আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২১ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৮

সমসাময়িক

প্রচার ছাড়াই শক্তিশালী হচ্ছে কৃষক আন্দোলন


দেখতে দেখতে সাত সাতটা মাস কেটে গেল। ইত্যবসরে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার তাগিদে মানুষ ক্রমশঃ সমাজ বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিসত্ত্বায় রূপান্তরিত হয়েছে। কমবেশি সকলের মনে জারিয়ে গেছে উৎকণ্ঠা-আতঙ্ক-উদ্বেগ। বেহাল স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, পরিকল্পনাবিহীন টিকাকরণ ইত্যাদি বাড়িয়ে দিয়েছে দুশ্চিন্তার মাত্রা।

চতুর্দিকের বেসামাল পরিস্থিতির মধ্যে জীবন ও জীবিকার প্রশ্ন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উপস্থিত হলেও উত্তর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রশাসন নির্বিকার। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এক অব্যক্ত হাহাকার। সমস্যার সমাধান করার কোনো চেষ্টা নজরে আসছে কি?

সমাধানের সদিচ্ছা থাকলে এই সঙ্কটের সময় প্রতিদিন নিয়ম করে পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়ানো হত না। ভোজ্য তেলকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হত না। দেশের সব মানুষের টিকাকরণ বিনামূল্যে নির্দিষ্ট সময়সূচী মেনে সম্পন্ন করা যেত। শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য দূর করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল কলেজের দরজা খোলার উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। কিছুই হয়নি। সবমিলিয়ে সুষ্ঠু প্রশাসন পরিচালনায় চূড়ান্ত ব্যর্থতা-অদক্ষতা অথবা অনিচ্ছা প্রমাণিত।

এত কিছুর পরেও ঔদ্ধত্যর অভ্যাস পরিত্যক্ত হয়নি। মানুষের জীবন বাঁচানোর তুলনায় রাজধানীর পুনর্নির্মাণ গুরুত্বপূর্ণ। মন্দির যেন নির্ধারিত সময়েই নির্মিত হয়। রাজ্যগুলির বিধানসভা নির্বাচনে যেন কোনো বিঘ্ন না ঘটে। সেইসব নির্বাচনী প্রচারের ব্যস্ততায় প্রশাসনিক ক্রিয়াকর্মাদি ব্যাহত হলেও ক্ষতি নেই। ফলে সমাধানের বদলে প্রতিটি সমস্যার তীব্রতা বেড়েই চলেছে।

সমস্যার সমাধান করার সদিচ্ছা থাকলে রাজধানীর সীমান্তে কৃষকদের অবস্থান আন্দোলন এত দীর্ঘস্থায়ী হয়? জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে কৃষক আন্দোলন নিয়ে এত সমালোচনার পরেও সরকারের তরফে সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই। জাতীয় স্তরের সংবাদমাধ্যমও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কৃষক আন্দোলন নিয়ে খবর সম্প্রচার প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও কেন যেন ইদানিং কৃষক আন্দোলনের খবর সম্প্রচারের ব্যাপারে উৎসাহী নয়।

কৃষকদের অবস্থান আন্দোলন কিন্তু অব্যাহত রয়েছে। বরং তার ব্যাপ্তি বাড়ছে। তিন কৃষি আইন বাতিল ও ফসলের ন্যূনতম দাম নিশ্চিত করার জন্য আইন প্রণয়নের দাবিতে কৃষকদের আন্দোলন সাত মাস পেরিয়েও একই রকম ভাবে চলছে। আন্দোলনের ময়দানে পাঁচশোর বেশি সহযোদ্ধা প্রয়াত হলেও কৃষক দাবি আদায়ের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় আন্দোলনের সাত মাস পূর্তিতে কেন্দ্রীয় সরকারের রক্তচাপ বাড়িয়ে বড়ো ধরনের আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল আন্দোলনকারী কৃষকদের সংযুক্ত মোর্চা। অষ্টম মাসের প্রথম দিন মিছিল করে দিল্লি অভিযানের কথা কৃষকেরা ঘোষণা করতেই আঁটোসাঁটো নিরাপত্তা বলয়ে রাজধানীকে মুড়ে ফেলা হল। আগের দিন রাতেই দিল্লির তিনটি মেট্রো স্টেশন সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করা হয়। দিল্লির উপরাজ্যপাল তড়িঘড়ি কৃষক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। উপরাজ্যপালের অনুরোধে আপাতত মিছিল স্থগিত রাখলেও আন্দোলনে রাশ টানা হচ্ছে না।

