আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২১ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৮

প্রবন্ধ

আরএসএস - ক্ষমা প্রার্থনার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

সুনীল মুখোপাধ্যায়



“ওরে ভীরু, তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার।” রবীন্দ্রনাথের এই ভুবনজয়ী বাক্যটিকে আমরা, বীরত্বের পূজারী ভারতবাসীরা মিথ্যা প্রমাণ করে ছাড়ছি। নাহলে বাইরে বীরত্বের আস্ফালনকারী এক মহাভীরুকে ভোট দিয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতার আসনে বসিয়ে নিশ্চিন্ত হব কেন? দুর্বল পাকিস্তানকে রাতের অন্ধকারে চারটে বোমা মেরে চলে আসা আমাদের গণতান্ত্রিক রাজার বীরত্বে আমরা মুগ্ধ হই, তাকে দেশপ্রেমিক বীরের আসনে বসাই, অথচ সেই বীরপুঙ্গবই যখন শক্তিধর চিনের হাতে মার খেয়ে, দেশের জমি খুইয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে আসেন আর ব্যাপারটা ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করেন তখন আমরা মোহমুগ্ধ দেশভক্তরা তা দেখেও দেখি না, বা দেখতে চাই না। কুলোকেরা অবশ্য সেই বস্তাপচা বুলিটা আউড়ে গায়ের ঝাল মেটায় লোকটা শক্তের ভক্ত, নরমের যম।

বস্তুত, গোটা দুনিয়া জুড়েই এই ধরনের লোক ও শক্তির মিছিল আমরা দেখেছি। এরা যখন ক্ষমতায় থাকে না তখন বলবানের কাছে মাথা নোয়ায়, আর ক্ষমতায় এলে সাধারণ মানুষদের, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের, এমনকি সামান্যতম সমালোচকদের পর্যন্ত দুরমুশ করে নিজের ক্ষমতা জাহির করে। ‘গ্রেট ডিক্টেটর’ ফিল্মে চার্লি চ্যাপলিন দেখিয়েছেন হিটলারের অসহায়ত্ব। ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে মহাবীরপুরুষ হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় ও বিচারের ভয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।

সমালোচনা সহ্য করতে না-পারাটা শক্তিমানের লক্ষণ নয়। আমাদের রাজা আমাদের রাষ্ট্রনেতাদের মেধা, অভিজ্ঞতা, জনকল্যাণ ভাবনার ভিত্তিতে তৈরি সংবিধান ও প্রতিষ্ঠানগুলিকে ভর করে ক্ষমতায় এসেছেন, কুর্শিতে বসার পর সেই প্রতিষ্ঠানগুলিকেই ভেঙ্গে ফেলার খেলায় মেতেছেন। কিন্তু কেউ এর জন্য তাঁর সামান্যতম সমালোচনা করলেও তিনি রক্তচক্ষু দেখান, তাদের গায়ে দেশদ্রোহীর ছাপ্পা মেরে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। স্পষ্টতই তিনি সমালোচনায় ভয় পান। একবারও ভাবেন না যে, ন্যায্য সমালোচনা মেনে ভুল শোধরাতে পারলে আখেরে তাঁর, দেশ ও জাতির লাভ। দেশের অগণিত মানুষের লাভ। তা রাজশক্তিকেই শক্তি জোগায়।

আমাদের বর্তমান রাজা বা তাঁর পারিষদরা আপনা থেকেই এধরনের ‘শক্তের ভক্ত, নরমের যম’ আচরণ করছেন তা নয়। তাঁরা তো তাঁদের গুরুদের কাছ থেকেই এই বিদ্যেটি উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছেন। শিখেছেন যে, বলবানের সামনে মাথা ঝোঁকাতে হয়। আর তাই নিজেকে যখন বলবান মনে হয়, তখন অন্যরা মাথা ঝোঁকাবে না কেন? আমাদের রাজা নিজেই সগর্বে বলেন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) তাঁর গুরু। আর সেই গুরুর গুরু, অর্থাৎ মহাগুরু বিনায়ক দামোদর সাভারকর বা ‘বীর’ সাভারকর পথ দেখিয়েছেন কীভাবে ক্ষমতাবানের কাছে ক্ষমাভিক্ষা করতে হয়। তৎকালীন ইংরেজশাসিত ভারত সরকারের ও ব্রিটিশ সরকারের গোপন নথিপত্র এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত আদালতে সাভারকরের বিচারের রিপোর্ট থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

