আরেক রকম ● নবম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২১ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

তোমাকে একটু বুঝতে ইচ্ছে করে...

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী


খুব অ্যাসিডিটি হয়ে গিয়েছে ডাক্তারবাবু। গলার কাছে জ্বালা ভাব। কী করি? এই প্রশ্নটা হোয়্যাটসঅ্যাপ করার প্রায় আধঘন্টা পরে আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়নের কাছ থেকে উত্তর পেয়েছিলাম। একটা ছবি। প্রথমে মনে হয়েছিল, সাদা পাতার উপরে শবাসনে এলিয়ে রয়েছে কালো রঙের চাউমিনের মতো কিছু একটা। উত্তর দিলাম, না না ডাক্তারবাবু, উলটোপালটা কিছু খাইনি। তাও হল জানেন। এবারে একটা টাইপ করা উত্তর এল। লিখলেন, ওমিপ্রাজোল লিখে দিলাম তো!

পরিচিত এক প্রতিবেশী ডাক্তারের কথা জানি। বাড়ির কাজে সাহায্য করার জন্য একজন চব্বিশ ঘন্টার লোক রেখেছেন। ডাক্তারবাবু নাম করা কার্ডিওলজিস্ট। যখন ব্যস্ত ছিলেন না এত, তখনও বাজার করতে বড় ভালবাসতেন। রোগী দেখতে যাওয়ার আগে এখনও প্রতিদিনের বাজারের ফর্দটা নিজের হাতে নিয়ম করে গুছিয়ে করে দেন। কাজের লোকটি সবার প্রথমে সেই ফর্দ নিয়ে যায় পাড়ার মোড়ের ওষুধের দোকানে। গড়গড় করে সেই লিপি পড়তে শুরু করেন এ যুগের রাখালদাস। মানে বন্দ্যোপাধ্যায়। বিনিময়ে পাঁচটি টাকা রাখেন। সকাল সাড়ে সাতটায় এভাবেই দোকানের বৌনি হয় রোজ।

এদিক ওদিক থেকে প্রায়ই শুনি, চিকিৎসকরেরা বড় হন যত, তাঁদের হাতের লেখাও নাকি পাল্লা দিয়ে দুর্বোধ্য হয়ে যায়। আমার এক জেঠু আছেন, যিনি গলব্লাডারের সমস্যায় তিন জন ডাক্তারের মতামত নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত শুনেছিলেন দ্বিতীয় ডাক্তারের উপদেশ। কারণ সেই হাতের লেখাই। দ্বিতীয় ডাক্তারবাবুর প্রেসক্রিপশনের একটা শব্দও জেঠু উদ্ধার করতে পারেননি। তিনি সম্ভবত এই কারণের জন্যই বয়স্ক মানুষটির মনের ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। জেঠুর কাছে প্রায়ই শুনতাম, হাতের লেখা পড়া গেলে সে আসলে কোনও ডাক্তারই নয়।

শহরের পাঁচতারা হাসপাতালের ওপিডিতে এক রোগীকে গজগজ করতে শুনেছিলাম। ভদ্রলোক প্রায় ঘন্টাদুয়েক অপেক্ষা করার পরে ডাক্তারবাবুর দেখা পেয়েছিলেন। দামী পেন দিয়ে খসখস করে যে ওষুধ লিখেছিলেন, এক বর্ণও বুঝতে না পেরে ডাক্তারবাবুকে শুধিয়েছিলেন, কিছুই বুঝতে পারছি না স্যার। একটু বলে দেবেন? চিকিৎসক বলেছিলেন, আপনার বুঝে কি লাভ? ফার্মেসিতে নিয়ে যান, ওরা বুঝে নেবে। অনেক পেসেন্ট আছে, প্লিজ। রোগী ফার্মেসিতে গেলেন। সেখান থেকে শুনলেন, স্যার বিদেশে দেড় মাস কি একটা ট্রেনিং করে আসার পর হাতের লেখাটা আরও খারাপ হয়ে গিয়েছে। ক্ষমা করবেন। পাঁচটা ওষুধের মধ্যে তিনটেই মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। বয়স্ক রোগী ওপিডিতে এসে সে কথা জানানোয় আবার তাঁকে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল ঘন্টাখানেক। প্ল্যাকার্ডের মতো করে প্রেসক্রিপশনটা তুলে গর্জেছিলেন, একটা অক্ষরও কি ধরতে পারছেন আপনারা? এটা কি ইংরিজি? এঁদের কি খারাপ লেখার ট্রেনিং দেওয়া হয়?

