আরেক রকম ● নবম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২১ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

দেবেশ রায়ঃ একক স্রষ্টা ও তাঁর নিজস্ব নদী

গৌতম গুহ রায়




১৫ মে, ২০২০ থেকে ১৫ মে ২০২১, ঠিক এক বছর হলো কথোয়াল দেবেশ রায় প্রয়াত হয়েছেন। উত্তরবঙ্গ, তিস্তা ও এই অঞ্চলের জনপদের কথোয়ালের প্রথম প্রয়াণবর্ষে একবার ফিরে দেখা, বাংলা কথাসাহিত্যের অনতিক্রম্য আলোকস্তম্ভটিকে।

পাবনার পিতৃপুরুষের ভিটা ছেড়ে একদিন তাঁদের আত্মার মিনার হয়ে উঠেছিলো তিস্তাপাড়ের জনপদ জলপাইগুড়ি। এই ‘ভিটা’র টান আত্মায় রেখে, শেকড়ের সন্ধানেই তাঁর সৃজন মননের যাবতীয় নির্মাণ, স্বপ্ন, কল্পনা। এই শেকড়ের অন্বেষণে অক্লান্ত ছুটে চলা মানুষটি আত্মকথায় লিখেছিলেন, “আমাদের ছেলেমেয়েরা অনেকেই বাড়িমনা। আমাদের সেই বাড়ি, সবসময়ই স্মৃতির বাড়ি। যেন আমরা যে যেখানে আছি সেটা আমাদের বাড়ি নয়। অন্য কোথাও আমাদের একটা বাড়ি আছে। আমরা সেদিক দিয়ে স্মৃতিতাড়িত বংশ। সবসময়ই নিজেদের বাড়ি খুঁজে বেড়াই। ইহুদিদের মতো। কিংবা আফ্রো-আমেরিকানদের মতো। আমাদের বাড়িতে কোনোদিন না-জানা দেশ থেকে মানুষজন আসতেন, তাঁরা দু-একদিনের মধ্যেই আমাদের সেই আসল দেশটার আভাস দিয়েই চলে যেতেন, কিন্তু তাতে তো এটাই প্রমাণ হত নির্ভুল - আমাদের সত্যিকারের একটা দেশ আছে। ” (আত্মকথা, গায়ে গায়ে বাঁচা)

হিমালয় সন্নিহিত বাংলার তিস্তাপারের এই কথোয়ালের গল্পে মিশে থাকে তাঁর সবাক উপস্থিতি, অভিজ্ঞতার কথা, ক্রমশ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবাককথন আরো মুখরিত। যে বিকল্পহীন একান্তবর্তিতার কথা তাঁর জীবনকথায় তুলে আনছেন সেখানেও থাকে তার সময়ের স্পন্দন, হাসিকান্না, দ্বন্দ্ব, চলমান সময়তার বৈপরীত্যের সহ-অবস্থান এবং সংঘর্ষ। দেবেশ রায় তাঁর আত্মকথা ‘জলের মিনার জাগাও’-তে লিখলেন যে, “পরিবারের বন্ধনের ভেতরেও সারপ্লাসলেবার আর সারপ্লাসভ্যালুর তত্ত্বের উদাহরণ পান তিনি। আশংকার সঙ্গে তিনি সেই সরলীকরণের উল্লেখ করেন যেখানে মানুষের সামাজিক বিকাশের ধারাকে কতগুলো অনড় স্তরে ভাগ করে ফেলা হয়। উল্লিখিত একান্তবর্তিতার সঙ্গে সরলরেখায় এনে ফেলেন সমাজ বিকাশের বাঁক ও ঝোঁককেও; বেশ জটিল একতা বাঁচাতে যদি আদিসাম্যতন্ত্র, উপজাতীয়-জাতীয় এই সব লেবেল সাঁটা হয় তাহলে মানুষজনের নানারকম ঝোঁক, ভালোলাগা, ভালোবাসা, খারাপবাসা। অভ্যেস এইসব ক্যাটালগিং করে ফেলা হয়। ইট কাঠ পাথরের ক্যাটালগিং করা জীবন থেকে ফাঁক পেলেই ফিরে আসতে চান তিনি এই ডুয়ার্সের সবুজে। কৈশোরের শহর জলপাইগুড়িতে স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে বেরানো এই মানুষটার ভেতরে তার নিজস্ব যে ভুবন তা তার বেড়ে ওঠার জগত, নিজের কথায় যেমন লিখেছেন, ‘দেশ-বিদেশের কোথাও আমার বাড়ির হদিস করলে আমি জলপাইগুড়িই বলি। ম্যাপে জলপাইগুড়ি বের করা মুস্কিল। আমি তখন, পূর্ব হিমালয়ের নেপাল-সিকিম-ভুটানের অপর আঙ্গুল চালাই”।

ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এই ‘নাড়ীর টান’এর শহর জলপাইগুড়ি থেকে ২০০০-এর সূচনায় পাকাপাকিভাবে ‘শেকড় ছিঁড়ে’ চলে যান তাঁরা। কিন্তু শেকড় ছেঁড়ার অদ্ভুত যন্ত্রণা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, উত্তরের কথায় সেই যন্ত্রণা তাঁর চোখমুখে টের পাওয়া যায়। ১৩-১৪ বছর আগে তাঁর আত্মজীবনীধর্মী গদ্যে দেবেশ রায় লিখেছিলেন, ‘কলকাতার ফ্ল্যাট বাড়িতে আমাদের বিকেলটা-সন্ধ্যেটা একটু নিঝুম।... কাকলি বাড়িতে থাকলে গানের গুঞ্জন শোনা যায় একটু, না থাকলে তা নয়। সেই সময় বাইরের আকাশে সন্ধ্যে হওয়া, রাতপোকাদের প্রথম আওয়াজ ও সকাল জুড়ে পাখিদের দলবাঁধা পারাপার শোনা যায়। ঘরের চেয়ারে বসে বসেই অনেকটা বেড়ানো যায়। শুনেছি মাত্র বিশ ধাপ ওপরে বিশাল ছাদ সারা আকাশময় ও ভ্রমণ সম্পন্ন। ঐ বিশটি ধাপ পেরোতে পারি না।” তাঁর প্রয়াণের এক বছর আগেই কাকলি রায় চলে গেছেন।

বাংলা ভাষার পাঠক তাঁর স্পর্ধাকে কুর্ণিশ করে যিনি লিখিতে পারেন, ‘লেখককে প্রত্যাখ্যান করার শক্তি ও অধিকার লেখকের না থাকলে, পাঠক পাঠক হয় না। আর পাঠককে প্রত্যাখ্যান করার শক্তি ও অধিকার লেখকের না থাকলে, লেখক লেখক হতে পারে না। তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস প্রসঙ্গেও তিনি কোনো কৌশল আড়াল রাখেননি, “এই বিশ্বাসটুকু রাখার জন্য এই একটিমাত্র জীবনে কত অবিশ্বাসের সঙ্গে লড়ে যেতে হল আর সে তো সব একটু আধটু অবিশ্বাস নয়, দেব-দানবের মিলিত শক্তির সমান অবিশ্বাস। মার্কসবাদ এমনই এক নিখাদ বিজ্ঞান যে চাইলেও তার অন্ধ ভক্ত হওয়া সম্ভব নয়। বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় লক্ষণ নির্দিষ্টতা আর নির্দিষ্টতা যদি অনতিক্রম্য হয়, তাহলে সেখান থেকেই তৈরি হয় তার নিত্যসত্যতা।” মনে পড়ে যায় গত বর্ষায় জলপাইগুড়িতে এক সান্ধ্য আড্ডায় বলা তাঁর কথাগুলো, “আমার উপন্যাস লিখবার একমাত্র কাজ যদি হয় ব্যক্তির ঐতিহাসিকতা তা হলে আমাকে আর একটা শক্তিতেও বিশ্বাস করতে হয় যে শক্তির ইতিহাসটা তৈরি করতে পারে। ব্যক্তি, দেশ ও কালের সীমা অতিক্রম করেও সেই শক্তি সক্রিয় থাকতে পারে। সেই শক্তিটা কমিউনিস্ট পার্টি। ব্যক্তির একটা ইতিহাস আছে এটা যদি বিশ্বাস করি, তাহলে সে ইতিহাস আরো বড়ো একটা ইতিহাসের অংশ এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হয়”। অসাম্প্রদায়িক ও সাম্য সমাজের বিশ্বাসে তার আস্থা ছিল, এই জন্য লড়াইয়ে থেকেছেন আমৃত্যু। আমরা এই বিশ্বাসের অনুরণন শুনি তাঁর প্রতিটি বৃত্তান্তে, যেখানে আখ্যান হয়ে ওঠে সময়ের দলিল। আমাদের নিঃস্ব করে চলে গেলেন এই আখ্যানকার। যে পাঠক শুধুই বিনোদন চান, রহস্য রোমাঞ্চের মোহ চান, কাহিনির চটকদার ঘটনাবিন্যাস খোঁজেন, সে পাঠক দেবেশ রায়ের পাঠক নন। তাঁর আখ্যানের চরিত্ররা বিপন্ন অসহায় প্রান্তিক মানুষজন, মহানগরের বিছিন্ন মানুষ, একক মানুষ। এদের তিনি অনুসন্ধান করেছেন, তাঁর পাঠকদের টেনে নিয়ে গেছেন সেখানে, সেই সমাজ ও রাজনীতির আঙ্গিনায়। এই পথে ভারতীয় কথাসাহিত্যের প্রচলিত বা ঔপনিবেশিক আবেশ জাত মডেলকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন, গড়ে তুলেছেন নিজস্ব আখ্যানরীতি। ভারতীয় এই আখ্যানরীতি তিনি শুধু সৃজনে করেননি, যুক্তিতে তার প্রতিষ্ঠা করেছেন উপন্যাস নিয়ে লেখা অজস্র প্রবন্ধে।

