কাছাকাছি।

বিজেপি সরকারের বিদেশ নীতি অনেকটা 'ধর্মে-জিরাফে' থাকার মতো। একদিকে মায়ানমারের সেনা শাসকদের চটাবেন না। পাছে চিন সেখানে বাড়তি সুবিধা পায়। আবার আং সান সুচী-কেও অস্বীকার করতে পারবেন না। যেহেতু তিনি গণতন্ত্রের পক্ষের নেত্রী। বিশ্বের গণতান্ত্রিক সকল রাষ্ট্রই প্রায় সূচী-র মুক্তির পক্ষে। আং সান সূচী-কে সেনা সরকার কারাবন্দি করে রেখেছে। মায়ানমারে এখন প্রায় গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি। সেনা বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর সংঘাত লেগেই রয়েছে। শক্তিশালী জুনটা যেভাবে রাখাইন প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করেছে, তেমনি এখন বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীকেও সূচী-র সমর্থক বলে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। প্রাণ সংশয়ে এঁরাও পালাচ্ছেন। নিকটবর্তী ভারতের মিজোরাম ও মণিপুরে আশ্রয় নিচ্ছেন।

মিজো জাতিগোষ্ঠীদের অনেকেই মায়ানমারেও রয়েছেন। বিশেষ করে চিন প্রদেশে। এঁদের জাতিগত নৈকট্যের সম্পর্কের কারণে মায়ানমারের নিপীড়িত চিন প্রদেশের বাসিন্দাদের জন্য সহানুভূতি রয়েছে। তাই মিজোরামের মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাংগা প্রকাশ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারকে বলেছেন তিনি শরণার্থীদের আশ্রয় দেবেন। এবং দিয়েওছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক দায়সারা একটা অ্যাডভাইসরি পাঠিয়েছেন। এঁদের যেন আশ্রয় না দেওয়া হয়। কিন্তু মিজোরাম সরকার সেটা উপেক্ষা করেছেন এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক চোখ বুজে রয়েছেন, যেহেতু মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট এনডিএ শরিক। গত জুন মাসেই চিন প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সালাম লিয়ান লুয়াই হাজার খানেক শরণার্থী নিয়ে আইজল শহরের কাছেই ছাম্ফাইয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। ওঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিধায়কও রয়েছেন।

ভারতের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাচ্ছেন। বলছেন - এই বিষয়টা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে জিজ্ঞাসা করুন। দ্বিচারিতার কথা কেন উঠছে? একদিকে ভারত সরকার সুপ্রীম কোর্টে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের কথা বলছে অন্যদিকে রাষ্ট্রসংঘে ভারতের রাষ্ট্রদূত টি এস থিরূমুর্তি আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। শুধু তাই নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বারবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছেন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য। প্রশ্ন হলো যে নীতি বাংলাদেশের জন্য সঠিক সেটা ভারতের জন্য কেন নয়। ভারতে এক লক্ষ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেননি।

কয়েকদিন আগেই রাষ্ট্রসংঘে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি মায়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সেনসর প্রস্তাব এনেছিল। ভারত সেই প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল। যেমন ছিল বাংলাদেশ-রাশিয়া ও চিন সহ ৩২টি দেশ। মায়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ভারত সরকার নিজেরা কোনো দায় নেয়নি। আশিয়ান ভুক্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলির উপর ভারত সরকার সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিয়েছে। অথচ মায়ানমারের সেনা শাসকরা এখনও আশিয়ান দেশগুলির রাষ্ট্রদূতেদের গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করতে দেননি।

২০১৬ সালে আং সান সূচী মায়ানমারে ক্ষমতায় আসার পর ধারণা হয়েছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। কিন্তু ক্ষমতায় থাকার জন্য সূচী-কে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের সঙ্গে সমঝোতা করতে হয়। যার ফলে রাখাইন প্রদেশ থেকে ধীরে ধীরে রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার শুরু হয়। রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। আশ্রয় নেয় নিকটবর্তী বাংলাদেশে। রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করাকে এথনিক ক্লিনসিং-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়। ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গারা পলায়ন করতে থাকে। মানব দরদী বলে যাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, তিনিও নতি স্বীকার করেন। মায়ানমারে ক্রমান্বয়ে রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। যেটা আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা করতে চাইছেন বাঙ্গালিদের জন্য। আং সান সূচী-র উপর আর্ন্তজাতিক চাপ দেওয়া সত্ত্বেও তিনি অসহায়।

