আরেক রকম ● নবম বর্ষ চতুর্দশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ জুলাই, ২০২১ ● ১-১৫ শ্রাবণ, ১৪২৮

সমসাময়িক

আন্তর্জাতিক দুর্নীতি ও ভারত


২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে গোটা দেশে বিরোধীরা বলেছিলেন যে রাফাল বিমান কেনার যে চুক্তি মোদী সরকার ফ্রান্সের সঙ্গে করেছে, তার নেপথ্যে রয়েছে মস্ত দুর্নীতি। যৌথ সংসদীয় কমিটির আওতায় এনে সমগ্র বিষয়টির তদন্তের দাবি করেছিলেন বিরোধীরা। কিন্তু যথারীতি মোদী সরকার বিরোধীদের দাবিকে উড়িয়ে দেয়, এবং নির্বাচনেও বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে আবার ক্ষমতায় ফেরে। বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট অবধি গড়ায়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ রায় দেয় যে তদন্ত করার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। কাকতালীয় কি না জানা নেই, তবে সেই প্রধান বিচারপতি বর্তমানে বিজেপি মনোনীত রাজ্যসভার সাংসদ। দেশের মিডিয়া, সুপ্রিম কোর্ট এবং জনগণ সবাই বুঝে নেয় যে রাফাল নিয়ে কোনো কেলেঙ্কারী হয়নি। সবটাই বিরোধীদের ষড়যন্ত্র, প্রচার করে বিজেপি।

কিন্তু ফ্রান্সে আপাতত হাওয়া অন্য খাতে বইছে। ফ্রান্সে একজন বিচারপতির উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রাফাল সংক্রান্ত দুর্নীতির তদন্ত করার। প্রাথমিকভাবে ফ্রান্স সরকারও মনে করেছিল যে দুর্নীতির কোনো তদন্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। কিন্তু ফ্রান্সের প্রচারমাধ্যমের লাগাতার অনুসন্ধান দুর্নীতির প্রমাণ হাজির করেছে। অতএব রাফাল নিয়ে ফ্রান্সে তদন্ত হবে। বিজেপি পার্টি তথা সরকার বারবার এই বক্তব্য হাজির করেছিল যে দুই সরকারের মধ্যে যেখানে রাফাল নিয়ে চুক্তি হচ্ছে সেখানে দুর্নীতির কোনো অবকাশ নেই। অথচ, সেই দুই সরকারের মধ্যে একটি, ফ্রান্স, যখন তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে তখন মোদী সরকার মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।

এই চুক্তির মূল সমস্যা দুটি। প্রথমত, ইউপিএ সরকার যেই দামে রাফাল কেনার জন্য ফ্রান্স সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল, তার থেকে বেশি দামে এই যুদ্ধবিমান কিনছে মোদী সরকার। কেন? দ্বিতীয়ত, অনিল আম্বানির কোম্পানির সঙ্গে রাফাল নির্মাতার চুক্তি হয়েছে। অনিল আম্বানির এই সংস্থা তৈরি হয় রাফাল চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার ১৫ দিন আগে। অনিল আম্বানি রাইট্স ভ্রাতৃদ্বয়ের মতন প্রতিভাবান নন, যে তিনি ১৫ দিনে যুদ্ধবিমান বানানো শিখে যাবেন। তথাপি, ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হিন্দুস্থান এরোনটিক্স লিমিটেড (হ্যাল)-কে পেছনে ফেলে আম্বানির সংস্থা এই যুদ্ধবিমান ভারতে বানানো ও তার রক্ষণাবেক্ষণ করার বরাত পায়। আশ্চর্যের এখানেই শেষ নয়। ফ্রান্সের সংস্থা এবং অনিল আম্বানির সংস্থার মধ্যে চুক্তি হয় যে একটি নতুন কোম্পানি তৈরি হবে যার ৫১ শতাংশ থাকবে আম্বানির আর ৪৯ শতাংশ থাকবে ফ্রান্সের সংস্থার হাতে। অথচ, এই কোম্পানিতে ফরাসি সংস্থার বিনিয়োগের পরিমাণ ৯৪ শতাংশ। এমন দরাজ কোম্পানি মেলা ভার যে ৯৪ শতাংশ বিনিয়োগ করেও ৪৯ শতাংশ কোম্পানির মালিকানা নেবে। অতএব ফরাসি সংস্থা এবং অনিল আম্বানির সংস্থার মধ্যে যেই চুক্তি হয়েছে তা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। মনে রাখতে হবে যে ফ্রান্সের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হালান্দে বলেছিলেন যে অনিল আম্বানির সংস্থাকে বরাত দেওয়ার বিষয়ে তাঁদের কোনো হাত নেই। ভারত থেকে তাঁকে চাপ দেওয়া হয়েছিল এই সংস্থাকে বরাত দেওয়ার। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে কারা চাপ দিয়েছিল, কেন দিয়েছিল।

