আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২১ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৮

প্রবন্ধ

চা শিল্প ও শ্রমিকের সংকট

কিংশুক সরকার


আমাদের দেশের পুরানো সংগঠিত শিল্পের মধ্যে অন্যতম হল চা- শিল্প। এই শিল্পে শ্রমের ব্যবহার তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি। প্রধানত চা শিল্প একটি কৃষি-নির্ভর শিল্প যেখানে উৎপাদন ব্যবস্থা অনেকটাই কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার মতো করে আয়োজন করা হয়। ফলে শ্রমিকের ব্যবহার বেশি এবং জমির প্রয়োজনও অনেক বেশি। এছাড়াও চা উৎপাদনের জন্য অনুকূল পরিবেশ ও আবহওয়া লাগে। তাই দেশের কিছু নিদিষ্ট অঞ্চলেই চা উৎপাদন সম্ভব।

সময়ের সাথে সাথে চা অন্যতম জনপ্রিয় পানীয়-তে পরিণত হয়েছে। আমাদের প্রায় সকলের দিনের শুরু চা দিয়েই হয়। সারা বিশ্বে চায়ের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে চায়ের উৎপাদনও বেড়েছে। আমাদের দেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। চায়ের উৎপাদন এবং বিক্রি দুই-ই বেড়েছে। চা-শিল্প কে সংগঠিত ক্ষেত্রের শিল্প হিসাবে ধরা হয়। তাই চা শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকরাও সংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যে গণ্য হন। সমস্যা হল সংগঠিত শিল্পের শ্রমিক হওয়ার পর, চা শিল্পের শ্রমিকদের সার্বিক অবস্থা অনেক ক্ষেত্রে অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের থেকেও খারাপ। বাণিজ্যিক দিক থেকে চা শিল্পের অভূতপূর্ব উন্নতি হলেও, চা শ্রমিকদের অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বিষয়টি একটু গভীরে গিয়ে দেখা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রেও আমাদের দেশের দুই প্রান্তের চা শ্রমিকদের অবস্থাও তুলনামূলক দিক থেকে আলাদা।

ভারতে প্রথম চা বানানো তৈরি হয় ১৮৩৩ সালে অসমে। এরপর পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং জেলায় চা বাগান শুরু করা হয়। ব্রিটিশরা চা বাগান শুরু করেছিলেন। আর্ন্তজাতিক বাজারে চীনের আধিপত্য কমানোর জন্য ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে চা তৈরির সুযোগের খোঁজ করছিল। আসামে চা গাছ এবং চা তৈরির অনুকূল পরিবেশ পাওয়ার পর প্রথমে অসমে এবং পরে পশ্চিমবঙ্গের চা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হওয়া শুরু হয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে অসমে এবং পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ চা বাগানের প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। এর পরে চা উৎপাদন দক্ষিণ ভারতে তামিলনাডু এবং কেরালাতেও ছড়িয়ে পড়ে।

উৎপাদনের দিক থেকে দেখলে ভারতের মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশ চা অসমে উৎপন্ন হয়, পশ্চিমবঙ্গে ২৫ শতাংশের মতো উৎপন্ন হয়। বাকী ২৫ শতাংশ দক্ষিণ ভারতের তামিলনাডু, কেরালা, কর্ণাটকে হয়। গুণগত মানের দিক থেকে দেখলেও অসম আর পশ্চিমবঙ্গের চায়ের মান দক্ষিণ ভারতের চায়ের থেকে ভালো। গুণগত মানের সঙ্গে চায়ের দামের সমানুপাতিক সর্ম্পক রয়েছে। নিলাম এবং খোলা বাজারর দুই ক্ষেত্রেই অসম/পশ্চিমবঙ্গের উৎপাদিত চায়ের দাম তামিলনাডু/কেরালায় উৎপাদিত চায়ের দাম থেকে যথেষ্টবেশি। কিন্তু চা শ্রমিকদের অবস্থা দেখলে বলতেই হয় যে উত্তর-পূর্বের চায়ের শ্রমিকরা দাক্ষিণাত্যের শ্রমিকদের তুলনায় অনেকটাই খারাপ অবস্থার মধ্যে আছেন। বিষয়টির উপর একটু বিস্তারিত আলোকপাত করা যায়।

