আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২১ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

ভাষা থেকে ধর্ম - আসামে বিভাজনের রাজনীতির ভোলবদল

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার


এতদিন যা ছিল বাঙালি বিদ্বেষ, এখন তা-ই মুসলিম বিদ্বেষের চেহারা নিয়েছে। অন্তর্বস্তু পালটায়নি, ভোল পালটেছে মাত্র। এক সময়ে যাদেরকে স্থান দেওয়া হয়েছিল অন্দরে, পরিবর্তিত সময়ের হিসেব নিকেশে তারা এখন অবাঞ্ছিত অপরত্বের দূরত্বে নিক্ষিপ্ত। ঘুঁটে পুড়ছে দেখে কিছু গোবরের মুখে নির্বুদ্ধিতার তৃপ্তির হাসিও ফুটে উঠছে হয়ত কোথাও। জানে না, সব গোবরের অন্তিমদশা অভিন্ন। একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, আসামের শাসকশ্রেণির রাজনীতির কেন্দ্রে এখনও রয়ে গেছে সেই শতাব্দী প্রাচীন আতঙ্ক, অসমীয়া জাতির অস্তিস্ত্বের বিপন্নতা। বাঙালি বিরোধিতা, মুসলিম বিদ্বেষ, উৎস অভিন্ন। সেই আতঙ্ক। প্রাক্তন কংগ্রেসী হিমন্তবিশ্ব শর্মা আর যোগী আদিত্যনাথ, মুসলিম বিদ্বেষী কথাবার্তায় কে এগিয়ে আছেন বলা মুশকিল। হিমন্ত পশ্চিমবঙ্গের শুভেন্দু অধিকারীর মতই। জার্সি পালটেই মুসলিম বিদ্বেষী হুঙ্কারে আদি বিজেপিদের ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। ভোটের আগে হিমন্ত সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ফলাফল তো জানাই। মুসলিমরা কংগ্রেস জোটকে ভোট দেবে, আর হিন্দুরা বিজেপিকে। ব্যস, ফলাফল হয়ে গেল। হিসেব পরিষ্কার। ভোটের পরই দলের সংখ্যালঘু মোর্চার কমিটি ভেঙে দিল বিজেপি। বলল, মুসলিমরা ভোট দেয়নি, তাই এই মোর্চার কমিটিরও প্রয়োজন নেই। সাংবাদিক সম্মেলনে এক রাজ্যস্তরের নেতা বলে দিলেন, সংখ্যালঘু প্রধান এলাকায় উন্নয়নের কাজ করতে আমরা বাধ্য থাকব না। তার কিছুদিন পরই মুখ্যমন্ত্রী বললেন, মুসলিমদের জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। অদূর ভবিষ্যতে রাজ্যে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। মুখ্যমন্ত্রীর মতে, অতএব মুসলিমদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দু’টির বেশি সন্তান হলে রাজ্য সরকারের চাকরি পাওয়া যাবে না। এমনকী সরকারের সমাজ কল্যাণ প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত থাকবে যাদের সন্তান সংখ্যা দুইয়ের বেশি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সন্তানের সংখ্যা সীমিত রাখার নীতি আরো অনেক জায়গাতেই হয়েছে ইতিপূর্বে। কিন্তু আসামের সিদ্ধান্তটি অমানবিকভাবে অভিনব এবং বৈষম্যমূলক। সামগ্রিক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এই নীতির উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য শুধুমাত্র একটি জনগোষ্ঠীর অর্থাৎ মুসলিমদের জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ করে হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার স্থায়ীত্বের সুনিশ্চিত করা।

পৃথিবীর সর্বত্রই জনগোষ্ঠীগত বিদ্বেষের রাজনীতি পরিসংখ্যানের রাজনীতিকরণ ছাড়া এগোয় না। হিমন্ত বলছেন, মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান ধরন বজায় থাকলে হিন্দুরা রাজ্যে সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। এ ধরনের কথা আমরা এর আগে শুনেছি হিটলারের জার্মানিতে। ইহুদিদের জনসংখ্যা নিযন্ত্রণ এবং মিশ্রণ রোধ না করলে জার্মানদের আর্যরক্তের বিশুদ্ধতা থাকবে না। আসামে পরিসংখ্যান কী বলে? মুসলিমরা কি সত্যিই টপকে যাবে হিন্দুদের? পরিসংখ্যানের মর্জিমাফিক চয়ন ও বর্জনের মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে ভ্রান্ত তত্ত্ব। তারপর পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ওয়াটসআপ, ফেসবুক ও টুইটারের মাধ্যমে জনসমাজে। প্রকৃত পরিসংখ্যান বলছে, এই আশঙ্কাগুলো সম্পূর্ণ অমূলক। আজকের দিনে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় নারীর মোট প্রজনন হার বা টোটাল ফার্টিলিটি রেটের হিসেবের ওপর। অর্থাৎ প্রতিটি নারীর গর্ভে গড়ে কতজন শিশু জন্ম নেয় তার হিসেব। সারাদেশেই নারীর প্রজনন হার ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৯-২০ পর্বে কমেছে। এটা ঠিক আসামে মুসলিম নারীর প্রজননের গড় হিন্দু ও খ্রিস্টান নারীর চেয়ে বেশি। ২০১৯-২০ সময়পর্বে মুসলিম নারীর প্রজনন গড় ২.৪। অন্যদিকে হিন্দু নারীর ক্ষেত্রে এই হার ১.৬ এবং খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে ১.৫। কিন্তু ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৯-২০ সময়পর্বে মুসলিম নারীর প্রজনন গড় ৩.৬ থেকে কমে ২.৪ হয়েছে। অর্থাৎ প্রজনন গড়ের হ্রাসের হার ১.৩। হিন্দুদের ক্ষেত্রে হ্রাসের হার ০.৪। অর্থাৎ মুসলিম নারীর প্রজনন গড় কমেছে হিন্দু নারীর চেয়ে বেশি হারে। প্রজনন হারের বিষয়টি প্রধানত আর্থ সামাজিক উন্নয়নের উপরই নির্ভর করে। তাই দেখা যাবে কাশ্মীরের মুসলিম নারীর প্রজনন গড় ১.৪৫ আর বিহারে হিন্দু নারীর এই গড় ২.৯। একটি ডাহা মিথ্যের ওপর আসামে সরকার একটি সন্তান-নীতি জারি করেছে, যার লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। অথচ আসামে যে জনগোষ্ঠীর জন্মহার মুসলিমদের সমতুল বা তার চেয়ে বেশি সেই অনুসূচিত জাতি বা স্থানীয় জনজাতি এবং চা জনগোষ্ঠীর মানুষদের রাখা হয়েছে এই আইনের বাইরে। আসলে আসামের রাজনীতির বয়ানবাজীও পালটে পালটে যাচ্ছে। এতদিন বলা হত, আসামে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে কারণ বিপুল হারে বাংলাদেশ থেকে মুসলিমরা আসামে অনুপ্রবেশ করছে। এখন এন-আর-সি’র সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর দেখা যাচ্ছে অনুপ্রবেশের সেই অভিযোগগুলির বেশিরভাগই ভিত্তিহীন। এখন ‘অনুপ্রবেশ’ বিষয় হিসেবে আগের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তাই আমদানি হয়েছে জন্মহার বিষয়ক রাজনীতি। সারা রাজ্যেই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম বিরোধিতার প্রচার তীব্র করা হয়েছে। জবরদখল উচ্ছেদের নামে বেছে বেছে দরিদ্র মুসলিম পরিবারদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই মুসলিম জনগোষ্ঠী নিয়ে চলছে পরিকল্পিত অপপ্রচার। শ্রমের বাজারে মুসলিম শ্রমজীবী, আর ভোটের বাজারে মুসলিম জননেতা- সবাইকেই দেখা হচ্ছে ঘৃণার চোখ দিয়ে। একজন মুসলিম নেতা রাজ্যের বৈধ নাগরিক হলেও মুখ্যমন্ত্রীত্বের দাবিদার হতে পারবে না। মুসলিম মুখ্যমন্ত্রী হলেই নাকি ঘর থেকে হিন্দু মেয়েদের রাস্তায় টেনে এনে ইজ্জত লুটে নেওয়া হবে। এবারের নির্বাচনে এটাই ছিল সর্বাত্মক প্রচার। শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকলেই গলাধঃকরণ করেছে এই প্রচার। যে কোনো অপরাধে ধৃত ধর্ম পরিচয়ে মুসলিম হলে সমাজে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া, অ-মুসলিম হলে আরেক ধরনের প্রতিক্রিয়া, এটাই স্বাভাবিক ধরন হয়ে গেছে।

