আরেক রকম ● নবম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২১ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

প্রবন্ধ

পশ্চিমবঙ্গের ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের ফলের বিশ্লেষণ

মৈত্রীশ ঘটক ও পুষ্কর মৈত্র


পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে দীর্ঘ পাঁচ সপ্তাহব্যাপী ভোটপর্ব শেষ। ভোট নিয়ে আলোচনাও স্তিমিত হয়ে আসছে। কিন্তু ভোটের ফলাফল নিয়ে কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে, যা নিয়ে অনেকের অনেক মতামত থাকলেও এখনো তথ্যের অপ্রতুলতার কারণে ছবিটা খানিকটা অস্পষ্ট। রাজ্যের এই নির্বাচন এবং তার আগের কিছু নির্বাচনের ফলের ওপর নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত আসনভিত্তিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে কিছু তথ্য বেরিয়ে আসে, যা আমাদের এই ফলাফল বুঝতে খানিকটা সাহায্য করতে পারে।

প্রশ্ন অনেক, প্রত্যেকটি এই সীমিত পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব হবে না। যে প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করবো, সেগুলো তিনভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথমত, দল বা জোটভিত্তিক হিসেবে ২০১৬ সালের নির্বাচনের তুলনায় এই ত্রিমুখী প্রতিযোগিতায় কার ভোট কোন দিকে গেল? আর ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের তুলনাতেই বা এবারে তফাৎ হল কী? দ্বিতীয়ত, মহিলা ও সংখ্যালঘু ভোটের কতটা প্রভাব পড়ল ফলাফলের ওপরে? তৃতীয়ত, দীর্ঘসময় ধরে হওয়া নির্বাচনের শেষ দিকে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের হারের বৃদ্ধি কি কোনো প্রভাব ফেলেছে ফলাফলের ওপর?

২০১৬ আর ২০২১ সালের মধ্যে দলভিত্তিক ভোট কীভাবে পালটেছে সেটা দেখার জন্যে সারণি-১ দ্রষ্টব্য। ওপরে বাঁদিকে '২০১৬ সালে মোট আসন’ নামে স্তম্ভাকারে পরিবেশিত পরিসংখ্যান হল ২০১৬ সালে পার্টিভিত্তিক আসনের বিন্যাস। আর ‘২০২১ সালে মোট আসন’ নামে তলার আড়াআড়ি পংক্তিতে এই একই তথ্য দেখা যাবে ২০২১-এর নির্বাচন বিষয়ে। মূল দ্রষ্টব্য হল প্রতিটি দল ২০১৬ সালে যে যে আসন জিতেছিল, সেই আসনগুলি ২০২১ সালে কোন দল পেয়েছে। যেমন, ‘বামফ্রন্ট’ নামে ওপর দিকে যে আড়াআড়ি পংক্তিটি তার থেকে দেখা যাচ্ছে তারা ২০১৬ সালে যে ৩২-টি আসন পেয়েছিল, তার ২৩-টি এবার পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস, আর বাকি ৯-টি পেয়েছে বিজেপি। দলভিত্তিক ভোটের বিন্যাস দেখলে সবচেয়ে নজর কাড়ার মত তথ্য হল এই - বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস এই দুই দলের আসন যে শূন্যতে দাঁড়িয়েছে, তার থেকে প্রধানত লাভ হয়েছে তৃণমূলের, বিজেপি-র নয়। ২০১৬ সালে বামফ্রন্টের ৩২-টা আসন ছিল, তার মাত্র ৯-টা পেয়েছে বিজেপি আর ২৩-টা তৃণমূল। কংগ্রেসের ২০১৬ সালের ৪৪-টা আসনের ১৫-টা পেয়েছে বিজেপি আর ২৯-টা তৃণমূল। তাহলে বিজেপি এবার ৭৭-টা আসন পেল কি করে? এর ৪৮-টা আসন গতবারে তৃণমূলের ছিল, অর্থাৎ, শাসকদলের বিরুদ্ধে তাদের প্রচার ব্যর্থ হয়েছে বা ক্ষমতাসীন দলবিরোধী হাওয়া ছিলনা একথাগুলো মোটেই বলা যায় না। তৃণমূলের গতবারের ২০৯-টা আসনের ১৬০-টা তারা ধরে রাখতে পেরেছে, তাই তাদের এবারের সাফল্য মূলত এসেছে বামজোটের গতবারের ৫২-টা আসন এবারে জেতার ফলে।

