আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২১ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৮

প্রবন্ধ

বিপর্যয় মোকাবিলায় চাই সুসংহত জাতীয় ভাবনা

পার্থপ্রতিম বিশ্বাস


ফুটবল পাগল বাঙালির এক সময়ের নায়ক ছিল হল্যান্ডের বিশ্বখ্যাত ফুটবলার রুড গুলিত। লম্বা ঝাঁকড়া চুলের গুলিতের মাঝ মাঠ থেকে বাঁদিক ডানদিক ঘেসা দৌড়ে ইন সুইং কিংবা আউট সুইং লাগানো ফ্রি-কিক বাঙালির স্মৃতিতে আজও অমলিন। গুলিত যে দেশে জন্মেছিলেন সেই হল্যান্ডেও সামুদ্রিক ঝড় ঝঞ্জা জলোচ্ছ্বাস ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। তাঁদের গোটা দেশের দুই তৃতীয়াংশই রয়েছে সমুদ্রতলের পাঁচ থেকে সাত মিটার নিচে। এমন অবস্থায় সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে সেদেশের সমুদ্র সীমানায় স্তরে স্তরে বালির বাঁধ মানে ‘ডাইক’ দিয়ে বেঁচে রয়েছে মানুষ, বছরের পর বছর। সেদেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা সবচেয়ে বড় নদী ‘রাইন’-এর দুপাশ ঘিরেও রয়েছে নদীবাঁধ সেদেশের সিংহভাগ শহুরে মানুষকে জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। সেই গুলিতের দেশে যাচ্ছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে পেশাগত কারণে। জার্মানির বার্লিন থেকে ট্রেনে আমার অ্যামস্টারডাম যাত্রায় এক ডাচ সহযাত্রী রসিকতা করে বলেছিলেন ঐ ডাইক আর নদীবাঁধ বাঁচানোর তাগিদেই ডাচেরা নাকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিল। কারণ বিবাদমান যেকোনো পক্ষের রোষানলে পড়ে বোমা-গোলা-বারুদের বিস্ফোরণে একবার সেই বাঁধ ভেঙ্গে গেলে সেদেশের নগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি মুহূর্তে ধুলিস্মাত হতে পারে। কারণ ঐ হাজার হাজার কিলোমিটার নদীবাঁধ আর ‘ডাইক’ হল সেদেশের লাইফ লাইন। আর নদীমাতৃক এইদেশে নদীবাঁধ যে মানুষের জীবনেও ‘লাইফ লাইন’ সেই কথাটাই নতুন করে ভাবিয়ে তুললো সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এর বিধ্বংসী দৃশ্যে।

