আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২১ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৮

প্রবন্ধ

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিলঃ পরীক্ষার্থীর যন্ত্রণালিপি

শ্রেয়ান পালচৌধুরী


শিক্ষাব্যবস্থায় সুগঠিত পরিকল্পনার অভাবে ধৈর্য ও মানসিক যন্ত্রণার পরীক্ষা ছাত্রছাত্রীদের

আসলে, পরীক্ষা সম্পর্কে এ-রাজ্যে একটা প্রথা পালিত হয়ে আসছে, পরীক্ষার আগের দিন রাতে ছেলেমেয়েদের পিঠে বাবা বাছা করে হাত বুলিয়ে মন্ত্রগুপ্তি করা, পরদিন সকালে দই, চন্দন এর ফোঁটা দিয়ে ভিড় ট্রেনে, বাসে উঠে এক হাতে রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে ও আরেক হাতে বই খুলে সূত্র গুলো একবার চোখ বোলাতে বোলাতে আতঙ্কে চোখ মুখ কালি করে পরীক্ষার হলে পৌঁছনো, রেজাল্ট বেরোনোর দিন পাড়াপড়শি থেকে দূরদূরান্তের যত আত্মীয়-পরিজন সারা বছর কোনো খোঁজ রাখেন না, রাস্তায় দেখা হলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যান, শুধু কত নম্বর পেলো জানার জন্য ওই দিনটিতে বাঘের মতো ওঁৎ পেতে থাকেন। পুরোনো চিন্তনশৈলীতে বিশ্বাসী সমাজের একাংশ চিন্তায় পড়ে যায় কোনো একবছর এই প্রথা উপাচার সহ পালিত না হলে যদি তাদের উপর সরস্বতীর অভিশাপ নেমে আসে!

এত বছর এই নিয়মেই পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে, কেউ তো কোনো অনাচার সৃষ্টি করে নি! কিন্তু এই প্যান্ডেমিকের বছর কি বাকিবছরগুলোর সঙ্গে সমতূল্য! আসলে এদের মূল সমস্যা হলো, এরা প্রেক্ষিতটা বোঝে না, এরা যুগোপযোগী হতে জানে না, ভবিষ্যতে হতে পারে, এমন আশাও অমূলক, সারাবছর হাটে বাজারে, বাসে অটোয় পলিটিক্সের গুষ্টি উদ্ধার করে বেড়ান, আর পরীক্ষা এলেই বুদ্ধিGB সাজতে চান, ভোট এর কচকচানি থামতেই বঙ্গবাসীর বিদগ্ধ মননে হঠাৎ পরীক্ষা প্রীতি জেগেছিল,অথচ এই খোঁজটা রাখেননি যে, এই কঠিন পরিস্থিতিতে পরীক্ষা ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ও বিকল্প পদ্ধতিকে হাতিয়ার করে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ কী মসৃণ ভাবে শিক্ষাব্যবস্থা কে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আর এখানে? শিক্ষা ব্যবস্থাকে থমকে রেখে ২ সপ্তাহের অতি বুদ্ধিGB দের কথা নিয়ে মাথায় তুলে নাচা হয়েছে, এদের মূল বৈশিষ্ট্যই হলো, এরা অভ্যাসের বাইরে কোনো কিছুকে গ্রহণ করে না, নিজের ভাবনাকেই গায়ের জোরে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার একটা ক্ষতিকর প্রবণতা এদের মধ্যে দেখা যায়, এদের মতে, পরীক্ষা বলতে আমি যা বুঝি, এটা তার বাইরে! আমার জীবন থেকে বাদ। কখন যে তারা কী বলে বসে তার কোনো যুক্তিগত ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। গণতান্ত্রিক দেশ, কাজেই সবাই নিজস্ব মতামত প্রকাশ করতেই পারে, কিন্তু এখানে প্রকৃত বুদ্ধিজীবী দের উপেক্ষা করে অস্থায়ী ফেক বুদ্ধিGB দের মতামত কে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়, এবছর যার খেসারত দিতে হয়েছে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের, গত মাস দুয়েক তারা যে কী সাংঘাতিক অনিশ্চয়তা ও মানসিক দোলাচলের মধ্য দিয়ে দিন কাটিয়েছে, তা কল্পনার বাইরে, তার মধ্যে আমিও একজন। এক দেশ এক শিক্ষানীতি গোটা দেশে কার্যকর হওয়া উচিত কি? ভাবা উচিত।

