আরেক রকম ● নবম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২১ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

সমসাময়িক

ঝড়ের আগে ও পরে...


সুন্দরলাল বহুগুণা চলে গেলেন। অরণ্য ধ্বংসের বিরুদ্ধে, বড় বাঁধের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাঁর আন্দোলন আগামী বহু দশক ভারতবাসী মনে রাখবে। আর এমন একটা সময়ে গেলেন, যখন সাইক্লোন ইয়াসের দাপটে ভয়াবহ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বাংলার উপকূলবর্তী গ্রামগুলো। ভেসে গেছে লোকালয়, নষ্ট হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ। বহুগুণার মত মানুষ এই সময়ে দাঁড়িয়ে আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক কারণ আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি প্রকৃতি ধ্বংস করে নির্বিচারে উন্নয়নের যজ্ঞে সামিল হবার ফলাফল কী হতে পারে।

গত প্রায় দুই দশক ধরে সাইক্লোন নিয়মিতভাবে ফিরে ফিরে আসছে এবং ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে, এটার কারণ খুঁটিয়ে দেখতে গেলে সেই বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের দিকেই আঙুল উঠে যাবে। মনে রাখতে হবে, বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে নব্বইয়ের দশকে এরকম নিয়মিত সাইক্লোন তৈরি হত না। টর্নেডোর কথা তো বাদই দেওয়া গেল। মূলত সুনামির পর থেকে পরপর আয়লা বুলবুল ফণী আমফান ইয়াস ইত্যাদি ঝড় এসেই চলেছে, যেটা অশনি সংকেত। যদি স্থায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের ইঙ্গিত এগুলো হয়, তাহলে তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল কোথায় যেতে পারে কেউ জানে না। এবার এই জলবায়ু পরিবর্তন বা উষ্ণায়নের পেছনে নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংস ও শিল্পায়নের প্রভাব নিয়ে বহু আলোচনা হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। কিন্তু সেগুলোকে বাদ দিলেও, একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। সাইক্লোন যদি অবশ্যম্ভাবী হয়ও, তার ধ্বংসলীলা এত মারাত্মক আকারে যেতে পারে না যদি স্থানীয় স্তরে পরিবেশের প্রতি কিছুটা সচেতন হওয়া যায়। অন্তত বাংলার ক্ষেত্রে সেটুকুও হয়নি।

দীঘা মন্দারমণি ইত্যাদি অঞ্চল সাইক্লোনে তছনছ হয়ে গেছে। সমুদ্রের পাড় ভেঙে জল উঠে এসে ভাসিয়ে দিয়েছে বাড়ি ঘর হোটেল লোকালয় ও পেছনের গ্রামগুলো। এবার, পাড় এভাবে ভাঙল কী করে? অন্যতম কারণ, সরকারি নিয়মবিধির তোয়াক্কা না করেই হাজার হাজার অবৈধ হোটেল নির্মাণ। সেটা করতে গিয়ে নির্বিচারে সমুদ্রের ধারের জঙ্গল কেটে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বড় গাছ মাটিকে ধরে রাখে, সহজে ভূমিক্ষয় হতে দেয় না। যেই মুহূর্তে বড় গাছ কেটে সেখানে কংক্রিটের চাঙড় বসানো হয়, মাটি আলগা হয়ে যায়। সেই মাটি ঝড়ের দাপটে ধসে যেতে বাধ্য। আবার ঝাড়খণ্ডে রাঁচির সংলগ্ন অঞ্চলগুলিতে অবৈধ খনিগুলির বাড়বাড়ন্তের কারণে মাটি এমনিতেই আলগা হয়ে ছিল। এবারের সাইক্লোন তাই সেখানেও তছনছ করে দিয়েছে।

অথবা সুন্দরবন। সেখানে বহুদিন ধরে ভূমিভাগ বসে যাচ্ছে। কোনো কোনো অঞ্চলের উচ্চতা সমুদ্রতল থেকেও নিচে। আগামী হয়ত পঞ্চাশ কী একশ বছরের মধ্যে সুন্দরবন সম্পূর্ণভাবে মনুষ্য বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। কিন্তু সেখানেও নির্বিচারে কাটা হচ্ছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য, যার দৃঢ় ও গভীরপ্রসারী শিকড় মাটি ধরে রাখার কাজে অপরিসীম গুরুত্ব রাখে। গত বামফ্রন্টের আমলে সুন্দরবনে ইকো টুরিজমের নামে সাহারা কর্তা সুব্রত রায় যখন কয়েক হাজার একর জমির উপর তাঁর সাম্রাজ্য স্থাপন করতে চেয়েছিলেন, প্রমাদ গুণেছিলেন পরিবেশবিদরা। সাহারার অভ্যন্তরীণ গোলমালের কারণে সে প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু কর্পোরেট ও জমি হাঙরের ছদ্মবেশে বৃহৎ পুঁজিবাদীরা লোলুপ থাবা বাড়িয়েই আছে এখনও। অতি সম্প্রতি একটা দাবি উঠছে যে যেহেতু সুন্দরবনের মাটির বাঁধ ঝড়ে গুঁড়িয়ে গিয়েছে তাই দরকার কংক্রিটের বাঁধ। যাঁরা এই দাবি তুলছেন, ডান বাম নির্বিশেষে তাঁরা সকলেই মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। পাকা বাঁধ বানাবার মানেই হল মাটি আরও আলগা করে দেওয়া, গ্রামের পর গ্রাম জলের তোলায় আরও বেশি করে ভেসে যাওয়া। আর ইকো ট্যুরিজম থেকে পাকা বাঁধ, এই সমস্ত দাবিই উঠে আসছে এই ধ্রুব বিশ্বাস থেকে যে আঠেরো শতকের নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ধাঁচেই সমস্ত জায়গার অবিমিশ্র উন্নয়ন সম্ভব। সেই জায়গাগুলির নিজস্ব বাস্তুতন্ত্র, প্রকৃতি, মানুষের আকাঙ্ক্ষা এগুলিকে উন্নয়নের চাকার নিচে গুঁড়িয়ে দিয়েও কংক্রিট স্থাপন করতেই হবে।