জাতীয় পর্যায়ের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের মত আসামেও এখন সংবাদ মাধ্যমগুলিতে হিন্দুত্বের অলিখিত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কোভিড সংক্রমণের প্রথমপর্বে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিমন্ত সব দোষ চাপিয়েছিলেন দিল্লির মারকাজের মুসলিম ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ঘাড়ে। প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করে আক্রান্ত রোগীর নাম ঠিকানা প্রকাশ করে দেওয়া হত। সামাজিক গণমাধ্যমে কোভিড আক্রান্ত মুসলিমদের নাম প্রকাশ করে বলা হত এরা সব ‘কোভিড জেহাদী’। এ সব শুনলে মনে পড়ে যাবে, উনবিংশ শতকে ইংল্যান্ডে প্লেগের প্রাদুর্ভাবের সময় এভাবেই বলা হত, ইহুদিরা ইচ্ছে করে প্লেগ ছড়াচ্ছে। সম্প্রতি হঠাৎ বলা হল, মুসলিম প্রধান জেলাগুলিতে ভ্যাকসিন বিমুখতা চলছে। ফলে রাজ্যের ভ্যাকসিন প্রদানের হারের সর্বনিম্নে রয়েছে মুসলিম প্রধান জেলাগুলি। বিক্ষিপ্তভাবে একটি দু’টি মুসলিম ও অ-মুসলিম প্রধান জেলার তথ্য দিয়ে অপপ্রচারের মূল সুর তৈরি করে ফেলা হল। গত ১০ জুন আসামের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ‘আসাম ট্রিবিউন’ প্রথম পাতায় চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী প্রতিবেদন লিখল এই শিরোনামে, ‘ভ্যাকিসিন নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ততা মুসলিম প্রধান জেলায় সর্বাধিক’। বলা হল, ৯৫ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যার দক্ষিণ শালমারা জেলায় ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছে মাত্র ৩.৬৫% মানুষ। ধুবড়ি জেলা যেখানে ৭৩.৪৯% মুসলিম, ভ্যাকসিন নিয়েছে মাত্র ৬.৫%। পাশাপাশি ৪৬ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যার কামরূপ মেট্রো জেলায় ভ্যাকসিন নিয়েছে ৫০.৪৪% এবং ০.৩৫ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যার মাজুলি জেলায় ভ্যাকসিন নিয়েছে ২৯.৭৮%। বিচ্ছিন্নভাবে এই চারটি জেলার তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে মুসলিম বিরোধী প্রচার বিদ্যুতের মত ছড়িয়ে গেল। প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, সর্বনিম্ন ভ্যাকসিন গ্রহণের প্রথম ১০টি জেলার মধ্যে প্রথম ও দশম স্থানে দু’টি মুসলিম প্রধান জেলা থাকলেও দ্বিতীয় সর্বনিম্ন থেকে নবম সর্বনিম্ন ভ্যাকসিন গ্রহণের জেলাগুলির সবগুলিই অ-মুসলিম প্রধান জেলা, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যার শতকরা হার যথাক্রমে ০.৪২, ২.০৪, ০.৩৫, ২২.৬৬, ৬.৬৯, ২.৮৮, ১৪.২৯। ওয়াটসআপ ফেসবুক খবরের কাগজ মারফত ছড়িয়ে দেওয়া মিথ্যা এই তত্ত্ব। প্রকৃত সত্যটি কোথাও স্থান পেল না বললেই চলে। এই সর্বগ্রাসী মুসলিম বিদ্বেষ এখন ছড়িয়ে পড়েছে আসামের প্রতিটি কোণে। বলা যায়, মুসলিম বিদ্বেষের জ্বরে ছেয়ে আছে এখন আসাম।

এই যে পরিবর্তন আজ চোখে পড়ছে তা কিন্তু হঠাৎ ঘটেনি। ঘটেছে খুব ধীরে ধীরে সুনির্দিষ্ট নীল নকশা অনুযায়ী। শতাব্দী প্রাচীন অস্তিত্ত্বের বিপন্নতার প্রশ্নটি অসমীয়া সমাজের অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। স্বাধীনতা-পূর্ব আসামের ১২১ বছরের ইতিহাসে সমাজ সংস্কৃতি ও রাজনীতির নানা ঘটনাবলীর মধ্যেই এই বিপন্নতাবোধের জন্ম। এই ইতিহাস সম্পৃক্ত হয়ে আছে ‘আসাম’ নামের ভূগোলটির নানা ভাঙাগড়ার ঘটনার ঘনঘটায়। এই জটিল ইতিহাস না জেনে আজকের আসামকে বোঝা অসম্ভব। আসামের রাজনীতি প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের সাংস্কৃতিক রাজনীতি। এই সাংস্কৃতিক রাজনীতিকে এড়িয়ে রাজ্যের বাস্তব রাজনীতিতে যথাযথ ভূমিকা পালন করা অসম্ভব। এই সাংস্কৃতিক রাজনীতির আবার রয়েছে অসংখ্য বয়ান। অসমীয়া বয়ান, বাঙালি বয়ান। হিন্দু বয়ান, মুসলিম বয়ান। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বয়ান, বরাক উপত্যকার বয়ান। এই দ্বিমাত্রিকতাগুলির আবার রয়েছে নানা উপমাত্রা। এই বিচিত্রমুখী কখনো পরস্পর বিরোধী বয়ানগুলিকে একত্রিত বিবেচনায় আনা একটি অত্যন্ত দুরূহ বিষয়। আবার এই সামগ্রিক বয়ানের চর্চা বাদ দিয়ে বাস্তব রাজনীতির প্রগতিশীল অভিমুখ নির্মাণও সম্ভব নয়। আসামের রাজনীতির এই সুকঠিন চর্চাটির অনুপস্থিতিই আসামের রাজনীতিকে পারস্পরিক দ্বন্দ্বসর্বস্বতায় দাঁড় করিয়েছে বারবার।