বিপর্যয় মোকাবিলাঃ সুসংহত জাতীয় ভাবনা

দু'দশক আগেও হাওয়া অফিস বৃষ্টির পূর্বাভাস দিলে মানুষ ছাতা বাড়িতে রেখেই বেরত। সেই দিন চলে গিয়ে এখন ঝড়ের মুড়ো থেকে ল্যাজা পর্যন্ত ক্রিকেটের ধারা বিবরণীর ঢঙে টেলিভিশনের চ্যানেলে চ্যানেলে হাঁ করে দেখছে মানুষ। আর দেখছে দুর্যোগের ঘোলা জলের মধ্যেও চ্যানেলগুলির টিআরপি বাড়ানোর মরিয়া বাণিজ্যিক প্রচেষ্টা। ফলে প্রযুক্তি নির্ভর বিপর্যয়ের পূর্বাভাস এখন যেমন কার্যকরী হচ্ছে ঠিক তেমনই উত্তরোত্তর প্রয়োজন হয়ে পড়ছে বিপর্যয়ের পর প্রযুক্তি নির্ভর পরিকাঠামো নির্মাণ পরিকল্পনা। বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষেত্রে বিপর্যয় পূর্ববর্তী প্রয়াস, বিপর্যয় চলাকালীন তৎপরতা এবং বিপর্যয় পরবর্তী শিক্ষাগ্রহণ অত্যন্ত জরুরী। যেমন গত বছর আম্ফান বিপর্যয়ের পর আমাদের যেমন গাছ কাটা থেকে শুরু করে পানীয় জল, বিদ্যুৎ সংযোগ এমন বহুক্ষেত্রে ল্যাজে-গোবরে হতে হয়েছিল এবারটা অন্তত সেটা হয়নি। কারণ আম্ফানের থেকে নেওয়া শিক্ষা অনেকটাই কাজে লেগেছে শহরে ‘ইয়াস’ মোকাবিলায়। এবারে ঝড়ের দাপট যথেষ্ট থাকলেও প্রাণহানি এড়ানো গেছে কিন্তু এড়ানো গেল না মানুষের জীবন-জীবিকার বিপুল ক্ষয়ক্ষতি জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়া নদীবাঁধ ভাঙার কারণে। বিশেষত উপকূলবর্তী এলাকায় প্রান্তিক মানুষের প্রাণে বাঁচা আর পেটে বাঁচা নির্ভর করছে এরাজ্যের বিস্তীর্ণ নদীবাঁধের স্থায়িত্বের উপর। ফলে ফি বছর বর্ষার সময়ে কিংবা ঘূর্ণিঝড়ে এই নদীবাঁধের উপর্যুপরি ভাঙন সরকারের মাথাব্যথার তেমন কারণ না হয়ে উঠলেও রাজ্যবাসীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে গত কয়েক বছর ধরেই। এর একটা সম্ভাব্য কারণ বঙ্গোপসাগরে ঘন ঘন তৈরি হওয়া নিম্নচাপের প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় প্রকাশিত যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বঙ্গোপসাগরের জলের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার এই অঞ্চলের বিভিন্ন সাগর বা মহাসাগরের তুলনায় প্রায় সাত গুন বেশি হয়েছে। উপকুল জুড়ে দেশের মূল ভূখণ্ডে দ্রুত নগরায়ন, শিল্পায়ন এবং নির্মাণের ধাক্কায় বিঘ্নিত পরিবেশের ভারসাম্যের কারণেই ঘটছে জলবায়ুর এমন আঞ্চলিক পরিবর্তন। ফলে সমুদ্রের জলের উষ্ণতা দ্রুত বৃদ্ধির সাথে সাথেই সম্ভাবনা বাড়ছে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের। আর বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ঐ ঘূর্ণিঝড়ের আক্রমণের মুখে পড়ছে অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলি। আর এই রাজ্যের ঘূর্ণিঝড়ে নিয়ম করে আক্রান্ত হচ্ছে পূর্ব মেদিনীপুর, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা আর উত্তর চব্বিশ পরগনার মতো জেলাগুলি। ফলে নগরায়িত উষ্ণায়ণের ধাক্কায় তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের মত বিপর্যয়ে আক্রান্ত হচ্ছে এরাজ্যের সুন্দরবন-সহ বিস্তীর্ণ উপকূলবর্তী এলাকার মানুষজন। সেই প্রেক্ষিতে আজ প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী সুসংহত পরিকল্পনা।বলাই বাহুল্য গোটা পৃথিবীর অন্যতম দুর্লভ সম্পদ সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ অরণ্য এবং তাকে ঘিরে থাকা জনপদকে বাঁচানো রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব।

ঘূর্ণিঝড়, খরা, বন্যা, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার দায় দেশের এবং রাজ্যের উভয় সরকারেরই। ফলে দেনা-পাওনার সংঘাতের আবহে নয় সমন্বয়ের ভিত্তিতেই রাজ্যভিত্তিক বিপর্যয় মোকাবিলার মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা আশু প্রয়োজন। তার কারণ বিপর্যয়ের চরিত্র এবং তার ব্যাপ্তি সব রাজ্যে একরকম নয়। যেমন রাজস্থানে খরা, সিকিমে ভূমিকম্প, যেমন বিপর্যয়ের মুখ্য চরিত্র, তেমনই পশ্চিমবঙ্গে ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যা বিপর্যয়ের মুখ্য উপাদান। ফলে বিপর্যয় সম্ভাবনার নিরিখে এরাজ্যে ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যা দুটোরই সংঘবদ্ধ উপায়ে মোকাবিলা জরুরী। কারণ ঘূর্ণিঝড়ের সাথে ভারী বৃষ্টি স্বাভাবিক ঘটনা। আর এমন দীর্ঘক্ষণের ভারী বৃষ্টির প্রভাবে গ্রাম শহরে প্লাবন কিংবা মরশুমি জলে ভরা নদীতে প্লাবন অবশ্যম্ভাবী। এক্ষেত্রে বোঝা দরকার যে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হচ্ছে আন্দামানে, আছড়ে পড়ছে ওড়িশায়, বৃষ্টি হচ্ছে ঝাড়খণ্ডে আর বন্যা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। বিপর্যয় শৃঙ্খলের এমন প্রেক্ষিতে উপদ্রুত রাজ্যগুলিকে একত্রিত করে সঙ্গবদ্ধ এবং সুসংহত বিপর্যয় মোকাবিলার প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর সংস্কার আশু জরুরী।

