আরেক রকম ● নবম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২১ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

মতুয়াদের ভোট রাজনীতি

প্রস্কণ্ব সিংহরায়


২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে একটি কথা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বার বার উঠে এসেছে - ‘সাবঅলটার্ন হিন্দুত্ব’। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মত এই যে বিজেপি-র এই রাজ্যে উত্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল তারা সাবঅলটার্ন বা নিম্নবর্গের মানুষ, অর্থাৎ, দলিত-আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির ব্যাপক সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। উদাহরণ, ২০১৯-এর পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা ভোটের ফলাফল।

যেকোনো নির্বাচনে বিজেপির পাখির চোখ হল হিন্দু ঐক্য। মুসলমান সম্প্রদায়-কে নানা কায়দায় ভারতীয় সমাজের ‘অপর’ হিসেবে তুলে ধরা, বিজেপি-বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে মুসলমান তোষণের অভিযোগ নিয়ে আসা, এবংএক কাল্পনিক ‘হিন্দু খতরে মে হ্যাঁয়’ গল্প তৈরি করে উচ্চবর্ণ হিন্দুদের ভোটের সাথে দলিত ও আদিবাসি সম্প্রদায়েরসমর্থন সুনিশ্চিতকরাই হল বিজেপির নির্বাচনী কারিগরি। এই হিন্দু ঐক্যের ফর্মুলা অনেকক্ষেত্রেই কাজে দিয়েছে এবং বিজেপিকে ভোটে জিতিয়েছে জাতীয় ও বিভিন্ন রাজ্য নির্বাচনে। পশ্চিমবঙ্গেরনির্বাচনেও আমরা বিজেপির এই ফর্মুলা দেখতে পেয়েছি। এ রাজ্যের শাসক দলকে বিজেপি একদিকে দুর্নীতির প্রশ্নে যেমন আক্রমণ করেছে, অন্যদিকে তাদের বিরুদ্ধে মুসলমান তোষণের অভিযোগ-ও এনেছে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল বলছে বিজেপির এই ফর্মুলা ফেল।

লোকনীতির ভোট পরবর্তী সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৯-এর তুলনায় দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির অধিকাংশের সমর্থন এবার বিজেপি অনেকটাই হারিয়েছে, এমনকি বিজেপির উচ্চবর্ণ হিন্দু ভোট-ব্যাঙ্কেও চির ধরেছে। ফলতঃ হিন্দু ঐক্য বা সাবঅলটার্ন হিন্দুত্বের ধারণা দিয়ে এই নির্বাচনের ফলাফল সামগ্রিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাবেনা। কিন্তু একটি দলিত সম্প্রদায় বিজেপিকে ২০১৯-এর তুলনায় এই নির্বাচনে বেশি সমর্থন জুগিয়েছে। তারা হল নমঃশূদ্র সম্প্রদায় যাদের অধিকাংশই মতুয়া। মতুয়া রাজনীতি-কে কি তাহলে আমরা সাবঅলটার্ন হিন্দুত্বের ধারণা দিয়ে দেখা উচিত? মতুয়ারা কি হিন্দু ঐক্যের ডাকে সারা দিয়েছে? হিন্দু বর্ণব্যবস্থা বিরোধী মতুয়াদের অধিকাংশ কেন বিজেপির মত এক উচ্চবর্ণীয় হিন্দুত্ববাদী দলকে সমর্থন করল এই নির্বাচনে?

এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের বর্তমান মতুয়া রাজনীতির দাবিগুলি আলোচনা করা প্রয়োজন। তাহলেই বোঝা যাবে যে বিজেপি বা যেকোনো অন্য ব্রাহ্মণ্যবাদী দলের প্রতি মতুয়াদের সমর্থন আসলে দাবি-ভিত্তিক এবং শর্তাধীন। এই দাবিগুলি মূলত চার প্রকারের - এক, নাগরিকত্ব; দুই, সামাজিক স্বীকৃতি; তিন, উন্নয়নে অংশীদারি; এবং চার, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব।