Article 14 of the Constitution of India provides for equality before the law or equal protection of the laws within the territory of India. It states:

"The State shall not deny to any person equality before the law or the equal protection of the laws within the territory of India."

অতিমারীর করাল গ্রাস ও দীর্ঘ দেড় বছরের ঘরবন্দী জীবনযাপনে পড়াশোনা করা, বলা ভালো, পড়াশোনার চেষ্টা করা এটা প্রথম মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক ব্যাচ। এখনো স্কুলে পড়া আমার ছোটো ছোটো ভাইবোনদের ভবিষ্যতে এমন চূড়ান্ত দুর্দশা যেন না নেমে আসে। 'মানসিক অবসাদ' শব্দবন্ধটা তাদের পক্ষে যথেষ্ট ভারি, তার বাস্তব আদতে কীরকম হতে পারে, তারা ভাবতেও পারে না। অন্তত স্কুল স্তরে এমন অভিজ্ঞতা না হওয়াটাই কাঙ্খিত। দ্রুত এই সর্বনাশা অতিমারীর অবসান হোক। স্কুলগুলো আবার গমগমিয়ে উঠুক ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ে, আবার চক, ডাস্টারের ঠোকাঠুকি শোনা যাক, এক বেঞ্চে বসে টিফিন শেয়ার করা নিখাদ বন্ধুত্ব গুলো আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠুক। স্কুল জীবনের সেই মিষ্টি স্বাদ টা আবার ফিরে পাক ছোটো ছোটো ভাই বোনেরা।

আমি ২০২১ এর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিলাম, তাই প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করতে পেরেছি শিক্ষার্থীদের যন্ত্রণা। একটু শেয়ার করা যাক,

মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের আশা হতাশা, উদ্বেগের দিনলিপি

২৫.১১.২০
অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউ আসতে পারে, কারো মাথাতেও আসে নি, সেদিন এ রাজ্যের ২১ লক্ষ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী দের গত কয়েকমাস স্কুল বন্ধ থাকায় অসুবিধার কারণে পাঠ্যক্রমের বোঝা ৩০-৩৫% কমিয়ে দেওয়া হল।

২৮.১২.২০
এ রাজ্যের পরীক্ষার্থীদের হাতে চলে এলো পরীক্ষার সংশোধিত রুটিন, পরীক্ষা 'বাতিল' হয়ে যেতে পারে, এমন ভাবার কোনো অবকাশই ছিল না, প্রথম ঢেউয়ের দাপট কমতে শুরু করায়, সবাই আবার 'নরমাল ওয়ে' তে ফেরার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম, পরীক্ষার্থীরা আবার জোরকদমে পড়াশোনা করার শক্তি ফিরে পেয়েছিল।

২৭.০১.২১
কোভিড গ্রাফ প্রায় বেসলাইন ছুঁয়ে ফেলার মুখে। ঘোষণা হয়ে গেল এ-রাজ্যের উচ্চমাধ্যমিকের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার দিনক্ষণ, অর্থাৎ পরীক্ষার পথে আরো এক ধাপ। পরীক্ষার্থীরা তখনও মানসিক ভাবে যথেষ্ট সবল ছিল।

