আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২১ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৮

সমসাময়িক

পেরুতে বামপন্থীদের আগমন


বলিভিয়া, চিলির পর পেরুতে ক্ষমতায় বামপন্থীদের আগমন নিঃসন্দেহে শুভ ইঙ্গিত, এবং সমগ্র লাতিন আমেরিকায় যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ব্লক তৈরি হচ্ছে সেখানে গুরূত্বপূর্ণ এক সংযোজন। দীর্ঘ রক্তপাত পেরিয়ে এসেছে এই দেশ, সামরিক অভ্যুত্থান, একনায়কতন্ত্র, মাওবাদীদের শাইনিং পাথ এই সমস্ত কিছুর প্রতিক্রিয়ায় বিগত দশকগুলোতে নিহত হয়েছেন কয়েক লক্ষ মানুষ। এবার আশা করা যায় যে আস্তে আস্তে দেশটি সুস্থিতির দিকে এগোবে। যদিও বামপন্থী শাসককে উৎখাত করবার উদ্দেশ্যে আমেরিকা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে, এমনটাও আশা করা ভুল।

অনেক দিক দিয়েই পেরুর এই ফলাফল খুবই অপ্রত্যাশিত। ল্যাটিন আমেরিকার এই দেশটি প্রতিবেশী চিলির মতোই নব্য-উদারনৈতিক অর্থনীতির দুর্গ হিসেবে পরিচিত। এমনকি পেরুর বামপন্থী রাজনীতির পরিস্থিতি চিলির তুলনায়ও করুণ, কারণ চিলির ক্ষেত্রে পিনোশে শাসনের চূড়ান্ত অত্যাচারের মধ্যেও বামশক্তি গোপনে সংগঠিত হয়েছে এবং পিনোশের পতন পরবর্তীকালে দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। উলটোদিকে পেরুর বাম রাজনীতি আশির দশক থেকেই হঠকারী অতি-বাম সশস্ত্র আন্দোলনের পথে যায় এবং রাষ্ট্রশক্তির চূড়ান্ত দমন-পীড়নে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তারপর থেকেই সেদেশে বামশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছিল। সেই প্রেক্ষিত মাথায় রেখেই, এইবার পেরুর নির্বাচনে প্রতিবারের মতোই বামপন্থী শক্তিগুলিকে কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই রাখেনি। তাই পেরুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডের ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পরে যখন দেখা গেল মার্কস, লেনিন ও পেরুর বিখ্যাত মার্কসবাদী চিন্তক হোসে কার্লোস মারিয়াতেগির চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত পার্টি ‘পেরুলিব্রে’-এর স্বল্প পরিচিত প্রার্থী এক গ্রামের স্কুল শিক্ষক পেড্রো কাস্তিলো ১৯.১% ভোট লাভ করে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন, তখন স্বভাবতঃই তা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মার্তেগুইপন্থী দলের সদস্য, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক, জঙ্গী ট্রেড ইউনিয়ন নেতা পেড্রো কাস্তিলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান ২০১৭-র শিক্ষক ধর্মঘট থেকে। তাঁর মুখ্য স্লোগানঃ ধনী দেশে থাকবে না একজনও গরিব মানুষ। তাঁর অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরোধিতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে নজর দেওয়া, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের রাষ্ট্রায়ত্ত্বকরণের বার্তা বহু মানুষের কাছে, বিশেষ করে দেশের দক্ষিণে বসবাসকারী আদিবাসী জনজাতির মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা অতিস্বল্প সময়ে উল্কাগতিতে বৃদ্ধি করেছে। ধারণা করা হচ্ছে যে কাস্তিলো পেরুর সাধারণভাবে শহরকেন্দ্রিক রাজনৈতিক লড়াইকে গ্রামকেন্দ্রিক করে এবং এতদিন যে আদিবাসী সমাজের কন্ঠ চাপা ছিল, যাদের কোনো প্রতিনিধি ছিল না, তাদেরকে রাজনৈতিক যুদ্ধে একেবারে সামনের সারিতে নিয়ে এসেই কিস্তিমাত করেছেন।