ডাক্তারবাবুদের সামনে নতজানু হয়ে বসে হাতের লেখার এই রহস্য জানতে চাইলে নানা উত্তর পাওয়া যায়। ওঁরা বলেন, পৃথিবীর অধিকাংশ জীবিকা থেকেই হাতে লেখার অভ্যেসটা যখন কমে যাচ্ছে ক্রমশ, চিকিৎসাধর্মে এই কম লেখার কোনো অবকাশ নেই। বরং, দিন যাচ্ছে যত, লেখার পরিমাণ যেন বেড়েই চলেছে। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে কথা বলে ধমকের সুরে জেনেছি, দিনে আড়াইশ রোগী দেখলে আর প্রতিটা রোগীর জন্য একটা একটা করে প্রেসক্রিপশন লিখলে হাতের লেখা তো ক্যালিগ্রাফি হবে না মশাই। আমার যেমন খুশি আমি লিখব। বোঝাটা রোগীর হেডেক। আমার নয়। সেই ডাক্তারবাবু যখন হাসপাতালের পাট চুকিয়ে বাড়ি গিয়ে রোগী দেখতে বসেন ফের, তখন তাঁর হাতের লেখাটা হাসপাতালের থেকে আরও একটু বেশি বোধগম্য হয় কি না জানার বড় শখ হয়েছিল। সাহসে কুলোয়নি। ডাক্তারবাবুরা বলেন, শুধু প্রেসক্রিপশন লিখেই যদি তাঁদের লেখার কাজ শেষ হয়ে যায় বলে ভাবতে বসি আমরা, তাহলে একটা মস্ত ভুল হবে। রাউন্ডে গেলে প্রতিটি রোগীর যে মেডিক্যাল রিপোর্ট লিখতে হয়, সেগুলো লেখে কে? ভাল করে লেখার সময় কই? চিকিৎসক মহলের এক পক্ষ অবশ্য বলেন, ভাল হাতের লেখায় এসব লিখে লাভ কি? স্পষ্ট অক্ষরে লিখলেই গুগল পাশ করা রোগীর প্রশ্নের বান ধেয়ে আসবে একের পর এক। তখন এগুলো সামলানোর দায় কার? ফালতু সময়ের অপচয়। সুতরাং, ওষুধের দোকানদার হাতের লেখার মানে বুঝলেই যথেষ্ট।

মনে স্বাভাবিকভাবেই একটা হিজিবিজবিজ প্রশ্ন আসে। যাঁদের এই হস্তাক্ষরের মানে বোঝার কথা, তাঁদের সকলেই তা বুঝছেন তো? বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া করে জানা গেল, এই সমস্যা শুধুমাত্র কোনও দেশকেন্দ্রিক নয়, খারাপ লেখা ও তার পাঠোদ্ধারের এই মিসিং লিংক ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বজুড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইওএম অর্থাৎ ইনস্টিটিউট অফ মেডিসিন বলছে, সেদেশে বছরে প্রায় ৭ হাজার রোগীর মৃত্যু হয় শুধুমাত্র না বুঝতে পারা প্রেসক্রিপশনের জন্য। ডাক্তারবাবু হয়তো লিখেছেন এক। ওষুধের দোকানি নিজের মতো করে তার মানে করে রোগীর হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন অন্য কোনো ওষুধ। পরিণাম প্রাণঘাতী হয়েছে। ভারতবর্ষে এমন সমীক্ষা কতটুকু হয়েছে তা জানা নেই।৭ হাজার সংখ্যাটা এ দেশের নিরিখে হয়তো তুচ্ছ।