উদবাস্তু না হয়েও বারংবার আস্থানা পরিবর্তনের বাধ্যবাধকতায় আক্রান্ত দেবেশ রায়-কে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে সেই শেকড় ছেঁড়া স্মৃতির যন্ত্রণা। ছোটবেলা থেকেই বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অভিযাত্রা তার, শৈশবের গ্রামের স্মৃতি, কৈশোরের জলপাইগুড়ির ও তিস্তার স্মৃতি, রাজনৈতিক কর্মজীবনের স্মৃতি, সব নিয়ে এক স্মৃতির ভান্ডার তাঁর, যাকে নিয়েই তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নির্মাণ, স্তর থেকে স্তরান্তরে উত্তরণ। রাজনৈতিক কর্মীজীবন তাকে পরবর্তীতে রসদ দিয়েছে, তিস্তা ও সন্নিহিত অরণ্য, কমিউনিস্ট পার্টি তার অনেকটা জুড়ে ছিলো, দেশভাগ, পার্টি ভাগ সবকিছু তাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিলো, এই স্মৃতির রসদ তাঁর সৃজনে তিনি যুক্ত করেছেন, তাঁর এই কথা মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায়কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বলেছেন, “আমি খুব ছোটবেলা থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি করেছি। কমিউনিস্টদের মধ্যেই বরাবর আছি, কখনো বাইরে থাকিনি। আমি প্রথম আরেস্ট হয়েছিলাম ১৪ বছর বয়সে, ১৯৫০-এ কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি হলে। ...কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে থাকার ফলে, খাদ্য সংকটের ফলে, লোকজনের ভিতরে ঢুকে যাওয়ার ফলে, এখন হয়তো আমি লেখার কোনো কোনো সময় খুব করুণ এবং খারাপ অবস্থাতেই রসিকতা করে ফেলতে পারি। এটা আমার পক্ষে সম্ভবই হত না যদি আমি ওই চালের লাইনের অভিজ্ঞতা ও কমিউনিস্ট পার্টির ভিতর দিয়ে না আসতাম।” এর আগে লিখেছিলেন, “দেখতে দেখতে উত্তাল ছেচল্লিশ এল। সেই দূর মফস্বলেও এসে আছড়ে পড়ল নৌ বিদ্রোহের ঢেউ, আইএনএ মুক্তির দাবি, রসিদ আলি দিবসের শ্লোগান, ডাক-তার ধর্মঘট,আরো কত কী! সেই ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের মধ্যে দম ফেলার মত অবকাশ ছিলো না। আমি তখন বড়জোর ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ি। সেই সব সময়ে আমার বন্ধুরা মিলে আমাকে কমিউনিস্ট বানিয়ে দিল। ব্যঙ্গ বিদ্রুপ, ঠাট্টা তামাশার লক্ষ হয়ে আমি একা একা কমিউনিস্ট হয়ে গেলাম। সেই একা একা কমিউনিস্ট আমাকে অনেক দিন থেকে যেতে হল। ...আমারই মতো আরো কয়েকজন একলা কমিউনিস্ট শহরের রাস্তা দিয়ে চোঙা ফুঁকে চেঁচাতে চেঁচাতে গেলাম... আর হঠাৎ সেই বালক মনে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হল, আমি আর একলা কমিউনিস্ট নই, আমি কখনই একলা ছিলাম না”।