এমনকী সততা, সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার দীর্ঘ ঐতিহ্যের পরম্পরা থাকা সত্ত্বেও সাংস্কৃতিক রাজনীতির বিচিত্রমুখী ধারার সচেতন চর্চার ব্যবহারিক প্রয়োগকে নিজেদের কর্মধারায় অঙ্গীভূত করতে না পারার ব্যর্থতা আসামে বামপন্থীদের শক্তিশালী হয়ে ওঠার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। আসামের ইতিহাস বিচিত্রই। একটি জনগোষ্ঠীকে আবাহন জানিয়ে বাইরে থেকে রাজ্যের অভ্যন্তরে এনে সরকারিভাবে বসতি দিয়ে, কয়েক দশক পরই আবার তাদেরকেই সমূলে উচ্ছেদ করে বিতাড়ণের জন্যে বিপুল সরকারি ও রাজনৈতিক তোড়জোড়, এমন বিচিত্র মনোভাবের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্যত্র দুর্লভ। যাঁরা জঙ্গল কেটে জমি পরিষ্কার করে ম্যালেরিয়ার সাথে যুঝে আসামকে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা করেছে ওরাই নাকি পরে আসামের অস্তিত্ত্বের জন্যে বিপজ্জনক। প্রাক-ব্রিটিশ যুগে আসামে বহিরাগত জনগোষ্ঠীর প্রব্রজনের তেমন বড় দৃষ্টান্ত নেই। পূর্বপ্রান্তের পার্বত্য অঞ্চল থেকে মাঝে মাঝে নানা জনগোষ্ঠী আসামের সমতল অঞ্চলে নেমে এসে বসতি স্থাপন করেছে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ক্রমে তারা এখানকার জনসমাজের অংশই হয়ে গেছে। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৮২৬ সালে আসামকে যুক্ত করা হয় বঙ্গদেশের সাথে। এর পরপরই বঙ্গদেশ থেকে উকিল, কেরানি, ডাক্তার, মোক্তাররা ভাগ্যান্বেষণে আসামে আসতে শুরু করে। পরে আসামকে ১৮৭৪ সালে পৃথক রাজ্য হিসেবে গঠন করা হলে রাজস্বের ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে বঙ্গদেশের কয়েকটি অঞ্চলকে আসামের সাথে যুক্ত করে দেওয়া হয়। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময়ে আসাম ছিল জনবিরল ভূমি এবং এখানে অকর্ষিত পতিত জমি ছিল প্রচুর। কারণ আসামের স্থানীয় মানুষ জলাজমিতে চাষাবাদ করতে জানতেন না। ওদিকে তখন পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায়, বিশেষ করে ময়মনসিংহ অঞ্চলে জমির ওপর জনসংখ্যার চাপ ছিল প্রবল। জমির ক্ষুধায় ক্ষুধার্ত এই কৃষকদের পরবর্তীতে ১৯০১ সাল থেকে সরকারি সিদ্ধান্তে আসামে এনে বসতি প্রদান করা হতে থাকল এতদিনের অহল্যা জমিতে। এতে খাদ্যশস্য উৎপাদনে এক বিপুল বৃদ্ধির সঙ্গী হয়ে আসামে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এলো ঠিকই কিন্তু বঙ্গভাষীরা হয়ে গেল আসামের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী।

ব্রিটিশ প্রশাসন দুরভিসন্ধি কিংবা অজ্ঞানতা, এই দুইয়ের যে কোনো একটি কারণেই হোক, ১৮৩৬ সালে বাংলা ভাষাকে আসামে শিক্ষার মাধ্যম ও প্রশাসনের ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছিল। এই ব্যবস্থা চালু ছিল ৩৬ বছর। এই ঘটনার প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই অসমীয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রথম রাজনৈতিক আত্মপ্রকাশ। সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে প্রথমে ভাষা ও সংস্কৃতি, পরে জমি, আত্মপরিচয়ের এই বাহনগুলিকে হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত অসমীয়া মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে প্রথমে দেখা দিল বাঙালি বিরূপতা, পরে যা পরিণত হল বাঙালি বিরোধিতার রাজনীতিতে ও শেষে বাঙালি বিদ্বেষের মানসিকতায়। জন্ম নিল নিজ দেশে পরবাসী হওয়ার ভয়। অবশ্য ১৮৭৪ সালের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের পর ভাষিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের বিপন্নতার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল ইচ্ছের বিরুদ্ধে বঙ্গদেশ থেকে আসামের সাথে যুক্ত করে দেওয়া সিলেট ও কাছাড়ের জনসাধারণের মধ্যেও।

