আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২১ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৮

প্রবন্ধ

‘হিংসা’-প্রতিরোধ-অস্মিতাঃ “কারনান”-এর দলিত পাঠ

অমৃতা সরকার


দলিত টেক্সট একটি বহুস্তরীয় সমস্যাসঙ্কুল পরিসর। ব্রাহ্মণ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কোনো দলিত টেক্সট হয় ‘সমবেদনা ও করুণা’র পরিসরে আটকে থাকে, অথবা, শুধুমাত্র ‘সামাজিক সমস্যা’কে কাঠখোট্টা ‘বাস্তবিক’ ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করে। এই পরিসরে আটকে না থাকতে চাওয়া একটি টেক্সট মারি সেলভেরাজের সাম্প্রতিক সিনেমা “কারনান”। চিরায়ত গতে না হেঁটে নতুন ধারার দলিত টেক্সট হিসেবে ভাবায় ছবিটি। যদি বলি, শুধুমাত্র সোজাসাপ্টা প্রান্তিক মানুষের প্রতিরোধের গল্প তাহলে বোধহয় কিছুই বলা হয় না। দলিত যাপনের বহুস্তরীয় ক্রাইসিস মুন্সিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরেছেন পরিচালক, তাতে মিশেছে কবিতা। দলিত টেক্সটে একজন ‘ব্যক্তি’র গল্প, একজন ‘ব্যক্তি’র ক্রাইসিস, একজন ‘ব্যক্তি’র প্রতিরোধ কখনোই তার ‘ব্যক্তিগত’ নয়। সব সময়ই একজন ‘দলিত ব্যক্তি’র অভিজ্ঞতা কোনো না কোনোভাবে তার ‘কৌম অভিজ্ঞতা’। একজন ‘দলিত ব্যক্তি’ শুধুমাত্র ‘ব্যক্তি অভিজ্ঞতা’ দিয়ে দলিত হয়ে ওঠেন না। তার দলিত সত্ত্বায় মিশে থাকে তার কৌম-ইতিহাস, কৌম-মনস্তত্ব, কৌম-যাপন এবং কৌম হিসেবেই যুগের পর যুগ ‘অপর’ হয়ে ওঠার সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা যা আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে দলিত-অভিজ্ঞান।



এই জন্যই “কারনান” একটি দলিত-প্রতিরোধের গল্প। সিনেমায় চাষীদের যে গ্রামটিকে বাইরে থেকে ‘ভাগাড়’ বলে দেগে দেয় ‘অল্পশিক্ষিত’ বাস কন্ডাকটর থেকে শুরু করে ‘উচ্চশিক্ষিত’ পুলিশের বড়কর্তা, সেই ‘ভাগাড়’-এর ভিতরে ঢুকলে একটা ‘পৃথক’ জীবনপ্রবাহ চোখে পড়ে। এই দুনিয়ায় একটি কিশোরী মৃগীতে ছটফট করতে করতে মরে গেলেও অফিসিয়াল বাসস্টপ না থাকায় কোনো বাস দাঁড়ায় না। অফিসিয়াল বাসস্টপ না থাকার কারণে মূল রাস্তা থেকে দেড় কিমি ভিতরের গ্রামটির অফিসিয়াল অস্তিত্বই স্বীকার করে না বাইরের পৃথিবী। রাস্তা আটকে হাতি নিয়ে ধর্মীয় শোভাযাত্রা চলাকালীন আটকে পড়া বাইরের বর্ণহিন্দু পুলিশ অফিসারের কথা থেকে জানা যায় যে এই গ্রামের লোকরা ‘আমাদের’ অন্তর্ভুক্ত নয়, এই মানুষজন ‘আমাদের’ কাছে তাদের যাবতীয় অস্তিত্ব নিয়ে ‘ওরা’ হয়ে আছে। এই ‘ওদের’ পৃথিবীতে তাই এক কিশোর ঘোড়া পোষে তার বিকল্প যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে। এই ‘ওদের’ পৃথিবীতে মুরগির বাচ্চাকে বাজপাখি নিয়ে গেলে বাজকে কাকুতিমিনতি করা হয় ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। এই ‘ওদের’ পৃথিবীতে দশ বছর আগে মরে যাওয়া কারনানের কিশোরী বোন তার বাবার স্বপ্নে সেই গাঁয়ের আরাধ্যা