২৫.০২.২০২১
পরীক্ষা হচ্ছেই, এ-বিষয়ে কারো দ্বিমত ছিল না, সংশোধিত সিলেবাস অনুযায়ী প্রশ্নের প্যাটার্ন ও চলে এলো আমাদের কাছে, এবার আদা জল খেয়ে লাগার পালা। কিন্তু কেউ টের পায় নি যে একটা ভয়াবহ বিপদ আড়ালে লুকিয়ে ছিল।

২২.০৩.২১
পড়াশোনাটা যেই একটু গতিপ্রাপ্ত হলো, অমনি দেশের বুক চিড়ে নেমে এলো বিপর্যয়, সবার চোখ কপালে তুলে দিয়ে বেসলাইনে মিশে যাওয়া কোভিড গ্রাফ তেড়েফুঁড়ে উঠলো সুপ্ত আগ্নেয়গিরির ন্যায়। এই আবহে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ থেকে পরীক্ষার্থীদের জন্য জারি করা হলো হেল্পলাইন।

পরীক্ষার্থীদের মনঃসংযোগ জোর হোঁচট খেলো।কিছু দিন পর চিত্রটা আরো পরিষ্কার হতে বোঝা গেল, ২০২০ র চেয়েও ভয়াবহ এবারের বিপদ।

১৪.০৪.২১
তখন অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউ দুর্বার গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, এই আবহে দেশজোড়া পরীক্ষার্থীদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করেই করা হলো ঐতিহাসিক ঘোষণা, কেন্দ্রীয় বোর্ডের মাধ্যমিক পরীক্ষা সম্পূর্ণরূপে বাতিল, দ্বাদশ এর পরীক্ষা জুন পর্যন্ত স্থগিত ঘোষণা করা হলো, পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার কথা শুনলেও 'বাতিল' এর সঙ্গে পূর্ব পরিচিতি ঘটে নি আমাদের। কিন্তু, তাও ঠিক, সেই সময় এর থেকে ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারতো না, পরীক্ষা তো জীবনের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু দ্বাদশ এর পড়ুয়াদের সঙ্গে কি অবিচার হয় নি! তারাও তো রক্ত মাংসের মানুষ। রাতারাতি কোভিড বিধি মেনেই সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে শুরু হয়ে গেল movement from home. #cancel12thboardexam, #cancelexamsavestudents এ টুইটার থেকে ফেসবুক ছয়লাপ। বইপত্র লাটে তুলে তখনসারা দেশের পরীক্ষার্থীদের একটা বিরাট অংশ হয়ে পড়লো সোশ্যাল মিডিয়ামুখী।

তখনও ঘুম ভাঙেনি এ-রাজ্যের, তখন এখানে চলছে গণতন্ত্রের উৎসব (গণতন্ত্রের সম্মান কতটা রক্ষা হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে) তথা হাইভোল্টেজ নির্বাচনী লড়াই, আশ্চর্যজনক ভাবে সমস্তটাই অব্যাহত ছিল এই কোভিড সুনামির মধ্যে, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় নি। কত জন তাদের বাবা মা কে হারালো, তার হিসেব রাখেনি কেউ।

মনোবিদরা ডিপ্রেসড/ অবসাদগ্রস্ত হতে বারণ করেন, কিন্তু এক্ষেত্রে উপায় ছিল না। ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ যে ঝুলেছিল সরকারের হাতে। তাদের ভবিষ্যৎ এর কথাটা বাদ দিয়ে বাকী সব বিষয়ে সকলের দৃষ্টি ছিল। কেন্দ্রীয় বোর্ডের ক্ষেত্রে দশম এর ছাত্রছাত্রীরা নিস্তার পেলেও এ রাজ্যে তা হয় নি। দশম, দ্বাদশ উভয়েই কী পরিমাণ মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটিয়েছে, তা বলে বোঝানো যায় না। পরীক্ষা স্থগিতকরণের যন্ত্রণা প্রতি মুহূর্তে যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল আমাদের।

