আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২১ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৮

প্রবন্ধ

চাষি ফসলের দাম পায় না কেন?

অশোক কুমার সরকার


দু'দিন আগে ৪০ টাকা কিলো দরে আলু কিনে ভাবছি এত বেশি দাম দিয়ে যে আলু কিনলাম, চাষি তার কতটা পেল, আর কতটা গেল পাইকারি আর খুচরো ব্যবসায়ীদের ঘরে? দেশের উত্তর, দক্ষিণ, ও পূবে থাকার সুবাদে দেখেছি, একই মরশুমে আলুর দাম কোথাও ১০ টাকা তো কোথাও ৫০ টাকা, অর্থাৎ ৫ গুণ। প্রায় প্রতিটি কৃষিজ দ্রব্যের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একই। প্রায় বললাম কারণ দু-একটি ব্যতিক্রম আছে, দুধ ও রুই-কাতলা মাছ। প্যাকেটের দুধের দাম সারা দেশে প্রায় এক, আর রুই-কাতলার দাম সব শহরেই প্রায় কাছাকাছি।

আমাদের মত গ্রাহক কৃষিজ দ্রব্য যে দামে কেনে তার কতটা চাষি পায়? দুধের বেলায় কেন সারা দেশে প্রায় একই দাম হয়, কিন্তু সিংহ ভাগ কৃষিজ দ্রব্যের বেলায় তা কেন হয় না, এই দুটি প্রশ্ন সাধারণত কৃষির আলোচনায় ওঠে না। এই নিবন্ধে তাই সে বিষয়ে বিভিন্ন কাগজ ঘেঁটে যা দেখতে পাচ্ছি, তাই নিয়ে কথা বলব।

কথা শুরু করতে গেলে একটা কাঠামো লাগে। সেটি আগে ভাগে সাজিয়ে রাখি যাতে লেখায় যুক্তি ও তথ্যের জটিলতায় তা হারিয়ে না যায়। কাঠামোর এক দিকে আছে চাষি, যে চায় তার উৎপন্ন দ্রব্যের ন্যায্য দাম মিলুক। অন্য দিকে আছি আমরা; আমরা চাই অকারণ বেশি দাম দিয়ে যেন আমাদের কৃষিজ দ্রব্য কিনতে না হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই আমরার মধ্যে চাষিও আছে। আমরা ভাবি চাষি হল উৎপাদক। সে কথাটা ঠিক, কিন্তু একাধারে চাষিও ক্রেতা। দেশের ৮৬% চাষি প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষির পর্যায়ে পড়ে, তারা চাল-গমের প্রয়োজনের ৫০% বাজার থেকে কেনে, ২৫-৩৫% নিজেদের উৎপাদন থেকে পায়, আর ১৫-২৫% রেশন ব্যবস্থা থেকে কেনে। ডাল, ফল ও সবজির বেলায় ৬০-৯০% ভাগ তাদের বাজার থেকেই কিনতে হয়, আর দুধের বেলায় কিনতে হয় ৪০% এর মত। তার মানে আমরা যেমন চাই ন্যায্য দামে কিনতে, চাষিও তাই চায়। চাষি যদি অনেক বেশি দামে ফসল বিক্রি করে, তার যেমন লাভ, তেমনি আমাদের ক্ষতি, অন্য চাষিরও ক্ষতি। আর যদি চাষি খুব কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়, তাহলে তার ফায়দা আমরা পেতে পারি, নাও পারি। সেটা নির্ভর করছে চাষি ও আমার মধ্যে আর কে কে ওই কৃষিজ দ্রব্য নিয়ে ব্যবসা করছে।

সেখান থেকে কাঠামোর দ্বিতীয় দিকের কথা চলে আসে। চাষি ও আমাদের মধ্যে কে কে আছে? তারা কি করে? চাষির বেচা দাম আর আমাদের কেনা দামের মধ্যে তাদের কী ভূমিকা?

প্রথমে বলি দুধের কথা। দেশে বছরে ১৭ কোটি টন দুধ উৎপন্ন হয়, ২৭ ভাগ সমবায়ের হাত দিয়ে বিক্রি হয়, ১০ ভাগ গোয়ালার হাত দিয়ে সরাসরি বিক্রি হয়, ১৮ ভাগ মত প্রাইভেট কোম্পানির হাত দিয়ে। বাকিটা বাজারে আসে না। আমরা যে দামে দুধ কিনি, দুধ উৎপাদকেরা (যারা ৯৫% শতাংশ মহিলা),তার ৮১ শতাংশ পেয়ে থাকে, তার কারণ, দেশ জুড়ে সমবায়ের বিস্তৃত উপস্থিতি, যারা চাষিকে গুণমান ও ওজন অনুযায়ী ন্যায্য দাম দেয়। দেশের সাড়ে ৬ লক্ষের বেশি গ্রামের মধ্যে ১ লক্ষ ৮৫ হাজার গ্রামে দুধের সমবায় ও সংগ্রহ কেন্দ্র আছে, যার সদস্যরা রোজ সংগ্রহ কেন্দ্রে দুধ নিয়ে আসে। সেখান থেকে দেশব্যাপী একটা বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমাদের বাড়িতে দুধ পৌছয়। এই বিস্তৃত নেটওয়ার্কের মধ্যে আছে, যানবাহন, স্টোরেজ, প্রসেসিং, এবং প্রতিটি স্তরে তাপমাত্রা ও শুদ্ধতা নিয়ন্ত্রণ। এর প্রায় পুরোটাই গড়ে তুলেছে সমবায় ব্যবস্থা। যেহেতু সমবায়গুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতা দুটিই আছে, ফলে সারা দেশে দাম নিয়ন্ত্রিত থাকে। সমবায়ের সামগ্রিক সাফল্যের পাশাপাশি কিছু প্রাইভেট কোম্পানি এখন একই ভাবে দুধের ব্যবসা করছে, কিন্তু সমবায়ের বিস্তৃত উপস্থিতির ফলে তারা ফাটকা লাভ করতে পারে না।