সারণি-১: ২০১৬ আর ২০২১-এর মধ্যে জয়ী দলের আসন পরিবর্তন

রাজনৈতিক দল ২০১৬ সালে মোট আসন বামফ্রন্ট বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেস জাতীয় কংগ্রেস অন্যান্য/নির্দল
বামফ্রন্ট ৩২ ২৩
বিজেপি
তৃণমূল কংগ্রেস ২০৯ ৪৮ ১৬০
জাতীয় কংগ্রেস ৪৪ ১৫ ২৯
অন্যান্য/নির্দল
২০২১ সালে মোট আসন ২৯২ ৭৭ ২১৩

সূত্রঃ নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত পরিসংখ্যান থেকে গণনা করা হয়েছে, এবং যে ২৯২-টি আসনে ২০২১ সালে নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যেই বিশ্লেষণ সীমিত রাখা হয়েছে।

তার মানে কি ক্ষমতাসীন দলবিরোধী ভোট বামেদের থেকে বিজেপির দিকে যাবার যে বহুআলোচিত প্রবণতা, বিশেষত ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে যখন বামেদের আসন শূন্য হয়ে দাঁড়ায়, তা কি একেবারেই ঠিক নয়? নির্বাচন কমিশন প্রত্যেকটি লোকসভা আসনের সংশ্লিষ্ট বিধানসভা আসনগুলির পাৰ্টিভিত্তিক ভোটের পরিসংখ্যান পেশ করেন। তার ভিত্তিতে আমরা যদি ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের নির্বাচনের ফলের তুলনা করি (সারণি-২ দ্রষ্টব্য) তাহলে দেখা যাবে, বামফ্রন্টের হারানো আসনের থেকে বিজেপি ও তৃণমূল প্রায় সমান লাভ করেছে, যদিও তৃণমূল সামান্য এগিয়ে। খেয়াল রাখতে হবে এখানে হিসেব দেওয়া হয়েছে লোকসভা আসনের সংশ্লিষ্ট বিধাসনসভা আসনগুলির, তাই মোট আসন সংখ্যা ২৯৪। যেমন, ‘কলকাতা দক্ষিণ’ লোকসভা আসনের সংশ্লিষ্ট বিধানসভা আসন হল কলকাতা পোর্ট, ভবানীপুর, রাসবিহারী এবং বালিগঞ্জ, এবং নির্বাচন কমিশন এই প্রত্যেকটি বিধানসভা আসনে কোন দল কত ভোট পেয়েছে তাঁর তথ্য পেশ করেন, তাই তার ভিত্তিতে এই আসনে কোন দল জিতেছে সেটা হিসেব করা যায়। একথা ঠিক যে, লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের কারণগুলো এক নয়, তাহলেও, 'বাম থেকে রাম' বলে বর্ণিত প্রবণতা ২০১৯-এর নির্বাচনে অবশ্যই খানিকটা কাজ করেছে, কিন্তু এবারে তার প্রভাব অনেক কম।

সারণি-২: ২০১৪ আর ২০১৯-এর মধ্যে জয়ী দলের আসন পরিবর্তন

রাজনৈতিক দল ২০১৬ সালে মোট আসন বামফ্রন্ট বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেস জাতীয় কংগ্রেস অন্যান্য/নির্দল
বামফ্রন্ট ২৭ ১৩ ১৪
বিজেপি ২৪ ২১
তৃণমূল কংগ্রেস ২১৪ ৮২ ১৩২
জাতীয় কংগ্রেস ২৯ ১৫
অন্যান্য/নির্দল
২০২১ সালে মোট আসন ২৯৪ ১২১ ১৬৪

