আরেক রকম ● নবম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২১ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের ধারাবাহিক বিপর্যয় প্রসঙ্গে

সমীরণ সেনগুপ্ত


সদ্য সমাপ্ত পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন ২০২১ বহু নতুন উপাদানকে সামনে নিয়ে এসেছে। বিগত লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় পাঁচ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে ২১৩ টি আসন জিতে তৃতীয় বারের জন্য রাজ্য সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। বহু রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে রাজ্যের জণগন বিজেপিকে না জিতিয়ে বিরোধী আসনেই বসিয়েছেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় দুই শতাংশ ভোট কম পেয়েছে বিজেপি, তবে ৭৭টি আসনে তারা জয়লাভ করেছে। লোকসভার তুলনায় ভোটের শতাংশ কমলেও ২০১৬ সালের বিধানসভার তুলনায় বিজেপির ভোট বেড়েছে ২৮ শতাংশ। সংকুচিত থেকে সংকুচিততর হতে হতে বামফ্রন্টের ভোট ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৫.৭ শতাংশ, আসন সংখ্যা শূন্য। সিপিআই(এম)-এর ভোট শতাংশ ৪.৭। রাজ্যে বামফ্রন্টের এমন শোচনীয় হাল নিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরেই আলোচনা চলছে। দেশের শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থেই এই আলোচনা প্রয়োজন। প্রাসঙ্গিক কয়েকটি বিষয় এই নিবন্ধে উল্লেখ করা হল।

বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন রাজ্যে বামপন্থীদের বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতা। ২০০৬ সালের নির্বাচনে রাজ্যে বিপুল জয়ের পর থেকে প্রতিটি নির্বাচনে বামফ্রন্টের ভোট কমেছে। দেশের রাজনীতির ইতিহাসে কোনো রাজনৈতিক দল বা ফ্রন্ট কখনো কোনো নির্বাচনে জিতেছে, কোথাও হেরেছে, কিন্তু মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানে প্রতিটি নির্বাচনে জনসমর্থন ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে মাত্র ৫.৭ শতাংশে এসে উপস্থিত হওয়া কার্যত অভাবনীয়। এমন নজির গোটা দেশে দ্বিতীয় নেই। ফলে এই বিপর্যয় যে শুধুমাত্র সাংগঠনিক নয়, এই বিপর্যয় যে মতাদর্শগত, রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক এই তিন ধরনের উপাদানেরই সংমিশ্রণতা তা না বোঝার কথা নয়। অথচ এই সহজ সত্যটি রাজ্যের শীর্ষ বাম নেতারা বুঝতে চাইছেন না অথবা বুঝেও স্বীকার করে দায় গ্রহণে রাজি নন। বিপর্যয়ের কারণ হিসাবে নানাবিধ সাংগঠনিক ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং ‘বিরোধীদের চক্রান্তকেই’ তাঁরা কারণ হিসাবে চিহ্নিত করে চলেছেন, কেউ কেউ বলে বসছেন ‘মানুষ ভুল করেছে'। আরএসএস - বিজেপির মতো ফ্যাসিবাদী দল অথবা কংগ্রেস তৃণমূল কংগ্রেসের মতো দক্ষিণপন্থী দলগুলো বামপন্থীদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত না করে লাল কার্পেট বিছিয়ে রাখবে এমন আশা নিশ্চই রাজ্যের বাম নেতারা করেন না। কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া কর্পোরেটদের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেবে তাও স্বাভাবিক। অতীতে কিন্তু বামপন্থীরা এসব চক্রান্তের জাল ছিন্ন করেই জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। বিরোধীদের চক্রান্ত বলে দায় সারেননি।