প্রথমতঃ মতুয়াদের আজ প্রধান দাবি ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব। ২০০৩-সালে তৎকালীন এনডিএ সরকারের পাশ করা নাগরিকত্ব আইন বহু মতুয়া পরিবারের ভয় ও চিন্তার কারণ। এই আইন তাদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং বহু মানুষ বিভিন্ন সময় এই রাজ্যে ও অন্যান্য জায়গায় গ্রেফতার এবং প্রশাসনিক হেনস্থার শিকার হয়েছে। মতুয়া নেতৃত্বের মতে ২০০৩-এর আইন যখন লোকসভায় পাশ হয় তখন মতুয়াদের পাশে কোনো রাজনৈতিক দলই ছিলনা। ফলে তারা মতুয়া মহাসঙ্ঘের নেতৃত্বে আন্দোলনে নামে। এই আন্দোলনের প্রতিফলন এই পশ্চিমবঙ্গের ভোটের রাজনীতিতে দেখা যায় এবং তারা তাদের দাবির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। সম্প্রতি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ (সিএএ) পাশ করেছে এবং মতুয়াদের নাগরিকত্ব প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বেশীরভাগ মতুয়ারা এই নয়া আইন, সিএএ, সমর্থন করছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীমমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের এই নয়া নাগরিকত্ব আইন-এর বিরোধিতা করলেও মতুয়াদের আশ্বাস দিয়েছেন যে কারো নাগরিকত্ব নিয়ে টানাপোড়েন হবেনা। নাগরিকত্বের সমস্যা কেন্দ্রীয় সরকার-ই মেটাতে পারবে তা মতুয়ারা পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে খুব ভালো করেই জানে। ফলে তারা সাংগঠনিকভাবে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-কে সমর্থন করে এবং একই সাথে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রাখে। তার প্রমাণ আমরা এই নির্বাচনের আগেই পেয়েছি। মতুয়া মহাসঙ্ঘের নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ-কে ঠাকুরনগর-এ এসে সিএএ বিধি কবে আনা হবে এবং তারা নিঃশর্ত নাগরিকত্ব পাবে কিনা তা পরিষ্কার করে বলতে বাধ্য করেছে। অন্যদিকে মতুয়াদের আরেকাংশ সিএএ ও এনআরসি-র সাম্প্রদায়িক চরিত্রকে চিহ্নিত করে এর বিরোধিতাও করছেন। নাগরিকত্ব প্রসঙ্গে আজ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার উভয়েরই সমর্থন মতুয়ারা অর্জন করতে সফল। নাগরিকত্ব প্রদানের শর্তই আজ মতুয়াদের বিজেপিকে সমর্থন করার মূল কারণ।

দ্বিতীয়তঃ বর্তমান মতুয়া আন্দোলনের একটি বৈশিষ্ট্য হল স্বীকৃতি পাওয়ার রাজনীতি। গত দু-দশক ধরে তারা বার বার দাবি তুলে এসেছে যে তাদের আরাধ্য হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের নামে সরকারী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হোক, হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিতে সরকারী ছুটি দেওয়া হোক, এবং দলিত-পতিত-পিছিয়ে পরা মানুষের জীবনে তাদের অবদানকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হোক। এই সমস্ত দাবি তারা আদায় করেছে এক এক করে গত কয়েক বছরে। ২০১০ সালে বামফ্রন্ট সরকার ‘ঠাকুর হরিচাঁদ গুরুচাঁদ পুরস্কার’ চালু করে। হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের নামে তৃণমূল সরকার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছে এবং এবারে ভোটের আগে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিতে রাজ্য সরকার ছুটি দেবে ঘোষণা করেছে। মতুয়াদের আরাধ্য এবং আন্দোলনকে স্বীকৃতি প্রদান করার লড়াই-এ বিজেপিও আজ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গের ভোট চলাকালীন নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফরে যান এবং হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মস্থান ওড়াকাঁদি গিয়ে পুজো দেন। এই প্রথম ভারতবর্ষের কোন প্রধানমন্ত্রী ওড়াকাঁদি গেলেন। মতুয়া সমাজের কাছে এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ভোটের বাক্সেও তার প্রতিফলন স্বাভাবিকভাবেই দেখা গেছে।

তৃতীয়তঃ মতুয়ারা বাকি সমস্ত জনগোষ্ঠীর মত রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রকল্পগুলির অংশীদার হতে চায়। তাদের অনেক দিনের দাবি মতুয়া উন্নয়ন পর্ষদ তৈরি হোক। তৃণমূল সরকার তা মেনেছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মতুয়া মহাসঙ্ঘ এবং শাখা সংগঠনগুলিকে আর্থিক ও অন্যান্য অনুদান প্রদান করেছে। এইবারের ভোটের আগেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দ্রষ্টব্য যে বিজেপি নিজেদের ২০২১-এর নির্বাচনী সংকল্প পত্রে ঘোষণা করে যে ক্ষমতায় এলে তারা মতুয়া দলপতিদের মাসিক ৩০০০ টাকা পেনশন দেবে। এখানে বলে রাখা ভালো যে মতুয়াদের সংগঠনের ভিত্তি হল ছোট ছোট দল এবং বুনিয়াদি সংগঠক হল দলপতিরা। বলাই বাহুল্য যে অন্যান্য দলের তুলনায় বিজেপির এই প্রতিশ্রুতিমতুয়াদের সমর্থন আদায় করতে তাদের বাকিদের থেকে বেশি সাহায্য করেছে।