৩০.০৪.২১
তখন সকলের কাছে জলের মতো পরিষ্কার যে ২০২০ আদতে ছিল ট্রেলার। দেশজুড়ে বেড, ভ্যাকসিন,অক্সিজেনের অকাল, শ্মশান এ অবিরত জ্বলতে থাকা সার সার চিতা, স্বজনহারার কান্না বুঝিয়ে দিয়েছে যে বেঁচে থাকা মোটেও সহজ কাজ নয়। কত ছোট ছোট ছেলেমেয়ে দের কাছে পৃথিবীটা শূন্য হয়ে গেল, সে খোঁজ কেউ রাখে নি, এমন সময় জানানো হলো পরীক্ষা হবে নিজেদের স্কুলে, অবাক লেগেছিল, যেখানে, জীবন বড় অনিশ্চিত, সেখানে পরীক্ষার নেওয়ার কথা ভাবছে কেউ কেউ।এ রাজ্যের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের তখন কূলকিনারা ছিল না। একদিকে কোভিডের ভয়, অপর দিকে পরীক্ষার চোখরাঙানি।

কথায় আছে, একে রামে রক্ষে নেই, সুগ্রীব দোসর। এ যেন ২০২০-র আপগ্রেডেড ভার্সান, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা নিয়ে হাজির হলো ঘূর্ণিঝড় ইয়াস, যথারীতি কেড়ে নিল বহু মানুষের মাথার উপরের ছাদ, আমরা শহর মফঃস্বলের বাসিন্দারা শুধু মুখে কুলুপ এঁটে টিভির পর্দায় তাদের ঘর সংসার অথৈ জলে ভাসতে দেখেছি।

২৭.০৫.২১
কোভিডের তেজ তখন কমেছে, তবুও পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। হঠাৎ এক বৃষ্টি ভেজা দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, সময় কমিয়ে পরীক্ষা হবে, জুলাই, আগস্টে। ঘোষণাটা অভাব অনটনের সংসারে, সদ্য বাবা মা হারানো পরীক্ষার্থী দের কাছে, ইয়াসে বইখাতা ভেসে যাওয়া ছেলে মেয়েদের মাথার উপর বজ্রাঘাত এর ন্যায় শুনিয়েছিল।দেশজোড়া দ্বাদশ এর পরীক্ষার্থীদের করুণ অবস্থা অব্যাহত, কোনো রাজ্য তখন দ্বাদশের পরীক্ষা বাতিল করে নি। ক্রমে বাড়তে থাকা মানসিক চাপে একাধিক ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে, পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি অতীতে কোনো দিন দেখা গেছে বলে মনে পড়ে না, সবাই চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করছিল পয়লা জুন এর জন্য, সেদিন কেন্দ্রীয় বোর্ডের স্থগিত হয়ে যাওয়া দ্বাদশ এর পরীক্ষার ভবিষ্যৎ ঘোষণার দিন। ছাত্রছাত্রীদের মনে একদিকে পুনরায় স্থগিতকরণের ভয়,অপরদিকে পরীক্ষা বাতিল এর মৃদু আশা।

১.০৬.২১
অবশেষে এলো বহু প্রতীক্ষিত সেই দিন। কিন্তু এ রাজ্যে মানসিক চাপের সাথে যুঝতে থাকা লাখ লাখ পড়ুয়া কে আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়ে ঘোষণা করা হলো যে পরের দিন রুটিন প্রকাশিত হবে। সারাবছর যারা অনলাইনে ক্লাস এর সুবিধা পায় নি, তাদের কাছে এই ঘোষণা কতটা নির্মম, তা শুধু তারাই বোঝে। সেদিন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে, কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় বোর্ডের দ্বাদশের পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা করলেন। যা দেশের লক্ষ লক্ষ পড়ুয়ার মন থেকে দু'মাসে উধাও হয়ে যাওয়া সুখশান্তিকে এক লহমায় ফিরিয়ে আনলো। জয় হলো #cancel12thboardexam এর। এরপর থেকে রাজ্য বোর্ডের ছাত্রছাত্রীরাও আশার আলো দেখতে শুরু করল। কারণ, কেন্দ্রীয় বোর্ড এর সিদ্ধান্তকে রাজ্য বোর্ডদের অনুসরণ করার ট্রেন্ড এ দেশে রয়েছে।