বিপর্যয় মোকাবিলাঃ স্থায়ী পরিকাঠামো

যে কোনো বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের চরিত্র, বিপর্যয়ে আক্রান্ত সমাজের আর্থ-সামাজিক বিন্যাস এবং সেই বিন্যাসে বিপর্যয়ে সবচেয়ে স্পর্শকাতর প্রান্তিক মানুষদের রক্ষার ভাবনাই জরুরি। এরাজ্যে ফি বছর ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়া উপকূলবর্তী অঞ্চলের এক বড় অংশ সুন্দরবন। অখণ্ড সুন্দরবনের মাত্র ৪০% এদেশের ভৌগলিক সীমানায় আর বাকিটা পড়ে, পড়শি বাংলাদেশে। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে গত তিরিশ বছরে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ হ্রাস পেয়েছে প্রায় ২৫%। আর এই ম্যানগ্রোভ ধ্বংসকে ‘Man made disaster’ বললেও কম বলা হয়। অপরিকল্পিত সুন্দরবন কেন্দ্রিক অর্থনীতির কারণেই বেসামাল হয়ে পড়েছে গোটা ম্যানগ্রোভের অস্তিত্ব। আয়লা কিংবা আম্ফানের পর যে তৎপরতায় ম্যানগ্রোভ লাগানোর সরকারি লক্ষ্য ছিল কার্যত তার থেকে বহু যোজন দূরে দাঁড়িয়ে আজকের সুন্দরবন। পাশাপাশি শাসক দলের প্রকাশ্য মদতেই চলছে নিত্যদিন ম্যানগ্রোভ কেটে সেগুলিকে ইট ভাটায় বিকল্প জ্বালানীর কাজে লাগানো। এমনকি সস্তায় দ্রুত লাভের লক্ষ্যে সেই ইট ভাটার পলিমাটির প্রয়োজনে জায়গায় জায়গায় নদীবাঁধ কেটে জল ঢুকিয়ে তার থেকে পলি তোলার কাজ চলছে পুলিস প্রশাসনের নাকের ডগায়।

ফলে ম্যানগ্রোভ ছাঁটা জঙ্গলের ওপর দিয়ে ছুটে আসা ঝড় বাতাসের ধাক্কাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা কমছে সুন্দরবনে। তার ফলে সেই অঞ্চলের নদীগুলিতে ঘূর্ণিঝড়ের সময় বেড়ে চলেছে জলোচ্ছ্বাসের বহর। আর ভরা কোটালের সময় এমন ঝড়ের ধাক্কায় নদীর জলের বাড়তি গতি হামেশাই দুর্বল কাদামাটির বাঁধের স্থায়িত্বকে বিঘ্নিত করছে। হল্যান্ডের নগরকেন্দ্রিক অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে তাঁদের ডাইক রক্ষণাবেক্ষণে যেমন সর্বোচ্চ পর্যায়ের অগ্রাধিকার রয়েছে ঠিক বিপরীতে প্রান্তিক আয়ের গ্রামীণ মানুষের জনপদ সুন্দরবন হওয়ার কারণে ঐতিহাসিকভাবেই সুন্দরবনে নদীবাঁধের মত পরিকাঠামো নির্মাণ উপেক্ষিত রয়ে গিয়েছে। যে কারণে দেখা যায় ভোটের আগে শহর কলকাতায় উড়ালপুল দিয়ে মুড়ে ফেলার সরকারি প্রতিশ্রুতি আর সুন্দরবনের প্রান্তিক জনপদের বাঁচার জন্য পোক্ত নদীবাঁধ নির্মাণের কথা চলে যায় বিস্মৃতির অতলে।