অসম এবং পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার জেলার অংশকে একসাথে ভারতের উত্তর-পূর্বের চা উৎপাদনের অঞ্চল হিসাবে বলা যেতে পারে। অসম এবং পশ্চিমবঙ্গ আলাদা রাজ্য হলেও চা উৎপাদনের বৈশিষ্ট্য এই দুই রাজ্যে অনেকটা একই রকম। শিলিগুড়ি থেকে শুরু করে তেজপুর পর্যন্ত একটা নিরবিছিন্ন চা উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসাবে দেখা যেতে পারে। উৎপাদন ব্যবস্থা এবং শ্রমিকের নিয়োজনে এই পুরো অঞ্চলে এক ধরনের সামঞ্জস্য দেখা যায়। দার্জিলিং পাহাড়ে প্রধানত অর্থডক্স (যা দার্জিলিং চা বলে পরিচিত) চা উৎপাদন করা হয়। অসমের উপর দিকের চা বাগানেও এই ধরনের চা তৈরি হয়। বাকী এই পুরো অঞ্চলে সিটিসি চা তৈরি হয় যা গণ চাহিদা দেশের মধ্যে বা দেশের বাইরে সেটা মেটায়।

সম্পূর্ণ উত্তর-পূর্বের চা শ্রমিকদের প্রায় বেশিরভাগই আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রধানত সাঁওতাল সম্প্রদায়ভুক্ত। এরা সবাই সেই অর্থে ছোটনাগপুর মালভূমির (যা আজকের দিনে ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা, ছত্রিশগড় ইত্যাদি রাজ্যের অংশ)। প্রথমে যখন চা বাগান ইংরেজদের দ্বারা শুরু হয় তখন স্থানীয় শ্রমিক খুব কম পাওয়া যেত। চা-উৎপাদনের উপযোগী জায়গাগুলি অধিকাংশই একটু পার্বত্য বা তরাই অঞ্চলে ছিল যা সেই সময়ে অপেক্ষাকৃত দুর্গম পাহাড়ী জঙ্গল ছিল। এইসব জায়গায় খুব কম লোক বাস করতেন। ফলে স্থানীয় শ্রমিক পাওয়া কঠিন হতো। যে অল্প সংখ্যক স্থানীয় শ্রমিক কাজ করতে ইচ্ছুক ছিলেন, তারাও সেই সময়ের অনুপাতে মজুরি দাবি করেছিলেন যা ব্রিটিশ নিয়োগকারীরা দিতে চাননি। নিযোগকারীরা অন্তঃবর্তী মধ্যসত্ত্বাকারীদের মাধ্যমে ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল থেকে নিয়ে গিয়ে উত্তর-পূর্বের চা বাগানগুলিতে শ্রমিকদের নিয়োজন করেছিলেন। এই ‘মাইগ্রেসন’ পরিবারের সবাইকে নিয়ে আর স্থায়ী ছিল।

প্রথম দিকে যেইসব শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তারা যে সবাই থেকে যেতে চেয়েছেন, তা নয়। কাজের পরিবেশ বেশ কঠিন এবং মজুরি খুব কম ছিল। চা বাগানের কাজের পরিবেশের সাথে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের মানিয়ে নিতে যথেষ্ট অসুবিধে হচ্ছিল। অনেকেই ফিরে আসতে চাইছিলেন। কিন্তু বিভিন্নভাবে তাদের ফিরে আসা থেকে প্রতিহত করা হয়। এমনকি তারা যাতে ফিরে যেতে না পারে সেইজন্য ব্রিটিশ সরকার কিছু আইনও প্রণয়ন করেন। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা একদমই ভালো ছিল না। কিছু নির্দিষ্ট জায়গা দিয়েই যাওয়া আসা করতে হত। শ্রমিকদের ফিরে আসা আটকানোর জন্য এই নির্দিষ্ট জায়গাগুলিতে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পালাতে গিয়ে ধরা পড়লে কঠোর শাস্তি দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় আইন তৈরি করা হয়। যাদের মাধ্যমে শ্রমিকদের নিয়ে আসা হত তাদের 'সর্দার' বলা হত। এরাই শ্রমিকদের উপর কড়া নজর রাখতেন যাতে তারা ফিরে যেতে না পারেন এবং চা বাগানগুলিতেই কাজ করতে বাধ্য হন।