প্রথম লেখা প্রকাশ ১৯৫৫- প্রয়াণ ২০২০ মে, ৬৫ বছর ধরে এই কলম যোদ্ধার অক্লান্ত লড়াইয়ের শেষে রণক্ষেত্রে একা-একাই নিঃসঙ্গ দহনে পঞ্চভূতে লীন হয়েছেন। কিন্তু গোটা বাংলা ভাষা বিশ্বের যোদ্ধাদের জন্য যুদ্ধের অস্ত্র রেখে গেলেন, তার আখ্যান, তাঁর প্রবন্ধ, তাঁর সমাজভাষ্যের আয়ুধ। স্বতন্ত্র এক আখ্যানবিশ্ব তৈরি করেছিলেন দেবেশ রায়, এক অপার বিস্তৃতির দ্বার উন্মোচন করেছিলেন বাংলা গদ্যসাহিত্যের জন্য। লোকজীবনের প্রান্তিক বাস্তবতাকে তিনি সম্যক উপলব্ধির থেকে তুলে এনেছিলেন, উপন্যাস নিছক কাহিনির বিন্যাস থাকেনি, ব্যক্তির আলেখ্য থাকেনি সেখানে। তার নিজের ভাষায়, ‘ব্যক্তির ইতিহাস মানে ব্যক্তির জীবনী নয়। সেই জীবন যে ইতিহাসের অংশ সেই ইতিহাসে সেই ব্যক্তিকে স্থাপন করাই উপন্যাসের কাজ।” এই অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির ফসল ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’, ‘তিস্তা পুরান’-এর মত ব্যাপ্ত ও বিস্তৃত আখ্যান, অথবা ‘আপাতত শান্তি কল্যান হয়ে আছে’, ‘মানুষ খুন করে কেন’-র মতো লেখার উপকরণ ও ভিত সে সময়েই তৈরি। ১৯৫৩-তে জলপাইগুড়ির পত্রিকা ‘জলার্ক’এ প্রকাশিত ‘নিশিগন্ধা’ তার মুদ্রিত প্রথম লেখা, এরপর তিস্তাকে নিয়ে লেখেন ‘মৃতদংশন ও বিপজ্জনক ঘাট’। গোটা জীবন বহন করেছেন একটি নদীকে, এই নদীর জল হাওয়া মাটির মানুষের স্মৃতি।