সূত্রঃ নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত পরিসংখ্যান থেকে গণনা করা হয়েছে। প্রত্যেকটি লোকসভা আসনের সংশ্লিষ্ট বিধানসভা আসনের দলভিত্তিক ভোট ও তার ভিত্তিতে জয়ীকে সেই অনুযায়ী গণনা করা হয়েছে।

আমরা যদি মোট ভোটের অনুপাত দেখি (সারণি-৩) তাহলে ২০১১ এবং ২০২১-এর মধ্যে বামফ্রন্টের মোট প্রাপ্ত ভোটের অংশ যে হারে কমেছে, বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ ঠিক সেই হারে বেড়েছে। ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বামফ্রন্টের ভোটের অনুপাত ৩৯% থেকে ৬% এর তলায় গেছে আর বিজেপি-র ভোটের অনুপাত ৪.৫% থেকে ৩৮% হয়েছে। এদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত যোগ করলে প্রায় একই দাঁড়াচ্ছে । তৃণমূল কংগ্রেস আগের দুই নির্বাচনের তুলনায় তাদের ভোট বাড়াতে সক্ষম হলেও, ভোটের অনুপাত হিসেব করলে গত এক দশকে বিজেপি-র উত্থান এবং বামফ্রন্টের পতন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা তা নিয়ে দ্বিমত থাকার অবকাশ নেই।

সারণি-৩: দলভিত্তিক ভোটের বিন্যাস

বিধানসভা নির্বাচন
রাজনৈতিক দল নির্বাচনের বছর ২০১১ ২০১৬ ২০২১
বামফ্রন্ট মোট ভোটের শতাংশ ৩৯.০৭ ২৫.৫৬ ৫.৬৭
  প্রার্থী দেওয়া আসনে মোট ভোটের শতাংশ ৪০.৪৭ ৩৬.০৮ ৯.২
  আসনে প্রার্থী দেওয়ার অনুপাত ০.৯৭ ০.৭ ০.৬১
বিজেপি মোট ভোটের শতাংশ ৪.৫৫ ১০.২২ ৩৮.১৩
  প্রার্থী দেওয়া আসনে মোট ভোটের শতাংশ ৪.৪৩ ১০.৫১ ৩৮.১
  আসনে প্রার্থী দেওয়ার অনুপাত ০.৯৮ ০.৯৯ ০.৯৯
তৃণমূল কংগ্রেস মোট ভোটের শতাংশ ৩৮.১৫ ৪৫.০৬ ৪৭.৯৪
  প্রার্থী দেওয়া আসনে মোট ভোটের শতাংশ ৪৯.৬৬ ৪৪.৮৮ ৪৮.৬৭
  আসনে প্রার্থী দেওয়ার অনুপাত ০.৭৭ ০.৯৮
জাতীয় কংগ্রেস মোট ভোটের শতাংশ ৯.৩৩ ১২.১৮ ২.৯৩
  প্রার্থী দেওয়া আসনে মোট ভোটের শতাংশ ৩৮.২ ৩৯.৩ ৯.৬৯
  আসনে প্রার্থী দেওয়ার অনুপাত ০.২৫ ০.৩২ ০.৩১
লোকসভা আসনের সংশ্লিষ্ট বিধাসনসভা আসন
রাজনৈতিক দল নির্বাচনের বছর ২০০৯ ২০১৪ ২০১৯
বামফ্রন্ট মোট ভোটের শতাংশ ৪৩.৩ ২৯.৯৪ ৭.৫৭
  প্রার্থী দেওয়া আসনে মোট ভোটের শতাংশ ৪৩.০৫ ২৯.৬ ৭.৭৬
  আসনে প্রার্থী দেওয়ার অনুপাত ০.৯৯ ০.৯৮
বিজেপি মোট ভোটের শতাংশ ৬.১৪ ১৭.০৩ ৪০.৬
  প্রার্থী দেওয়া আসনে মোট ভোটের শতাংশ ৬.২১ ১৭.৩৮ ৪০.৫৬
  আসনে প্রার্থী দেওয়ার অনুপাত ০.৯৯
তৃণমূল কংগ্রেস মোট ভোটের শতাংশ ৩১.৩১ ৩৯.৭৯ ৪৩.৭৩
  প্রার্থী দেওয়া আসনে মোট ভোটের শতাংশ ৪৭.৫৬ ৩৯.৩১ ৪৩.৬১
  আসনে প্রার্থী দেওয়ার অনুপাত ০.৬৩
জাতীয় কংগ্রেস মোট ভোটের শতাংশ ১৩.৩৩ ৯.৬৯ ৫.৬৭
  প্রার্থী দেওয়া আসনে মোট ভোটের শতাংশ ৪২.০৪ ১০.১ ৬.০৯
  আসনে প্রার্থী দেওয়ার অনুপাত ০.৩৩ ০.৯৫