আসামে বাঙালি রাজনীতির বিকাশ ঘটে দু’টি সমান্তরাল ধারায়। ময়মনসিংহ থেকে আসা বাঙালি কৃষকদের সংখ্যা বিংশ শতকের দুইয়ের দশকে এসে ৫,৫০,০০০ দাঁড়ালে অসমীয়া সমাজে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল চাষযোগ্য জমির ওপর দখল হারানোর। ফলে সরকারের তরফে ‘লাইন প্রথা’ চালু করে বঙ্গদেশ থেকে আসা কৃষকদের একটি নির্দিষ্ট চরিত্রের জমি ও নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে বসতিকে সীমাবদ্ধ রাখার কথা ঘোষণা করা হয়। যারা এর বাইরের জমিতে বসতি স্থাপন করেছিল হাতি দিয়ে তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে, ফসল নষ্ট করে উচ্ছেদ করা হল। এর বিরুদ্ধে মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে কৃষকদের প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হল। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা এই কৃষকদের ৮৫ শতাংশই ছিলেন মুসলিম। তাই কৃষকদের এই লড়াই প্রতিভাত হয়ে গেল পূর্ববঙ্গাগত বাঙালি মুসলিমদের সংগ্রাম হিসেবে। ওই সময়পর্বে বহিরাগত বাঙালি কৃষক সমাজের মূল লড়াই ছিল জমি ও ফসলের অধিকার রক্ষা করার। মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এই তীব্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই তাঁরা একটি বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ১৯৩৭ সালে আসামের পরিষদীয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করে। মৌলানা ভাসানীও কৃষকদের অধিকারের বিষয়কেই পরিষদীয় রাজনীতির ক্ষমতার লড়াইয়ে দরকষাকষির বিষয় হিসেবে প্রাধান্য দেন। পরাধীনতার শেষ লগ্নে মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে কৃষকদের জমি ও ফসলের সংগ্রাম পাকিস্তান আদায়ের আন্দোলনের সাথে একাকার হয়ে যায়। মৌলানা ভাসানী আসামের পাকিস্তান ভুক্তির মধ্য দিয়ে কৃষকদের জমি ও ফসলের সংগ্রামের নিষ্পত্তি হবে বলে প্রচার করতে থাকেন। যদিও এই প্রচারণার কোনো পর্যায়েই মৌলানা ভাসানী দেশের অন্য প্রান্তের মুসলিম লিগ নেতাদের মত হিন্দুবিরোধী বক্তৃতা করেননি। এই কারণে ভাসানীকে নিয়ে কেন্দ্রীয় মুসলিম লিগ নেতাদের অস্বস্তির শেষ ছিল না। মুসলিম জমিদার ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আসা ওই নেতাদের রাজনৈতিক আদর্শ ও ভাসানীর রাজনীতি ছিল বিপরীত মেরুর। কিন্তু কিছু করার ছিল না। কারণ ভাসানী ছিলেন আসামের মুসলিম লিগের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা যাকে উপেক্ষা করা অসম্ভব ছিল। ভাসানীর সমস্ত বক্তৃতাই কেন্দ্রীভূত থাকত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক ও জমির সামন্ত মালিকদের বিরুদ্ধে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকেও তিনি হিন্দুবিরোধী মুসলিম একাধিপত্যের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হিসেবে দেখেননি। ভাসানীর নেতৃত্বাধীন কৃষক সমাজের সামনে ভাষা বা সংস্কৃতির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বিচ্ছিন্নভাবে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে গোয়ালপাড়া জেলায় বাংলা ভাষার অধিকার চেয়ে সভাসমিতির দৃষ্টান্ত যদিও খুঁজে পাওয়া যায়। তবু এঁদের লড়াইটা ছিল মূলত ভূমির অধিকার কেন্দ্রিক।

অন্যদিকে, বাঙালি হিন্দুদের রাজনীতির মূল সুরটি ছিল ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার কেন্দ্রিক। তাছাড়া ছিল পরিষদীয় রাজনীতির ক্ষমতার অংশীদারিত্বের লড়াই। বাঙালি মুসলিম কৃষকদের জমির অধিকারের আন্দোলনে বাঙালি হিন্দু নেতৃত্বের কোনো প্রত্যক্ষ সমর্থন সূচক ভূমিকা ছিল না। বরং এই প্রশ্নে কখনো কখনো আইনসভার ভেতরে ও বাইরে অসমীয়া রাজনীতির সাথেই তাদের সহমত ব্যক্ত করতে দেখা গেছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে দেশভাগ অনিবার্য হয়ে উঠলে ভাসানীর নেতৃত্বে কৃষকদের ‘লাইন প্রথা’ বিরোধী অবারিত জমি অধিকার ও উচ্ছেদ বিরোধী লড়াই মিলে গেল পাকিস্তান আদায় ও আসামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে। অসমীয়া মধ্যবিত্তের রাজনীতিও এই পর্যায়ে এসে হিন্দু ও মুসলিম চেহারাতে বিভক্ত হতে শুরু করে। একদিকে, ভাষার প্রশ্নে বাঙালি মুসলিমদের অনুচ্চস্বর অবস্থান, অন্যদিকে, বরপেটা অঞ্চলের কোনো কোনো জায়গায় অসমীয়া ভাষা গ্রহণ করার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে অসমীয়া মুসলিম রাজনৈতিক নেতারা পাকিস্তান ভুক্তির আগ্রহে ‘লাইন প্রথা’ বিরোধিতা নিয়ে এতদিনকার দ্বিধা বা অসমর্থন ত্যাগ করে বাঙালি মুসলিম কৃষকদের স্বপক্ষে দাঁড়ালেন। উলটোদিকে আসামের পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতায় বাঙালি হিন্দু রাজনীতি ও অসমীয়া হিন্দুর রাজনীতি কাছাকাছি চলে এসেছে। তবে সিলেটকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে অসমীয়া হিন্দু রাজনীতি মুসলিম লিগের রাজনীতিকেই সমর্থন করে গেছে কখনো প্রকাশ্যে, কখনো প্রচ্ছন্নভাবে।

সিলেট নিয়ে ১৮৭৪ থেকে ১৯৪৭, বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম রাজনীতির ভূমিকা বদলগুলি চমকপ্রদ। ১৮৭৪ সাল থেকে ১৯০৫ অবধি আসামের অসমীয়া ও বাঙালি সমাজের হিন্দু মুসলিম উভয়পক্ষই চাইতেন সিলেটকে বঙ্গদেশে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। ১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠিত হওয়ার পর বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম সমাজের ভূমিকা বিপরীত পথ নিল। বাঙালি হিন্দুরা চাইলেন সিলেট বঙ্গদেশেই ফিরে যাক। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের ফলে জনসংখ্যার ভারসাম্যের পরিবর্তন নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশকে মুসলিম রাজনীতির একটি সম্ভাব্য উত্থানভূমি হিসেবে আবিষ্কার করে বাঙালি মুসলিমরা চাইলেন সিলেট আসামেই থাক। এই অবস্থান থেকেই বিপিনচন্ত্র পালের উদ্যোগে কলকাতায় সিলেটের বঙ্গভুক্তির দাবিতে আয়োজিত নাগরিক সভা ভণ্ডুল করে দেন কলকাতা বন্দরের সিলেটি মুসলিম খালাসীরা। ব্রিটিশ শাসনামলেই আসামের আইন সভায় সিলেটের বঙ্গভুক্তির প্রস্তাবও গৃহীত হয়েছিল। ১৯৪৭ এর বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম রাজনীতির অবস্থানের একশো আশি ডিগ্রি বদল হয়ে গেল দেশভাগ অবশ্যম্ভাবী প্রতীয়মান হতেই। এবার বাঙালি হিন্দুরা চাইলেন সিলেট আসামে থাকুক এবং মুসলিমরা সিলেটের পূর্ববঙ্গভুক্তির জন্যে সোচ্চার হয়ে উঠলেন। আসলে তখন আসাম মানে ভারত এবং পূর্ববঙ্গ মানে পাকিস্তান হয়ে গেছে।