কিন্তু ডাল? দেশের প্রায় সব অঞ্চলে ডাল খাওয়া হয়, কিন্তু ডাল উৎপন্ন হয় মূলত ৭টি রাজ্যে - অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, তেলেঙ্গানা, উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশ। উৎপাদনের ৮৮ থেকে ৯১% বাজারজাত হয়, ছোট মাঝারি, বড় ও প্রান্তিক - সব চাষিই বাজারে আসে। সরকার ডাল কেনে না, ফলে সবটাই প্রাইভেট ব্যবসায়ীরা কেনে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ২০১৮ সালে একটা সার্ভে করেছিল। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন ডালের বেলায় আমাদের কেনা দামের মাত্র ৬০-৬৫% চাষি পেয়ে থাকে। প্রশ্ন উঠবে বাকিটা যায় কোথায়? এখানে পাইকার ও খুচরো ব্যবসায়ীদের বড় ভূমিকা। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১০-৩০% যায় পাইকারদের ঘরে, আর আরও ১০-২০% যায় খুচরো বিক্রেতাদের ঘরে।ii

ডালের মতই আলু, টম্যাটো, পেঁয়াজও সারা দেশে খাওয়া হয়। এগুলিও সরকার কেনে না। গত ১ মার্চ, ২০২১ তারিখের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজে, বর্তমানের তিনটি কৃষি আইনের অন্যতম রূপকার অশোক গুলাটি এবং সহযোগী হর্ষবর্ধন দেখিয়েছেন টম্যাটোর ক্ষেত্রে চাষি পায় আমাদের কেনা দামের ৩২%, আলুতে ২৭%, আর পেঁয়াজে ২৯%। তুলনায় প্রাথমিক স্তরের ব্যবসায়ী টম্যাটোতে পায় আমাদের কেনা দামের ২৬%, আলুতে ৮% আর পেঁয়াজে ২৪%। তারপর প্রধান পাইকারি বিক্রেতা পায় ১৬%, ২১%, আর ১৬%। আর খুচরো বিক্রেতা পায় ২৬%, ৪৪%, আর ৩১%। অর্থাৎ মাঠ থেকে আমাদের ঘরে পৌছতে ছাষি ছাডা়ও আলু পেঁয়াজ, টম্যাটোকে আর ও তিন হাত পেরোতে হয়, এবং আমরা যে দাম দিচ্ছি, তার সিংহ ভাগ এরাই খেয়ে যায়।iii

ফল-সবজির বেলায় ছবিটা একটু মিশ্র; কোনওটায় চাষি পাচ্ছে প্রায় ৭৫-৭৭%, কোনওটায় পাচ্ছে ৫০%, আবার কোনও ক্ষেত্রে পাচ্ছে মাত্র ৩০%।iv

বোঝাই যাচ্ছে, চাষি ছাড়াও কৃষি বাজারে দু'টি মস্ত বড় খেলোয়াড় আছে, এক হল পাইকারি ক্রেতা-বিক্রেতা, দ্বিতীয়টি হল খুচরো বিক্রেতা। ধানের মাঠের দাম (কেউ যদি মাঠ থেকে চাষির ধান কিনে নিতে চায়, সে যা দাম দেবে) আর পাইকারি দামের মধ্যে ৩-২৫% তফাত হয়, বিহারে সব চেয়ে বেশি তফাত হয়, আর অন্ধ্রে সবচেয়ে কম। গমের বেলায় দামের ফারাক হয় ৫ থেকে ৩৫%। উত্তরাখন্ডে এই তফাত সবচেয়ে কম, বিহারে সব চেয়ে বেশি। আর আলুর বেলায় ফারাক ১০ থেকে ৪৫%, এখানেও বিহারে সবচেয়ে বেশি, মহারাষ্ট্রে সবচেয়ে কম।

আর পাইকার থেকে খুচরো বিক্রেতা? চালের বেলায় ৩ থেকে ২৫০% দামের তফাত! (দিল্লিতে সবচেয়ে কম, অসমে সবচেয়ে বেশি), আটার বেলায় ১০% থেকে ৪৮% (পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে কম, মহারাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি।) অন্য দিক থেকে যদি দেখি, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন পণ্যের সবচেয়ে কম আর সবচেয়ে বেশি দামের মধ্যে ফারাক কত? ধানের বেলায় তা আড়াই গুণ, গমের বেলায় ২.৩ গুণ, আলুর বেলায় ৪.৫ গুণ, পেঁয়াজের বেলায় ৫ গুণ, বিভিন্ন ডালের বেলায় দুগুণের কম।v

এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি! চাষি দাম পাচ্ছে না, আর আমরা অনেকেই অনেক বেশি দাম দিয়ে একই জিনিস কিনছি। প্রশ্ন করতেই হয়, চাষির বেচা দাম আর আমার কেনা দামের মধ্যে এত ফারাক কেন?

ফারাকের কয়েকটা কারণ আছে। প্রথমত বুঝতে হবে, মাঠ থেকে বের হওয়ার পর, কৃষিজ দ্রব্যকে কী প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে যেখানে খরচ হচ্ছে? আলু, পেঁয়াজ, টম্যাটোর ক্ষেত্রে, পরিষ্কার করা, বাছাই করা, প্যাকিং ছাড়া আর কোনও প্রক্রিয়াকরণ নেই। ডালের ক্ষেত্রেও তাই। চাল-গমের ক্ষেত্রে রাইস মিল, বা আটাকলের দরকার হয়, ধান থেকে চাল করা, বা গম থেকে আটা করার জন্য। ফল সবজির ক্ষেত্রেও পরিষ্কার করা, বা বাছাই করা ছাড়া আর কিছু প্রক্রিয়াকরণ নেই। কিন্তু প্যাকিং, যানবাহন ও মজুতের দরকার আছে। এইখানে একটা জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। চাল, ডাল, গম, পেঁয়াজ সহজে মজুত করা যায়। আলুর ক্ষেত্রে কোল্ড স্টোরেজ লাগে, ফল সবজির ক্ষেত্রে বিশেষ ধরণের কোল্ড স্টোরেজ লাগে, এমনকি ঠান্ডা যানের দরকার হয়।