ভুলকে ভুল হিসাবে চিহ্নিত না করতে পারায় একই ভুলের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, এসে ভিড় করছে নতুন ভুল। জনমুখি বিকল্প শিল্পায়নের চর্চা না করে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের শিল্পায়নের মডেলটিকেই বাম নেতারা এখনো ঠিক বলে মনে করেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের সাথে জোট করে তৃতীয় হওয়ার পর ২০২১ সালে একই ভুল তাঁরা আবার করলেন, সাথে যুক্ত করলেন এক মুসলিম ধর্মগুরুকে যিনি নির্বাচনের তিন মাস আগেও ধর্মীয় জলসা ছাড়া অন্যত্র কোথাও বক্তৃতা করেননি। ২০১৯ সাল থেকেই রাজ্যের বাম নেতারা 'বিজেমূল' নামে একটি ভুল তত্ত্বের আমদানি করেন। নেতারা বলা শুরু করেন বিজেপি এবং তৃণমূল দুটো দল আসলে একই এদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই! ২০১৯ সালে এই মত জনগণ প্রত্যাখ্যান করার পরেও কোনো শিক্ষা না নিয়ে একই কথা এই নেতারা বলে যেতে থাকলেন। অথচ বামফ্রন্ট্রের প্রধান রাজনৈতিক দল সিপিআই(এম)-এর কর্মসূচীগত বোঝাপড়ার সাথে এই 'বিজেমূল' তত্ত্বের কোনো মিলই খুঁজে পাওয়া যাবে না। সিপিআই(এম) এর কর্মসূচীগত বোঝাপড়াই শুধুমাত্র নয়, বিগত তিন দশকের দলত্যাগী প্রার্থীদের তথ্যের দিকে তাকালেও উপলব্ধিতে আসে এই 'বিজেমূল' তত্ত্বটা কতোটা অসাড় (সারণি -১)।

সারণি-১: অন্য দল থেকে নেওয়া বিজেপি প্রার্থীদের সংখ্যা

সারণি-১ থেকে দেখা যাচ্ছে ১৯৮০ সালে বিজেপি গঠন হওয়ার পর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত গুজরাট, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে যতোগুলি বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে (উপ-নির্বাচন ধরে) সেই সব ক'টি নির্বাচনে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলো থেকে নেতা ভাঙিয়ে নিয়ে এসে বিজেপি নিজেদের প্রার্থী করেছে এমন সংখ্যাটা মোট ৩১৬। এই সময়ে উল্লেখিত রাজ্যগুলোতে কংগ্রেসে থেকে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় 'কাজ' করতে না পেরে কংগ্রেস ত্যাগ করে বিজেপির হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছেন ১৯৫ জন। বিজেপির এই দল ভাঙানোর খেলা অতীতের তুলনায় আক্রমণাত্মক ভাবে শুরু হয় মোদী-শাহ জুটি নেতৃত্বে আসার পর। ২০১৪ থেকে ২০২১ এই সাত বছরেই কংগ্রেস সহ অন্যান্য জাতীয় দল থেকে বিজেপির হয়ে উল্লেখিত রাজ্যগুলোতে ভোটে দাঁড়িয়েছেন মোট ১২৩ জন। ১৯৮০ থেকে ২০১৪ এই সময়ে সংখ্যাটা ছিল ১৯৩। শুধুমাত্র উল্লেখিত রাজ্যগুলোতেই নয় দিল্লি, অসম, বিহার, ত্রিপুরাতেও একই অভিজ্ঞতা। ত্রিপুরায় প্রথমে কংগ্রেসের নেতারা তৃণমূলে চলে যায় তারপর তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগদান করে। অসম রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীও প্রাক্তন কংগ্রেসী। দল ভাঙানোর এই খেলায় বিজেপির থেকে খুব বেশি পিছিয়ে নেই কংগ্রেস ও (সারণি-২)। ১৯৮০ থেকে ২০২১ এই কাল পর্বে উল্লেখিত ৬টি রাজ্যে অন্যান্য জাতীয় রাজনৈতিক দল থেকে ভাঙিয়ে নিয়ে এসে কংগ্রেস নিজেদের প্রার্থী করেছে ২২৭ জনকে। বিজেপি ছেড়ে এসে কংগ্রেসের হয়ে প্রার্থী হয়েছেন ১২৩ জন। অর্থাৎ কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপির হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছেন ১৯৫ জন, বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসের হয়ে লড়েছেন ১২৩ জন। এই হল সংখ্যার পার্থক্য।