প্রথম থেকেই চা শিল্পে শ্রমিকদের নিয়োগ এবং ব্যবহার এমন ভাবে করা হয়েছিল যে খুব কম মজুরিতে এক শ্রেণির শ্রমিক অত্যন্ত কঠিন পরিবেশে দিনের পর দিন কাজ করে যাবে। তারা চাইলেই বেরিয়ে যেতে পারবে না। আক্ষরিক অর্থে ক্রীতদাস না হলেও প্রথম দিকের চা শ্রমিকদের অনেকখানি সেইরকম ভাবেই ব্যবহার করা হত। প্রতিটি চা বাগান এক একটি নিজস্ব দেশ প্রায়। তাদের খুব নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকত। সামাজিক আদান প্রদান চা বাগানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগের সম্ভাবনা খুব কম ছিল বা এখনও আছে। চা শ্রমিকরা স্থানীয় জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে গেছেন। আজও অসম বা পশ্চিমবঙ্গের চা বাগানের শ্রমিকদের মূল সমাজের অন্তর্ভুক্ত মনে করা হয় না। শ্রমিকদের ভোট দেওয়ার অধিকার আছে বা কিছু সরকারি প্রকল্পের সুবিধা তারা ইদানিং পাচ্ছেন। কিন্তু এটা বলাই যায় যে তারা মূল সমাজের অংশ হয়ে উঠতে পারেননি বা দেওয়া হয়নি। চা শ্রমিক এবং স্থানীয় সমাজের মধ্যে দূরত্ব রয়েই গেছে।

এই ব্যবস্থাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ রীতি ব্যবহার করা হয়। একজন শ্রমিক ষাট বছর বয়সে অবসর নিলে সে তার কাজ তার পরিবারের কাউকে বা পরিবারে কেউ না থাকলে অন্য কাউকেও দিয়ে যেতে পারে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে শ্রমিকদের যোগান এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সুনিশ্চিত করা হয়। এই ব্যবস্থা এখনও চলছে এবং আপাতদৃষ্টিতে শ্রমিকদের ভালো হচ্ছে মনে করা হলেও এর ফলে শ্রমিকরা বংশ পরম্পরায় চা শ্রমিক হিসাবে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর শ্রমিকদের যোগান সুনিশ্চিত হচ্ছে। প্রথম থেকেই পরিবার-সহ ‘মাইগ্রেট’ করানোর পিছনে এটাও একটা পরিকল্পনা ছিল যে এই শ্রমিকদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ব্যবহার করা যাবে।একই কারণে মেয়েদেরও চা শিল্পে শ্রমিক হিসাবে প্রথম থেকেই নিয়োগ করা হয়। সবুজ পাতা তোলার জন্য মহিলা শ্রমিক বেশি উপযুক্ত। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে যে ব্যবস্থা অনেকটা জোর করে, কিছুটা আইনের সাহায্য নিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সেই ব্যবস্থাকেই অন্য ভাবে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আক্ষরিক অর্থে শ্রমের বাজার মুক্ত হলেও, বাস্তব এটা যে শ্রমের শর্ত শ্রমিক স্বার্থের অনুকূল না হলেও শ্রমিকরা চা শিল্প ছেড়ে যেতে পারছেন না।

চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরির দিকে তাকালেই শ্রমিকদের দুরাবস্থা কিছুটা বোঝা যাবে। আজকের তারিখে আসামে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরির হার ১৬৭ টাকা, পশ্চিমবঙ্গের সেটা ২০২ টাকা। এই দুই রাজ্যে কৃযিকাজের নূণ্যতম মজুরিও পারয় দৈনিক ২৫০ টাকা। চা-শিল্পে শ্রমিকদের দক্ষ হতে হয় এবং চা-একটি সংগঠিত শিল্প। কিন্তু তার পরেও চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি এত কম কেন সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরির দিকে তাকালে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। কেরালাতে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৩৮০ টাকা এবং তামিলনাডুতে সেটা ৩১৪ টাকা। একই দেশে একই কাজের জন্য দেশের দুই প্রান্তের রাজ্যগুলেতে মজুরির এই পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। পশ্চিমবঙ্গে মজুরি জানুয়ারি মাসে ১৭৬ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২ টাকা হয়। এক্ষেত্রে এক ধাপে ২৬ টাকা বৃদ্ধি পায়। অসমের এরপরেই ৫০ টাকা মজুরি বাড়িয়ে মজুরি ১৬৭ টাকা থেকে ২১৭ টাকা করা হয়। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে চা মালিকরা কোর্টে যান এবং কোর্ট স্থাগিতাদেশ দেওয়ার ফলে মজুরি ১৬৭ টাকাই থেকে যায়। বিষয়টি এখন বিচারধীন রয়েছে। অসমে কৃষিকাজের জন্য ন্যূনতম মজুরি এই সময় ৩৩২ টাকা। অর্থাৎ, চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ন্যূনতম মজুরির প্রায় অর্ধেক। চা সংগঠিত শিল্প এবং চা শ্রমিকরা সংগঠিত শ্রমিকদের অংশ হওয়ার পর মজুরির ক্ষেত্রে এই বিশাল পার্থক্য থাকছে।

চা মালিকরা এই ব্যাপারে কিছু যুক্তি দিয়ে থাকেন। প্রথমতঃ তারা বলেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই স্থায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করছে তাই পারিবারিক মজুরি দ্বিগুণ হচ্ছে। ব্যক্তিগত ভাবে মজুরি কম হলেও গোটা পরিবারের মজুরি পরিবার চালানোর জন্য তারা যথেষ্ট মনে করেন। পরিবারের দুজন কাজ পাচ্ছেন, এই বিষয়টা তারা জোর দেন। আসলে চা-মালিকদের এই যুক্তি অনেকটাই অসার, স্বামী-স্ত্রী দুজন যেমন কাজ করছেন, মালিকরা দ্বিগুণ হারে উৎপাদনও পাচ্ছেন। পরিবারের সদস্য বলে উৎপাদনের মাত্রা তো কম করা হচ্ছে না। তাই মালিকদের যুক্তির কোনো সারবত্তা নেই।

দ্বিতীয়ত, চা মালিকরা বলে থাকেন যে অসম এবং পশ্চিমবঙ্গের চা শ্রমিকদের প্রায় বিনামূল্যে রেশন এবং জ্বালানির জন্য কাঠ দেওয়া হয়। কিন্তু এই যুক্তি দিয়েও কম মজুরির বিষয়টিকে মেনে নেওয়া যায় না। রেশন বা জ্বালানির কাঠের বাজার মূল্য আলাদা করে যোগ করা হলেও তা দৈনিক ৩০ টাকার বেশি হবে না। মজুরির যে বিশাল পার্থক্য সেটা খুব যে কমবে তা নয়।

দেশের দুই প্রান্তের মজুরির এই বিস্তর ফারাকের কারণ অ্নুসন্ধান করলে এটা দেখা যাবে যে দুই জায়গাতে মজুরি নির্ধারণের পদ্ধতি আলাদা। দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে চা-শিল্পের মজুরি ন্যূনতম মজুরি আইনের আওতায় আনা হচ্ছে এবং সেইমতো মজুরি ঘোষণা রাজ্যসরকারগুলি করে থাকে। মালিকপক্ষ এবং শ্রমিক সংগঠনগুলির সাথে আলোচনা করা হয় কিন্তু মজুরি নির্ধারণ ন্যূনতম মজুরি আইন অনুযায়ী করা হয়ে থাকে। ফলে প্রতি ছয়মাস অন্তর মুদ্রাস্ফীতির সূচক অনুযায়ী মহার্ঘ্য ভাতাও যুক্ত করা হয় এবং মজুরি সেই মতো বৃদ্ধি পেতে থাকে। অনাদিকে, অসম আর পশ্চিমবঙ্গে চা-শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ যৌথ দর কষাকষির মাধ্যমে হয়ে থাকে। সত্তর দশকেও এই দুই রাজ্যে চা-শিল্পের মজুরি ন্যূনতম মজুরি আইনের আওতায় ছিল। পরে তা পরিবর্তন করে যৌথ দর কষাকষির আওতায় আনা হয়। মনে করা হয়েছিল যে, যৌথ দর কষাকষির মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত বেশি মজুরিতে পৌঁছানো যাবে। চা শিল্পের শ্রমিকরা সংগঠিত এবং প্রায় সবাই শ্রমিক সংগঠনের সদস্য। নিয়মিত যৌথ দর কষাকষির পরিকাঠামোও তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু দেখাই যাচ্ছে যে যৌথ দর কষাকষির ফলে নির্ধারিত মজুরি খুবই কম, এমনকি ন্যূনতম মজুরির থেকেও কম।