আলু যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের একটা মুখ্য কৃষিজ দ্রব্য, তাই তার কাহিনিটা দেখা যাক। সুমন নাথ ও ভাস্কর চক্রবর্তী ২০১১ সালে একটি গবেষণায় সুন্দর দেখিয়েছেন আলু মাঠ থেকে বেরোবার পর কোন কোন পথে বিচরণ করে। দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছু মিডল্ ম্যান, কোল্ড স্টোরেজ মালিক, আলুর বন্ড বিক্রেতা, এবং খুচরো ক্রেতা-বিক্রেতারা আলুর বাজারে প্রধান খেলোয়াড়। তার সঙ্গে ব্লক ও জেলা স্তরের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও জড়িয়ে। এই কোল্ড স্টোরেজগুলি যে শুধু আলু মজুত করে তা নয়, তারাই আলু চাষের আসল মহাজন, তারাই আলু চাষিকে ঋণ দেয়, দাম নিয়ন্ত্রণ করে। কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা এককাট্টা হয়ে কৃত্রিম মজুত সীমা তৈরি করে যাতে চাষিরা কিছু আলু অল্প দামে বেচতে বাধ্য হয়। কোল্ড স্টোরেজ মালিকদের দালালরাই এই আলু তৎক্ষণাৎ কম দামে কিনে নেয়। এই কোল্ড স্টোরেজগুলি আবার অন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নেয়। পুরো আলু চাষটাই একটা ঋণের জালে জড়ানো। ক্ষমতার সমীকরণে চাষি এখানে গৌণ।vi

কোল্ড স্টোরেজ আর ঠান্ডা যানের কথা যখন উঠলই, তখন বলে নেওয়া ভাল, যে সরকারি তথ্য বলছে, কোল্ড স্টোরেজগুলির সামগ্রিক মজুত ক্ষমতায় খুব একটা ঘাটতি নেই, কিন্তু মারাত্মক ঘাটতি আছে ঠান্ডা যানের ক্ষেত্রে; প্রায় ৮৫% ঘাটতি।viiএ-ও অদ্ভুত; প্রত্যেকদিন গুজরাতের আনন্দ থেকে আসামের গৌহাটি পর্যন্ত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে দুধের ট্রেন পৌছে যেতে পারে, কিন্তু ফল সবজি আলু সারা দেশে পরিবহণ করার মত ঠান্ডা যান বাহন নেই। ফলে অত্যন্ত সাবেকি পদ্ধতিতে নানা হাত ঘুরে তা বিভিন্ন শহরে-মফস্বলে পৌছয়, যাতে দাম বাড়তে বাধ্য।

চাষির বেচা পণ্যের দাম কম হবার আর একটা বড় কারণ, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিদের ফসল ওঠার পরেই তা বিক্রি করে ঋণ শোধ করতে হয় এবং ঘরে কিছুটা নগদ টাকার জোগান দিতে হয়। কাজেই বাজারে অনেক পরিমাণ ফসল বিক্রির জন্য ওই সময়ে আসে। এইখানে শুরু হয় বাজারের খেলা। চাষির কাছে তিন রকমের বাজার আছে। এক গ্রামীণ হাট, দুই মান্ডি, আর তিন সমবায় বা সরকার। তৃতীয়টির আলাদা কোনও বাজার নেই, স্থায়ী মান্ডিগুলিতে কাউন্টার খুলে, অথবা অস্থায়ী মান্ডি তৈরি করে সরকার যা কেনবার কেনে। কিছু কিছু ফসলের ক্ষেত্রে ডিলাররা সরাসরি কিনে নেয়, বা প্রসেসিং কোম্পানিগুলি নিজেরা কিনে নেয়, কিন্তু তার নেটওয়ার্ক খুব একটা বিস্তৃত নয়।

আমি যদি চাষি হই আমি চাইব, যেখানে সবচেযে বেশি দাম পাব সেখানে যেতে, কিন্তু যেতে পারব কি? গ্রামীণ হাটগুলি আমার সবচেয়ে কাছে আছে। দেশে প্রায় ২৪০০০ গ্রামীণ হাট আছে, পশ্চিমবঙ্গেই আছে ২৯০০-র একটু বেশি, অর্থাৎ প্রতিটি ব্লকে ৮-৯টি গ্রামীণ হাট পাওয়া যাবে। কিন্তু সেখানে বেচলে সবচেয়ে আমি কম দাম পাব। দেশে মাত্র ৭৩০০ মান্ডি আছে, তার মধ্যে বেশির ভাগ ছোটো শাখা মান্ডি, কিন্তু মান্ডিগুলি চাষির থেকে অনেক দূরে। ১৭টা রাজ্যে ১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় মাত্র একটা মান্ডি পাওয়া যাবে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য ২৬ বর্গ কিলোমিটারে একটা মান্ডি পেয়ে যাব। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তো কৃষি উৎপাদন দেশের একবারে উপরের সারিতে, ফলে এই মান্ডিগুলির এত কেনার ক্ষমতা আছে কি? এখানে আছে ৪৭৫টি মান্ডি কিন্তু উৎপাদনের নিরিখে দরকার ৮২৬টি।viiiঅর্থাৎ মান্ডি থেকেও আমার খুব একটা সুবিধা হচ্ছে না। বীরভূমের এক চাষির অভিজ্ঞতা শুনুন।