যে নদীবাঁধ দেওয়া হয় নদীর নোনা জলের থেকে চাষের জমি কিংবা বাসের জমি রক্ষা করতে, সেটাই জলোচ্ছ্বাসের কবলে ভেঙে নদীর নোনা জল একবার চাষের জমিতে ঢুকে পড়লে সেই মাটির চাষের ক্ষমতা, সেখানকার খাল বিল পুকুরে মাছ চাষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় যতক্ষণ পর্যন্ত না বৃষ্টির মিষ্টি জলে সেই নোনা জলের প্রভাব ধুয়ে মুছে যায়। তাই এমন প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে সুন্দরবনের লাইফ লাইন হয়ে উঠেছে সেখানকার নদীবাঁধ। পাশাপাশি সুন্দরবন অঞ্চলের সিংহভাগ নদীগুলিতে ধারাবাহিকভাবে পলি পড়ার কারণে সেগুলির জলধারণ ক্ষমতা উপর্যুপরি কমে চলেছে। অথচ দেশের কিংবা রাজ্যের কোনো সরকারের হেফাজতেই সুন্দরবনের নদী এবং খাড়িগুলিতে এই পলি জমার তথ্য নেই। নেই সুন্দরবনের জলোচ্ছ্বাসের সময় বিভিন্ন অঞ্চলে জলের উচ্চতা বৃদ্ধির তথ্য। অথচ তিন দশক আগেও ভরা কোটালে জলোচ্ছ্বাস যে উচ্চতায় পৌঁছাত এখন সেই উচ্চতাও বেড়ে চলেছে। এই প্রেক্ষিতে এই সমস্ত নদীগুলির জলধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রয়োজন নদীবক্ষের পলি কেটে সরিয়ে সেই মাটিকে নদীবাঁধ নির্মাণে ব্যবহার।

জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে এমন নদীবাঁধ বাঁচাতে চাই বাঁধগুলির উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা প্রতিহত করার শক্তি বৃদ্ধি। আর সেখানেই প্রয়োজন বিকল্প নির্মাণ সামগ্রী এবং নির্মাণ প্রযুক্তির প্রয়োগ যাতে নদীবাঁধের আয়ু দীর্ঘ হয়। নদীবাঁধের উচ্চতা বাড়াতে গেলে জ্যামিতিক কারণেই প্রয়োজন চওড়া ভিতের আর যার জন্য প্রয়োজন বাড়তি জমির। আর এই বাড়তি জমি জোগাড়ের কাজটাই করতে হবে পঞ্চায়েতকে যুক্ত করে রাজ্যের সরকারকেই। যেমন গ্রামীণ সড়কের জন্য প্রয়োজনীয় জমি গ্রামের মানুষের পঞ্চায়েতের যৌথ উদ্যোগেই সংগৃহীত হয় কোনো ক্ষতিপূরণ ব্যতিরেকেই তেমনটাই প্রয়োজন নদীবাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রেও। আর এই বাড়তি জমির পরিমাণ কমিয়ে আনা যায় বিকল্প নির্মাণ সামগ্রীর প্রয়োগে যেগুলি নরম কাদামাটির চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী। কিন্তু এমন জমিজটের রাজনৈতিক কারণে এই আয়লার ক্ষতিতে বিপর্যস্ত ৭৭৮ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের কেন্দ্রীয় অনুদানের প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা এই সরকারের আমলেই ফেরত গেছে। আজ যারা শাসক এক দশক আগে আয়লার পরে তারাই গলা ফাটিয়ে বলেছিলেন সুন্দরবনে পরিকাঠামোর উন্নয়নে কেন্দ্র যেন একটি টাকাও রাজ্যকে না বরাদ্দ করে। আর আজকের রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে সাংবাদিক সম্মেলন করে বলতে হচ্ছে বাঁধ নির্মাণে সরকারের টাকা জলে গেছে বলে। সরকারের অপরিকল্পিত পদক্ষেপ আর অগ্রাধিকারে ফি বছর বাঁধ সারাইয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও কাটমানি এবং সিন্ডিকেটের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ছে উপকূলের নদী কিংবা সমুদ্র বাঁধের গুনগত মান।