সেনাশাসক ও বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে বোঝাপড়া করার পরেও ২০২১ সালে সূচী-কে ফের ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাবাহিনী, যাঁরা আজ ক্ষমতায়। ফলে মায়ানমারে গণতন্ত্রের পক্ষে এটা নিঃসন্দেহে ধাক্কা। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তা বলা যাচ্ছে না। এখন তো পরিস্থিতি ভয়ানক। বহু মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। সূচী সহ গোটা ক্যাবিনেট আটক। সেনা শাসকরা যদিও আগামী দু' বছরের মধ্যে ফের নির্বাচন করবেন বলে ঘোষণা করেছেন। সেই নির্বাচন অবাধ হবে কিনা সন্দেহ।

মায়ানমারে গণতন্ত্র ফিরলেও সেনাবাহিনী কখনই ক্ষমতার অলিন্দের বাইরে ছিল না। সেটা বুঝতে সূচী-র ভুল হয়েছিল। সেনাবাহিনী মনে করে, তাঁরাই প্রকৃত শাসক। তবে সূচী সরকারকে বরখাস্ত করার পর যেভাবে সাধারণ মানুষ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন সেটাও সেনাশাসকরা বুঝতে পারেননি। এখনকার ক্ষমতাশালী সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিদ্রোহের বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।

ক্ষমতায় আসার পর সূচী মায়ানমারের সরকারে সেনাবাহিনীর ভূমিকা খর্ব করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেটা তাঁদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল। সেনাবাহিনীও সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সেটা সূচী-ও বুঝতে পারেননি। সামরিক অভ্যুত্থানের আগে ভারতের বিদেশ সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা এবং সেনা বাহিনী প্রধান একত্রে মায়ানমার সফর করেন। কোভিড নিয়ন্ত্রণের মেডিক্যাল সামগ্রী পৌঁছে দিতে। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি যে সেনাবাহিনী তলে তলে সূচী-কে হঠানোর ষড়যন্ত্র করে ফেলেছে।

এরমধ্যে সূচী সরকার নির্বাচনের ঘোষণা করেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ফের জয়ী হন। মায়ানমারে সেনাবাহিনীর জন্য কিয়দংশ আসন সংরক্ষিত থাকে। সেটা সূচী কমিয়ে দশ শতাংশ করে দিয়েছিলেন। অথচ সেনা প্রধান মিং হান হাইলাং, যিনি এখন সেনা শাসক, তিনি ভোটের আগেই চেয়েছিলেন মায়ানমারের রাষ্ট্রপতি হতে সেটা সূচী রুখে দেন। তাতেই রাষ্ট্র সেনাবাহিনী সূচী-র নির্বাচনকে জালিয়াতি বলে অভিযোগ করে আচমকা তাঁকে বন্দি করে ফেলে। এবং মায়ানমারের ক্ষমতা দখল করে ফেলে। আর একটি বিরোধ তৈরি হয়েছিল সূচী-র সঙ্গে সেনাবাহিনীর। জাতিগত দাঙ্গায় বিধ্বস্ত রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সূচী সবকটি জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তি স্থাপন করতে চেয়েছিলেন, যাদের অনেককেই সেনাবাহিনী পছন্দ করত না। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও সমঝোতা সেনা বাহিনী পছন্দ করত না। একমাত্র উগ্র সাম্প্রদায়িক কারণে। তাঁরা মায়ানমারকে বৌদ্ধ রাষ্ট্র হিসাবেই দেখতে চান। ধর্মনিরপেক্ষ নয়। বর্তমান বিজেপি সরকারের সঙ্গে অনেকটা আদর্শগত মিল রয়েছে সেনা শাসকদের।

ভারতের পক্ষে আরো একটি অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চিনের প্রভাব বৃদ্ধি। যে আরাকান সশস্ত্র বাহিনীকে চিন প্রকাশ্যে সমর্থন করতো তাঁদের উপর থেকে বর্তমান সেনা শাসকরা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। মূলত চিনকে সঙ্গে পাওয়ার জন্য। এছাড়া কয়েকটি জাতি গোষ্ঠীকে সেনা শাসকরা আর্থিক স্বাধীনতা দিয়ে সমঝোতা করেছে। তবে রাজনৈতিক ক্ষমতা এখনও দেয়নি। অন্যদিকে সূচীর সমর্থকরাও অন্য জাতি গোষ্ঠীদের সংগে সমঝোতা করার উদ্যোগ নিয়েছে গোপনে। এমনকি তথাকথিত স্বাধীন সরকার রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও সমঝোতা করতেও প্রস্তুত বলে ঘোষণা করেছে। তাঁরা চিন প্রদেশের জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গেও জোট বেঁধেছে। তাতেই তাদের উপর আক্রমণ নেমে এসেছে। তাই তাঁরাও আজ রোহিঙ্গাদের মতো ঘরছাড়া। ভারতে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। সেনা সরকারকে না চটাতে চাইলেও শাঁখের করাতের মুখে ভারতের কূটনীতি। জলে কুমীর - ডাঙ্গায় বাঘ। আগামী দিন মায়ানমার ভারতের যে কঠিন শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।