একটি কথা পরিষ্কার অসমীয়া বা বাঙালি রাজনীতির এই অবস্থানগুলি সংকীর্ণ স্বার্থের দ্বারাই চালিত ছিল। কোনো সার্বিক মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা এর সাথে জড়িত ছিল না। পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরিকল্পনাটিই ছিল স্ববিরোধী। পাকিস্তান কি সমস্ত ভারতীয় মুসলিমদের জন্যে অখণ্ড বাসভূমি হিসেবে আত্মপ্রকাশের কথা ছিল? নাকি, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান ও অ-মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত নামে আসলে সব ধর্মের মানুষের জন্যে দু’টি পৃথক সমচরিত্রের দেশ হওয়ার কথা ছিল? এই বিভ্রান্তি সেদিনও ছিল, আজও রয়েছে। এর কোনো একটিও যদি সুচিন্তিতভাবে আনুষ্ঠানিক প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে হত, তবে দেশভাগের সময় সাড়ে তিন কোটি মানুষকে অসহায়ের মত সহায়সম্বল নিয়ে উন্মাদের মত দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে সীমান্তরেখার দিকে ছুটতে হত না। জনসংখ্যা বিনিময় অথবা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, সবটাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হওয়ার কথা ছিল। আসামের রাজনীতির ক্ষেত্রে এই কথাগুলি আজও প্রাসঙ্গিক। কারণ আসামের অসমীয়া নেতৃবৃন্দ ভেবেছিলেন তৎকালীন আসামে বঙ্গদেশ থেকে সংযুক্ত করা অঞ্চলগুলিকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিলেই তারা বাঙালি কেন্দ্রিক আশঙ্কা, উৎকন্ঠা ও আতঙ্ক থেকে চিরতরে মুক্তি পাবেন। এই ভাবনা থেকেই গোপীনাথ বরদলৈয়ের ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাবের জোরালো বিরোধিতা। তাঁরা ভেবেছিলেন, বাংলা ও আসাম অভিন্ন গ্রুপিং-এ থাকলে আবার বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অধীনতার যুগ ফিরে আসবে। কিন্তু দেশভাগ যে বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীর বিপুল বহিরাগমন ঘটাবে এই ভবিষ্যৎ বাস্তবতা বুঝতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাঁরা আতঙ্কিত হয়ে থাকলেন শুধু বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির দিনগুলির প্রত্যাবর্তনের আশঙ্কায়। ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাবে রাজ্যগুলির কিন্তু গ্রুপিং থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অধিকারও ছিল। ক্যাবিনেট মিশন বাস্তবায়িত হলে দেশভাগ হত না। সাড়ে তিনকোটি মানুষ বাস্তুহারা হত না। পঁচিশ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারাতো না। প্রায় এগারো লক্ষ নারী অপহৃতা হতেন না। সর্বোপরি, আসাম, পার্বত্য ত্রিপুরা বা উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিকে উদ্বাস্ত জনসংখ্যার বোঝা বইতে হত না। শুধুমাত্র ভাষা ও সংস্কৃতি হারানোর আতঙ্ক এত বড় একটি ট্রাজেডির জন্ম দিয়েছে এই উপমহাদেশে যার ক্ষত সত্তর বছরেও অন্তর্হিত হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে হবেও না।

ভাষা ও ধর্মের রাজনীতির এই দোলাচল ছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বের আসামের রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য। এই পরস্পর বিরোধী বিভ্রান্তিকর রাজনীতির বয়ানের দ্বন্দ্বসংঘাতেই নির্মিত হয়েছে আধুনিক আসামের রাজনৈতিক ইতিহাস। স্বাধীনতার পর অস্তিত্বরক্ষার রাজনীতি ভাষিক একাধিপত্যের রাজনীতিতে পরিবর্তিত হল। ভাষিক বৈচিত্রের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে যেনতেন প্রকারেণ আসামকে একভাষী রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাটাই হয়ে উঠল মূল কার্যসূচি। রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সুস্পষ্ট সুপারিশ ছিল, কোনো রাজ্যে শতকরা অন্তত পঁচাত্তর শতাংশ মানুষ একটি নির্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর হলেই সেই ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যটি একভাষী রাজ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। যদি কোনো রাজ্যে দেখা যায় প্রধান ভাষাটি বাদ দিয়ে অন্য কোনো একটি ভাষা সেখানকার জনসংখ্যার অন্তত তিরিশ শতাংশের মাতৃভাষা তবে সেক্ষেত্রে রাজ্যটিকে দ্বিভাষী রাজ্য হিসেবে পরিগণিত করা হবে। এই মাপকাঠিতে আসামকে একভাষী রাজ্য হিসেবে দাবি করার কোনো অবকাশ ছিল না। প্রকৃতপক্ষে ১৯০১ সাল থেকে সাম্প্রতিকতম সময় অবধি কোনো জনগণনায় অসমীয়া ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ যে অঞ্চলগুলি নিয়ে আজকের আসাম গঠিত তার কোনো অংশে জনসংখ্যার পঁচাত্তর শতাংশ ছিলেন না। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক ও সরকারি নানা উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীকে জনগণনায় অসমীয়া ভাষীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার পরও অসমীয়াভাষীর সংখ্যা কখনোই ষাট শতাংশ অতিক্রম করেনি। এই বাস্তবতাকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করেই শাসকশ্রেণির রাজনীতির বয়ানটি নির্মিত হতে থাকে উগ্র জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে। এই রাজনীতির প্রথম রূপায়ন হয় ১৯৫১ সালের জনগণনায় পূর্ববঙ্গ মূলের বাঙালি মুসলিমদের অসমীয়াভাষী হিসেবে নথিভুক্ত করানোর সর্বাত্মক সরকারি উদ্যোগ ও রাজনৈতিক অভিযানের মধ্য দিয়ে। এই সফল রূপায়নের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ শাসিত আসাম প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানো অসমীয়া জাতি জনগনণার মাধ্যমে সরকারিভাবে সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ফিরে পায়। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত কতটা নৈতিক এবং কতটা অনৈতিক এ নিয়ে আসামের রাজনীতি আজও দ্বিধাবিভক্ত। ১৯৫১ সালের জনগণনার পৃনরাবৃত্তিতে ১৯৭১ সালের জনগণনায় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বহিরাগত চা জনগোষ্ঠীকে অসমীয়াভাষী ও বরাক উপত্যকার চা জনগোষ্ঠীকে হিন্দিভাষী হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। অথচ দুটো দাবিই ঐতিহাসিকভাবে ভিত্তিহীন।

ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার চা শ্রমিকরা এসেছিল মূলত সাঁওতাল পরগণা থেকে, আবার বরাক উপত্যকার চা শ্রমিকদের বেশিরভাগের আদি বাসভূমি বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর এবং তদানীন্তন মানভূম অঞ্চল। এই জোরাজুরি ও সরকারি নীতি ও কৌশলে ভাষিক পরিচয় পরিবর্তন করার রাজনীতির ফল হয়েছে বিপরীতই। আসামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলি যারা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অসমীয়া জাতিসত্তায় বিলীন হয়ে যাচ্ছিল তারাও স্বাধীনতা উত্তর সময়ের আগ্রাসী উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রতিক্রিয়ায় নিজেদের স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ের রাজনীতির পথই গ্রহণ করে। অসমীয়া ভাষাকেই একমাত্র রাজ্যভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে ষাটের হিংসাত্মক আন্দোলনের কয়েক বছর মধ্যেই আসামের সুপ্রাচীন জনগোষ্ঠী বোড়ো সম্প্রদায় নিজেদের ভাষা ও স্বশাসনের দাবিতে রাজনৈতিক ভাবে সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে। যতদিন যাচ্ছে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে পৃথক পরিচিতিসত্তার রাজনীতি শক্তিশালী হয়েই চলেছে। এর জন্যে স্বাধীনতা উত্তর আসামের আগ্রাসী উগ্র জাতীয়তাবাদী অসমীয়া রাজনীতিকেই দায়ী করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। বঙ্গদেশ মূলের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের বক্তব্য, স্বাধীনতার অনেক আগেই চর অঞ্চলের নানা স্থানে নিজস্ব উদ্যোগে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মুসলিম সম্প্রদায় অসমীয়া মাধ্যমের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফলে জনগণনায় এই পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক পরিণতি এবং সেজন্যেই ভাষিক পরিচয় পরিবর্তনের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ওই সমাজের তরফ থেকে তেমন জোরালো প্রতিরোধ বা বিরোধিতা হয়নি।

প্রকৃতপক্ষে, বিষয়টি এতটা সরল নয়। এটা সত্যি যে, ব্রিটিশ শাসিত আসামেই ধনীরাম তালুকদারের মত অসমীয়া বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের অস্তিত্ত্বের আতঙ্কের উপশমের উদ্দেশ্যে বহিরাগত বাঙালি মুসলিম কৃষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন অসমীয়া ভাষা সংস্কৃতি গ্রহণের জন্যে। ১৯২৫ সালেই ‘অসমত বিদেশি’ শীর্ষক বই প্রকাশ করে জয়নাথ বরাও বহিরাগত বাঙালি কৃষকদের অসমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণের আবেদন জানিয়েছিলেন। গণভোটের মাধ্যমে সিলেটের পাকিস্তানভুক্তি সুনিশ্চিত হওয়ার পর মৌলানা ভাসানী দাবি তুলেছিলেন কাছাড়, গোয়ালপাড়া সহ অন্যত্র একইভাবে গণভোটের মাধ্যমে ভারত বা পাকিস্তান ভুক্তির বিষয় চূড়ান্ত করার জন্যে। এরই প্রতিক্রিয়ায় ‘বঙ্গাল খেদা’ ডাক দিয়ে ১৯৫০ সালে নিম্ন আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক মুসলিম বিরোধী দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। আসামের পূর্ববঙ্গ মূলের মুসলিম সমাজে এই সময়টিকে ‘রায়টের বছর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মৌলানা ভাসানী সে সময়ে পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিবাদ সভায় বক্তৃতা করতে থাকেন। এমন একটি আবহেই পুলিস মৌলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করে আসাম থেকে বহিষ্কার করে তাঁকে সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়া হয়। শর্ত দেওয়া হয়, তিনি আসামে ফিরতে পারবেন না। একদিকে দাঙ্গা, অন্যদিকে মৌলানা ভাসানীর দৃশ্যপট থেকে চলে যাওয়া। দুইয়ে মিলে আতঙ্কিত হয়ে প্রায় এক লক্ষ পূর্ববঙ্গ মূলের মুসলিম নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ববঙ্গ প্রদেশে আশ্রয় নেয়। পরে দেশভাগকালীন নির্বিচার দাঙ্গাহাঙ্গামা ও সংখ্যালঘুর জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্যে যে নেহরু-লিয়াকত চুক্তি হয়, তার সুবাদে পূর্ববঙ্গে আশ্রয় নেওয়া কৃষকদের সিংহভাগ পরবর্তীতে আসামে ফিরে আসে। আসামের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও সাংসদ হেম বরুয়ার মতে প্রায় ৫৩,০০০ হাজার পরিবার পূর্ববঙ্গ থেকে আবার আসামে ফেরার সুযোগ পায়। এই ফিরে আসাও খুব সুখের ছিল না। এই সময়পর্বেই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অসমীয়া জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে মুসলিম বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়। অম্বিকাগিরি রায় চৌধুরীর মতো অসমীয়া সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব প্রকাশ্য বক্তৃতায় বাঙালি বিরোধিতা, কম্যুনিস্ট বিরোধিতার পাশাপাশি মুসলিমদের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখেন। এই সময়পর্বে ১৯৫১ সালে শুধু আসামের জন্যে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী তৈরির সিদ্ধান্ত হয় পূর্ববঙ্গ থেকে ভবিষ্যৎ বহিরাগমন বন্ধ করার লক্ষ্যে। পূর্ববঙ্গ থেকে বাঙালিদের আগমন প্রতিহত করার জন্যে ‘ইমিগ্রেন্টস (এক্সপালসন ফ্রম আসাম) অ্যাক্ট’ নামে তখন একটি আইন ১৯৫০ সালে শুধু আসামের জন্যে বলবৎ করা হয়। লক্ষ্যণীয়, এই আইন এমন সময়ে প্রণয়ন হচ্ছে যখন সীমান্তের এক পার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ অপর পারে আশ্রয় নিচ্ছেন। নেতাদের স্বহস্তে রচিত এরকম একটি মানবিক বিপর্যয়ের সময়ে নেতারাই মানুষের আশ্রয়লাভের পথ বন্ধ করার জন্যে একটি অমানবিক আইন প্রণয়ন করছেন। আমাদের স্বাধীনতার লগ্নটি ক্ষমতালোভী নেতাদের এমন বর্বর আচরণের জন্যেই কুখ্যাত হয়ে আছে।