মেডিকেল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া অর্থাৎ এমসিআই, ২০১৬ সালেচিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন লেখার ব্যাপারে কয়েকটা নিয়ম বলবৎ করার চেষ্টা করেছিল। বলা হয়েছিল, ওষুধ লিখতে হবে জেনেরিক নামে। লিখতে হবে বড় হাতের অক্ষরে। বছরকয়েক আগে অসমের একটি ঘটনা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রখ্যাত নিউরোসার্জেন ড. নোমাল চন্দ্র বোরার একটি লেখা থেকে জানতে পারলাম, এক রোগিনী ভর্তি হয়েছিলেন অসমেরই এক হাসপাতালে। এর আগে দিল্লিতে যে চিকিৎসককে তিনি দেখিয়েছিলেন, তিনি প্রেসক্রিপশনে লিখেছিলেন ডুয়োডিল নামের একটি ওষুধ, যা প্রধানত অ্যানালজেসিক। হাতের লেখা এমন সুপাঠ্য ছিল যার ফলে ওষুধের দোকান থেকে রোগীকে উপহার দেওয়া হল ডাওনিল নামের এক পথ্য, যা আসলে মধুমেহ রোগীদের জন্য ব্যবহার করা হয়। এর ফলে ওই রোগিনীর রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যেতে শুরু করে হু হু করে। এমন ঘটনা ঘটছে আকছার। রোগী কোনো কারণে প্রভাবশালী হলে তাঁর বিষয়টি খবর হয়। তবে অপাঠ্য প্রেসক্রিপশনের শিকার হওয়া যাঁদের কথা আমরা জানতে পারি, তার থেকে অনেক বেশি রোগীর গোঙানির শব্দ থেকে যায় আমাদের অগোচরেই।

ডাক্তারবাবুদের প্রেসক্রিপশন একজন রোগী কিংবা তাঁর পরিবারের কাছে অন্ধের যষ্টির মতো। নামী হাসপাতালে দামি কোনও চিকিৎসক যখন তাঁর প্যাড থেকে প্রেসিক্রিপশনটি ছিঁড়ে দেন, তা রোগীর কাছে এক মুহূর্তে হয়ে যায় বেঁচে থাকার ব্লুপ্রিন্ট। সঙ্কটের মুহূর্তে এক চিকিৎসক কোনো রোগীর কাছে ঈশ্বরের ঠিক পরের জায়গাটা দখল করে নেন, সঙ্গত কারণেই। অপারেশন থিয়েটারে যখন কোনও মুমূর্ষু রোগীর জটিল অস্ত্রোপচার হয়, তখন রোগীর পরিজনদের মনে প্রথম জায়গা দখল নিয়ে ঈশ্বর ও চিকিৎসকের মধ্যে কোনও টাগ অফ ওয়ার হয়? হয়তো হয়। কে জানে! আমরা জানি, ওষুধ রোগ সারাতে পারে, কিন্তু একজন রোগীকে সারাতে পারেন ডাক্তারবাবুই। বহু রোগী আছেন, সুস্থ হয়ে ওঠার পরে অনেকটা পথ উজিয়ে ফের সেই চিকিৎসকের কাছে আসেন শুধুমাত্র একবাক্স মিষ্টি পৌঁছে দেওয়ার জন্য। ডাক্তারবাবুদের জন্য মানুষের এই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মেশানো সম্মান আজকের নয়।

যে লেখাগুলো অন্ধকারের মধ্যে থাকা একজন মানুষের কাছে টর্চের আলোর মতো, জিপিএস-পূর্ব যুগের পথ হারিয়ে ফেলা কোনো নাবিকের কাছে লাইটহাউসের দ্যুতির মতো, সেগুলো কি আরও একটু সহজবোধ্য করার কথা ভাবা যায় না? একটি প্রেসক্রিপশন তো শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক সমাধান লেখা এক টোটকাপত্র নয়, রোগীর যদি রোগ আরও জটিল হয়, যদি অন্য কোনো চিকিৎসকের কাছে যেতে হয় দ্বিতীয় মতামত অর্থাৎ সেকেন্ড অপিনিয়নের জন্য, কিংবা তৃতীয়, তাহলে তো পরের ডাক্তারবাবু আগের যাবতীয় প্রেসক্রিপশন দেখতে চান। রোগীর কেস হিস্ট্রি তৈরি করার জন্য প্রেসক্রিপশনের প্রতিটা পাতা কাজ করে এক এক অধ্যায়ের মতো। পরম আদরে সাজিয়ে রাখা ফাইল যখন অন্য চিকিৎসকের হাতে তুলে দেন কোনো রোগী, দেখা যায়, দ্বিতীয় ডাক্তারবাবুই প্রথম জনের হাতের লেখা উদ্ধার করতে পারছেন না। এমন অভিজ্ঞতা কম বেশি সবারই হয়েছে। দুঃখের কথা, যে অভিজ্ঞতার ঝুলি শূন্য হলে ভাল হত, দিন যাচ্ছে যত, তা উপচে পড়ছে।