০২.০৬.২১
প্রত্যাশিত ভাবেই কেন্দ্রীয় বোর্ডের এমন সিদ্ধান্তের পর আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গও এই করোনা আবহে ছাত্রছাত্রীদের অফলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে চাইল, ফলস্বরূপ, সেদিন এ-রাজ্যের মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের সূচী প্রকাশিত হল না।সেদিনই আঁচ পাওয়া গিয়েছিল, যে পরীক্ষা বাতিলের সংবাদ আসন্ন, ভেবে ভালো লাগছিল, মাস দুয়েক ধরে চূড়ান্ত মানসিক অবসাদ ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগার পর এ-রাজ্যের ২১ লক্ষ পরীক্ষার্থী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে। হলোও তাই।

০৭.০৬.২১
সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা- 'এবছর হচ্ছে না মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক'। যে ঘোষণা শোনার জন্য ছাত্রছাত্রীরা চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষা করছে দিনের পর দিন।রেহাই তো মিলল শেষমেষ, কিন্তু শিক্ষাক্ষত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তহীনতা ও পরিকল্পনার অভাব, ছাত্রছাত্রীদের গত দু'মাসে যে মানসিক রোগী বানিয়ে ছেড়েছিল, তার বিচার করবে কে!

শিক্ষক সমাজের একাংশের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, সংরক্ষণশীল ও অবাস্তব চিন্তাধারার পরিচয়

শিক্ষকরা সমাজের মেরুদণ্ড - ছোটো থেকেই কথাটা শুনে এসেছি। কিন্তু এই করোনা কালে তাঁরা এর মর্যাদা কতটা রক্ষা করতে পেরেছেন, সে-বিষয়ে প্রশ্ন উঠবেই। এই করোনা পরিস্থিতিতে বহু শিক্ষক সংগঠন বারেবারে সরকারের কাছে অফলাইন পরীক্ষার দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন, এই পরিস্থিতি কোনো ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা দিতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হলে, তার দায়িত্ব সেই শিক্ষকরা নিতেন তো? হোম সেন্টারের দাবি সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন, কারণ, পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছতে যে গণপরিবহণ লাগে, তাতে করোনাবিধি সঠিক ভাবে মানা যেতে পারে, এমন ভাবনা অমূলক। তাদের কাছে প্রশ্ন করতে চাই, যখন দীর্ঘ দেড় বছর, স্কুল বন্ধ ছিল, ছাত্রছাত্রীরা ঠিকমতো অনলাইনে ক্লাস করতে পারেনি, তখন আপনাদের তো তাদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় নি! ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার বিষয়ে সত্যিই সজাগ থাকলে তখন সরকার পক্ষের কাছে তারা, রেডিও, টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে শিক্ষাদানের দাবি করেননি কেন তারা! প্রকৃত অর্থে শিক্ষা সচেতন হলে কেন্দ্রীয় বোর্ড যখন এপ্রিলে দশমের পরীক্ষা বাতিল করেছিল, আন্দোলন, দাবিদাওয়া তখন থেকেই শুরু করতে পারতেন। এ-রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরাও তো কেন্দ্রীয় বোর্ডে পড়ে, তাই তখন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে তারা এখন পরীক্ষা বাতিলের বিরুদ্ধাচরণ করলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠার অবকাশ থাকে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা বাতিলের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে আন্দোলন করেছে, তার প্রধান কারণ, দেশের করোনা পরিস্থিতি। সেই বিষয়টি লঘু করে শিক্ষক সমাজের একাংশ তাদের ঘাড়ে দায় চাপিয়েছেন যে ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার ভয়ে বাতিল চাইছে, তারা পড়াশোনা করে নি ... ইত্যাদি। এমন অভিযোগকারীরা একটু ভেবে দেখুন তো! অতীতে কোনোদিন কোনো ছাত্র সামান্য একটা ইউনিট টেস্ট বাতিলেরও দাবি জানিয়েছে কিনা!