আমাদের রাজ্যে যা আছে, তা সরকার নিয়ন্ত্রিত মান্ডি। Agriculture Extension office-এর অধীনে পরিচালিত হয়। গত বছর পর্যন্ত চাষিদের নিজেদের জমির রেকর্ড ও মালিকানা সংক্রান্ত নথিপত্র নিয়ে এই সব মান্ডিতে যেতে হত। সেখানে নাম নথিভুক্ত করে এসে অপেক্ষা করতে হত ডাক আসার জন্য। নিয়মটা ছিল, নাম নথিভুক্ত করার পরে তাকে ফোন করে ডেকে পাঠালে তবে সে ধান নিয়ে মান্ডিতে যেতে পারবে। তারপর ধান বিক্রি, বিক্রির টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢোকা ইত্যাদি মোটামুটি নিয়ম মাফিক হয়ে থাকে।

আমি নিজে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মান্ডিতে এ ভাবে ৩২ কুইন্টাল ধান বিক্রি করে টাকা পেয়েছিলাম। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল গত বছর থেকেই। গত বছরেও ডিসেম্বারের গোড়ায় আমি নিয়মমাফিক নাম নথিভুক্ত করেছিলাম, কিন্তু ডাক এল এ বছরের মার্চের শেষে। মনে রাখতে হবে, চলতি বছরের ২৪শে মার্চ সরকার করোনা সংক্রমণ রুখতে দেশজুড়ে প্রথম দফার লকডাউন জারি করে। ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে না পেরে আমি আগেই খোলা বাজারে ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হই। অবশ্যই সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের চাইতে অনেক কম দরে। এ বছর ৩রা ডিসেম্বর আমি ওদের অফিসে নাম নথিভুক্ত করতে গিয়ে জানতে পারি, নিয়ম বদলে গেছে। এখন থেকে নাম নথিভুক্ত করতে হলে একমাত্র 'খাদ্যসাথী' অ্যাপ দিয়েই তা করা যাবে। এই অ্যাপটা আবার কেবলমাত্র অ্যান্ড্রয়েড ফোনে রয়েছে। আমার অ্যান্ড্রয়েড ফোন নেই, বাধ্য হয়ে সেটা কিনতে হল। নাম নথিভুক্ত করলাম। অ্যাপ জানিয়ে দিল, নাম নথিভুক্ত হয়েছে। কিন্তু ফোন নম্বর পাল্টাতে নিয়ম মেনে ফর্ম ভরে জমা দিলাম। একটা বার্তা এল যে ফর্ম জমা পড়েছে। কোনও ক্রমিক সংখ্যা কিন্তু দেওয়া হল না। খোঁজ নিতে গিয়ে শুনলাম, মেশিন খারাপ। ১১ ডিসেম্বরেও তা সারানো হয়নি বলে খবর পেলাম। ফলে, কতজনের পরে আমার ডাক আসবে, সে ব্যাপারে আমি অন্ধকারেই।

সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন মান্ডিতে এই ভাবে ৩রা ডিসেম্বর নাম লেখানোর পরে মার্চ পর্যন্ত ধান ঘরে রেখে বসে থাকতে হয় আমার মতো অনেককেই। কারণ, গোটা ব্লকে একটি করে মান্ডি, দিনে ২০ জনের বেশি চাষির কাছ থেকে ধান কিনতে সরকার অপারগ, বা কিনবে না। ফলে, মান্ডিতে সরকারের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ধান বেচার বিষয়টা অনেকটা লটারির মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। মান্ডি থেকে কবে ডাক আসবে তার জন্য ফসল আগলে রেখে বসে থাকতে হলে পকেটে বাড়তি টাকা থাকা দরকার। ইঁদুর ও পোকামাকড় থেকে ধান ঠিকমতো বাঁচিয়ে রাখতে গোলা তৈরি করা দরকার, সে জন্য কয়েক হাজার টাকা বাড়তি খরচ করতে হয়। ডাক আসতে আসতে পরের চাষের সময় এসে যাবে, এই ধান বিক্রি না করেই আবারও মাটি চষা, বীজ বোনা, রোয়া ইত্যাদির জন্য খরচ করার সঙ্গতি থাকে না বলেই অধিকাংশ চাষি অপেক্ষা করতে পারে না, তারা খোলা বাজারে অনেক কম দামে ফসল বেচে দিতে বাধ্য হয়।ix

যদি বা আমি মান্ডিতে যেতে পারি, সেখানে আমাকে বিক্রি করতে হবে কমিশন এজেন্টকে। কমিশন এজেন্টরা সেখানে স্টল খুলে বসে আছে, তারা ১০-১২% কমিশনে কিনবে চাষির কাছ থেকে, আর বিক্রি করবে আসল পাইকারি ব্যবসায়ীকে। যে কোনও মান্ডিতে এই কমিশন এজেন্টদের একটা একচেটিয়া জোট আছে। দীর্ঘ দিনের বিশ্বাসের সম্পর্কের ভিত্তিতে - কমিশন এজেন্টদের সঙ্গে চাষির সম্পর্ক, আর পাইকারদের সঙ্গে কমিশন এজেন্টদের সম্পর্ক। কমিশন এজেন্টরা অনেক ক্ষেত্রেই আবার মহাজন, চাষিদের মরশুম-ভিত্তিক ঋণ দিয়ে উৎপাদনের একটা অংশ যাতে পূ্র্ব নির্ধারিত দামে পায়, তা সুনিশ্চিত করে। এই ব্যবস্থা, ফল-সবজির ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য।x

