আরেক রকম ● নবম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২১ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

মন্দাবস্থা ও মূল্যবৃদ্ধির সহাবস্থান


১০৪ টাকা ৯০ পয়সা, ৯৬ টাকা ৭২ পয়সা। মুম্বাই শহরে যথাক্রমে প্রতি লিটার পেট্রোল ও ডিজেলের দাম। কলকাতায় পেট্রোল বিক্রি হচ্ছে লিটার প্রতি ৯৮ টাকা ৬৪ পয়সা, এবং ডিজেলের দর উঠেছে ৯২ টাকা ৩ পয়সা। গৃহস্থ্যের গ্যাসের সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ৮৩৫ টাকায়। ভারতে স্বাধীনতার পরে পেট্রোল, ডিজেল বা রান্নার গ্যাসের এহেন মূল্যবৃদ্ধি কখনও ঘটেনি। একটা সময় ছিল যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতারা বিরোধীর ভূমিকায়, তখন পেট্রোপণ্যের দাম বাড়লেই তাদের দেখা যেত রাস্তায় নেমে হইচই করতে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার সময় বিজেপি বলেছিল যে তাদের ভোট দিলে পেট্রোপণ্যের দাম প্রায় জলের দরে চলে আসবে। কিন্তু ঘটেছে তার ঠিক উলটো।

পেট্রোপণ্যের এই বিপুল মূদ্রাস্ফীতি বর্তমান ভারতের অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে বেমানান। কোভিড-জনিত লকডাউনের দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশের অর্থব্যবস্থায় আবার মন্দার ছায়া পড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ভারতে জ্বালানি ব্যবহার কমেছে ৯ শতাংশ। ২০২১ সালের এপ্রিল-মে এই দুই মাসের হিসেবেও দেখা যাচ্ছে যে জ্বালানির ব্যবহার নিম্নগামী। অথচ, দাম বেড়েই চলেছে। এর প্রধান কারণ দুটি। প্রথমত, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ছে। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে ভারত যেই খনিজ তেল আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কেনে তার দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ৩০.৬১ ডলার, যা ২০২১ সালের মে মাসে বেড়ে হয়েছে ব্যারেল প্রতি ৬৬.৯৫ ডলার। অর্থাৎ বিগত এক বছরে খনিজ তেলের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে, ফলে ভারতে পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বেড়েছে, এতে কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু করার নেই। বিজেপি-র তরফে এই যুক্তিটি গণপরিসরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিজেপি-র অন্যান্য যুক্তিগুলির মতই এটিও বিভ্রান্তিমূলক।

যেমন ২০১৪ সালের মে মাসে যখন নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এলেন, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ছিল ব্যারেল প্রতি ১০৬.৮৫ ডলার। অর্থাৎ, বর্তমান দামের থেকেও ৪০ ডলার বেশি। কিন্তু সেই সময়ে ভারতে পেট্রোল ডিজেলের দাম এর থেকে অনেক কম ছিল। তাহলে, বর্তমানে তেলের দাম বেশি কেন? তেলের দাম বেশি থাকার নেপথ্যে রয়েছে বিজেপি সরকারের গরিব মারা এবং ধনীদের সুবিধা করে দেওয়ার নীতি। যখন তেলের দাম ২০১৪ সালের পর থেকে কমতে থাকে, তখন সেই সুযোগে মোদী সরকার লাগাতার তেলের উপরে উৎপাদন শুল্ক বাড়িয়েছে। ২০২০ সালে দেশে যখন করোনার হাহাকার চলছে, সেই সময়ে তেলের দাম বিশ্ব বাজারে তলানিতে এসে ঠেকলেও দেশের মানুষকে অনেক বেশি টাকা গুনতে হয়েছে, কারণ কেন্দ্রীয় সরকার আবার তেলের উপর উৎপাদন শুল্ক বাড়িয়ে দেয়। সব মিলিয়ে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে, যখন দেশের জিডিপিতে রেকর্ড পতন দেখা যায়, তখন উৎপাদন শুল্কের আওতায় কর সংগ্রহ বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। লাগাতার কর্পোরেট ক্ষেত্রকে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, অথচ নিত্যপ্রয়োজনীয় পেট্রোপণ্যের উপর করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে গেছে যে ২০২০-২১ সালে জিডিপি-র অনুপাতে প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ হয়েছে ৪.৭ শতাংশ এবং পরোক্ষ করের অনুপাত হয়েছে ৫.৪ শতাংশ। গত ১৩ বছরে দ্বিতীয় বার প্রত্যক্ষ কর ও জিডিপি-র অনুপাত পরোক্ষ করের থেকেও কমে গিয়েছে, শেষবার ২০১৫-১৬ সালের নোটবন্দীর সময় এই ঘটনা ঘটেছিল।