প্রশ্ন উঠতে পারে যে গাছ তো লাগানো হচ্ছেই। সামাজিক বনসৃজন প্রকল্প রাজ্য সরকারের ঘোষিত প্রজেক্ট। তাহলে এই সমস্যার মোকাবিলা করা যাচ্ছে না কেন? এই সামাজিক বনসৃজন প্রকল্পে লাভের থেকে আসলে ক্ষতি হচ্ছে বেশি। কারণ যে গাছ কাটা হচ্ছে আর যে গাছ লাগানো হচ্ছে তারা এক জিনিস নয়। সুন্দরি গাছ কেটে ফিনফিনে ইউক্যালিপটাস লাগিয়ে খাতায় কলমে সংখ্যা মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে বটে, কিন্তু তাতে ভূমিক্ষয় বা নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার সমস্যা কমছে না। এ হল উন্নয়নের ধোঁকার টাটি, যার পেছনে সুপ্ত থাকে মুনাফা ও পুঁজিবাদের বিষাক্ত মুখ।

আর এই সমস্ত কিছুর বলি হচ্ছেন গরীব মানুষ, দীঘা কাকদ্বীপ গোসাবা পাথরপ্রতিমার সেই কালো অপরিচ্ছন্ন মানুষগুলো, যাঁদের আমরা বছরের অন্যান্য সময়ে ভুলে থাকি, শুধু এরকম কোনো দুর্যোগ এলে শীতঘুম থেকে গা ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠে ত্রাণবণ্টনের শহুরে শৌখিন আবেগের দাঁড়িপাল্লায় তাঁদের দুরবস্থা মেপে নিতে থাকি। যত হাজার হাজার মানুষ ত্রাণ পাঠাচ্ছেন বা নিজেরাই চলে যাচ্ছেন সেসব জায়গাতে, বছরের অন্যান্য সময়ে সেই নাগরিকেরা যদি এসব অঞ্চলের দারিদ্র্য, অর্থনীতি, পরিবেশ বাস্তু ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সচেতন থাকতেন, তাহলে জনমতের চাপে সরকার হয়ত কিছু করতেও পারত। শৌখিন অ্যাক্টিভিজমের দোহাই দিয়ে বছরের একদিন শুকনো খাবার আর কম্বল পাঠিয়ে দায় সারলে সেই মানুষগুলোরই অপমান হয়, বন্যায় যাঁদের বাড়ি ঘর গবাদি পশু ধানের খামার সমস্ত ভেসে গিয়েছে, নোনা জল ঢুকে নষ্ট হয়ে গিয়েছে ক্ষেত ও ভেড়ি, মরে গিয়েছে মাছ। এক দিনে সর্বহারা হয়ে যাবার এই আখ্যানের রচনাকার আসলে পুঁজিবাদ, তার ক্রমবর্ধমান মুনাফার লোভ, এবং উন্নয়ন নামক বিমূর্ত একটি ধারণাতে বিশ্বাস। এই বিশ্বাস ধ্রুপদী মার্ক্সবাদীদেরও, যাঁরা উনিশ শতকের মার্ক্সবাদের সনাতন সূত্রগুলিকে ছেড়ে এখনও বাইরে বেরন নি, দেখেননি যে এর মধ্যে বহু ওলটপালট ঘটে গিয়েছে, এবং পরিবেশ এসে দাঁড়িয়েছে শ্রেণিভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে। বড় বাঁধ, ভারী শিল্প ও নির্বিচার নগরায়ণ তাই কোনোমতেই সমস্ত লোকালয়ের উন্নয়নের একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না।

যদিও এসব লেখা বৃথাই হচ্ছে। কারণ সাইক্লোনের মতই মুনাফার লোভও সেই ঘুরেফিরেই আবার আসবে। দুদিন বাদেই দীঘার চত্বরে গজিয়ে উঠবে নতুন অবৈধ হোটেল। মন্দারমনীতে গাছ কাটা শুরু হয়ে যাবে। অবৈধ খাদান ও খনিতে রমরমিয়ে উঠবে শিল্পতালুকগুলি। হয়ত পাকা বাঁধ উঠবে সুন্দরবনেও। আপাতত ঝড়ের তাণ্ডবে সবকিছু একটু স্তিমিত। কয়েকদিন যাক, ঠোটের কষ থেকে রক্ত মুছে নিয়ে পুঁজিবাদ আবার পরবর্তী আহারের সন্ধানে বেরবে। এই সম্পাদকীয়র শুরুতে আসলে যা লেখা হয়েছে, পুরোপুরি ভুল। সুন্দরলাল বহুগুণাদের মনে রাখার দরকার এই ভারতবর্ষের নেই।