ইংরেজ সরকার সাভারকরকে আন্দামানের সেলুলার জেলে নিয়ে আসে ১৯১১-র ৪ জুলাই। ১৯০৯-এ নাসিকের জেলা কালেক্টর এটিএম জ্যাকশনকে হত্যার অভিযোগে তাঁর কালাপানি হয়েছিল। সেলুলার জেলে বন্দীদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হত। আর বিপ্লবীরা সেসব নির্যাতন সহ্য করলেও মুচলেখা দেবার কথা কল্পনাও করতে পারতেন না। কিন্তু ‘বীর’ সাভারকর জেলে যাবার ছ'মাসের মধ্যেই ক্ষমাভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯১৩-র ১৪ নভেম্বর জেলারকে পাঠানো তাঁর দ্বিতীয় আবেদনেঃ “...আপনাকে আমি সবিনয়ে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই ১৯১১-তে পেশ করা আমার ক্ষমাভিক্ষার আবেদনটির কথা। আপনি কি সেটা অনুমোদন করে ভারত সরকারের কাছে পাঠিয়েছেন?” ঠিক তার আগে, ১৯১৩-র অক্টোবরে ভাইসরয়ের একজিকিউটিভ কাউন্সিলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেজিনাল্ড কার্ডক সেলুলার জেল পরিদর্শন করেন। সেখানে সাভারকরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। ১৯১৩-র ২৩ নভেম্বর নিজের নোটে কার্ডক ১৪ নভেম্বরে পেশ করা সাভারকরের দয়াভিক্ষার আবেদন নথিভুক্ত করেন।

দ্বিতীয় আবেদনে সভারকর খোলাখুলি লিখেছিলেনঃ “সরকার আমাকে যে দায়িত্ব দেবে আমি সেই দায়িত্ব নিয়েই সরকারের সেবা করতে প্রস্তুত... সরকারের পিতৃসম দুয়ার ছাড়া এই উড়নচণ্ডী সন্তান আর কোথায়-ই বা যেতে পারে?”

ওই আবেদনের উপসংহারে সাভারকর লিখেছিলেনঃ “ভারতীয় রাজনীতির হালের ঘটনাগুলি এবং ভারত সরকারের বন্ধুত্বপূর্ণ আপস-আলোচনার নীতি আর একবার সাংবিধানিক রীতিপ্রথা মেনে চলার সুযোগ করে দিয়েছে। ১৯০৬-১৯০৭ সালে ভারতে যে উত্তেজক ও নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, তা আমাদের বিভ্রান্ত করে শান্তি ও প্রগতির পথ থেকে সরিয়ে কন্টকাকীর্ণ পথে নিয়ে গিয়েছিল। আন্তরিকভাবে ভারত ও মানবজাতির কল্যাণ কামনা করে এমন কোনো মানুষই বর্তমানে অন্ধের মতো সেই পথ অনুসরণ করবে না। সুতরাং, সরকার যদি সর্বপ্রকারের দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শন করে আমাকে মুক্তি দেন, তাহলে আমার চেয়ে আন্তরিকভাবে কেউ-ই আইন মেনে চলতে এবং ইংরেজ সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখাতে পারবে না। এই আনুগত্যই আইন মেনে চলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।”

১৯২০-র ২২ মার্চ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার উইলিয়াম ভিনসেন্ট জানিয়েছিলেনঃ পোর্ট ব্লেয়ারের সুপারিনটেনডেন্টের মাধ্যমে সাভারকরের দুটি আবেদন এসেছে - একটি ১৯১৪ সালে, অপরটি ১৯১৭ সালে। বিশিষ্ট আইনজীবী ও লেখক এ জি নূরানি তাঁর ‘দা আরএসএস’ গ্রন্থে (পৃঃ ৯৪) লিখেছেন, ভিনসেন্ট যেটিকে ১৯১৪ সালের বলে উল্লেখ করেছেন সেটি সম্ভবত ১৯১৩-এর আবেদন।