এই কারণে গত বেশ কিছু বছর ধরে অসম এবং পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক সংগঠনগুলি ন্যূনতম মজুরি চালু করার দাবি করে চলেছেন। পশ্চিমবঙ্গে এই নিয়ে বেশ কিছু ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে। গত তিন বছরে দুই দফায় অন্তবর্তীকালীন মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে ন্যূনতম মজুরি এখনো প্রণয়ন করা যায়নি। অসমে ন্যূনতম মজুরি এখনো ৩৫০ টাকা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও এখনও পর্যন্ত সেটা করা যায়নি। অসমে সব মিলিয়ে প্রায় ৮ লক্ষের কাছাকাছি চা শ্রমিক রয়েছেন। ২০১৭ সালে ন্যূনতম মজুরি প্রণয়নের জন্য অসম সরকার কমিটি গঠন করেন। সেই উপদেষ্টা কমিটি ৩৫১ টাকা দৈনিক মজুরি ধার্য করার কথা বলে। ২০১৮ সালে অসম সরকার দৈনিক মজুরি ১৩৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬৭ টাকা করে। যেভাবে ৫০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির বিরোধিতা করে চা মালিকরা আদালতে গেছেন, তাতে বলা যায় যে উপদেষ্টা কমিটির ধার্য করা ৩৫১ টাকার ন্যূনতম মজুরি অদূর ভবিষ্যতে চালু হওয়ার সম্ভবনা খুব কম যদি না সরকার অতি সচেষ্ট হন।

অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখলে এই দুই রাজ্যে এত কম দৈনিক মজুরি কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। চা শিল্পের সমস্ত রকম অর্থনৈতিক সূচক শিল্পের উত্তরোতর বৃদ্ধি নির্দেশ করে। চা শিল্পের অধীনে থাকা জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে, চাহিদা এবং দাম দুইয়ের বৃদ্ধি ঘটে। সময়ের সাথে সাথে এইসব সূচকের গতিবিধি সারণী ১-এ দেওয়া হল।

সারণী ১: ভারতে চা শিল্পের সূচকের গতিবিধি

- ১৯৮১ ১৯৯১ ২০০১ ২০১১ ২০১৮
জমি (হেক্টর) ৩৪৩,৬২৯ ৪২০,৪৭০ ৫০৯,৮০৬ ৫৭৯,৩৪৩ ৫৬৬,৬৬০
উৎপাদন (মিলিয়ন কেজি) ৫৬০ ৭৫৪ ৮৫৩ ১,১১৫ ১,৩২২
উৎপাদনশীলতা (কেজি/হেক্টর) ১,৪৬১ ১,৭৯৪ ১,৬৭৫ ১,৯২৫ ২,৩৩৩
রপ্তানী (মিলিয়ন কেজি) ২৮২ ২০২ ১৮৩ ২১৫ ২৫২
অভ্যন্তরীণ চাহিদা (মিলিয়ন কেজি) ৩৭৬ ৫০২ ৬৫০ ৯৪৪ ১,০৮৪
শ্রমিকের নিয়োজন ৮৪৯,২০৬ ৯৯৬,৭৩৫ ১,২৩২,১৫০ ১,২৫৯,৯৫০ ১,২৫৯,৯৫০
কিলো প্রতি দাম ১৩.৯৪ ৪০.৩৯ ৬৯.৬৬ ১০৬.০৭ ১৩৩.১১