সারণি-২: অন্য দল থেকে নেওয়া কংগ্রেসের প্রার্থীদের সংখ্যা

জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির উত্থানে কংগ্রেসের অর্থনৈতিক নীতি এবং সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে আপোসকারী ভূমিকার অবদান অনস্বীকার্য। কিন্ত একথার অর্থ বিজেপি এবং কংগ্রেসের মধ্যে কোনো তফাত নেই তা তো নয়। বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে যেমন পার্থক্য আছে, বিজেপি আর তৃণমূলের মধ্যেও পার্থক্য আছে। তৃণমূল কংগ্রেসের স্বৈরাচারী, অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে আপোসকারী চরিত্রকে বিবেচনায় রেখেই একথা উপলব্ধিতে আনা প্রয়োজন যে তৃণমূল আর যাই হোক বিজেপি নয়, আবার তৃণমূলের লেজুরবৃত্তি করেও বিজেপির অগ্রগতিকে রোখা যাবে না। কংগ্রেস-ও আর যাই হোক বিজেপি নয় একথার পাশাপাশি স্মরণে রাখা প্রয়োজন নয়া উদার অর্থনীতির প্রবক্তা, সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন, পরিবারবাদে নিমজ্জিত, সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপোসকারী কংগ্রেস গণতান্ত্রিকও নয়, কংগ্রেসের লেজুরবৃত্তি করে রাজ্যের বাম আন্দোলন শক্তিশালী তো হচ্ছেই না উলটে নির্বাচনে জনসমর্থন ক্রমাগত কমছে। এই পথেও বিজেপিকে ঠেকানো সম্ভব নয়।

দক্ষিণপন্থী দলগুলোর ‘কমন’ শত্রু হল বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। এই কারণেই রাহুল গান্ধী কেরালার নির্বাচনী সভায় প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন কংগ্রেস মুক্ত ভারতের কথা বললেও কেন কমিউনিস্ট মুক্ত ভারতের কথা মোদীজি বলেন  না। বামপন্থীরা 'কমন শত্রু' বলেই নিজেদের অধিবেশনের উদ্বোধনে কংগ্রেস নেতা প্রয়াত প্রণব মুখার্জিকে আহ্বান করে আরএসএস, প্রণব মুখার্জী সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে নাগপুরে গিয়ে বক্তৃতাও করে এসেছিলেন। বামপন্থীরা কমন শত্রু বলেই নিজেরা জয় না পেলেও আরএসএস এই ভেবে খুশি হয় যে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা অন্তত জিততে পারেনি। ফ্যাসিবাদী আরএসএস-বিজেপি যে মেজরিটারিয়ান পলিটিক্সের চর্চা করে সেই চর্চার সামগ্রিকতায় দক্ষিণপন্থী মতাদর্শই শক্তিশালী হয়, একইভাবে কংগ্রেসের, তৃণমূলের নরম হিন্দুত্বের রাজনীতিতে অথবা মুসলিম মৌলবাদী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণের ফলে বিজেপির সুবিধা হয়। এর অর্থ কখনোই এমন হতে পারে না যে বিজেপি এবং কংগ্রেসের কোনো তফাত নেই অথবা বিজেপি এবং তৃণমূল দুটো একই দল। রাজ্যের বাম নেতৃত্বের মস্তিষ্ক প্রসূত 'বিজেমূল' একটি সাবজেকটিভ এবং সম্পূর্ণ ভুল মূল্যায়ন যা এই নেতৃত্বের একের পর এক করে চলা রাজনৈতিক ভুলের সাম্প্রতিকতম নমুনা।

এ প্রশ্ন উত্থাপন করাই যায় যে 'বিজেমূল' তত্বের আমদানি না হলে কি বামফ্রন্টের নির্বাচনী ফল ভালো হতো? 'বিজেমূল' তত্ত্বটা না থাকলে নির্বাচনের প্রচারে বিজেপির বিরুদ্ধে আরো জোরালো বক্তব্য বেশি সময় ধরে রাখতেন বাম নেতারা। ব্রিগ্রেডের মাঠের সিংহভাগ বক্তৃতায় যেমন বোঝাই যায়নি যে এ রাজ্যে বিজেপি নামে কোনো দল আছে, এমন হতো না। ফলে বিধানসভায় বিজেপিকে কোনোমতেই ভোট দেবেন না আবার বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূলকেও অপছন্দ, এমন মানুষের বেশি বেশি করে সিপিআই(এম) বা বামফ্রন্টকেই ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা বাড়তো। বামফ্রন্টের ফলাফল যা হয়েছে তার থেকে সামান্য হলেও ভালো হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল হতো।