দেবীর মুখোশ পড়ে ফিরে ফিরে আসে নিজের বেঁচে থাকা দিদির বিয়ের টাকার হদিশ দিতে। এই ‘ওদের’ পৃথিবীতে কোনো মেয়ে কলেজে যেতে পাশের গ্রামের বাসস্টপে বাবার সাথে অপেক্ষা করলে খুব ‘স্বাভাবিক’ ভাবেই তাকে ‘মলেস্টেড’ হতে হয় এবং তার বাবাকে মার খেতে হয় এবং তার পরে মেনে নিতে হয় যে এই ঘটনা তো ঘটারই ছিল। এইখান থেকে মুক্তির পথ হিসেবে তারা একমাত্র ভাবে ‘সরকারি চাকরি’কে। এই ‘ওরা’ হয়ে মাথা নিচু করে থাকতে, মাথা নিচু করে মিনতি করতে (যাকে ‘ভদ্রতা’, ‘সৌজন্য’, ‘বিনয়’ ইত্যাদি বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়) অস্বীকার করে কারনান। তার মাকে জানায় যে বাজপাখির কাছে হাজার মিনতি করেও লাভ নাই, একইরকম ভাবে লাভ নেই পাশের গ্রামের তামিল ‘ব্রাহ্মণ’ সংস্কৃতির চিহ্নধারক অপেক্ষাকৃত প্রিভিলেজড গ্রামটির লোকের সামনে মাথা নিচু করে, তাদের করুণার উপর নির্ভর করে বাঁচার কিছু নেই। নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখতে যদি এদের লাঠিপেটা করতে হয়, তবে তাই সে করবে এবং করেও। এইসবের মাঝে সে নিয়ম মেনে পুলিশ, সিআরপিএফে লাইন দিতে যায়, ‘সরকারি চাকরি’ নামক মুক্তির পথের জন্য। এই ‘মুক্তি’র হাহাকার কতটা যন্ত্রণার তা আমরা বুঝতে পারি যখন কারনান সিআরপিএফের ফিজিক্যাল টেস্টের পরীক্ষায় সফল হয়ে দৌড় শেষ করে এবং দড়ির ওপারে ক্যামেরা ধরে কারনানের মতোই আরেকটি মুখকে যে সফল হতে না পেরে দড়িটিকে ছোঁয়ার জন্য উর্দিধারীদের পা জড়াচ্ছে। কারনান নিজের ‘দুর্বিনীত’ স্বভাবের কারণে গাঁওবুড়োদের কাছে বকাঝকা খেলেও তার রাজনৈতিক-বোধ থেকে সরে আসে না। ছবির শুরু থেকেই যে সামনের দুই-পা বাঁধা গাধাটিকে দেখতে পাওয়া যায়, তাকে বারবার খুলে দেওয়ার কথা বলে কারনান এবং একসময় সে নিজেই গাধাটির পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। ঘটনাচক্রে ঠিক এর পরেই একটা বাস ভাঙচুর করে কারনান এবং তার সঙ্গীরা । বাসটি অফিসিয়াল স্টপ না থাকার কারণে এই গ্রামের এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে না দেখেই এগিয়ে যাচ্ছিল। এই ‘ভাঙচুর’-এর দৃশটি টেক্সটির ক্লাইম্যাক্স কারণ ব্যক্তি কারনান ও গ্রামটির গল্প এই ঘটনার পরেই চেনা খাতের বাইরে বইতে শুরু করে। দৃশ্যটিকে মহাকাব্যিকভাবে ধরেছেন পরিচালক। ‘ভাঙচুর’-এর সীমানা ছাড়িয়ে বাস ভাঙার দৃশ্য প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে। সাবধানী না হয়ে পরিচালক ‘গ্লোরিফাই’ করে এই ঘটনাকে। পুরো ফ্রেম জুড়ে মেঘ, পাহাড় ও সবুজের ভিতর দিয়ে ছুট লাগায় বাঁধনহীন গাধা। দূরের পাথুরে পাহাড়ে আসন্ন বর্ষার মেঘের ব্যাকড্রপে আমরা দেখতে পাই দৌড়ে আসছে আরেকজন। হাততালি দিচ্ছে। শরীরে সে কিশোরী এক। তার পোষাক দেখে বোঝা যাচ্ছে দশ বছর আগে মৃগীতে মরে যাওয়া সেই কিশোরী। এবং তার মাথা ও মুখ কোনো মানুষের নয়, কারনানদের কৌম-দেবীর। যে দেবীর মুখ অনার্যসুলভ। তথাকথিত ‘রাক্ষসী’র মতো, শ্বদন্ত প্রকট হয়ে আছে এবং মাথায় সাপ। গাধাটি দৌড়তে দৌড়তে এই দেবী-ভূত কিশোরী অস্তিত্বের পাশে এসে শান্তভাবে দাঁড়ায়। সে হাত রাখে গাধার পিঠে। পাহাড়ের নিচে তখন বাসের ভিতর ঢুকে ‘তাণ্ডব’ চালাচ্ছে কারনান । এরপর এই হাইব্রিড-অস্তিত্ব দেখা দিতে শুরু করে গ্রামে যখনই প্রতিরোধের সুর শোনা যায় কৌম জুড়ে।