সূত্রঃ নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত পরিসংখ্যান থেকে গণনা করা হয়েছে। আসনে প্রার্থী দেবার অনুপাতের সর্বাধিক সম্ভব মান ১ আর সর্বনিম্ন সম্ভব মান ০।

মোদ্দা কথা তাহলে কী দাঁড়ালো? শাসকবিরোধী হাওয়া এবারে অবশ্যই উপস্থিত ছিল, যার থেকে লাভ করেছে বিজেপি। কিন্তু এটা হয়েছে মূলত তৃণমূলের গতবারের আসন দখল করে, বিকল্প বিরোধীপক্ষ বামজোটের আগের বারের আসন দখল করে নয়। আর বামজোটের ভোট বিজেপির দিকে খানিক গেলেও মূলত গেছে শাসক দলের দিকে। বিয়োগে বিয়োগে যেমন যোগ হয় প্রধান বিরোধীশক্তি বিজেপি প্রতিপন্ন হওয়ায় তাদের জেতার সম্ভাবনার আশংকায় শাসকদল-বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে আখেরে লাভ হয়েছে শাসকদলের।

এতো গেল পাৰ্টিভিত্তিক ভোটের সমষ্টিগত বিন্যাস। এবার একটু ভেতরে ঢুকে দেখা যাক বিভিন্ন আর্থসামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে ভোটের বিন্যাস কীরকম।

একটা তত্ত্ব আছে যে মহিলাদের ভোট এই নির্বাচনে একটা বড় প্রভাব ফেলেছে। তা 'কন্যাশ্রী' এবং আরো নানা বণ্টনমূলক প্রকল্পের কারণেই হয়ে থাকতে পারে, বা প্রচারে লিঙ্গভিত্তিক যে কিছু বিভাজনমূলক প্রসঙ্গ উঠে আসে তাও অন্যবারের তুলনায় বেশি করে মহিলাদের বিজেপির থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে থাকতে পারে। দিল্লির লোকনীতি সংস্থা থেকে যে নির্বাচন-পরবর্তী ভোটার সমীক্ষা হয় তার থেকে জানা যাচ্ছে, সেই সমীক্ষার নমুনায় অন্তর্ভুক্ত মহিলাদের ৫০% তৃণমূলকে ভোট দেন, বিজেপিকে দেন ৩৭%। আরো উল্লেখযোগ্য হল এই তথ্যটি - মধ্য ও উচ্চবিত্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে কিন্তু তৃণমূল ও বিজেপির ভোট প্রায় সমান সমান কিন্তু নিম্নবিত্ত ও দরিদ্রশ্রেণির মহিলাদের মধ্যে এই ফারাক অনেকটা বেশি। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত হল যথাক্রমে ৪৬% ও ৪০%। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনেও মহিলাদের ভোটের পাল্লা তৃণমূলের দিকে ঝুঁকে ছিল (আর পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রায় সমান সমান), কিন্তু এবার তার মাত্রা নিশ্চিতভাবে বেশি।