সূত্রঃ ইন্ডিয়ান টি এ্যামোসিয়েশন।

এই সারণি থেকে বলা যায় যে চা-শিল্প গত ৪০ বছরে অনেকখানি কলেরবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জমির পরিমান প্রায় দ্বিগুন হয়েছে। উৎপাদন ৫৬০ মিলিয়ন কেজি থেকে বেড়ে ১,৩২২ মিলিয়ন কেজি হয়েছে। হেক্টর প্রতি উৎপাদন ১,৪৬১ কেজি থেকে বেড়ে ২,৩৩৩ কেজি হয়েছে। রপ্তানীর তেমন কোনো বৃদ্ধি হয়নি। কিন্তু তার জন্য উৎপাদকদের অসুবিধে হয়নি। কারণ, দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে। ৪০ বছরে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ৩৭৬ মিলিয়ন কেজি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১,০৮৪ মিলিয়ন কেজি হয়েছে। দেশের বাজার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য চা উৎপাদকদের বৈদেশিক বাজারে রপ্তানীর জন্য নির্ভর করতে হয়নি। নিলামে চায়ের কিলো প্রতি দামও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮১ সালে যা ছিল ১৩.৯৪ টাকা সেটা ২০১৮ সালে হয়েছে ১৩৩.১১ টাকা। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, প্রায় সমস্ত সূচকের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হলেও, শ্রমের ব্যবহার সে হারে বাড়েনি। ১৯৮১ সালে প্রায় সাড়ে আট লক্ষ শ্রমিক নিয়োজিত হলে, ২০১৮ সালে সেটি বেড়ে দাড়ায় ১২ লক্ষের একটু বেশি। জমি বা উৎপাদন যে হারে বেড়েছে, শ্রমের ব্যবহার সে হারে বৃদ্ধি পায়নি। এর থেকে এটাও বলা যায় যে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। জমি দ্বিগুণ হলেও শ্রমের ব্যবহার মাত্র ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
দুঃখের বিষয় এই যে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেলেও তাদের যে পারিশ্রমিক অর্থাৎ দৈনিক মজুরি সেটা সেই অর্থে বৃদ্ধি পায়নি। বিশেষত উত্তর-পূর্ব ভারতে যেখানে মোট চা উৎপাদনের ৭৫ শতাংশ সংগঠিত হয়ে থাকে। এটা আরো বেশি দুর্ভাগ্যের যে প্রায় সব চা শ্রমিক কোনো না কোনো শ্রমিক সংগঠনে সদস্য হওয়া সত্ত্বেও এবং যেখানে মজুরি যৌথ দর কষাকষীর মাধ্যমে স্থির করা হচ্ছে, সেই অবস্থায় শ্রমিকরা এমনকি ন্যূনতম মজুরি থেকেও বঞ্চিত। সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক হয়েও, এমন একটি শিল্প যেটা ক্রমাগত বড় হয়েছে এবং লাভজনক শিল্প, তার অংশ হয়েও আজকের শ্রমের বাজারের একদম তলানীর দিকে চা শ্রমিক থাকবেন। সংগঠিত ক্ষেত্র, শ্রমিক সংগঠনের উপস্থিতি, লাভজনক শিল্প সব মিলিয়ে এতো উপাদান থাকা সত্ত্বেও টা শ্রমিকরা শোষিত হয়ে চলেছেন।

অনেকে বলবেন যে শ্রমের বাজার তো স্বাধীন, তাহলে চা শ্রমিকরা আজকের দিনে চা বাগানে আটকে রয়েছেন কেন। ছেড়ে যাচ্ছেন না কেন? সাম্প্রতিক কালে ছেড়ে যে যাচ্ছেন না, তা নয়। বেশ কিছু সংখ্যায় চা শ্রমিক অসম, পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে কেরালা-তে কাজ করতে গেছেন। বিশেষতঃ বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকরা। কেরালাতে মজুরি প্রায় দ্বিগুন এবং সেখানে শ্রমিকরা অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও পেয়ে থাকেন। অসম, পশ্চিমবঙ্গে ন্যূনতম মজুরির প্রণয়ন না করা গেলে এই ধরনের মাইগ্রেশন আরও বাড়বে।