‘নামের রাজনীতি’ ও ‘দলিতের অপ্রত্যাশিত আচরণ’ ছবিটিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাস ভাঙচুরের তদন্তে আসা ‘অপ্রেসর কাস্ট’-এর পুলিশ কর্তাটির নাম কাননাবীরন। তামিলে কৃষ্ণের একটি নাম ‘কাননাবীরন’। পুলিশ কর্তাটির এই গ্রামে এসে প্রথম আঁতে লাগে এই ‘ছোটোলোক’দের নাম দুর্যোধন, অভিমণ্যু, যম, দ্রৌপদী, কারনান (কর্ণ) ইত্যাদি। তার মনে হয় এই ‘ছোটলোকরা’ও এইসব নাম রাখে কেন! তার আরও মাথা গরম হয় যখন সে দেখে তার জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা করছে না কেউ, তার কাঁধে হাত রেখে মিটমাটের চেষ্টা করছে। গ্রামের মোড়ল’কে সে ‘পাগড়ি’ খুলে কথা বলতে বললে গোটা গ্রাম জানায় যে প্রধান-চাষী কখনোই ‘বাইরের’ কারো সামনে পাগড়ি খুলবে না। গ্রামবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে দেখে বাসমালিক নিজে থেকেই মিটমাট করে নিতে চায় এবং জানায় অফিসিয়ালি না হলেও সে তার বাসকে দিনে দু-বার এই গ্রামের জন্য থামাবে। কাননাবীরন নিজের গায়ের ঝাল মেটাতে না পেরে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং কিছু গ্রামবাসীকে থানায় গিয়ে দেখা করতে বলে। গ্রামের বুড়োরা যাবে বলে ঠিক হয়। ফেরার পথে কাননাবীরন রাস্তার ধারের এক পুকুরে এক ‘ছোটোলোক’ মাছ ধরছে দেখে গাড়ি থামায়। মানুষটি তাকে দেখেই উঠে দাঁড়ায়, নিজের পাগড়ি খুলে মাথা নিচু করে ছিপটি এগিয়ে দেয় তার দিকে। কাননাবীরনের মুখ প্রশান্তিতে ভরে ওঠে ও সে উর্দি পরেই রাস্তার ‘সাধারণ’ মানুষের মতো মাছ ধরতে বসে। থানায় ফিরে পিটিয়ে লাট করে এই ‘সহবত’ না দেখানো গাঁওবুড়োদের। থানার ছাদে ফেলে রাখে রাতভর। পরদিন কারনান গ্রামবাসীদের নিয়ে এসে ঘটনা জানতে পারলে পুরো থানা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। যে বুদ্ধিজীবিদের রেল লাইন উপড়ে ফেললে, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ধ্বংস করলে ‘বাড়াবাড়ি’ হচ্ছে মনে হয় তাদের মুখে এই দৃশ্যটি একটা সপাট চড়। প্রতিরোধ কোনোদিন ‘সীমারেখা’ মেনে হয় না। পরিচালক আবার ‘গ্লোরিফাই’ করেই ক্যামেরায় ধরেন রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ভাঙচুর, সরকারি ফাইল ছেঁড়াকে। দলিত-প্রতিরোধের সিম্বল হিসেবে এই থানা আক্রমণ একটা অন্য মাত্রা পায় যখন থানার দেওয়ালের সমস্ত ‘বিশিষ্ট’ মানুষের টাঙানো ছবিগুলির ভিতর একমাত্র আম্বেদকরের ছবিকেই ফোকাসে রাখা হয়। থানা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় গাঁওবুড়োদের। গাঁয়ের