অরবিন্দ ঘোষের ভাই বারীন ঘোষ ও তাঁর সহযোগীরা তখন সেলুলার জেলে বন্দী। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলার উল্লেখ করে সাভারকর আর একবার ক্ষমাভিক্ষা করে আবেদন করেন ১৯২০-এর ৩০ মার্চ। তাতে তিনি লেখেনঃ “পোর্ট ব্লেয়ারে বন্দী অবস্থাতেও ওরা বড় রকমের ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ।” আর তিনি রাজভক্ত। ওই আবেদনের উপসংহারে তিনি লিখেছিলেন “আমি আর আমার ভাই এই অঙ্গীকার করতেও রাজি যে, আমরা সরকার নির্ধারিত একটা নির্দিষ্ট ও যুক্তিসম্মত সময়সীমা পর্যন্ত রাজনীতিতে অংশ নেব না...। আমরা জেল থেকে ছাড়া পাবার পর নির্দিষ্ট একটা প্রদেশের বাইরে যাব না কিংবা আমাদের গতিবিধি পুলিশকে নিয়মিত ভাবে জানাব। আমরা আন্তরিকভাবেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার অঙ্গীকার করছি এবং আমি ও আমার ভাই তা মেনে চলব।”

পরের দৃষ্টান্ত ১৯৪৮-এর ৩০ জানুয়ারি গান্ধীজী হত্যা এবং পরিণামে আরএসএস নিষিদ্ধ হবার ঘটনা। ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ মনে করেন, দেশভাগের পর পাঞ্জাবের দাঙ্গায় আরএসএস যুক্ত থাকলেও, গান্ধীজী হত্যায় এই সংগঠন প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল না। (‘ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী’, পৃঃ ৯৭) নাথুরাম বিনায়ক গডসে গান্ধীজীকে হত্যা করার তিন-চার দিনের মধ্যেই আরএসএস এক বিবৃতি দিয়ে জানায় যে গডসে এই সংগঠনের সদস্য নয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুকে লেখা একটা চিঠিতে মন্তব্য করেনঃ “(গান্ধী হত্যার) ষড়যন্ত্র দিল্লীতে হয়নি, হয়েছিল পুনেতে। বোম্বাই, আহমেদনগর ও গোয়ালিয়রে।... তবে, আরএসএস আদৌ এর সঙ্গে যুক্ত ছিল না। সাভারকরের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভার কাজ এটা।” একই সঙ্গে প্যাটেল লিখেছেন, “গান্ধীজীর চিন্তাধারার ঘোরতর বিরোধী আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার সদস্যরা অবশ্যই এই হত্যাকাণ্ডকে স্বাগত জানিয়েছে।” নেহরু মন্ত্রিসভার আর এক সদস্য শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ব্যস্ত ছিলেন অপরাধীকে আড়াল করতে। তিনি প্যাটেলকে লেখেনঃ “এর (গান্ধী হত্যা) পিছনে সাভারকারের হাত আছে বলে শোনা যাচ্ছে। আমি জানি না তাঁর বিরুদ্ধে কী কী সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।” নাথুরামের ভাই গোপাল গডসে পরে এক সাক্ষাৎকারে অবশ্য আসল কথাটা স্বীকার করেছিলেনঃ “আমরা সব ভাই-ই, নাথুরাম, দত্তাত্রেয়, আমি আর গোবিন্দ আরএসএস-এ ছিলাম। আমরা, বলতে পারেন, আমাদের বাড়িতে নয়, আরএসএস-এর মধ্যেই গড়ে বেড়ে উঠেছি।”