চাষি দুটো জিনিস বাজার থেকে আশা করে; উৎপাদন তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে যাবে, যাতে সেই টাকা সে পরের চাষে এবং ঘর সংসারের কাজে লাগাতে পারে; আর দাম যেন এমন হয় যাতে খরচ বাদ দিয়ে ঘরে কিছু আসে। আমাদের দেশে চাষি এই দু'টি নিশ্চয়তা কোথাও পায় না - না পায় সরকারের থেকে, না বাজার থেকে। সরকার ধান-গম কেনে, রেশন ব্যবস্থার জন্য আর পুলিশ-মিলিটারিদের জন্য। এখন তো প্রায় ৮১ কোটি মানুষ সারা দেশে রেশন ব্যবস্থার আওতায়। ফলে সরকারি সংগ্রহ বেড়েছে, কিন্তু এই সুবিধা সব চাষি পায় না। বিশেষত প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষি হলে সরকারকে ফসল বিক্রি করতে পারার সম্ভাবনা কম। তবে এখন যে হেতু রাজ্য সরকারগুলি ধান-গম বেশি সংগ্রহ করছে, তাই সে সম্ভাবনা একটু বেড়েছে।xi আর বাজারের অনিশ্চয়তা তো ফি বছর দেখা যায়; আলু, বেগুন, টম্যাটো, কপি, পেঁয়াজ, লঙ্কা চাষিরা রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে, এ ছবি দেশের কোনও না কোনও প্রান্ত থেকে প্রতি বছর ভেসে আসে। ভাল উৎপাদন হলে অনেক ক্ষেত্রেই চাষিদের বিপদ বেড়ে যায়।

প্রশ্ন ওঠে, তাহলে চাষিদের ফসল বিক্রি ও দামের নিরাপত্তা কী করে আসতে পারে; সরকারের কাছ থেকে না বাজার থেকে? ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ও সরকারি ক্রয়ের প্রাসঙ্গিকতা এইখানে। আমাদের দেশে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে দু'ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে - এক, বাজারে যাতে ফসলের দাম হঠাৎ না পড়ে যায়, তার জন্য সরকার মান্ডিতে গিয়ে কয়েক দিন ধরে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কিছু ফসল কিনে নেয়। এর পোশাকি নাম price stabilization scheme, আর তার জন্য সরকারের নির্দিষ্ট কোষ আছে, তাকে বলা হয় price stabilization fund।এই টাকাটা বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মাধ্যমে খরচ হয়। আর আছে রেশন ব্যবস্থা। ২০১৩ সালে খাদ্য সুরক্ষা আইন চালু হবার পরে এখন রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে ৮১ কোটি মানুষকে চাল-গম সরবরাহ করে। তার জন্য চাল-গম উৎপাদনের প্রায় ৩০-৩৫ ভাগ সরকারের ঘরেই যায়। আরও ২১ টা ফসলের ক্ষেত্রে সরকার সহায়ক মূল্য ঘোষণা করে, কিন্তু কেনে খুব কম, উৎপাদনের ২-৪% মাত্র, ওই price stabilization scheme-এর দৌলতে। ধান গম ছাড়া বাকি ফসলে বাজারেরই আধিপত্য। (আখ ও কাপাসকে এখানে আলাদা রাখতে হবে। এ-দুটির জন্য সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা আছে।)

মান্ডির একচেটিয়াত্ব অতিক্রম করে, চাষিরা যাতে বাজারে গিয়ে প্রয়োজন অনুসারে বিক্রি করতে ও ন্যায্য দাম পেতে পারে, তার জন্য নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। যেমন, দেশে এখন ৭০০-র বেশি কিষাণ মার্কেট চালু হয়েছে, যেখানে চাষিরা কোনও রকম এজেন্ট ছাড়াই নিজেরা এসে তাদের সামগ্রী বিক্রি করতে পারে। আমাদের রাজ্যেই তো ১৮৬টি কৃষক বাজার তৈরি করেছে, সরকার। কিন্তু সেগুলি কেমন চলছে তার কোনও তথ্য নেই। কিষাণ মার্কেটগুলি কেমন কাজ করছে, তাই নিয়ে দক্ষিণ ভারত থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। তাতে দেখা যাচ্ছে, মূলত প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিরাই কিষাণ মার্কেটে আসে। এরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাজারের কাছাকাছি অঞ্চলের চাষি। কিষাণ মার্কেটে মূলত সব্জি-ফলই বিক্রি হয়। যানবাহন-এর সমস্যার জন্য এরা চাইলেও খুব বেশি পরিমাণ এই বাজারে নিয়ে আসতে পারে না। এরা স্থানীয় পাইকারি বাজার থেকে প্রায় ২০-২২% বেশি দাম পায়।xii

কিন্তু কিষাণ মার্কেটও সরকার নিয়ন্ত্রিত, কাজেই তাকে পুরোপুরি বাজারের অংশ বলা যাবে না। সুপার মার্কেট চেনগুলিকে নিশ্চয়ই বলা যাবে। গত ২০ বছরে একাধিক সুপার মার্কেট চেন বাজারে এসেছে, যারা কিছু ফসল সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে কেনে। এরা, চুক্তি চাষে নেই, সরাসরি স্পট কেনাকাটা করে থাকে। ফল, সবজি, আলু, পেঁয়াজই মূলত কেনাকাটা হয়ে থাকে। ২০০৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত একাধিক গবেষণায় দেখা যায়, চাষিরা তাদের উৎপাদনের ১৬-৩২% সবজি সুপারমার্কেটকে বেচে থাকে, দক্ষিণ ভারতে সবচেয়ে বেশি, তারপরে পশ্চিম, উত্তর ভারত হয়ে, পূর্ব ভারতে সবচেয়ে কম। সুপারমার্কেট চেনের সঙ্গে চাষিদের বছরে ৩-৪ বার লেনদেন হয়, এ ছাড়াও সাবেকি বাজারগুলিতেও তিন-চারবারই ফল-সবজির লেনদেন হয়ে থাকে। সবচেয়ে ভাল মানের সবজি (টম্যাটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, চেঁড়স, বেগুন, আতা, আনারস, পেঁপে ইত্যাদি) চাষিরা সুপারমার্কেট চেনদের কলেকশন সেন্টারে নিয়ে যায়, কারণ, সেখানে তারা বেশি দাম পায়। বাকিটা তারা সাধারণ বাজারে বিক্রি করে।