মোড়ল দুর্যোধন আত্মহত্যা করতে চায়, তাকে আটকায় গ্রামবাসী। চূড়ান্ত সংকটাপন্ন মুখে সে কাতড়াতে কাতড়াতে জানায় যে কাননাবীরন তাদের বাস ভাঙচুরের জন্য মারেনি। মারার সময় কাননাবীরন বারবার বলে গেছে যে এইসব নাম রাখলেই কেউ ‘জাতে’ উঠে যায় না, কোন সাহসে তারা ‘সহবত’ দেখায় না, কোন এক্তিয়ারে তারা তার কাননাবীরনের ‘সমান’ হয়ে কথা বলতে চায়! কারনান গ্রামের হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা ঝুঁকবে না, পুলিশি-মিলিটারি কোনো রাষ্ট্রীয় শক্তির কাছেই । গ্রামের মেয়েরা একজোট হয়ে এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানায়। এখানে উল্লেখ করা দরকার এই গ্রামের মেয়েরা পোশাকে, কাজেকর্মে পুরুষদের থেকে ‘আলাদা’ নয়।

প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নিতেই সেই দেবী-ভূত কিশোরীকে গ্রামে দেখা যেতে শুরু করে। সংখ্যায় সে এক থেকে বহু হয়ে ওঠে। কখনো বৃষ্টিভেজা টালির ছাদে বসে থাকে। কখনো গোটা গ্রাম নিজেদের বাড়ি থেকে দা-বল্লম-কাটারি বার করে আনার সময় সে কোনো জানলায় বৃষ্টির পরের আলো মেখে দাঁড়িয়ে থাকে। গাঁয়ের মেয়েরা রাতজাগার জন্য একসাথে খাবার বানাবার সময় সে নিজেকে ভেঙে তারা হয়ে নাচতে থাকে অপার আনন্দে। গ্রামের পুরুষরা রাতের সম্ভাব্য পুলিশি আক্রমণ ঠেকাতে কাঁটাগাছের বেড়া তৈরি করার সময় সে গাছের উপর বসে দেখতে থাকে সব। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি এই অস্তিত্বটিকে ‘আর্কাইক প্রি-কলোনিয়াল’ সত্তা করে রাখেননি পরিচালক। তাই সে কখনো স্কার্ট পরে হাঁটে, কখনো সালোয়ার কামিজ, কখনো আবার গ্রামের ঐতিহ্যবাহী পোষাক। ডিকলোনিয়াল এই মেশিনারি “কারনান”-এর মোটিফকে বহুমাত্রিক করে তুলেছে। সকাল হয়। পুলিশ আসে না। আসে ডাকপিওন, কারনানের সিআরপিএফের নিয়োগপত্র নিয়ে। গোটা গ্রাম ও তার পরিবার তাকে ‘সরকারি চাকরি’র পথ নিয়ে মুক্তি খুঁজতে বলে কারণ সে যদি এই পথে তার গাঁয়ের বাকিরাও পরবর্তীতে ‘সরকারি চাকরি’র পথে এই অসম্মানের জীবন থেকে মুক্তি পাবে। কারনান যেতে অস্বীকার করলে তারা কারনানকে জোর করে পাঠায়। কারনান তার বাপের সাথে ফাইলপত্র গুছিয়ে যাত্রা শুরু করে। পুলিশি সন্ত্রাস নেমে আসে গাঁয়ের ওপর। কারনানের অতি প্রিয় প্রৌঢ় সঙ্গী ইয়েমন (যম) নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করে বাঁচাতে চায় গ্রামকে। গ্রামের প্রান্তর ছাড়াবার আগেই কারনান বারবার ফিরতে চায়, তার বাবা তাকে কিছুতেই ফিরতে দিতে চায় না। ইয়েমনের খবর কারনানের কাছে পৌঁছলে তার বাবা নিজেই গ্রামের দেবীর তলোয়ার কারনানের হাতে তুলে দেয়। এই তলোয়ার ছবির শুরুতে কারনান অর্জন করেছিল কৌমরীতি মেনে দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত একটা মাছকে শূন্যেই দুই টুকরো করে। কারনান ‘সরকারি চাকরি’ নামক মুক্তির পথ ছেড়ে গ্রামের দিকে রওনা দেয়। মাঠের