গডসে যে গান্ধীজীকে হত্যা করতে পেরেছিল, নেহরু মন্ত্রিসভার তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তার জন্য পুলিশের এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্যাটেলের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন। ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ গ্রন্থে (পৃঃ ২৪৩-৪৪) তিনি লিখেছেনঃ “পুলিশ যদি সতর্ক থাকত তাহলে তাকে (অপরাধীকে) ধরে নিরস্ত্র করা যেত। লোকটা রিভলভার নিয়ে ঢুকল, অথচ কেউ তাকে তল্লাশি করল না।” তিনি আরো লিখেছেনঃ “আমি প্যাটেলকে অনুরোধ করেছিলাম, তিনি যেন দাঙ্গাবিধ্বস্ত দিল্লী ছেড়ে বোম্বাই না যান। গান্ধীজীও একই অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি শোনেননি।” কেন? আজাদের মতে, “দিল্লীর মুসলমানদের নিরাপত্তা দেবার দাবিতে গান্ধীজী অনশনে বসেছিলেন। কিন্তু প্যাটেলের মনে হয়েছিল এই অনশন তাঁর বিরুদ্ধে। তাই তিনি আমাদের অনুরোধ উপেক্ষা করে দিল্লী ছেড়ে বোম্বাই চলে গিয়েছিলেন।... তাঁর এই মনোভাবের খুব দুর্ভাগ্যজনক প্রভাব পড়েছিল স্থানীয় পুলিশের উপর। পুলিশ অফিসাররা সর্দার প্যাটেলের নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু যখন তারা দেখলেন গান্ধীজীর নিরাপত্তার জন্য কোনো বিশেষ নির্দেশ এল না, তখন তারা মনে করলেন এব্যাপারে বিশেষ ব্যবস্থা নেবার কোনো প্রয়োজন নেই।”

জয়প্রকাশ নারায়ণ দিল্লীর এক শোকসভায় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করে বলেন, গান্ধী হত্যার দায় তিনি এড়াতে পারেন না। গান্ধীজীকে হত্যার হুমকি দেওয়া ও তাঁকে লক্ষ করে বোমা ছোড়ার ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও কেন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হল না প্যাটেলের কাছে তিনি তার কৈফিয়ত চান। প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষও একই প্রশ্ন তুলে জানতে চান, গান্ধীজীর জীবন রক্ষার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হল না কেন? আজাদ লিখেছেনঃ “গান্ধীজীকে হত্যা করায় মানুষ এত খেপে গিয়েছিল যে, হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস-এর নেতারা দু-তিন সপ্তাহ ধরে ঘর থেকে বের হবার সাহস পাননি।” (ঐ, পৃঃ ২৪৫)

গান্ধী হত্যার দুদিন পর, ১৯৪৮-এর পয়লা ফেব্রুয়ারি আরএসএস-এর সাধারণ সম্পাদক মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর গ্রেপ্তার হন এবং তার তিন দিন পর আরএসএস-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আর সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় ১৯৪৯-এর ১১ জুলাই। গোলওয়ালকর অবশ্য ছাড়া পেয়েছিলেন তার আগেই, ১৯৪৮-এর ৬ আগস্ট। তার জন্য তাঁকে ৮ ফেব্রুয়ারি জেল থেকে এক বিবৃতি দিয়ে বলতে হয়েছিলঃ “যত দিন আরএসএস নিষিদ্ধ থাকবে তত দিনের জন্য এই সংগঠন ভেঙ্গে দেওয়া হল।” মানতে হয়েছিল সরকারের দেওয়া অবমাননাকর সব শর্ত।

সরকারের পক্ষ থেকে কী কী শর্ত দেওয়া হয়েছিল তখন? (১) জেলাশাসকের লিখিত অনুমতি ছাড়া উনি নাগপুরের বাইরে যেতে পারবেন না; (২) কোনো জনসভায় ভাষণ দিতে পারবেন না; (৩) জেলাশাসকের অনুমোদন না নিয়ে কোনো লেখা কোন‌ো সংবাদপত্র বা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করতে দিতে পারবেন না; এবং (৪) “প্রাদেশিক বা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ছড়ায় বা বিব্রত করে কিংবা ভারত অধিরাজ্যের (ডোমিনিয়ন) বিভিন্ন শ্রেণি ও প্রজাবর্গের মধ্যে ঘৃণা বা শত্রুতার মনোভাব সৃষ্টি করে কিংবা জনসাধারণের শান্তি বিঘ্নিত করে এমন কোনো কাজে নিজে যুক্ত থাকতে বা যুক্ত আছে এমন কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বা তার সহযোগী হতে পারবেন না।”