নির্বাচনের ফলাফলে সংখ্যালঘু ভোটের প্রভাব দেখার জন্যে আমরা ২০১১ সালের সর্বশেষ জনসুমারির তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন জেলায় জনসংখ্যায় মুসলিমদের অনুপাতের সাথে বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা দেখেছি। প্রত্যাশিতভাবেই, যেখানে এই অনুপাত কম সেখানে বিজেপি-র ভোট বেশি, আর যেখানে এই অনুপাত বেশি সেখানে তৃণমূলের ভোট বেশি। কিন্তু এই সম্পর্ক তো আগে থেকেই থাকতে পারে, এই নির্বাচনে কিছু পালটেছে কি? আমরা যদি ২০১৬ সাল আর ২০২১ সালে দলভিত্তিক প্রাপ্ত ভোটের পার্থক্যটা হিসেব করি, তার সাথে জেলার জনসংখ্যায় মুসলিমদের অনুপাতের খুব সুস্পষ্ট সম্পর্ক দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, যা এই নির্বাচনে ধর্মীয় মেরুকরণের প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে ধরা যায় (চিত্র-১ দ্রষ্টব্য)। এই অনুপাত যত বেশি, তত তৃণমূলের ভোটের অংশ বেড়েছে আর তা হয়েছে মূলত বামজোটের ভোটের অংশ গতবারের থেকে কমার জন্যে। এর উলটোটাও সত্যি - হিন্দুদের অনুপাত যত বেশি, বিজেপি-র ভোটের অংশ বেড়েছে গতবারের তুলনায়, আর তা মূলত হয়েছে বামজোটের ভোটের অংশ কমার ফলে। অর্থাৎ, মেরুকরণের রাজনীতি একদিক থেকে সফল - ত্রিমুখী প্রতিযোগীতা কার্যত দ্বিমুখী হয়ে গেছে বামজোটের ভোটের ভাঁড়ার প্রায় নিঃস্ব করে। কিন্তু এই মেরুকরণের মশলা যথেষ্ট ছিলনা - অর্থাৎ, হিন্দুদের একটা বড় অংশ এবারেও ধর্মীয় ভিত্তিতে ভোট দেননি - সবচেয়ে হিন্দুপ্রধান জেলাগুলোতেও বিজেপি-র ভোট ৫০% অতিক্রম করেনি। বরং, তাদের এই নির্বাচনী নীতি সংখ্যালঘু ভোট কার্যত তৃণমুলের দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং, তুলনাটা গতবারের সাথে, তাই ভোটের প্রথাগত দলভিত্তিক বিন্যাসের কথা এখানে হচ্ছে না। ২০১৬ এবং ২০১৯-এর সাথে তুলনা করলে তৃণমুলের সংখ্যালঘু ভোটের এই বাড়তি লাভ, অন্তত মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলায় হয়েছে জাতীয় কংগ্রেসের লোকসান করে।

চিত্র-১: জেলাভিত্তিক মুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত এবং ২০১৬-২০২১ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের ভোটের অনুপাতের পরিবর্তন

সূত্রঃ নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে লেখকদের গণনা। ২৯২ আসনের হিসেব।