সুন্দরবনে জলোচ্ছ্বাস আটকাতে চাই বহুস্তরীয় বাঁধের নিরাপত্তা। সেই ব্যবস্থায় নদীর পার ঘেঁসে যেমন লাগানো থাকবে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল যেটা হবে প্রবল জলের ধাক্কা আটকানোর জন্য প্রথম স্তরের নিরাপত্তা। তার পরের স্তরে থাকবে বিকল্প নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে তৈরি পোক্ত উঁচু নদীবাঁধ। আর এমন বাঁধের পিছনে তিনশো মিটার পিছিয়ে সাবেকী মাটির নদীবাঁধ যাতে পোক্ত উঁচু বাঁধ ছাপিয়ে কালেভদ্রে যদি জলোচ্ছ্বাসে জল উপচে পড়ে সেক্ষেত্রেও সেই নোনা জল বিস্তীর্ণ চাষের জমিতে ঢুকতে পারবে না। আর মাটির বাঁধ শেষে উঁচু গাছের সারি। ঠিক সেনাবাহিনীর কায়দায় বিভিন্ন স্তরে পর্যুদস্ত করার ভাবনা ভাবতে হবে এই জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলার জন্য। পাশাপাশি সুন্দরবনের মূল ভূমিতে নোনা জলের স্তর দ্রুত উঠে আসছে ভূপৃষ্ঠের কাছে। ফলে অগভীর টিউবওয়েলগুলিতে তৈরি হচ্ছে মিষ্টি জলের সংকট। এই সমস্যা জলোচ্ছ্বাস ব্যতিরেকেই বেড়ে চলেছে নিত্যদিন। ফলে এবিষয়ে সরকারকে দ্রুত পরিস্রুত পানীয় জলের প্ল্যান্ট স্থাপন করতে হবে সেই অঞ্চলের পঞ্চাশ লাখ মানুষের জনস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখেই।

একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে আজকের সুন্দরবনের উপর নেমে আসা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী অপরিকল্পিত উন্নয়ন ভাবনা। বিপন্ন অর্থনীতির জাঁতাকলে পড়ে সুন্দরবনের অরণ্যভূমির দখল নিতে বাধ্য হয়েছে আমাদের সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা যাঁদের জীবন আর জীবিকা হয়ে উঠেছে ঐ অঞ্চলের নদী আর জঙ্গল কেন্দ্রিক। অথচ এমন মানুষদের জল আর জঙ্গলের সাথে একাত্ম করার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস ছিল না কখনও। ভোটের আগে প্রতিশ্রুতি আর ঝড় বন্যার পর ত্রাণ ত্রিপলের রাজনীতির শিকার হয়েছে এই দ্বীপভূমির মানুষজনেরা। এখন বহুবিধ সমীক্ষায় প্রকাশ পাচ্ছে যে সুন্দরবনে ধারাবাহিকভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়া ষাটটি গ্রামের পাঁচ লক্ষ মানুষের বিকল্প পুনর্বাসন ভাবনা জরুরি। এখানেই সবচেয়ে বড় বিষয় উদ্বাস্তুর ভিড়ে ভরা এই প্রবল জনঘনত্বের রাজ্যে পুনর্বাসনের বিকল্প জমির অন্বেষণ। একথাও আজ ঠিক যে সুন্দরবনের দ্বীপভূমির নতুন প্রজন্ম বিকল্প এবং উন্নত আয়ের আশায় পরিযায়ী হয়ে ঘাঁটি গাড়ার চেষ্টা করছে মূল ভূখণ্ডে। কিন্তু কৃষি ছেড়ে শিল্প অথবা পরিষেবায় যুক্ত হওয়ার পরিকল্পিত সরকারি প্রয়াস অপর্যাপ্ত। ফলে জল আর জঙ্গলের জমি ছেড়ে প্রাণে বাঁচাও দায় হয়ে পড়ছে তেমন প্রান্তিক মানুষজনের। এইখানেই প্রয়োজন সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে বহুমাত্রিক দৃষ্টিতে বিপর্যয় মোকাবিলার রনকৌশলের প্রস্তুতি। এটাকে জাতীয় গুরুত্বের মর্যাদা না দিয়ে দেখলে ভবিষ্যতে শুধু সুন্দরবন নয় এমনকি শহর কলকাতাও হারিয়ে যেতে বসবে বিপর্যয়ের ধাক্কায়।