এই চাষিরা কারা? ওই গবেষণাগুলি দেখাচ্ছে, এরা তুলনায় বেশি শিক্ষিত, একটু বেশি জমির মালিক, এদের জমিতে ভাল সেচ আছে, এবং এরা কলেকশন সেন্টারের কাছাকাছি থাকে। তুলনায় অন্যান্য বাজারগুলি অনেক দূরে, কিন্তু বেশির ভাগ উৎপাদন বিক্রি করতে সেখানেই যেতে হয়। সুপারমার্কেট ভাল গুণমানের সবজি বলতে কী বোঝে? বোঝে বড় সাইজ, দাগমুক্ত ও একই রকমের চেহারা। সুপারমার্কেটের ক্রেতাদের নাকি সেটাই পছন্দ! এ যেন ছাঁচে ফেলা ফ্যাকটরিতে তৈরি জিনিস! এবং একমাত্র এই কারণেই, চাষি চাইলেও তার উৎপাদনের বেশির ভাগটাই সুপারমার্কেটকে বিক্রি করতে পারে না। কিন্তু যখন বিক্রি করে, তখন প্রতি কিলোতে ২-৩ টাকা বেশি দাম পায়।xiii

আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে সুপারমার্কেট চেন নিয়ে যতগুলি গবেষণা হয়েছে, তাতে এটা পরিষ্কার যে, ১) সুপারমার্কেট-রা স্পট কেনাবেচা করে বলে চাষিকে ঠকানোর সুযোগ কম, ২) সুপারমার্কেট গুলির চাহিদা এমনই, যে নিজেদের তৈরি বা বাজারে-কেনা বীজ দিয়ে চাষ করলে, চাষি কখনওই উৎপাদনের অধিকাংশ সুপারমার্কেটগুলিকে বিক্রি করতে পারবে না, এবং চাষি সেটা চায়ও না, তারা চায় একাধিক বাজারে তাদের বেচার সুযোগ যেন থাকে, ৩) ফল-সবজির ক্ষেত্রে সুপারমার্কেট চেনগুলি নিঃসন্দেহে চাষিকে বেশি দাম দিতে প্রস্তুত, কিন্তু সব চাষি তার সুযোগ নিতে পারবে না, এবং ৪) যত বেশি সুপারমার্কেটগুলি জেলা শহরগুলিতে ছড়াবে, তত তাদের কালেকশন সেন্টারও বাড়বে।xiv

তৃতীয়টি হল চুক্তি চাষ, সবচেয়ে বিতর্কিত। একটা ধারণা হল, চুক্তি চাষে, চাষের নিয়ন্ত্রণটাই চলে যাবে কর্পোরেটদের হাতে, ফলে চাষি মার খাবে, খাদ্য সুরক্ষা বিঘ্নিত হবে, কর্পোরেটদের যেহেতু পরিবেশের প্রতি কোনো দায়বন্ধতা নেই, ফলে পরিবেশ বান্ধব চাষের বদলে পরিবেশক্ষয়ী চাষ হবে। অন্য ধারণা হল, চুক্তি চাষে চাষি দামের নিশ্চয়তা পায়, কর্পোরেটদের যেহেতু দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ থাকে, তারা চাষির সঙ্গে সে রকমই সম্পর্ক তৈরি করতে চায়, চাষিকে ঠকিয়ে তা সম্ভব নয়। বাজার ব্যবস্থার মধ্যে যে অনিশ্চয়তা থাকে তার শিকার কর্পোরেটও হয়, চাষিও হয়, আর তাছাড়া একবার ঠকলে চাষি আর ও পথ মাড়াবে না, কাজেই খুব ক্ষতির সম্ভাবনা কম।

বাস্তব চিত্রটা একটু জটিল। সেটা বুঝতে গেলে মাঠের তথ্য কি বলে তাও যেমন দেখতে হবে, আবার নীতি প্রণয়ন করতে গেলে কী কী বোঝার আছে, দেখতে হবে। মাঠের তথ্য দুটি পক্ষকেই সায় দেয়; চুক্তি চাষে চাষি লাভবান হয়েছে, বছরের পর বছর স্বস্তিতে চুক্তি চাষ করছে, এ তথ্য যেমন আছে, পাশাপাশি চাষি ঠকেছে, সর্বস্বান্ত হয়েছে, এ তথ্যও আছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ-সমেত ১১টি রাজ্যে চুক্তি চাষ চলছে, এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, সরাসরি কর্পোরেটরা দোকান খুলে চুক্তি চাষ করাচ্ছে এ ঘটনা খুব কম, সব জায়গাতেই একজন এজেন্ট মাঝখানে আছে, মূল দায়িত্ব তারই, ঝুঁকির অনেকটাই তার। এটা বোঝা কঠিন নয়। এক গবেষক পশ্চিমবঙ্গে চুক্তি চাষের পত্তনের সময়ে গবেষণা করে দেখিয়েছিলেন, স্যুট-বুট পরা, গাড়িতে আসা যাওয়া করা, ম্যানেজমেন্ট পড়া, ইংরেজি বলা, শহুরে চেহারার ও কথাবার্তা বলা সরাসরি কর্পোরেটের প্রতিনিধিকে চাষি একেবারেই বিশ্বাস করে না, কিন্তু একজন স্থানীয় মাঝারি-বড় ব্যবসায়ীকে চাষি বিশ্বাস করে অনেক বেশি।xvসে এলাকার মহাজন হতে পারে, সারের ডিলার বা অন্য কেউ হতে পারে। তার জন্য কর্পোরেটকে নিজেকে আড়াল করার প্রয়োজন হয় না, কেনাবেচায় ও তার শর্ত নির্ধারণে চাষির সামনে না এলেই হল।

চুক্তি চাষ বিভিন্ন রাজ্যে চলছে বটে, কিন্তু সরকারের বিশেষ কোনো নিয়ন্ত্রণ তার উপর নেই। অথচ, দুনিয়ার অন্য অনেক বাজার অর্থনীতি নির্ভর দেশে চুক্তি চাষের উপর সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণ আছে। চুক্তি রেজিস্ট্রি করাতে হয়, চাষ কেমন হচ্ছে তার ইন্সপেকশন হয়,চুক্তির নির্দিষ্ট সরকার অনুমোদিত বয়ান আছে, এবং যে কোনও অনিয়মের বিহিত হবার ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশেও ২০১৮ সালে চুক্তি চাষের যে মডেল আইন কেন্দ্রীয় সরকার এনেছিল, তাতে এর সবই ছিল, অজ্ঞাত কারণে তার অনেকটাই নতুন আইনে অনুপস্থিত।