দুর্ভাগ্যের বিষয়, যে জয়প্রকাশ নারায়ণ গান্ধী হত্যার জন্য আরএসএসকে দায়ী করছিলেন এবং মনেপ্রাণে ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন, তিনিই জরুরি অবস্থা ঘোষণার আগেই ১৯৭৩ সালে আরএসএস-কে অনুরোধ করেন তাঁর নেতৃত্বে ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি’ আন্দোলনে সামিল হবার জন্য। লালকৃষ্ণ আদবানি তাঁর ‘মাই কান্ট্রি, মাই লাইফ’ গ্রন্থে (পৃঃ ১৮৯) লিখেছেনঃ “একদিন উনি (জয়প্রকাশজী) অটলজী আর আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমি আপনাদের সহযোগিতা চাই। আপনারা আমার আন্দোলনে যোগ দিন।’ জয়প্রকাশজীর প্রস্তাব বিবেচনার জন্য আমি হায়দ্রাবাদে আমাদের সিনিয়ার নেতাদের একটা বৈঠক ডাকলাম। বাস্তবিকপক্ষে, আমি জেপি-র আন্দোলনকে দেশ জুড়ে বিজেপি-র গণ-আবেদন ও গণভিত্তি যথেষ্ট বাড়ানোর একটা সুযোগ বলে মনে করেছিলাম।”

আদবানি আরো লিখেছেন, “জয়প্রকাশজী জনসংঘকে তাঁর আন্দোলনে যোগ দেবার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, আর আমরা সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি বলে সিপিআই এবং সিপিআই(এম) উভয়ই খুব ক্ষুব্ধ হয়।” (ঐ, পৃঃ ১৯০)

তিনি লিখেছেন, “ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ তখন সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদক। তিনি জয়প্রকাশের সঙ্গে দেখা করে বলেন, ‘আপনি জনসংঘের মত একটা দক্ষিণপন্থী ও সাম্প্রদায়িক দলকে আপনার আন্দোলনে যোগ দেবার আমন্ত্রণ জানালেন কেন? আপনি কি ভুলে গিয়েছেন, ১৯৪৮-এ গান্ধী হত্যার পর আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করার দাবিতে আন্দোলনের পুরোভাগে আপনিও ছিলেন? ‘অর্গানাইজার’ (আরএসএস-এর মুখপত্র) অফিসের সামনে আরএসএস-এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে আপনি নেতৃত্ব পর্যন্ত দিয়েছিলেন! এটা বিশ্বাসঘাতকতা’।” (ঐ, পৃঃ ১৯১)

আদবানির বিবরণ থেকে জানা যাচ্ছে, জয়প্রকাশজী ১৯৭৩-এর ৭ মার্চ জনসংঘ-র অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমি এই অধিবেশনে এসেছি দেশকে একথা জানানোর জন্য যে, জনসংঘ ফ্যাসিস্ট নয়, প্রতিক্রিয়াশীলও নয়। জনসংঘ-র এই মঞ্চ থেকেই আমি ঘোষণা করতে চাই, জনসংঘ যদি ফ্যাসিস্ট হয়, জয়প্রকাশ নারায়ণও ফ্যাসিস্ট।” (ঐ, পৃঃ ১৯২)

জনসংঘ ও আরএসএস যে জয়প্রকাশের আন্দোলনের সম্পূর্ণ ফায়দা নিতে পেরেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭৫-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’য় প্রকাশিত আরএসএস প্রধান বালাসাহেব দেওরস-এর এক বিবৃতি থেকে। তিনি দাবি করেছিলেন, গোটা দেশে আরএসএস-এর ১০,০০০ শাখা ও দশ লক্ষ সদস্য আছে। কেরালায় আছে ১,০০০ শাখা ও একশ সর্বক্ষণের কর্মী। আর উত্তর প্রদেশে আছে ২,৫০০ শাখা।