এবারে আসি দীর্ঘসময় ধরে আট পর্যায়ে নির্বাচন চলার এবং এই সময়ে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার বাড়তে বাড়তে আকাশছোঁয়া হবার কোনো প্রভাব ফলাফলের ওপর পড়েছে কিনা এই প্রশ্নে। মার্চের মাঝামাঝি নথিভুক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল দিনে ১০০, আর মে-র গোড়ায় তা দাঁড়ায় দিনে ১৫,০০০। আসল সংক্রমণের হার নিশ্চয়ই এই পরিসংখ্যানের থেকে বেশি, কিন্তু তাহলেও এ এক অস্বাভাবিক রকমের বৃদ্ধির হার। আমরা যদি নির্বাচনের ফলের পর্যায়ভিত্তিক বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাচ্ছে, পঞ্চম পর্যায়ের পর থেকে তৃণমূলের ভোটের অংশ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে শুধু না, বিজেপি-র ভোটের অংশ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে (চিত্র-২ দ্রষ্টব্য)। লোকনীতি-র নির্বাচন-পরবর্তী সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে যে ভোটাররা কাকে ভোট দেবেন শেষ মুহূর্তে ঠিক করেছেন, তাঁদের বিজেপি-র থেকে তৃণমূল-কে ভোট দেবার সম্ভাবনা সাধারণভাবে বেশি সব পর্যায়েই, কিন্তু নির্বাচনের পঞ্চম পর্যায়ের পরে এই প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। মনে হতে পারে, যে যে আসনে পরের দিকে ভোট হয়েছে, সেগুলো হয়তো আগের থেকেই তৃণমুলের দিকে ঝোঁকা। কিন্তু আমরা যদি ২০১৬ সালে প্রাপ্ত ভোটের সাথে তুলনা করি, তাহলেও ২০২১ সালে এই পরের দিকের ভোটে তৃণমূল লাভবান হয়েছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণ কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে মোকাবিলা করেছে তা নিয়ে অসন্তোষ ছাড়া আর কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে এই তথ্যটির? কেউ কেউ ভাবতে পারেন যে শীতলকুচির ঘটনাটি ঘটে নির্বাচনের চতুর্থ পর্যায়ে এবং তার ফলে ধর্মীয় মেরুকরণের প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হয়ে থাকতে পারে। এখন, পঞ্চম পর্যায়ের পরের ভোটে তৃণমুলের অধিকতর এগিয়ে থাকার প্রবণতাটি সব জেলাতেই উপস্থিত ছিল, তাই কোভিড-১৯ সংক্রমণের বৃদ্ধির প্রভাব ভোটারদের প্রভাবিত করেছে বলেই আমরা মনে করি। কিন্তু একথাও ঠিক যে এই প্রবণতা মুসলিম-প্রধান জেলায় আরো খানিকটা বেশি কাজ করেছে, তাই অন্য উপাদানটি একেবারে অনুপস্থিত ছিল তা বলা যায়না।

চিত্র-২: কোভিড সংক্রমণ ও তৃণমূল ও বিজেপি-র প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত

সূত্রঃ নির্বাচন কমিশন ও www.covid19india.org থেকে প্রাপ্ত সংখ্যার ভিত্তিতে লেখকদের গণনা।