চুক্তি চাষে, চাষি ও কোম্পানির মধ্যে ক্ষমতার যে অসম সমীকরণ আছে, তার জন্যই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের কথা ওঠে। এছাড়াও, চুক্তি চাষের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের আরেকটা ন্যায়িক কারণ আছে। কৃষি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির সুরক্ষার ভিত্তি। বাজারি অর্থনীতি অনেক সময়ই তাকে উপেক্ষা করে। কর্পোরেটরা এমন চাষ করতে বলতে পারে, যাতে চাষির ও কোম্পানির লাভ অনেক, কিন্তু খাদ্য ও পুষ্টির নিরিখে তার কোনও মূল্য নেই। জৈব জ্বালানি ও পাম অয়েল তার উদাহরণ। আবার কোম্পানি এমন চাষ করতে বলতে পারে যাতে অনেক বেশি জল লাগে বা মাটির জৈব ক্ষমতা নষ্ট হয়। আমাদের দেশে বিমার বাজার, টেলিকম, শেয়ার বাজার, শ্রমের বাজারের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আছে, কৃষি বাজারে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না একথা ভাবা যায় না।অন্য দিকে চুক্তি চাষ মানেই খারাপ, এটাও মানার মত যুক্তি নয়।

এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে চুক্তিতে আলু চাষ নিয়ে একটি বিশদ গবেষণার উল্লেখ করা যেতে পারে। বর্ধমান, হুগলী, বাঁকুড়া, হাওড়া জেলার ১৩টা ব্লকের ১৪৪ জন চুক্তি চাষি ও ১৩৯ জন সাধারণ আলু চাষির মধ্যে সার্ভে করে, গবেষকরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে এনেছেন। প্রথমত কোম্পানি এক বিশেষ ধরনের আলু বীজ ধারে সাপ্লাই করে, বিনা পয়সায় চাষের ট্রেনিং ও তদারকি করে, ফসলের দাম আগে থেকে ঠিক করা থাকে। দামের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকেন চাষিরা। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে চাষিরা ওই কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিতে চাষ করছেন, তাঁদের কোনো অবিযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, এই চাষিরা সাধারণ আলু চাষিদের তুলনায় নিঃসন্দেহে সম্পন্ন চাষি, জমির পরিমাণ, যন্ত্রপাতির মালিকানা, সেচের সুবিধা - সবেতেই এঁরা এগিয়ে।xvi

বাজার তৈরির তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন, চাষিদের নিজস্ব কোম্পানি। আগে ছিল চাষিদের সমবায়, প্রায় ১ কোটি কৃষি সমবায় দেশে আছে, যার অর্ধেকের কাছাকাছি ইতিমধ্যেই পঙ্গু হয়ে গেছে। একথা সকলেরই জানা যে সমবায়গুলি পঙ্গু হয়েছে সরকারি আমলাতন্ত্র, আর রাজনৈতিক নেতাদের খপ্পরে পড়ে। এও জানা যে এই কৃষি সমবায়গুলি মূলত বড় চাষিদের সংস্থা। তাই ২০১৩ সালে কোম্পানি আইনে সংশোধন করে, চাষিদের নিজস্ব কোম্পানি তৈরির সুযোগ করে দেওয়া হল। চাষিদের সংগঠিত করার এ এক নতুন প্রয়াস। চাষিরা নিজেরা একত্রিত হয়ে শেয়ার কিনে কোম্পানি তৈরি করবে, যাতে শিল্পপতিদের মত চাষিরাও কোম্পানি আইনের সুযোগে নিবেশক পেতে পারে, বাজার থেকে অর্থ লগ্নি পেতে পারে, রপ্তানি করতে পারে। ছোট চাষিদের বাজারের সঙ্গে মোকাবিলা করে ফায়দা নিতে গেলে যেহেতু একজোট হওয়া খুবই প্রয়োজন, এবং বাজারের নিজস্ব নিয়মে চলা প্রয়োজন, তাই অনেকে মনে করেন চাষিদের কোম্পানির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় মহারাষ্ট্র্ ও বিহারের চাষি কোম্পানিদের তথ্য ঘেঁটে দেবেশ রায় ও অন্যান্যরা দু রকমের চাষি কোম্পানি দেখতে পাচ্ছেন; মহারাষ্ট্রের চাষি কোম্পানিগুলি চাষিদেরই সাংগঠনিক প্রচেষ্টা থেকে গড়ে উঠেছে, আর বিহারে বেশির ভাগই সরকারি পৃষ্ঠপোশকতায়। প্রথম বর্গের ৯৯ টি চাষি কোম্পানিগুলির মধ্যে ৬৪% বলেছে যে তাদের রোজগার বেড়েছে, আর দ্বিতীয় বর্গেরগুলির ৩০৩টির মধ্যে ৯৮% তাই বলেছে, বরং এই সংস্থাগুলির চারপাশে যে সব চাষিরা কোনো চাষি কোম্পানির আওতায় আসে নি, তাদের মাত্র ৩২%-এর ক্ষেত্রে রোজগার বাড়ার খবর পাওয়া গেছে।xvii