স্বাধীনতার ৭০ বছর কেটে যাবার পরও উত্তর-পূর্বের চা শ্রমিকদের অবস্থা দেখলে বোঝা যায় এই শোষণের সাথে অনেকগুলি আর্থ-সামাজিক কারণ জড়িত। প্রথম যেটা বলা যায় যে চা শ্রমিকদের এই দুই রাজ্যের মূলস্রোতের সমাজ কখনই নিজের অংশ মনে করেনি। তাদের চা বাগানের শ্রমিক বলে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। 'সামাজিক দূরত্ব' এখানে ভীষণভাবে প্রকট। চা বাগান 'এনক্লেভ' অর্থনীতি হিসাবে এখনও রয়ে গেছে আর তাতে কাজ করা আদিবাসীরা আজও বাইরে থেকে আসা শ্রমিক হিসাবেই রয়ে গেছে। মূল সমাজ তাদের আপন করে নেয়নি।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয়, যে চা উৎপাদন যে সমস্ত অঞ্চলে হয়ে থাকে, সেখানে অন্য কোনো শিল্প গড়ে তোলার কোনো চেষ্টা স্বাধীনতা উত্তর সময়ে করা হয়নি। সমগ্র অঞ্চলটাই সামগ্রিকভাবে চা অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল। এই অবস্থায়, চা বাগানের শ্রমিকরা যাদের মানব সম্পদ উন্নয়নের সীমারেখা বেশিরভাগ সময় প্রাথমিক শিক্ষা পর্যন্ত এসে শেষ হয়ে যায়, তাদের কাছে চা বাগানে শ্রমিক হিসাবে কাজ করা ছাড়া আর তেমন কোনো সুযোগ থাকে না। কোনো কারণে, বাগান বন্ধ হয়ে গেলে, কিছুদিনের মধ্যেই অনাহারে দিন কাটাতে হয়। আশে পাশে অন্য কোনো শিল্প গড়ে না ওঠার জন্য বা শহরে অসংগঠিত ক্ষেত্র না থাকার জন্য বা নিজেদের জমি না থাকার জন্যে, এই শ্রমিকরা জীবিকার জন্য পুরোপুরি চা বাগানের উপর নির্ভর করে। তাদের জন্য বিকল্প জীবিকার সুযোগ খুব কম।

তৃতীয় যে কথাটি বলা যায় যে, চা শিল্পের উত্তরোত্তর যে শ্রীবৃদ্ধি বা মুনাফা অর্জন তার সাথে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক শোষণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চা মালিকরা প্রায়শই বলে থাকেন যে আর্ন্তজাতিক বাজারের প্রতিযোগিতাতে টিকে থাকতে গেলে উৎপাদন ব্যয় কম রাখতে হবে। ওনারা শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া ইত্যাদি দেশের তুলনা টানেন যাদের প্রতি ইউনিট উৎপাদন ব্যয় ভারতের থেকে কম। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তাই উৎপাদন ব্যয় আরও কমাতে হবে বা বাড়তে দেওয়া যাবে না। যেহেতু চা শিল্প শ্রম-নিবিড় একটি শিল্প উৎপাদন ব্যয় কমানোর অর্থ সেই শ্রম ব্যয় কমানো। অন্যান্য যে উৎপাদন দ্রব্য ব্যবহার করা হয় যেমন সার, কীটনাশক ইত্যাদি সেগুলির দামের উপর চা মালিকদের তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই সব নিয়ন্ত্রণ এসে পড়ে শ্রমিকের উপর। মজুরি বৃদ্ধির কথা উঠলেই চা মালিকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন যে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে এবং ভারতীয় চা শিল্প মুনাফা করতে পারবে কিনা সেটা অনেকটাই নির্ভর করে চা শ্রমিকদের কতটা শোষণ করা যাচ্ছে তার উপর। এটা দূর্ভাগ্যের হলেও কঠিন বাস্তব।