এই জয় থেকে মূলত দুটো জিনিস আমাদের শেখার আছে। প্রথমত, নির্বাচনে পর্যুদস্ত হলাম কী না, জনাদেশ আমার বিপক্ষে থাকল না পক্ষে, ক্ষমতা পেলাম না পেলাম না, এই কোনোকিছুই বামপন্থীদের রাজনীতির নির্দেশিকা হতে পারে না। ভোটের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে রাজনীতির গতিমুখ পালটায় বুর্জোয়ারা, বামেরা নয়। এমনকি মানুষ এই মুহূর্তে কী চাইছে সেটাও রাজনীতির নির্দেশিকা নয়। বাম রাজনীতির নির্দেশিকা এটাই, যে এই মুহূর্তে কোন শ্রেণি-স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব সেটা করছে, এবং তা করতে গেলে কী কী দাবি তাকে রাখতে হবে। সেই শ্রেণি-স্বার্থ যদি এই মুহূর্তে দেশের নব্বই শতাংশ মানুষের পছন্দের না-ও হয়, তাতেও নিজের অ্যাসারশন থেকে সরে আশা চলবে না। মানুষ কী চায় সেটা বড় কথা নয়, মানুষকে দিয়ে আমি কী চাওয়াতে পারছি সেটাই বড় কথা। পেরুতে এতদিন ধরে বামেরা ক্ষীয়মাণ, কেউ তাদের ধর্তব্যের মধ্যে রাখেনি, এবং পেরুর সামগ্রিক রাজনীতির অভিমুখ ছিল নব্য-উদারবাদী দক্ষিণপন্থী। কিন্তু যুগের হাওয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বামেরা তথাকথিত প্রাসঙ্গিক হতে চায়নি, আর তাই সেই উদারবাদকে গ্রহণ করেনি। তারা বলেনি 'শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ', অথবা 'ভিক্ষা চাই না চাকরি চাই'। তারা বরং সংখ্যালঘু হয়েও, কোনো কোনো ভোটে এক শতাংশের কম ভোট পেয়েও বলে গিয়েছে শিল্প জাতীয়করণের কথা, শিক্ষা স্বাস্থ্যের কথা, গরীব মানুষের কথা। বেসিক রাজনীতি ঠিক ছিল তাঁদের, ছিল শ্রেণিভিত্তিও। তাই মানুষ একসময়ে বাধ্য হয়েছেন তাঁদেরই বেছে নিতে। নিজের রাজনীতিকে কোনো ভোট বা কোনো ক্ষমতার হিসেব অথবা কোনো  জনগণের চাওয়া পাওয়ার হিসেবেই বদল করা যে যায় না, বরং জোরের সঙ্গে সেই শ্রেণিকেই আঁকড়ে ধরতে হয়, পেরু আমাদের সেটা শেখাল।

দ্বিতীয়ত, কাস্তিলো হলেন হতদরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। এখনও চাষবাস করেন নিজে। এরকম প্রান্তিক অবস্থান থেকে উঠে আশা একজন মানুষ নেতা হয়েছেন, কোনো মধ্যবিত্ত নেতৃত্বের হাতে আন্দোলন বা নির্বাচনের রাশ ছাড়া হয়নি। এটা একটা বিরাট ব্যাপার। আদর্শ পরিস্থিতি তো সেটাই, যেখানে শ্রমিক কৃষকের ভেতর থেকে উঠে আসবে স্বাভাবিক নেতৃত্ব। সেটা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হবে না, এবং মধ্যবিত্তের হাতে নেতৃত্বের রাশ দেওয়া হবে না। খেতমজুর আন্দোলনের জাতীয়স্তরের নেতা নিজেও হবেন ভূমিহীন কৃষক, গ্রামীণ মধ্যবিত্ত অথবা বড় কৃষক নন; শ্রমিক আন্দোলনের জাতীয় নেতৃত্ব উঠে আসবে তৃণমূলস্তরের ফ্যাক্টরি বস্তি, রংকল, চটকল ইত্যাদি থেকে, কোনো মধ্যপদলোভী 'বাবু'র স্থান সেখানে হবে না, এরকম নানাবিধ স্বপ্ন যাঁরা দেখেন, আদর্শ বামপন্থা ব্যাপারটা কিছুটা সোনার পাথরবাটি হলেও যাঁরা শ্রেণির প্রশ্নে মোটামুটি অনাপোষী অবস্থানে থাকতেই পছন্দ করেন, পেরু তাঁদের উৎসাহীত করবে।

কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। সামাজিক কিছু প্রশ্নে, মূলত LGBTQ-সংক্রান্ত বিষয়ে কাস্তিলোর অবস্থান রক্ষণশীল। লিঙ্গসাম্যের ক্ষেত্রেও কিছু উলটোপালটা কথা তিনি বলেছেন, যার বিরোধিতা এসেছে কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর ভেতর থেকে। এসব প্রশ্নে তাঁদের অবস্থান যথাযথ করবার দায় থেকেই যায়। আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে পরিচিতির প্রশ্নও গুরূত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, সামাজিক অধিকারের বিষয়গুলোও। সেগুলোকে উপেক্ষা করা বামপন্থীদের পক্ষে সম্ভব না।

কাস্তিলো এখনই দেশের অর্থনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন করতে পারবেন কী না সেটা সময় বলবে। তাঁর দলও ছোট, এবং সামনে বিস্তর বাধা। নব্য-উদারনীতিক, দক্ষিণপন্থীদের বাধা, মার্কিন চাপ ইত্যাদি থাকবে। সেগুলোকে অগ্রাহ্য করে তিনি দ্বিতীয় স্যাভেজ বা ইভো মোরালেস হয়ে উঠতে পারবেন কী না, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাঁর জয় লাতিন আমেরিকার প্রেক্ষাপটে শুধু স্বস্তির নিঃশ্বাসই নয়, এতদিনকার দক্ষিণপন্থী শাসনের অবসান এক হিসেবে যে ক্ষমতার সমীকরণ ও মার্কিন আধিপত্যের পটপরিবর্তনের সূচক, সেটা নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়।