প্রতিকূলতাকে ভেদ করার প্রাথমিক শর্ত হল সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলা। ভুল তথ্যের পরিবেশন, প্রকৃত তথ্যকে আড়াল করা, সামগ্রিকতার পরিবর্তে খন্ডিত তথ্যের ব্যবহার ইত্যাদি বিষয় ত্রুটিমুক্ত পর্যালোচনার অন্তরায় হয়। ২৭ মে ২০১৬, গণশক্তি পত্রিকার চার নম্বর পাতায় এক উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধের এক জায়গায় লেখা হয়েছিল "৭০টি আসনে জোট প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন ৫০০০ এর কম ভোটে"। প্রকৃত তথ্য হল ৫০০০ ভোটের কম ব্যবধানে জয় পরাজয়ের নিষ্পত্তি হয়েছিল ৩৭টি আসনে। ২১টি আসনে জোট প্রার্থীরাই জয় লাভ করেন ৫০০০ ভোটের কম ব্যবধানে। গণশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত এ ধরনের ভুল তথ্য জোট নিয়ে আশাবাদ তৈরি করলেও জনসমর্থন যে পরবর্তীতে ফিরে আসেনি তা নির্বাচনের ফলে পরিষ্কার। তবে এই ধরনের ভুলগুলো সচেতন কিনা তা অবশ্য রাজ্যের বাম নেতারাই বলতে পারবেন।

রূঢ় সত্য হল ২০০৬ সালে ১ কোটি ৯১ লক্ষ ২ হাজার ২৬৮ ভোট পাওয়া বামফ্রন্ট ২০২১ সালে ৩৪ লক্ষ ৯৮৪ ভোট পেয়েছে। বামফ্রন্টের ভোট কমেছে ১ কোটি ৫৭ লক্ষ। এই সময়ে রাজ্যে প্রদত্ত ভোট বেড়েছে ২ কোটি ৪ লক্ষ ৭৯ হাজার ২১৩। সব অংশের মানুষের মধ্যেই বামফ্রন্টের জনসমর্থনের ব্যপক ক্ষয় হয়েছে। রূঢ় সত্য হল এই ক্ষয় গরিব মানুষের মধ্যে তুলনায় বেশি হয়েছে (সারণি-৩)।

সারণি-৩: সংরক্ষিত ও সাধারণ আসনে বামফ্রন্টের প্রাপ্ত ভোট (শতাংশের হিসেবে)

২০০৬ থেকে ২০২১ এই সময়ের ব্যবধানে তফশিলী জাতি সংরক্ষিত আসনগুলোতে বামফ্রন্টের ভোট কমছে ৪৪.৬ শতাংশ বিন্দু। তফশিলী উপজাতি সংরক্ষিত আসনগুলোয় কমেছে ৪৭.১ শতাংশ বিন্দু এবং এই দুই ধরনের সংরক্ষিত আসন ছাড়া অন্যান্য সাধারণ বিধানসভা আসনগুলোতে ভোট কমেছে ৪২ শতাংশ বিন্দু।

২০২১ সালের নির্বাচনে বামফ্রন্টের প্রার্থী তালিকায় ১৩৩ জনের বয়স ৪০ বছরের কম ছিল। এত সংখ্যক তরুণদের প্রার্থী করা অত্যন্ত সদর্থক ভাবনা এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই তরুণ প্রার্থীরা অনেকেই তুলনায় বয়স্ক প্রার্থীদের থেকে বেশি ভোট পেয়েছেন। বিপরীতে বামফ্রন্টের তরুণদের থেকে তৃণমূল বা বিজেপির তরুণ প্রার্থীরা বেশি ভোট পেয়েছেন। আবার, কেরালার তরুণ এবং তুলনায় বয়স্ক দুই প্রধান বাম দলের প্রার্থীরা কেরালায় কংগ্রেস বা বিজেপির সব বয়সী প্রার্থীদের থেকেই বেশি ভোট পেয়েছেন (সারণি-৪)।