কয়েক হাজার কোটি টাকার এই চুক্তি, যার ভিত্তিতে দেশের বায়ুসেনার উন্নতি সাধন হবে বলে মোদী সরকার দাবি করছে, সেই চুক্তির গায়ে যদি দুর্নীতির কাদা লেগে থাকে তবে তা দেশ তথা বায়ুসেনার সুনামের জন্য যথেষ্ট ক্ষতিকর। অতএব, ফ্রান্সের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমাদের দেশেও পুনরায় রাফাল চুক্তিতে কোনো বেনিয়ম বা দুর্নীতি হয়েছে কি না তার তদন্ত করা জরুরি। কিন্তু মোদী সরকার কোনো তদন্তের আওতায় আসতে রাজি নয়। গণতান্ত্রিক দেশে, জনগণের টাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে কেন তদন্ত হবে না, তার কোনো উত্তর দিতেও মোদী সরকারের কোনো ইচ্ছে নেই।

অন্যদিকে, ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যার সঙ্গে ভারতের ভ্যাক্সিন বাণিজ্য জড়িত। ভারতে তৈরি কোভ্যাক্সিনকে বরাত দেওয়া নিয়ে ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট সেখানকার রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে ফৌজদারি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। প্রথমত, ব্রাজিলের স্বাস্থ্য সংস্থা এখনও কোভ্যাক্সিনকে ছাড়পত্র দেয়নি। দ্বিতীয়ত, কোভ্যাক্সিন যেই টাকা দিয়ে ব্রাজিল কিনছে তার থেকে অনেক কম দামে ফাইজারের ভ্যাক্সিন আন্তর্জাতিক বাজারে পাওয়া যাচ্ছে বলে ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম তথা বিরোধীরা দাবি জানিয়েছে। তাহলে ভারতের কোভ্যাক্সিনকে রাতারাতি ব্রাজিলে ব্যবসা করার ছাড়পত্র দেওয়ার কারণ কী? কেন বেশি টাকা দিয়ে ব্রাজিল ভারত থেকে কোভ্যাক্সিন আমদানি করবে। এই প্রশ্নে ব্রাজিলের রাজনীতি উত্তাল।

করোনা অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি বলসোনারো বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এই ভয়াল রোগকে তুচ্ছ দেখানোর চেষ্টা করেছেন। পরিণতি হয়েছে এই যে ব্রাজিলে ৫ লক্ষের বেশি মানুষ করোনায় মৃত হয়েছেন। এর ফলে ব্রাজিলের মানুষ ক্ষিপ্ত। সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে ভ্যাক্সিন সংক্রান্ত এই দুর্নীতির অভিযোগ। ভারতের কোভ্যাক্সিন প্রস্তুতকর্তা ভারত বায়োটেক এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নয় বলে বিবৃতি দিয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদী যেখানে ভারতের ভ্যাক্সিন কূটনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বারবার বলেছেন সেখানে ভারতে তৈরি হওয়া স্বদেশী ভ্যাক্সিন ব্রাজিলের মতন দেশে দুর্নীতির অভিযোগে দুষ্ট হচ্ছে, তা নিয়ে দেশের সরকারের যেন কোনো মাথাব্যথাই নেই।

সমস্ত রকম দুর্নীতি মানুষকে নির্লজ্জভাবে ঠকানোর প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই জনস্বার্থে রাফাল দুর্নীতির তদন্ত ভারত সরকারেরও উচিত এই দেশে শুরু করা। অন্যদিকে, ভারতে তৈরি ভ্যাক্সিনকে কেন্দ্র করে যেই কেলেঙ্কারি ব্রাজিলে দানা বাঁধছে, তা নিয়ে কোভ্যাক্সিন উৎপাদনকারীদের কাছে জবাব চাক ভারতের সরকার। নয়ত, আন্তর্জাতিক স্তরে এই বার্তাই যাবে যে ভারতে দুর্নীতি কোনো বিষয় নয়, দু্র্নীতির প্রশ্নে ভারত সরকারের কোনো দৃঢ় অবস্থান নেই।