নয়ানজুলি থেকে উঁকি মারে সেই দেবী-কিশোরী। ঘাস আর জলের ফাঁক দিয়ে এগোতে থাকে তার মুখ। কারনানের বাবা নিজের আরাধ্যা ও মরে যাওয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে। কারনান গ্রামে ফিরে পণবন্দী করে কাননাবীরনকে এবং শেষ অবধি মুণ্ডচ্ছেদ করে সেই উদ্ধত ‘অপ্রেসর কাস্ট’কে যে তলোয়ারের সামনে দাঁড়িয়েও নির্দ্বিধায় বলে যায় একমাত্র তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে বাঁচলেই সে রক্ষা করবে তাদের। কবন্ধ হয়ে পড়ে থাকে কৃষ্ণের সমনামী সেই ক্ষমতাশালী যার কাছে মাথা না ঝোঁকালে সে শাস্তি দিতে গুঁড়িয়ে দেয় সবাইকে।

এইখানেই হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী টেক্সটগুলিকে গুঁড়িয়ে দিয়ে নয়া ভাষ্যের জন্ম দেয় সিনেমাটি। কৃষ্ণ যে তার বিধি অনুযায়ী না চললে তার সুদর্শন দিয়ে কবন্ধ করে গেছে একের পর এক অনার্য দলিত প্রতিরোধ, এখানে তাকে কবন্ধ হয়ে পড়ে থাকতে হয়। কারনানদের বেশিরভাগ দেবতাই ছিল কবন্ধ, মুণ্ডহীন শরীরকে পূজা করত তারা। ‘শরীর’কে দলিত ও মাথাকে ‘ব্রাহ্মণ’ হিসেবে দেখার যে হিন্দুরীতি সেইটিকে প্রতিফলিত করে শেষে গিয়ে সাবভার্ট করে দেয় এই টেক্সট। অ্যানিম্যাল মোটিফ সাবলীলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে গল্প বুনতে। গাধা অনার্য দেবতার বাহন হিসেবে পরিচিত। গল্পে ঘোড়ায় করে ফিরে আসার সময় কারনানের সিল্যুয়েট লার্জার দ্যান লাইফ হয়ে ওঠে। আর্য ঘোড়া ও তরোয়ালের জোরে অনার্যদলনের গল্প উলটে যায় এখানে। গল্পের শুরুতে শূন্যে ছুঁড়ে দেওয়া মাছ এক কোপে কেটে ফেলার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামে প্রচলিত বিশ্বাস ছিল, ওই মাছ কেউ এক কোপে কেটে ফেলতে পারলে, কৌম জীবনে পরিবর্তন আসে। এক্ষেত্রে মাছকে যদি পুরাণ বর্ণিত বিষ্ণু অবতারের সিম্বল হিসেবে দেখা যায়, তাহলে স্পষ্ট হয়, ব্রাহ্মণ্যবাদের জনক মনুর রক্ষাকর্তা এই মীন অবতারকে কোনো দলিত তরোয়াল দু'ভাগ করলে কী করে বিপদ নামে কৌমের উপর। প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদ ছাড়া আর একটিও পথ খোলা থাকে না দলিতের। এবং নিজের কৌমের অস্মিতা রক্ষার জন্য তাকে দু-টুকরো করতে হয় কাননাবীরনকে। ‘ভায়োলেন্স’ কতটা কনস্ট্রাকটিভ হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে বোঝা যায় এরপরেই।

সিনেমা শুরু হয়েছিল এই জায়গা থেকেই। নাচ ও গানের ভিতর দিয়ে ‘ব্যক্তি’ কারনান মুছে গিয়ে কৌমের কারনান হয়ে উঠছে। পেপারে বার হওয়া তার ছোট্ট ছবি ঘরের দরজায় ভাতের মাড় দিয়ে আটকাচ্ছে এক দলিত কিশোর। আগুনের ফুলকি দিয়ে তার ছবি আঁকছে কেউ। রাতে ভূতগ্রস্তের মত তার জন্য নেচে চলেছে কোনো বৃদ্ধা। দশ বছরের জেল হয় কারনানের। সরকারি চাকরিও জোটে না। জেলে থেকেই সে বোনের চিঠিতে জানতে পারে যে তাদের গ্রাম বদলে গেছে সেই দিনের পর। কিছু অচেনা মানুষ এসেছিল তাদের গ্রামে এর