দেবেশ রায়ের গত দু-তিন দশকের লেখালেখিতে স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ও বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায়। আত্মজীবনী গোছের লেখাও অনবরত লিখে চলেছেন। আত্মকথা ‘জলের মিনার জাগাও’ প্রসঙ্গে লিখেছেন। “এই লেখাটিতে, আমার সেই বয়সের কথা, যে শৈশব শুধু স্মৃতিই সঞ্চয় করতে থাকে আমার পরের বয়সের কথা, যে যৌবনে শুধু প্রমাণ তৈরি করতে হয় তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল, আমার বেশ ভালোই লাগছিল, যেমন, তখন সেই শৈশবের জলস্রোতের দৃশ্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ৭৫ সাল পর্যন্ত জলপাইগুড়ির অনিবার্য জনজীবন। জলপাইগুড়ির বনাচ্ছন্ন জনজীবনে কোনো কার্যকারণ ছিল না।... ব্যাপারটাতো এমন হতে পারেনা যে দেশভাগের ফলে, তিস্তার বন্যা বেড়ে গেল। কিন্তু ঘটনাক্রমে তাই দাঁড়িয়েছিল। ১৯৫০ সালের আগে তিস্তা কখনো শহরে ঢুকেছে - এমন দেখিনি। ১৯৫০-এর পর যেন বছর বছর তিস্তা তার খাত থেকে উঠে শহরের ভিতর ঢুকে পড়ত। আমাদের বাড়ি ছিল তিস্তা থেকে অনেকটাই দূরে, মাইল দূর তো হবেই, ঘুম থেকে উঠে দেখতাম তিস্তার ঘোলা জল তীরবেগে বয়ে যাচ্ছে আমাদের রোয়াক ছুঁয়ে, বয়ে যাচ্ছে দক্ষিণে।

..৫২তে আমি কলেজে ঢুকেছি। তখন আমার বাসা বদলে এলাম তিস্তার মাইলখানেকের মধ্যে। তখনো সেই বছরে দু-এক দিন তিস্তার জল এসে দরজা ঠেলত। এই সময়কার এই এক আশ্চর্য ব্যাপার যে তিস্তা সবসময় গভীর রাতে শহরে ঢূকত।... এই তিস্তাকে নিয়ে তাঁর প্রথম গল্প ‘মৃতদংশন ও বিপজ্জনক ঘাট’, সেখান থেকে শুরু ধরলে সেই জলস্রোত আজও বহমান। তিস্তাকে নিয়ে দেবেশ রায়ের লেখলেখি অফুরন্ত। ‘তিস্তা’ প্রসঙ্গেই তাই তিনি লেখেন “বিপজ্জনক ঘাট... নামে একটি গল্পই তিস্তাকে নিয়ে আদি লেখা। যখন লিখছি তখন তিস্তাকে চিনতামই না। খুব টানতো তিস্তার বিস্তার, চর আর স্রোত। সেই স্রোত পেরনোর শক্তি, যৌবন ও দক্ষতা। এই টানটার ভিতর রোমান্স ছিল। রোমান্স ছাড়া তো আর কোনো গল্পই গল্প হয় না। কিন্তু এখনো নিশ্চিত জানি না - জানা সম্ভবও নয় - সেই রোমান্সের উৎস কোথায়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কিছু গল্প উপন্যাসই নয়তো। সেগুল থেকেই একটা ধারণার অনড়তা তৈরি হয়েছিল?... তখন তিস্তায় আমি নিমজ্জিত। তখন তিস্তা আমার আয়ুধ হয়ে উঠছে। তখন, তিস্তা পৃথিবীর যে কোনো নদীর সমস্পর্ধী। এ এক অদ্ভূত বৈপরীত্য। তিস্তা যখন আমাদের ঘরের সিঁড়িতে বা দরজাতেই তখন সে দৈনন্দিন অংশ হয়ে যায়। সে আর অচেনা থাকে না, আর, যখন সে অচেনা তখন সে দৈনন্দিন আর অচেনার এই দ্বন্দ্ব আমার মিটল না।... তখন তো স্মৃতি এসে বাস্তবের দখল নিয়েছে। তখন তো আমার শৈশবের সেই পুকুরগামী জলপ্রপাত দিগন্তগামী হয়ে তিস্তার জলপ্রলয় হয়ে উঠছে। তখন তো আমি আমার শৈশবের জলস্রোতকে ফিরে পেয়েছি। স্মৃতি বড় কঠিন অসুখ। সে আগুনে লোহা গলে যায়”।