অর্থনীতির প্রথম বর্ষের ছাত্ররাও জানে যে কোনো অর্থব্যবস্থায় জিডিপি-র অনুপাতে প্রত্যক্ষ কর কমে যাওয়া এবং পরোক্ষ কর বেড়ে যাওয়া আসলে অসাম্যের জন্ম দেয়। প্রত্যক্ষ কর মূলত আসে ধনীদের থেকে, আর পরোক্ষ কর সবাই দেয়। অতএব প্রত্যক্ষ করের অনুপাত কমে পরোক্ষ করের অনুপাত বাড়লে, আসলে তা ধনীদের কর ছাড় দিয়ে গরিবদের ঘাড়ে করের বোঝা চাপায়। দেশের সাধারণ মানুষের জন্য কুম্ভীরাশ্রু ফেলতে দড় নরেন্দ্র মোদীর জমানার নীতি আসলে গরিবদের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনছে।

একদিকে নিয়ন্ত্রণহীন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বহু মানুষের জীবনহানি ঘটিয়েছে। অন্যদিকে, বিভিন্ন রাজ্যে লকডাউন জারি হওয়ার ফলে মানুষের আয় কমেছে। কেন্দ্রীয় সরকার লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষগুলির সাহায্যার্থে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, তাদের হাতে নগদ টাকা তুলে দেয়নি। অথচ, পেট্রোল-ডিজেলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মূল্যবৃদ্ধির বোঝা সাধারণ মানুষের জীবনে বেড়েই চলেছে। ২০২১ সালের মে মাসের সরকারী রিপোর্ট বলছে, খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে ৬.৩ শতাংশ হয়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি ভোজ্য তেল, যার মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ ৩২.৪৭ শতাংশ। সর্ষের তেলের দর গত বছর ছিল প্রতি কেজি ১২০ টাকা, যা বর্তমানে হয়েছে ১৭০ টাকা, সোয়াবিন তেলের দাম কেজি প্রতি ১০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫৭.৫ টাকা, সূর্যমুখী তেলের দাম বেড়েছে ১১০ টাকা থেকে ১৭৫ টাকা। সাধারণ মানুষের জীবনে সমস্যা বাড়িয়ে বাড়ছে ডিম, মাছ, মাংস, ডালের দাম। কিন্তু সরকার নির্বিকার। তারা রেশন থেকে কিছু সামগ্রী গরিব মানুষদের দিয়েই নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলছে।

অথচ, দেশে যেখানে প্রায় মন্দাবস্থা বিরাজমান সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এইরূপ বিশাল মূল্যবৃদ্ধি বেমানান। মন্দাবস্থার সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি এক সঙ্গে হচ্ছে মানে, অর্থনীতির পরিভাষায়, এই মূল্যবৃদ্ধি চাহিদা নির্ভর নয়। এর আসল কারণ হল পণ্য তৈরি ও তা চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় পেট্রোল ও ডিজেলের দামের বিপুল বৃদ্ধি। যেহেতু এই পণ্য বাকি সমস্ত পণ্যের চলাচল ও উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাই তেলের দাম বাড়লে দেশে মূদ্রাস্ফীতির বিপদ বাড়ে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মনে করে যে সুদের হার বাড়িয়ে কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু যখন সেই মূল্যবৃদ্ধি চাহিদা নির্ভর নয়, তখন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সুদ নীতি তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে না। অতএব, বল আবারও সরকারের কোর্টে।

দেশের মানুষকে তারা যদি কিছুটা স্বস্তি দিতে চান, তবে তেলের উপর উৎপদান শুল্ক কমাতে হবে। শুধু তাই নয়, পেট্রোল ও ডিজেলের মতন অত্যাবশ্যক পণ্যকে জিএসটি-র আওতায় নিয়ে আসা দরকার যাতে করের হারের ঊর্ধ্ব সীমা বেঁধে দেওয়া যায়। যেখানে জিএসটি-র আওতায় পণ্যের উপর সর্বাধিক ২৮ শতাংশ কর নেওয়া যায়, সেখানে পেট্রোপণ্যের উপর করের পরিমাণ ১০০ শতাংশেরও বেশি। এই অসাম্য অবিলম্বে দূর করা দরকার।

রাজনৈতিক অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হল এই যে, মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ বেশি প্রতিক্রিয়া দেখান। তাই বেকারত্ব, আর্থিক বৃদ্ধির মতন কাঠামোগত অর্থনৈতিক সমস্যার তুলনায় মূল্যবৃদ্ধি অনেক বেশি রাজনৈতিক আন্দোলন ও সরকার পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তবে বিরোধীরা ঘরে বসে টুইট করবে আর সান্ধ্যকালীন টিভি-র আসর গরম করবে তাহলে এই রাজনৈতিক অর্থনীতির পাঠ কোনো কাজে আসবে না। মোদী সরকারের বিরুদ্ধে এই বিষয়গুলি নিয়ে তারা কেন আন্দোলনে নামছে না, তার খোঁজ করতে হলে রাজনৈতিক অর্থনীতির গভীর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।