ভুল চিকিৎসার অস্বস্তিকর রেশ যখন আদালত অবধি গড়ায়, অনভিপ্রেত কোনো ঘটনায় রোগী ও চিকিৎসক যখন দুপক্ষই যখন একে অন্যকে আড়চোখে, অবিশ্বাসের চোখে দেখে, তখন অনেকসময়ই কাঠগড়ায় ওঠে দুর্বোধ্য প্রেসক্রিপশন। দেশে মেডিকো-লিগাল মামলার সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সম্প্রতি এমন একটি মামলা ওড়িশার এক আদালতে উঠলে সে রাজ্যের হাইকোর্টের বিচারপতি এস কে পাণিগ্রাহী বলেছিলেন, মেডিকো লিগাল মামলার জট আরও জটিল করার প্রবণতা পুরোমাত্রায় রয়েছে মেডিক্যাল রেকর্ডের দুর্বোধ্য হস্তাক্ষরের মধ্যে। মেডিক্যাল রেকর্ডের অত্যন্ত খারাপ হাতের লেখার মর্ম উদ্ধার করার জন্য ওই মামলায় আদালতকেও অন্য জায়গা থেকে সাহায্য নিতে হয়েছিল। বিরক্ত বিচারপতি জানিয়েছিলেন, আদালত মনে করে, চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে জড়িত যাঁরা, হাতের লেখা বোধগম্য করার জন্য যদি তাঁদের আরও বেশি ‘পরিশ্রম’ করার প্রয়োজন হয়, খাটতে হয়, তা করতে হবে।

সামাজিকভাবে এক চিকিৎসক যখন একজন রোগীর থেকে অনেকটা উঁচু চেয়ারে বসে থাকেন, তখন সেই ডাক্তারবাবুকে কিছু বলার জন্য অসুস্থ মানুষটিকে কিংবা তাঁর পরিজনদের একটা টুলের উপরে দাঁড়াতে হয়। রোগীর পরিবারের চারদিকে প্রভাবের নিয়ন না থাকলে এই টুল সহজলভ্য নয়। নতুন নিয়ম চালু হয়েছেডাক্তারবাবু, বড় হাতের অক্ষরে, বোঝা যায় এমন অক্ষরে প্রেসক্রিপশন লিখতে আপনি বাধ্য—টেবিলের অন্যদিকে বসে এ কথা বললে তা ডাক্তারবাবুর কানে পৌঁছবে না। পৌঁছলেও বিনিময়ে হয়তো পাওয়া যাবে পাত্তা না দেওয়া, তুচ্ছ করা এক অভিব্যক্তি। হয়তো সেই মুহূর্তে কলমটা বন্ধ করে ক্লিপটা পকেটে ঢুকিয়ে চিকিৎসক বলে উঠবেন, তাই নাকি! অন্য লোকের কাছে গিয়ে দেখান প্লিজ। রোগীর মনে সঙ্কোচ বুড়বুড়ি কেটে জানান দেবে, ছোট মুখে বড় কথা বললে যদি আমায় মন দিয়ে না দেখেন ডাক্তারবাবু? যাঁরা চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রক, তাঁরা কি এ নিয়ে আরও একটু কঠোর হতে পারেন না? যে চিকিৎসক রোগীকে চার মিনিট দেখে প্রেসক্রিপশন লিখতে তিরিশ সেকেন্ড সময় নেন, নেই আধ মিনিটটা হয়তো সেক্ষেত্রে এক মিনিট হবে। নদীর পাড়ে ঢেউয়ের মতো যে অক্ষরগুলো শুয়ে থাকত এতদিন, বড় হাতের অক্ষরে লিখলে তা হয়তো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখবে। চিকিৎসক ও ফার্মেসির মধ্যে যে কোডিং-ডিকোডিংয়ের খেলা চলে, অক্ষরগুলো সেই কাঁটা দেওয়া বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে হয়তো সহজবোধ্য হবে সবার কাছে।