এ-বছর তারা পড়েনি নয়, পড়তে পারেনি, যার দায়ভার বর্তায় সেই সমস্ত শিক্ষকদের উপর, যারা কঠিন সময় ছাত্রছাত্রীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন। সুতরাং,এখন পরীক্ষার দাবিতে চিৎকার করে সস্তা পাবলিসিটি আদায় করাটা একেবারেই শোভা পায় না। ভাষা ব্যবহারের জন্য মার্জনা করবেন, কিন্তু বলতে বাধ্য হলাম, সংবাদপত্রে প্রতিদিন নানা মুনির নানা মত দেখে পরীক্ষার্থীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়তো। যত সব অবাস্তব দাবিদাওয়া, কারো মতে সময় কমিয়ে একদিনে দুটো পরীক্ষা নিলে ভালো হতো, দ্বাদশ এর ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি বই দুটোর ওজন জানলে হয়তো একথা বলতে দুবার ভাবতেন, কারো মতে করোনা নির্মূল হয়ে গেলে আগস্ট মাসে পরীক্ষা হওয়া উচিত। তাদের কাছে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, একটা স্টুডেন্ট এর জীবন কি বোর্ড পরীক্ষা অবধিই সীমাবদ্ধ! কেন্দ্রীয় বোর্ডের স্টুডেন্টরা তিন মাস আগে পরবর্তী শ্রেণির পড়া শুরু করে দিয়েছে আর বাংলা বোর্ডের স্টুডেন্টরা আঠারো মাস একই পড়া নিয়ে ঘষা মাজা করবে! কেন এই বৈষম্য! দ্বাদশের বাংলার পড়ুয়ারা কি এবছর সর্বভারতীয় পরীক্ষাগুলোতে বসবেন না? বোর্ড ভিত্তিক পড়াশোনাই কি ভবিষ্যতের একমাত্র পথ প্রদর্শক! এই বছরের তথ্য অনুযায়ী দেশ থেকে নয় লক্ষ ছাত্রছাত্রীর বিদেশের ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন নেওয়ার কথা, শুধুমাত্র বোর্ড পরীক্ষার নামে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছেলেখেলা করাটা কি খুব যুক্তিযুক্ত? অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে বাবা মা হারানো ছাত্রছাত্রীদের এই মানসিক অবস্থায় হলে বসে তাদের পরীক্ষা দিতে বাধ্য করা কি অসমীচীন নয়! প্রশ্ন উঠবেই, পুরাতন চিন্তাধারার মানুষেরা এদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এতটাই পরীক্ষা নির্ভর করে তুলেছেন, যে পরীক্ষা না হলেই গেল গেল রব তোলেন, সংরক্ষণশীল চিন্তাধারার শিক্ষানুরাগীরা সমাজ কে এমন মাথার দিব্যি দিয়ে এসেছেন, যে প্রথাগত পরীক্ষা না হলে মূল্যায়ন অসম্ভব। আজ এই ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়েও খাতায় কলমে মুখস্ত বিদ্যাকে উগড়ে দেওয়াই মূল্যায়নের একমাত্র চাবিকাঠি... এই আদ্যিকালের চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসার আবেদন রইল শিক্ষক সমাজের কাছে।

করোনাকালে এই দেশে শিক্ষা নামক সিস্টেমটার হাড় পাঁজর বেরিয়ে আসা জীর্ণ দশা পরিলক্ষিত হলো এবং এর ফলে বলির পাঁঠা হতে হলো ছাত্রছাত্রীদের।