১৯৭৫-এর ২৫ জুন গভীর রাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হল। নাগপুরে ৩০ জুন মিসায় (মেন্টেন্যান্স অফ ইন্টারনাল সিকিউরিতি অ্যাক্ট) গ্রেপ্তার হলেন দেওরস। তাঁকে প্রথম শ্রেণির বন্দী হিসেবে রাখা হল পুনের ইয়েরওয়াড়া সেন্ট্রাল জেলের আন্ধেরি ইয়ার্ডে (মিসা বন্দী নং ৩০৮)। বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে ৪ জুলাই ১৯৭১-এ সংসদে পাশ করানো ভারত রক্ষা আইনে নিষিদ্ধ করা হল আরএসএস সমেত ২৬টি সংগঠনকে। ওই আইনের ৩৩ নং ধারা আরএসএস-এর উপর লাগু হয় ৬ জুলাই। এরপর আরএসএস-এর পদাধিকারীরা সংঘের সমস্ত কাজকর্ম স্থগিত রাখার বিজ্ঞপ্তি জারি করেন।

আবার সরকারের কাছে ক্ষমা ভিক্ষার সেই কাহিনি। বিশিষ্ট সোশ্যালিস্ট নেতা এবং জনতা পার্টি পরিচালিত সরকারের অন্যতম মন্ত্রী মধু লিমায়ের লেখা ‘জনতা পার্টি এক্সপেরিমেন্টঃ অ্যান ইনসাইডারস অ্যাকাউন্ট অব অপজিশন পলিটিকস’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন জেল থেকে দেওরসের মুক্তির জন্য এবং আরএসএস-এর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবার জন্য কতভাবে চেষ্টা চালানো হয়েছিল।

আরএসএস-এর পক্ষ থেকে আটটি চিঠি লেখা হয় ১৯৭৫-এর ১৫ জুলাই থেকে ১৯৭৬-এর ১৬ জুলাই পর্যন্ত। এর মধ্যে দেওরসের আইনজীবী ও আরএসএস অনুগামী ভিএন ভিদে (তিনিও ইয়েরওয়াডা জেলে বন্দী ছিলেন) মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শংকররাও চ্যবনকে অনুরোধ জানিয়ে তিনটি চিঠি লেখেন। আর দেওরস নিজে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তিনটি এবং চ্যবনকেও দুটি চিঠি লেখেন। এছাড়াও, বিনোবা ভাবে যাতে এব্যাপারে ইন্দিরা গান্ধীকে বোঝান তার জন্য অনুরোধ জানিয়েও দেওরস দুটি চিঠি লিখেছিলেন ভাবেকে।

দেওরস ১৯৭৫-এর ২২ আগস্ট ইন্দিরা গান্ধীকে লেখেন, স্বাধীনতা দিবসে আপনার বক্তৃতা “আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে আপনাকে এই চিঠি লিখতে...। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বা আইন-শৃংখলার পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে এমন কোনো কার্যকলাপের সঙ্গে আরএসএস কখনো যুক্ত হয়নি...। আমি আরএসএস-এর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার জন্য আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি। আপনি আমাকে সাক্ষাতের অনুমতি দিলে বাধিত হব।” ১৯৭৬-এর ১৬ জুন দেওরস মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীকে একটি চিঠি লিখেও আবেদন করেন, “আমি যাতে কতগুলি ব্যাপার ব্যাখ্যা করে আপনাকে বোঝাতে পারি” তার জন্য আমাকে প্যারোলে মুক্তি দিন। তার আগে, ১৯৭৫-এর ১০ নভেম্বর ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেওরস দাবি করেছিলেন, “আরএসএস-এর সঙ্গে জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই।”