চতুর্থতঃ গুরুচাঁদ ঠাকুরের মতুয়া সমাজের প্রতি একটি জনপ্রিয় বার্তা হল - ‘যে জাতির রাজা নাই, সে জাতি তাজা নাই’। অর্থাৎ, নিজের জাতির রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব করা অত্যন্ত আবশ্যক। মতুয়াদের তিনি সক্রিয় রাজনীতির সাথে যুক্ত হতে বলেছিলেন। এরকম অনেক উপদেশ মতুয়া ধর্মগ্রন্থ গুরুচাঁদচরিত-এ আছে। ‘যে জাতির রাজা নাই, সে জাতি তাজা নাই’ - এই পংক্তিটির ব্যবহার নজরে পড়ল ২০২১-এর নির্বাচনের আগে বিজেপি প্রার্থী সুব্রত ঠাকুরের ছবি-সহ ব্যানার-এ। গুরুচাঁদ ঠাকুরের পৌত্র ও কংগ্রেস নেতা প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের জীবনাবসানের পর বেশ কয়েক বছর মতুয়াদের ঠাকুর পরিবারের কেউ নির্বাচনী রাজনীতিতে লড়েননি। ২০১১ সালে প্রমথরঞ্জনের ছোট ছেলে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর নির্বাচনে লড়েন। জেতার পর মন্ত্রীও হন। পরের কয়েক বছর ঠাকুর পরিবারের অনেকেই বিভিন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। কেউ জিতেছেন, কেউ হেরেছেন। ভোট রাজনীতি ঠাকুর পরিবারের মধ্যে ফাটলও ধরিয়েছে শেষ কয়েক বছরে। ভোটে ঠাকুর পরিবার থেকে প্রার্থী দাঁড় করাতে পারলে তা বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে এবং মতুয়াদের সমর্থন পেতে সুবিধে হবে সেটা সব রাজনৈতিক দলের জানা। ঠাকুর পরিবারের সদস্যরাও এই প্রার্থীপদ নিয়ে দর কষাকষি করে এসেছে সমস্ত দলগুলির সাথে। এই নির্বাচনের আগেও সেটা দেখা গেল। ছেলে সুব্রত ঠাকুর-কে প্রার্থী করার দাবি তুলে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর সংবাদমাধ্যম ডেকে বিজেপি-কে সমর্থন করবে কিনা সেই শর্ত রাখেন। পরের দিন-ই সুব্রত ঠাকুর-কে গাইঘাটা কেন্দ্র থেকে প্রার্থী ঘোষণা করে বিজেপি। ঠাকুর পরিবারের একজন সদস্য বিজেপির প্রার্থী হওয়ায় তারা গাইঘাটা-সহ অন্যান্য মতুয়া অধ্যুষিত কেন্দ্রগুলিতেও এবারের নির্বাচনে লাভবান হয়েছে।

মতুয়া রাজনীতির বর্তমান চরিত্র দেখলে তা ‘সাবঅলটার্ন হিন্দুত্ব’ মডেল-এ ফেলে দেওয়াটা ভুল হবে। এ কথা সত্যি যে দেশভাগের পূর্ববর্তী রাজনীতি অধিকাংশ মতুয়া সমাজকেই হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত করে তুলেছিল। তবে আজ মতুয়াদের এক বিশাল অংশ মনে করেন যে মতুয়া মতবাদ একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র ধর্ম। ২০১৪ সালে মতুয়া মহাসঙ্ঘ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে মতুয়া ধর্মকে পৃথক ধর্মের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তোলে। সেই দাবি আজ চাপা পড়ে আছে। এই মুহূর্তে বিজেপি মতুয়াদের হিন্দু ঐক্যের পরিকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করতে মরিয়া। সিএএ আইন তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। একজন মতুয়া শরণার্থী যদি নিজেকে হিন্দু হিসেবে পরিচয় দেয়, তবেই সে ভারতবর্ষে নাগরিকত্ব পাবে এই নতুন আইনের নিরিখে। নিম্নবর্গের মানুষের জনপ্রিয় প্রতিবাদী ধর্মাদর্শগুলিকে হিন্দু ধর্মের ছত্রছায়ায় নিয়ে আসার একটি উপায় হল আইনী মারপ্যাঁচ। এটাই হিন্দু প্রধানতন্ত্রবাদী রাজনীতি। আইনের অস্ত্র ছাড়াও হিন্দু ঐক্য গড়ে তোলার জন্য আসন্ন রামমন্দির-এ মাটি পাঠানো অথবা ভোট পূর্ববর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মত নানা কৌশল হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির কার্যকরী করেছে বিভিন্ন রাজ্যে। মতুয়ারা এই হিন্দু প্রধানতন্ত্রবাদের ফাঁদে পা না দিয়ে কতদিন নিজেদের স্বতন্ত্র শর্তভিত্তিক রাজনীতি চালিয়ে যেতে পারে, সেটাই এখন দেখার। মতুয়াদের দাবিতে সারা দিয়ে তাদের সমর্থন আদায় কীভাবে করা যাবে সেই দিকে তাকিয়ে থাকে সমস্ত রাজনৈতিক দল। এবারের ভোটেও সেটা দেখা গেছে। ফলে মতুয়া রাজনীতিকে হিন্দুত্ববাদের চাদরে ঢেকে ফেলাটা ঠিক হবেনা। মতুয়া রাজনীতি বর্তমানে অধিকার, স্বীকৃতি ও মর্যাদার লড়াই। বিজেপিকে এই নির্বাচনে মতুয়াদের শর্তভিত্তিক সমর্থন সেই লড়াইয়ের-ই একটি অধ্যায় মাত্র।