মধ্যে। তাদের নিয়ে কিছু অচেনা জায়গায় যায়। হঠাৎ করে তাদের গ্রামে বাস থামতে শুরু করে। ছেলেমেয়েয়া নিশ্চিন্তে ইস্কুল-কলেজে যায়। এমনকি অনেকে সরকারি চাকরিও করছে। বেশিরভাগ গাঁওবুড়ো মরে গেছে। বাসে চেপে কারনান সেইখানে নামে যে জায়গায় বাস ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে গোলমালের সূত্রপাত। গ্রামে ফিরে সে দেখে দেওয়ালে মুণ্ডহীন ছবিটিতে মাথা আঁকা হয়েছে। সেই মাথা তার প্রিয় ইয়েমনের। গ্রামের এক বুড়ি বিষণ্ণ কারনানকে বলে সমস্ত বিষণ্ণতা কাটিয়ে নাচে মেতে উঠতে কারণ জীবনের নাচই তাদের দুঃখ ও আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। জড়তা নিয়ে নাচতে নাচতে একসময়ের পর উন্মাদের মতো নাচতে থাকে কারনান, গ্রামের মেয়েরা, বুড়িরা, বাচ্চারা যোগ দেয় সেই নাচে। তাদের চোখের জল মিশতে থাকে ঠোঁটের বিহ্বল হাসির সাথে। এই নাচই তাদের পার করায় সুগভীর যন্ত্রণাবোধকে। দূরে পাহাড়ের গায়ের জলাশয়ে জেগে ওঠে সেই দেবী-কিশোরী। হাততালি দিতে দিতে একসময় বিন্দু বিন্দু জল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সে।

দলিত এস্থেটিক্সের প্রেক্ষিত থেকেও “কারনান” একটা গুরুত্বপূর্ণ টেক্সট হয়ে রইলো। ‘দলিত টেক্সট’গুলির বিরুদ্ধে টিপিক্যাল ব্রাহ্মণ্যবাদী অভিযোগ হল যে এখানে শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় ‘চিৎকারের’ হেতু। প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃত নন্দনতত্ত্বের ‘নবরসে’র নিরিখে এই অভিযোগ করা হয়। মারাঠি দলিতচিন্তক যদুনাথ থাট্টে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দেই খোলাখুলি জানান যে ‘দলিত টেক্সট’কে এই নয়টি রস দিয়ে মাপতে চাওয়াই ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতা। ‘দলিত’ যেহেতু ‘ব্রাহ্মণ’-এর বিপ্রতীপ এক অবস্থান, তাই দলিত ‘রস’কে বুঝতে গেলে এই নয়টি রসের বাইরে ‘দশম’ ও ‘একাদশ’ রস খুঁজে পেতে হবে। এই ‘রস’ দুটি হল চিৎকার, কান্না এবং বিদ্রোহ। ‘কারনানে’ চিৎকার, কান্না ও বিদ্রোহ একসাথে সংশ্লেষ হয়ে রয়েছে। এইটি সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় সিনেমার শেষে এসে যখন কারনানের বিদ্রোহ, গ্রামের মানুষদের ইয়েমনের পুড়ে যাওয়া শরীরকে ঘিরে কান্না, বিধ্বস্ত বাড়িঘরের সামনে মানুষের কান্নায় মিশে যায় এক আসন্নপ্রসবা নারীর চিৎকার ও এইসবের মাঝে সদ্য জন্মানো এক নবজাতকের চিৎকৃত কান্না। আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল ‘মেলোড্রামা’কে কবিতার মুনশিয়ানায় ব্যবহার করেছেন পরিচালক। যখন চিৎকার-কান্না-বিদ্রোহ ‘বাস্তবতায়’ ‘চড়া দাগের’ হয়ে ওঠে, পাহাড়ের খাঁজে বৃষ্টির জমা জলে দেবী-কিশোরীর চুপচাপ বসে থাকা ঠিক ততটাই কবিতা। পোয়েটিক্স ও পলিটিক্সকে মেশানো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজগুলির একটি। “কারনান” এই কাজ অনায়াসে করেছে।