এই দাবির সঙ্গে যে সত্যের বিন্দুমাত্র যোগ নেই, তার প্রমাণ পাওয়া যায় নূরানির ‘দা আরএসএস’ গ্রন্থে উধৃত জ্যাফ্রেলটের ‘দা হিন্দু ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট অ্যান্ড ইন্ডিয়ান পলিটিকস’ বইটিতে। জ্যাফ্রোলেট প্রমাণ করে দিয়েছেন, “জেপি-র আন্দোলনে শামিল হতে পেরেছিলেন বলে আরএসএস-এর সদস্যরা গর্ব বোধ করেন”, “ছাত্র সংঘর্ষ সমিতির নেতৃত্ব ছিল কার্যত আরএসএস-এর ছাত্র শাখা অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের হাতে” এবং “আরএসএস তথা জনসংঘ নেতা নানাজি দেশমুখ ছিলেন জেপি-র এইড-ডি-ক্যাম্প”। (পৃঃ ২৫৮-২৬৮) আর, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের পর আরএসএস নেতারা সগর্বে বলে বেড়িয়েছেন সম্পূর্ণ ক্রান্তি আন্দোলনে আসল শক্তি ছিলেন তাঁরাই।

তবে ওই ১০ নভেম্বরের চিঠিতে দেওরস প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, “আপনি আরএসএস স্বেচ্ছাসেবীদের মুক্তি দিন। তাহলে লক্ষ লক্ষ আরএসএস স্বেচ্ছাসেবী দেশ গঠনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বে।” আসলে, দেওরস যে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন এবং কার্যত ক্ষমা ভিক্ষা করেছিলেন এটা কি তার একটা বড় প্রমাণ নয়?

প্রমাণ আরও আছে। মহারাষ্ট্র সরকার বলেছিল মুক্তি পেতে হলে বন্দীদের লিখিত হলফনামা বা মুচলেখা দিতে হবে। সেই হলফনামার বয়ান ছিল এরকমঃ “শ্রী......... প্রথমশ্রেণির বন্দী নং......... হলফনামা দিতে রাজী যে, আমাকে মুক্তি দেওয়া হলে আমি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সামাজিক শান্তি বিপন্ন করে এমন কোনো কাজ করব না। অনুরূপভাবে, আমি একান্ত প্রয়োজনীয় পণ্য বন্টন বিঘ্নিত করতে পারে এমন কোনো কাজ করব না। কোনো বেআইনি কাজে অংশ নেব না। বর্তমান জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকলাপে অংশ নেব না।”

জেলের বাইরে আরএসএস নেতৃত্ব হলফনামা দেবার অনুমতি দিলেও, বিরোধীদের ‘সংগ্রাম কমিটি’ নির্দেশ দিয়েছিল, আরএসএস ও জনসংঘের লোকেরা যেন এই হলফনামায় সই না করেন। এস এম জোশী তা জানিয়েও দিয়েছিলেন। নাসিক জেলে সোশ্যালিস্টরাও হলফনামা দিতে রাজি হননি। তবুও বন্দী আরএসএস ও জনসংঘের বেশিরভাগ সদস্য হলফনামায় সই করেছিলেন। (নূরানি, ‘দা আরএসএস’। পৃঃ ১৮০)

ভারতের ইতিহাসের পাতায় পাতায় আরএসএস-এর কথা ও কাজের মধ্যে ফারাকের, মানুষকে বিভ্রান্ত করার, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করে দমিয়ে রাখার অসংখ্য দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তাঁদের আচরণে একটা গুণগত পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। স্বাধীনতা লাভের পর আমরা গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে একটা আধুনিক সংবিধান তৈরি করতে পেরেছিলাম, জোট-নিরপেক্ষ ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছিলাম। নানা আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে, খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে ও শিল্পায়ন করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার না হলেও, বিপুল সংখ্যক গরিব, পিছিয়ে পড়া মানুষের দারিদ্র দূর করতে পেরেছিলাম। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ক্ষমতায় এসে আমাদের বর্তমান নির্বাচিত রাজা সংখ্যার জোরে সেই সাফল্যগুলিকেই নস্যাৎ করে দিতে আদা জল খেয়ে লেগেছেন।