সারণি-৪: বয়স ভিত্তি প্রাপ্ত ভোট

দ্রষ্টব্যঃ RSSCMJP হচ্ছে ISF।

অর্থাৎ বয়সের সাথে ভোটের সম্পর্কটি খুবই দুর্বল। তরুণদের প্রার্থী করা অত্যন্ত সদর্থক ভাবনা হলেও বামপন্থীদের কাছে মূল বিষয় রাজনীতি এবং রাজনৈতিক লাইন। রূঢ় সত্য হল কংগ্রেস এবং হঠাৎ গজিয়ে ওঠা আইএসএফ-কে যুক্ত করেও ২০১৯-এর তুলনায় বামফ্রন্টের ভোট কমেছে ৮ লক্ষেরও বেশি। রূঢ় সত্য হল দেশের বাম আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ সালের নির্বাচনে বামফ্রন্টের ১৬০টি আসনে জমানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। সংযুক্ত মোর্চা নামক কর্মসূচীবিহীন জগাখিচুড়ি জোট ধরলে ২৯২টি আসনের মধ্যে জমানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে ২৬২টি আসনে। তথ্য আড়াল করে এই ব্যাপক বিপর্যয়ের কোনো সমাধান সূত্র পাওয়া যাবে না।

একদা রাজ্যের গরিব শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে বহু সদর্থক কাজের মাধ্যমে গোটা দেশেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। ইউনাইটেড নেশনস্ প্রকাশিত হিউম্যান ডেভলপমেন্টের (মানব উন্নয়ন সূচক) তথ্য এক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং আয়, এই তিনটি বিষয় বিবেচনায় রেখে ১৯৯০ সাল থেকে এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশের সূচকের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের সূচক বেশি ছিল। এর পর থেকে দেশের সূচকের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের সূচক কমতে থাকে। ২০০৫ সালের পর থেকে দেশের সূচকের সাথে রাজ্যের সূচকের ফারাক বাড়তে থাকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত (চিত্র-১)। অর্থাৎ বাম আমলের শেষের দশকে মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে বাম আমলেরই অতীত দিনের তুলনায় পারফরম্যান্স খারাপ হতে শুরু করে।

চিত্র-১: ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের মানব উন্নয়নের সূচক

খেয়াল রাখা দরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো বুনিয়াদী বিষয়গুলোর সাথে এই সূচকের সরাসরি সংযোগ রয়েছে। বিকল্প জনমুখী শিল্পায়নের বিপরীতে এসইজেড নির্ভর সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের শিল্পায়নের মডেলটি যে এই রাজ্যের জনগণ কেন প্রত্যাখ্যান করেছেন সে কথা এখনো রাজ্যের বাম নেতারা বুঝে উঠতে পারলেন না।

বামফ্রন্টের ধারাবাহিক নির্বাচনী বিপর্যয় কেবলমাত্র রাজ্যের দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের সামনেই প্রতিকূলতার সৃষ্টি করেছে তা নয়, গোটা দেশের শ্রমজীবী মানুষের লড়াই সংগ্রামও এই বিপর্যয়ের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বামফ্রন্টের ধারাবাহিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে উদঘাটিত বাম নেতাদের মতাদর্শগত বিভ্রান্তি কাটিয়ে তোলার, রাজনৈতিক ভুল সংশোধনের কোনো সচেতন পদক্ষেপ নেতারা গ্রহণ করবেন কি? সময়-ই এই প্রশ্নের উত্তর দেবে। কোভিড আক্রান্ত মানুষের পাশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে একদল যুবক-যুবতী রেড ভলেন্টিয়ারের পক্ষে রাস্তায় নেমে এসেছেন, বোঝাই যায় সঠিক রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ করতে পারলে রাজ্যের বাম আন্দোলনে পুনরায় গতি আসবে। রাজনীতি ব্যতীত শুধুমাত্র ত্রাণকার্যে কিন্তু হাল ফিরবে না।


______________________________
* চিত্র এবং লেখায় বামফ্রন্টের ভোট অর্থে সিপিআই(এম), সিপিআই, ফরোয়ার্ড ব্লক এবং আরএসপি এই চারটি দলকে ধরা হয়েছে।