এই লেখাটাকে একটু রোদে তাতিয়ে নিয়ে বলা যায়, দিনের শেষে চিকিৎসাও তো একটা পরিষেবা। পরিষেবা দিচ্ছেন যিনি, তিনি সমাজের উঁচু তলার বাসিন্দা হলেও পরিষেবাই তো। রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে যদি মানে না বোঝা কোনও বিল পাই, শপিং মল থেকে বাজার করার পরে যদি হাতে গুঁজে দেওয়া হয় মাথামুন্ডু উদ্ধার না করতে পারা কোনও ইনভয়েস, তা হলে যে ক্ষোভ হয়, এক্ষেত্রেও মনে সেই বিরক্তি আসা স্বাভাবিক। ক্ষোভের মাত্রা সঙ্গত কারণে অনেক বেশি হওয়া উচিত, কারণ আমার স্বাস্থ্য, আগামী দিনের ভাল থাকা এর সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। কয়েকশ টাকা ভিজিট দিয়ে, কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করে যে চিকিৎসকের দেখা পাচ্ছি, তাঁদের থেকে আমরা কেন দাবি করতে পারি না কম্পিউটারাইজড বিল, মানে প্রেসক্রিপশন? ডাক্তারবাবুদের চেম্বারে একটি হাজারতিনেক টাকার প্রিন্টার রেখে দিলেই তো এই সব সমস্যার সমাধান হয়। এই টাকা অনেক বড় চিকিৎসকের কাছে মাত্র দুটি প্রেসক্রিপশনের সমান। যে কোনও হাসপাতাল কিংবা পলিক্লিনিকে এখন তৈরি করা হয় পেশেন্ট আইডেন্টিফিকেশন নম্বর। ডাক্তারবাবুর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে, আগে থেকে পয়সা মিটিয়ে দেওয়ার পর প্রিন্টার থেকে ঝড়ের মতো বেরিয়ে আসে কনসাল্টেশন ফি-এর রিসিপ্ট। পয়সা নেওয়ার সময় যে প্রফেশনালিজম ও প্রযুক্তির ব্যবহার, রোগী দেখার সময় হলেই তা হারিয়ে যায় কেন? মনে রাখা দরকার, চেম্বারের মধ্যে কোনো ডাক্তারবাবু যথেষ্ট দরদ দিয়ে রোগী দেখলেও চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসার পরে ওই একপাতা প্রেসক্রিপশনটাই রোগীর কাছে থেকে যায় প্রমাণ হিসেবে, লম্বা মিটিংয়ের পরে সামারি রিপোর্টের মতো। এই রিপোর্ট যদি দুর্বোধ্য হয়, মিটিং যতই ভাল হোক না কেন, তার কোনো মূল্য থাকে না।

ওষুধের দোকানের যে বাহারি রিটেল চেইন হয়েছে আজকাল, তারই একটির এইচআর ম্যানেজারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল সম্প্রতি। জানতে পারলাম, আউটলেটগুলোতে নতুন কর্মচারী নিয়োগ করার সময় ওষুধের জ্ঞানের পাশাপাশি হাতের লেখা উদ্ধার করার জ্ঞানগম্যি নিয়েও তাঁদের ‘বাজিয়ে’ নেওয়া হয়। ল্যাপটপে একটি ফোল্ডার খুলে দেখালেন। তাতে রাখা ছিল কম করে গোটা পঞ্চাশেক প্রেসক্রিপশনের স্ক্যান করা কপি। এগুলো আসলে প্রশ্নপত্র। নাম না জানা চিকিৎসক থেকে শুরু করে বহু প্রথিতযশা ডাক্তারবাবুদের কলম এই প্রেসক্রিপশনগুলোর জনক। দুর্বোধ্য হওয়ার লড়াইয়ে এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায়। ম্যানেজারবাবু বলছিলেন, পাঁচটা প্রেসক্রিপশনের অন্তত ৯০ শতাংশ উদ্ধার না করতে পারলে অনার্সে সেরা নম্বর পাওয়া ক্যান্ডিডেটও নিয়োগের পরীক্ষায় ডাহা ফেল।

তাঁদের অক্ষরের পর্দার পিছনের চিত্রনাট্য নিয়েও ডাক্তারবাবুরা অবসর সময়ে একটু ভেবে দেখলে পারেন।