এটা যদি আশার খবর হয়, দুশ্চিন্তার খবরও আছে তার পাশাপাশি। কোম্পানি তৈরি করেন শিল্পপতিরা। কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার অনেকে হতে পারেন, কিন্তু চালিকাশক্তি তাঁরাই। চাষি কোম্পানির ক্ষেত্রে এ রকম কেউ নেই। এখন পর্যন্ত ৭৫০০-৮০০০ চাষি কোম্পানির মধ্যে কম সংস্থা পাওয়া যায়, যেখানে এরকম কোনও চালিকাশক্তি আছে। ফলে কোম্পানি চালনার জন্য যে পেশাদারি ম্যানেজমেন্ট লাগে তা বেশির ভাগ সংস্থাতেই অনুপস্থিত।xviiiঅনেক ক্ষেত্রেই সরকার নয় তো এনজিও-রা চাষি কোম্পানি তৈরি করেছে। আমাদের দেশে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চাষিদের সঙ্গে কাজ ক'রে কোম্পানি তৈরি করে পেশাদারিত্বের সঙ্গে তার পরিচালনা শেখানোই হয়না। ফলে উপযুক্ত পেশাদারি মানব সম্পদ পাওয়া এই কোম্পানিগুলির পক্ষে খুব কঠিন। তাই চাষি কোম্পানিগুলির ভবিষ্যৎ কি হবে তা যথেষ্টই অনিশ্চিত। চাষি কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনি শেষ কথা বলার সময় আসেনি।

যেখানে শুরু করেছিলাম, সেখানেই ফিরে আসি। চাষি ও গ্রাহক-কে ন্যায্য দাম পেতে গেলে, উৎপদান পরবর্তী পরিকাঠামোয় আমূল পরিবর্তন দরকার। চাল, গম, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, টম্যাটো এবং সারা বছরের কয়েকটা ফল সবজির জন্য জাতীয় বাজার তৈরি হওয়া দরকার, যার মধ্যে পড়ে যানবাহন, কোল্ড স্টোরেজ, প্যাকিং, দূরপাল্লার যান, সুসংগঠিত চাষিদের সংস্থা, সংহত বাজার - সবই। চাষি কোম্পানি, ইলেক্ট্রনিক ন্যাশানাল এগ্রিকালচারাল মার্কেট (E-Nam) বা কৃষক ট্রেন ওই দিকেরই দিশারী। এগুলোর কোনওটারই ভাবনা প্রাইভেট সেক্টর থেকে আসেনি। '৬০-'৭০ এর দশকের সবুজ বিপ্লব (গম-ধান), বা '৮০-'৯০ দশকের শ্বেত বিপ্লব (দুধ), দুটোর কোনটাই প্রাইভেট সেক্টরের কোল থেকে আসেনি। যা এসেছে, তা হল সুপারমার্কেট, যা জনসংখ্যার অতি সামান্য অংশের প্রয়োজন মেটায়। যদি মনে করা হয়, প্রাইভেট সেক্টর এগিয়ে এসে কৃষিজ দ্রব্যের জাতীয় বাজার তৈরি করবে যেখানে ক্রেতা ও বিক্রেতা দুজনেই স্বস্তি পাবে, সেটা দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।


তথ্যসূত্রঃ
i) Compiled by the author form NSSO Report Number 545 (66th Round), "Public Distrihution System and Other Sources of Household Consumption", 2012-2013.
ii) Supply Chain Dynamic and Food Inflation in India", RBI Bulletin October 2019, page-100.
iii) Ashok Gulati and Harshabardhan, Indidan Express, Kolkata Edition, 1st March, 2021, page-7.
iv) "Report of the Committee on Doubling Farmers' Income", First Volume, 2016, page-92.
v) "Report of the Committee on Doubling Farmers' Income", Fourth Volume, 2018, page 16-20.
vi) "Political Economy of Cold Storages in West Bengal", Suman Nath and Bhaskar Chakrabarti, Commodity Vision, Volume 4, Issue-4, Jan-Feb 2011.
vii) "All India Cold Chain Infrastructure Capacity: Assessment and Gaps", National Centre for Cold-Chain Development, 2015, page xvi of the Executive Summary.
viii) "Report of the Committee on Doubling Farmers' Income", Fourth Volume, 2018, page-64.
ix) https://4thpillars.com/details/combination_of_enforcement_of_minimum_suport_price_and_crop_diversification_only_solution_to_save_Indian_agriculture, downloaded on 14th March 2021.
x) "Supermarkets in India: Struggles over the Organizations of Agricultural Markets and Food Supply Chains", Amy. J. Cohen, University of Miami Law Review, 12th November 20132, page-47.
xi) "Rittika Khera, Sudha Narayan, Prankur Gupta, "MSP: The Factoids vs Facts", The Hindu, 9th Dec., 2020.
xii) "Rythu Bazar (Farmers' Markets) - an Innovative Direct Marketing Model to Benefit Small and Marginal Farmers" - M. Srinivasa Reddy, T. Satyanarayana and M. K. Singh, in Agricultural Situation in India, Directorate of Economics and Statistics, Department of Agricalture and Cooperation, Government of India, November 2014, page-15: also Economic analysis of marketing performances in the rythu bazars (direct marketing) in Hyderabad city, by Deep Narayan Mukherjee, Economic Affairs, 59(4) pages 621-627.
xiii) "Supermarket procurement and farmgate prices in India", by S.R. Chandra et. al. World Development, 134 (2020) 105034, Pages 8-10. [এই গবেষণায় সুপারমার্কেট চেনগুলির কেনাকাটা নিয়ে অনেকগুলি গবেষণার উল্লেখ আছে]
xiv) IBID, page-12.
xv) "Supermarkets in India: Struggles over the Organizations of Agricultural Markets and Food Supply Chains", University of Miami Law Review, Amy. J. Cohen, Volume 68:19, page-63.
xvi) Arun Pandit et. al., "An Assessment of Potato Contract Farming in West Bengal State, India", Journal of the European Association of Potato Research, 3rd September 2014, page 6-7.
xvii) C. Rangarajan, S. Mahendra Dev, Indian Express, 11th March, 2021, page-7 quoting Debesh Roy, et. al's work in IFPRI.
xviii) "Farmers Producers' Organisations: Past, Present and Future," A report by Richa Govil, Annapurna Neti, Azim Premji University, 2020, executive summary.