দু’দিন আগেও যে মানুষগুলি ছিল অভিন্ন দেশের সহ-নাগরিক, রাতারাতি তাঁরাই ঘৃণিত অবাঞ্ছিত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। উদ্বাস্তু জনসাধারণের সোচ্চার দাবির মুখে ১৯৫৭ সালে এই আইনের প্রত্যক্ষ প্রয়োগ স্থগিত হয়। পূর্ববঙ্গ মূলের মুসলিমদের উদ্দেশ্য করেই ১৯৪৮ সালের মে মাসে আসামের রাজস্ব বিভাগ একটি সার্কুলার প্রকাশিত করে বলেছিল, তোমরা আমাদের ভাষা গ্রহণ কর। বিনিময়ে জমির অধিকারের সুনিশ্চয়তা নাও। পূর্ববঙ্গ মূলের বাঙালি মুসলিমদের পক্ষে এমন রাজনৈতিক চাপের মুখে ভাষিক পরিচয় পরিবর্তনে শামিল হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। রাজ্যভাষা হিসেবে একমাত্র অসমীয়াকে মেনে নেওয়ার দাবিতে যে বাঙালি বিরোধী সহিংস আন্দোলন গড়ে ওঠে তাতে অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের স্বপক্ষে যোগ দেয় পূর্ববঙ্গীয় মূলের বাঙালি মুসলিমরা। সাতের দশকের শুরুতে হওয়া ‘বঙ্গাল খেদা’ অভিযানেও উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছে আসামে ন-অসমীয়া বা নতুন অসমীয়া বলে পরিচিতি হওয়া এই বাঙালি মুসলিমরা। ভাষিক পরিচয়ের এই পরিবর্তন সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গ মূলের এই জনগোষ্ঠীর উপর সরকারি উচ্ছেদ ও বহিষ্কারের অভিযান কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। ছয়ের দশকেই ভারত-পাক যুদ্ধের আবহে ‘পাকিস্তানী অনুপ্রবেশকারী’দের চিহ্নিত ও বহিষ্কারের নামে প্রায় বিনা শোরগোলে হাজার হাজার পূর্ববঙ্গ মূলের মুসলিমদের আসাম থেকে বহিষ্কার করে পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে ওপারে ঠেলে দেওয়া হয়। এই সংখ্যাটা কত তা নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব। কারো মতে পঞ্চাশ হাজারের বেশি, কারো মতে লক্ষাধিক। বহু পরিবার বিভাজিত হয়ে যায় এতে। বিবাহিত স্ত্রী সন্তান ও স্বামীর কাছ থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে ওপারে নিক্ষিপ্ত হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত অসংখ্য। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আসামের রাজনীতিতে এমন একটি অমানবিক পর্ব নিয়ে রয়েছে হিমশীতল নীরবতা। অতি সন্তর্পর্ণে ঘটেছিল ঘটনাগুলি। বহিষ্কৃত মানুষগুলি পূর্ববঙ্গে গিয়েও যথাযথ পুনর্বাসন পাননি। অধুনা বাংলাদেশের বহু অঞ্চলে ‘আসাম পাড়া’ নামে এক ধরনের বসতি দেখা যায় যেগুলোর জন্ম ওই ছয়ের দশকের আসামের তথাকথিত ‘পাকিস্তানী অনুপ্রবেশকারী’ বহিষ্কারের পরই।

বোঝা যায়, আজকের মুসলিম বিরোধী রাজনীতি হঠাৎ গজিয়ে ওঠেনি। এর উৎস রয়েছে আসামের রাজনীতির ঘটনাবহুল ইতিহাসের পরতে পরতে। তবে সেদিনের আসামের রাজনীতির মুসলিম বিরোধিতার এই ধারাটি ছিল সম্পূর্ণই এই ভূমিজাত। এর সাথে অবশিষ্ট ভারতের হিন্দু রাজনীতির তেমন সংযোগ ছিল না কিংবা হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার সর্বভারতীয় নীলনকশার সাথে এর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল না। গত শতকের সাতের দশকের শেষে আসামে যে বিদেশি নাগরিক বাছাই ও বহিষ্কারের দাবিতে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন হয়, তাকে উপলক্ষ্য করেই প্রথম অসমীয়া জাতিসত্তার অস্তিত্ত্বরক্ষার রাজনীতির সাথে আর্যাবর্তের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির যোগসূত্র গড়ে ওঠে। এই যোগসূত্রই ক্রমে ক্রমে আসামের রাজনীতিতে মুসলিম বিদ্বেষী আগ্রাসী হিন্দুত্বের জন্যে একটু একটু করে পরিসর নির্মাণ করে দিতে থাকে। নেলী, গহপুর, মোকালমুয়ার গণহত্যার ঘটনা ঘটে। পরবর্তী সময়ে ‘বিদেশি’ শব্দ ক্রমেই ‘বাংলাদেশী’তে পরিণত হতে থাকে যার মুখ্য লক্ষ্য বঙ্গমূলের মুসলিমরা। ‘চিরাং চাপরি’ নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে এই আওয়াজ তোলে যে বঙ্গমূলের মুসলিমদের সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে। সারারাজ্য জুড়ে বঙ্গমূলের মুসলিমদের উপর হেনস্থার খবর আসতে থাকে। এমন একটি প্রেক্ষাপটেই বাঙালিত্ব ছেড়ে আসা, অসমীয়াত্বের ভেতর ঘরে ঠাঁই না পাওয়া বঙ্গমূলের মুসলিমদের রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে মৌলানা বদরউদ্দিন আজমলের নেতৃত্বে এইউডিএফ। বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলনের সময় বাঙালি হিন্দু মুসলিম ও বঙ্গমূলের ভাষান্তরিত মুসলিমদের মিলিত রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে গঠিত হয়েছিল সংযুক্ত সংখ্যালঘু মোর্চা। ক্ষমতার রাজনীতির নানা চোরাস্রোতে সেই রাজনৈতিক উদ্যোগ প্রভূত সম্ভাবনা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেও অকাল মৃত্যুর মুখে হারিয়ে যায়।

এই সময় থেকেই আসামের অসমীয়া রাজনীতি রূপ বদল করতে থাকে। কখনো উগ্র জাতীয়তাবাদের মোড়কে হিন্দুত্ব, কখনো হিন্দুত্বের আড়ালে উগ্র জাতীয়তাবাদ। মুখ ও মুখোশের এই নিরন্তর ভূমিকা বদলের নানা পর্বের শেষে এবারে নির্বাচনের পর আসামের শাসকশ্রেণির রাজনীতিতে উগ্র জাতীয়তাবাদকে ছোট শরিকের ভূমিকায় ঠেলে দিয়ে হিন্দুত্ববাদ প্রধান সুর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সংখ্যালঘু সমাজের রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত ‘আইএমডিটি আইন’ বাতিলের প্রধান কারিগর, আসামের ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে অভিষিক্ত অগপ দলের প্রাক্তন সাংসদ সর্বানন্দ সনোয়ালকে মুখ হিসেবে তুলে ধরেই ২০১৬ সালে বিজয় অর্জন করেছিল বিজেপি। অর্থাৎ উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদের আড়ালেই ক্ষমতায় আরোহন করতে হয়েছিল হিন্দুত্বের রাজনীতিকে। পরবর্তী পাঁচ বছরে সর্বানন্দ সনোয়ালকে পাদপ্রদীপের আলোকবৃত্ত থেকে ঠেলে দিয়ে কংগ্রেস থেকে আগত বর্ণময় চরিত্র হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে সদাতৎপর, অসমীয়া বর্ণহিন্দু সমাজের প্রতিনিধি হিমন্তবিশ্ব শর্মাকে একটু একুট করে প্রধান মুখ করে সামনে নিয়ে এসেছে বিজেপি। ২০১৯ এর নির্বাচনে পর্বান্তর ঘটেছে। আসামের আদিবাসিন্দা সনোয়াল কাছাড়ী সমাজের সন্তান সর্বানন্দের অসমীয়া জাতিসত্তার রাজনীতি জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে উচ্চবর্ণের হিমন্ত বিশ্ব শর্মার নেতৃত্বে তৈরি হওয়া চরম আক্রমণাত্মক হিন্দুত্ববাদকে।