বাংলা তথা ভারতীয় কথা সাহিত্যের এই বটবৃক্ষটির ছায়ার ব্যাপ্তি যেমন ছিল অনেকটা নিয়ে তেমনি এর একক নিঃসঙ্গতা ছিলো অনেকটা জুড়ে। একাকিত্বকে তিনি তাঁর লেখার শক্তি করে তুলতেন। গভীরভাবে ডুব দিতেন পড়াশোনায়। তার রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথী বা তাঁর আস্থার জায়গাগুলো থেকে ‘বেদনা’ই ছিলো তাঁর অর্জন। এক বিষন্ন দিনের সাক্ষাৎকারে দেবেশ রায় বলেছিলেন, ‘সংস্কৃতে ‘বেদ’ কথাটির অর্থ জ্ঞান... জানা... যা থেকে ‘বিদ্যা’। বিস্ময়ের কথা যেটা... সেটা হচ্ছে এই একই ধাতু থেকে। ‘বেদনা’। আমি পড়াশোনা করেছি আমার নিজের ক্ষমতার মধ্যে যতটা সম্ভব। কোনো কিছুকেই আমার মনে হয় না যে এটা আমার বিষয় নয়। কিন্ত... তার মানে আমি যে সব বিষয়ের যোগ্য তা তো নয়। আমি সায়েন্স জানি না। অংক জানি না। ইংরাজী-বাংলা ছাড়া কোনো ভাষা জানি না। এবং আমি যতটাই পড়াশোনা করেছি, জ্ঞান চর্চাতে পরিত্রাণ খুঁজেছি ততটাই বেদনা নিয়ে ফিরে এসেছি।...”

নিজেকে বলতেন ‘কথোয়াল’, এই দেবেশ কথোয়াল কলম ধরলেই মাথায় চেপে বসতো স্মৃতিতে গেঁথে থাকা মানুষজন, যে চোখ দিয়ে তিনি এই পরিব্যাপ্ত লোকজীবনকে দেখেছেন এবং যে সহৃদয় মনষ্কতা দিয়ে - তাকে হৃদয়ঙ্গম করেছেন তার প্রতি দায়বোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেন না। ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থবোধ সেখান থেকে তাঁকে বিচ্যুত করতে পারে না। যেখানে তিস্তা নদী বা আপেলচাঁদ ফরেস্ট নিছক জলস্রোত বা গভীর অরণ্য নয় এ যেন সেই লোকজীবনের অংশ যা গ্রামে, বন্দরে, নগরে ব্যাপ্ত। যার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস দেবেশ রায় অনুভব করেন, পাঠককে সেই ধ্বনির কাছে নিয়ে যেতে চান। ‘ধরো, একজন রাজবংশী কৃষকের বাড়িতে বসে আছি।... শহর থেকে গেছি, পাঁচ ছয় দিন থাকব। বাইরের আঙিনায় দুয়েকটি গাছটাছ থাকে, তার নীচে বাঁশের মাচাটাচা থাকে। সেখানে একটু বসেছি, কিছুক্ষণ পর হঠাৎ আমি একটা শব্দ সম্পর্কে সচেতন হলাম। যেটি আমারই হৃৎপিণ্ডের শব্দ। নীরবতা ও নৈঃশব্দ এমনই গভীর যে হৃৎপিন্ডের শব্দ শোনা যায়।”

বারংবার আস্তানা হারানো এই নিঃসঙ্গতার অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ দেবেশ রায়ের শেকড় সমাজের গভীরে প্রথিত। তাই তিনি লিখতে পারেন, ‘দেশ গাঁ জন্মভূমি যদি ঘন্টার পর ঘন্টায় নতুন নতুন বন্যায় ডোবে আর ডাঙ্গায় ভাসে, কেমন করি ঘাটা-আঘাটা চিনিবারে পাস?” সময় বিষয় হয়ে ভিত তৈরি করে তাঁর কাহিনিতে, আখ্যানে, কথায়। এই ভিত ক্রমশঃ বিস্তৃত হতে হতে দিগন্তের রেখা মুছে দেয়। আর এই দেবেশহীন দিনে বাংলা ভাষার দিগন্ত জুড়ে সেই একক কথোয়ালের তুর্য ধ্বনি শুনতে পাই। মৃত্যুর বর্ষ অতিক্রমের পরেও সেই ধ্বনি অভ্রান্ত।