তিন কৃষি আইন বাতিল ও জরুরি অবস্থার ৪৬তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ‘খেতি বাঁচাও, লোকতন্ত্র বাঁচাও’ দিবসের ডাক দিয়ে সারা দেশের আন্দোলনকারী কৃষকদের কাছে সংযুক্ত কিষান মোর্চার তরফে আবেদন জানানো হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির রাজভবনে কৃষকেরা যাতে রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করে লেখা স্মারকলিপি জমা দেন। সেই উদ্দেশ্যে পঞ্জাব এবং হরিয়ানার কৃষকেরা মিছিল করে রাজভবন অভিমুখে যাত্রা শুরু করতেই তাদের পথ আটকাতে সক্রিয় হয় পুলিশ। চণ্ডীগড়-মোহালি সীমানায় হরিয়ানার রাজভবনের উদ্দেশে কৃষকদের মিছিল থামাতে জলকামান ব্যবহার করে। অন্যদিকে কৃষকদের একটি বড়ো মিছিল পঞ্জাবের রাজভবন অভিমুখে যাত্রা শুরু করলেও পথ আটকায় বিশাল পুলিশ বাহিনী। চণ্ডীগড়-পঞ্চকুলা সীমানাতেও পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়। দিল্লি পুলিশ পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশ সীমানায় নিরাপত্তা জোরদার করে। বহু জায়গাতেই কৃষকেরা পুলিশের বাধার মুখে পড়েছেন। কৃষক নেতারা প্রশাসনের এই আচরণকে ‘অঘোষিত জরুরি অবস্থা’ বলে তীব্র নিন্দাও করেছেন। দেশের সর্বত্র কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে সভা সমাবেশ আয়োজিত হয়েছে।

আন্দোলনকারী কৃষকদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। কৃষক আন্দোলন নিয়ে আলোচনা শুরু করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলি ছাড়াও সমাজের বিশিষ্টজনেরা আবেদন করেছেন। কিন্তু প্রশাসনের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

শুরুর দিন থেকেই আন্দোলনের বিরুদ্ধে নানারকম প্রচার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সম্পন্ন কৃষকের পিকনিক। খালিস্তানি। সন্ত্রাসবাদী। দেশদ্রোহী। সংক্রমণের আখড়া। ইত্যপ্রকার তকমায় ভূষিত হয়েও শীত গ্রীষ্ম বর্ষা উপেক্ষা করেই এগিয়ে চলেছে কৃষক আন্দোলন এবং প্রচারের অবহেলা চুরমার করে দিন দিন প্রতিদিন আন্দোলনের সংহতি বেড়ে চলেছে।

সরকারের তরফে কোনো প্রতিক্রিয়া আপাতদৃষ্টিতে দেখা না গেলেও সরকারি দলের বিপন্নতা চোখে পড়ছে। গেরুয়া শিবিরের স্থানীয় স্তরের নেতা কর্মীরা সমাজ থেকে ক্রমশঃ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। পঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত নির্বাচনে গেরুয়া শিবিরের প্রার্থীরা পরাস্ত। ভক্তবৃন্দের বৃন্দগান এখন আর তেমন উচ্চকিত নয়। এমনকি দলীয় সাংসদ বিধায়কদের মধ্যে নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সমালোচনার সুর ছড়িয়ে পড়ছে। পঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন এগিয়ে আসছে। ফলতঃ সবমিলিয়ে গেরুয়া শিবিরের ঔদ্ধত্যবাদী কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কার্যত দিশাহারা।

এমন এক জটিল পরিস্থিতির মধ্যে কৃষক আন্দোলনের সংহতি জ্ঞাপনের জন্য গত ২৮ জুন হরিয়ানার সুনেহেড়া-য় আয়োজিত হল 'কিসান মজদুর ভাইচারা মহাসম্মেলন'। কয়েক হাজার কৃষক এই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। হিন্দু, মুসলমান, শিখ সম্প্রদায়ের কৃষকদের মধ্যে মহিলাদের উপস্থিতিও ছিল লক্ষণীয়।

সুনেহেড়ার ভৌগোলিক অবস্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। হরিয়ানার নূজেলা, রাজস্থানের ভরতপুর ও আলোয়ার জেলা এবং উত্তরপ্রদেশের মথুরা জেলার সংযোগস্থল সাধারণ ভাবে 'মেওয়াট' নামে পরিচিত। এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা যথেষ্ট বেশি। কাজেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের জন্য গেরুয়া শিবিরের ভক্তবৃন্দ মাঝেমধ্যেই এখানে দাঙ্গা বাধানোর প্ররোচনা দিয়ে থাকে। সম্প্রতি এমন দুটি ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে একটি ঘটনা তো থানার মধ্যেই ঘটে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় কৃষক আন্দোলনের অবদান হিসেবে সুনেহেড়া ছিল মহাসম্মেলনের আদর্শ স্থান। কৃষক আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় সমস্ত নেতারা এই মহাসম্মেলনে উপস্থিত হয়ে কৃষি আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে গণতন্ত্র বাঁচানো এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার দাবি জানান।

কৃষক আন্দোলন নিয়ে সরকার নৈর্ব্যক্তিক আচরণ করতেই পারে। বিভিন্ন পন্থায় প্রচারমাধ্যমকে নীরব করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কৃষক আন্দোলন সামগ্রিক ভাবে সামাজিক আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মরশুমে কৃষক আন্দোলন জীবন ও জীবিকার স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে সামাজিক সংহতি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ভারতীয় গণতন্ত্রে নিঃসন্দেহে এ এক অনুকরণযোগ্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই আন্দোলনের অভিজ্ঞতার আলোকে সমৃদ্ধ হবে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সর্বব্যাপী গণ আন্দোলন।