দুই শতাব্দী প্রাচীন বাঙালি বিদ্বেষের রাজনীতি এখন মুসলিম বিদ্বেষের রূপ পরিগ্রহ করেছে যে রাজনীতি আসামের ভূমিজাত পুরোনো মুসলিম বিরোধিতার রাজনীতি থেকে গুণগতভাবেই সম্পূর্ণ আলাদা। জাতীয় স্তরের ওই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সাথে মুসলিম বিরোধিতার স্থানীয় সংস্করণকে মিশিয়ে দিয়ে আবার জাগানো হচ্ছে ভাষিক অস্তিত্বের আতঙ্ককে। এর মানে এটা নয় যে এই মুসলিম বিদ্বেষের আগমনে বাঙালি বিদ্বেষ অন্তর্হিত হয়েছে। বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে প্রচার করা হচ্ছে, ‘তোমার ধর্মীয় অস্তিত্ত্ব বাঁচাতে হলে অসমীয়া ভাষাকে গ্রহণ কর মাতৃভাষা হিসেবে। নয়ত অচিরেই আসাম ইসলামিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অংশ হযে যাবে। ভাষা বড়, না ধর্ম বড়!’ এখন ভাষিক আগ্রাসন ধর্মীয় মোড়কে অনেক বেশি অবারিত হয়েছে। শিলচরের ভাষা আন্দোলনের মাটিতে দাঁড়িয়ে বিনা বাধায় বিজেপি নেতারা বলছেন, ভাষা আন্দোলন ভুল হয়েছিল। ধর্মীয় উগ্রতার মোহাঞ্জন চোখে বাঙালি হিন্দুরা এই আগ্রাসনকে দেখতেই পাচ্ছে না। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি উন্মোচন করেছেন হিমন্তবিশ্ব শর্মা। ইতিহাসের অপলাপ করে ওই অনুষ্ঠানে বলেছেন, শ্যামাপ্রসাদ চেয়েছিলেন আসামের সব বিদ্যায়তনে অসমীয়া ভাষা বাধ্যতামূলক করা হোক। বলেননি মূল সত্যটি যে শ্যামাপ্রসাদ যদি বাংলা না ভাগ করতেন এবং গোপীনাথ বরদলৈ যদি দেশভাগ এড়ানোর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে না লাগতেন, তবে আসামকে এত বঙ্গভাষীর বোঝা সহ্য করতে হত না। ভারত অবিভক্ত অবস্থায় স্বাধীন হলে বঙ্গদেশ থেকে যুক্ত হওয়া অঞ্চলগুলিকে আবার নির্বিঘ্নে বঙ্গদেশে ফিরিয়ে দেওয়াও হয়ত যেত। সাম্প্রতিকতম ভাষাসংক্রান্ত নির্দেশনামার মাধ্যমে বহুভাষিক আসামে অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর মাতৃভাষা শিক্ষার পথ কার্যত বন্ধ করে দিয়ে অসমীয়া ভাষার একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার নতুন করে উদ্যোগ শুরু হয়েছে। যতটুকু অধিকার অর্জিত হয়েছিল, প্রতিবাদ না হলে হয়ত অচিরেই সব চলে যাবে।

আসামের বাইরের মানুষের জন্যে তো বটেই, বহু জাতি ভাষা ধর্ম ও সংস্কৃতির আসামের মানুষের কাছেও আসামের রাজনীতি একটি অত্যন্ত জটিল সমাধানের অতীত গাণিতিক ধাঁধার মত। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সচেতন অনেকেরই প্রশ্ন, প্রথমে ৪০ লক্ষ, পরে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম এন-আর-সি থেকে বাদ পরে যাওয়ার পরও কেন আসামে ‘নো এন-আর-সি’ আন্দোলন নেই। অথচ পশ্চিমবঙ্গে এন-আর-সি প্রক্রিয়া (আইনী পরিভাষায় অবশ্য এটা পৃথক একটি পঞ্জী যার নাম হবে এন-আর-আই-সি) শুরু হওয়ার আগেই এখানে ‘নো এন-আর-সি’ একটি শক্তিশালী শ্লোগান। এই আওয়াজের পেছনে প্রভূত জনমত রয়েছে। আসামে প্রকৃতপক্ষে কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন, এমনকী কোনো জনগোষ্ঠীই এন-আর-সি’র বিরোধিতা করে না। বরং একটি শুদ্ধ এন-আর-সি তৈরির মধ্য দিয়ে দু’শো বছর ধরে চলে আসা অস্তিত্ত্বের বিপন্নতার রাজনীতি এবং ভাষিক ও ধর্মীয় অত্যাচার ও লাঞ্ছনার ঘটনাগুলির চিরতরে অবসান ঘটুক, এটাই সমস্ত জনগোষ্ঠীর সাধারণ চাওয়া। শুদ্ধ এন-আর-সি প্রণয়ন যেমন দুঃসাধ্য, আবার যতটা বিজ্ঞাপিত তার তুলনায় সংখ্যায় কম হলেও ভিত্তিবর্ষের পরেও অনেক মানুষ আসামে এসেছেন, এটাও সত্য। এন-আর-সি প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত যাদের নাম বাদ পড়বে তাদেরকে সীমান্তের ওপারে বহিষ্কার করা তো একটি সমাধান নয়। তারও একটি মানবিক এবং গণতান্ত্রিক বিকল্প নীতির প্রণয়ন করতে হবে। আসামের প্রতিটি জনগোষ্ঠীরই বিপন্নতার একটি নিজস্ব বয়ান রয়েছে, যে বয়ানগুলির কোনোটিই সম্পূর্ণত অমূলক নয়। আবার এই বয়ানগুলিকে পৃথকভাবে মান্যতা দিলে পুরোনো যুগোস্লাভিয়া বা লেবাননের মত আসাম জাতিগত সংঘর্ষের চিরস্থায়ী যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে। ইতিহাস কখনোই পেছনের দিকে হাঁটে না। আসামেও হাঁটবে না। আসামকে আবার ১৮২৬ সালের আগে যেমন নেওয়া সম্ভব নয়। ১৯৪৭ সালের আগেকার অবস্থাতেও ফেরানোও সম্ভব নয়। বুঝতে হবে সাধারণভাবে। কারো ভাষাই বিপন্ন নয়। আবার পরিবর্তিত সময়ের বুকে কোনো ভাষাই চিরদিন অবিকৃত থাকে না। আসাম একটি বহুভাষিক, বহুজাতিক, বহুসংস্কৃতির রাজ্য। এই বহুভাষিকতা, বহুসাংস্কৃতিকতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে আসামের অভ্যন্তরে বহুত্বের রাজনীতির নতুন অধ্যায় রচিত হতে হবে। তবে এর আগে প্রয়োজন এই বহুত্বের উপলব্ধির। এই উপলব্ধির মধ্য দিয়েই সমস্ত ধরনের বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তম সাংস্কৃতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক মোর্চা গঠন প্রয়োজন। ইতিহাস এ পথেই যাবে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু কবে?