এই ঐতিহাসিক নির্বাচন এবং তার ফলাফলের বিশ্লেষণ অনেকদিন ধরে চলবে। আমরা তার কয়েকটি দিক নিয়ে কিছু আলোচনা করলাম কিন্তু খানিকটা বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে কোন প্রশ্নগুলো উঠে আসে? লোকনীতি-র সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে কোন ইস্যু ভোটারদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল - শুনে অবাক লাগতে পারে, বিশেষত নির্বাচনী প্রচার আর তা নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে - কিন্তু উত্তর হল "উন্নয়ন" (৩৩%)। ভাবতে পারেন, উন্নয়ন? উন্নয়ন কোথায় চারিদিকে তো শুধু দুর্নীতি আর খয়রাতির রাজনীতি! গত এক দশকে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির পরিস্থিতি নিয়ে কিছু গতানুগতিক ধারণা আছে, যেমন সারা দেশের তুলনায় এবং আগের দশকের তুলনায় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের শ্লথগতি, যার মূলে আছে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ না থাকার কারণে বিনিয়োগের অপ্রতুলতা। অনেক প্রথাগত ভাবনাচিন্তার মত এর মধ্যে কিছু সত্যতা থাকলেও, তার থেকে যে ছবিটা উঠে আসে তা আংশিক এবং বিভ্রান্তিকর। আমাদের একজন সরকারি পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে কিছু তথ্য প্রতিষ্ঠা করেছি (তার বিস্তারিত বিবরণের জন্যে "West Bengal’s economic performance relative to India over the last three decades", Ideas for India, May 1, 2021 দ্রষ্টব্য) যার থেকে বেরিয়ে আসছে যে, এই জমানায় এই রাজ্য পুরোটা খয়রাতির খুচরো রাজনীতির ওপর চলছে, এই ধারণাটি সত্য নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকাশিত পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণ থেকে জানা যাচ্ছে, গত এক দশকে রাজ্যে কৃষিক্ষেত্রে আয়বৃদ্ধির হার সারা দেশ ও আগের দশকের তুলনায় বেশি। একই ছবি দেখা যাচ্ছে খাদ্যশস্যের উৎপাদনে, গ্রামীণ অঞ্চলে বেকারত্বের হারের পরিবর্তনে (বিশেষত, মহিলাদের ক্ষেত্রে রাজ্যে তা কমেছে, এদিকে সারাদেশে বেড়েছে), মাথাপিছু পারিবারিক ব্যয়ের বৃদ্ধির হারে এবং দারিদ্র্ররেখার নিচে থাকা মানুষের অনুপাতে। অর্থাৎ, শিল্পের ক্ষেত্রে হতাশাজনক পরিস্থিতি বা সার্বিক অর্থনৈতিক উদ্যমের অভাব দিয়ে পুরো রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা বিচার করলে পক্ষপাতের সম্ভাবনা থেকে যায়। অবশ্যই সমষ্টিগত পরিসংখ্যানের সীমাবদ্ধতা আছে। সারা দেশের তুলনায় রাজ্যের গ্রামীণ বাংলায় অর্থনীতির পরিস্থিতি কেন মন্দ নয় এবং কীভাবে তা সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলছে, তাতে ফসলের বৈচিত্র্যকরণ ও বিপণনের ভূমিকা কী, গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিযায়ী ও প্রবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের জন্যে প্রেরিত অর্থের ভূমিকাই বা কী, সত্যি 'পশ্চিমবঙ্গ মডেল' বলে কিছু একটা নির্দিষ্ট কাঠামো উঠে আসছে কিনা এইরকম অনেক প্রশ্ন ওঠে, ভালোমন্দ বিচার করা বা বিকল্প নীতি ভাবার আগে, যা আরো খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করা দরকার। কিন্তু এইটুকু পরিষ্কার যে এই ভোটের ফলাফল বুঝতে গেলে, গ্রামীণ বাংলা যেখানে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ রাজ্যবাসী বাস করেন, সেখানে কী হচ্ছে নগর ও মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক আখ্যান ছাড়িয়ে সেখানে দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক। বামফ্রন্টের সাড়ে তিন দশক ব্যাপী নির্বাচনী সাফল্যের ভিতও কিন্তু ওই গ্রামীণ বাংলাতেই গড়ে উঠেছিল।


______________________________
[লেখকদের "2021 West Bengal Assembly Election: Did the Covid-19 surge matter?" Ideas for India, May 12, 2021" প্রবন্ধের ভিত্তিতে লিখিত, যার আংশিক ও সংক্ষিপ্ত সংস্করণ 'আনন্দবাজার পত্রিকা'য় ১৭ই মে, ২০২১ তারিখে প্রকাশিত হয়েছে। এই লেখায় পরিবেশিত কিছু তথ্যের আরও বিস্তারিত বিবরণ মূল প্রবন্ধে পাওয়া যাবে।]