আরেক রকম ● নবম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুন, ২০২১ ● ১৬-৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

ভ্যাকসিন নিয়ে অবাধ বাণিজ্য


দেশের বিদেশমন্ত্রী ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী-সচিব এবং ভ্যাকসিন উৎপাদক বিভিন্ন ফার্মা কোম্পানির সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন। অনলাইনে ভার্চুয়াল বৈঠক নয়। সশরীরে দুয়ারে দুয়ারে করুণ আকুতি নিয়ে আবেদন চলছে। ভারতের জন্য ভ্যাকসিন এবং ভ্যাকসিন তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য এই দীর্ঘ সফর।

সরকারি অনুমোদন ছাড়া কোনো ফার্মা কোম্পানি ভ্যাকসিন বা তা তৈরির কাঁচামাল রপ্তানি করতে পারে না বলে মন্ত্রী-সচিবদের সন্তুষ্ট করার প্রচেষ্টা। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ফার্মা কোম্পানিগুলি এখন ভ্যাকসিনের দাম কত হতে পারে তার হিসেবনিকেশ কষতে শুরু করে দিয়েছে। একই সঙ্গে চলছে আইনি দলিল-দস্তাবেজ তৈরির কাজ। ফার্মা কোম্পানি তো ঠেকে শিখেছে। ২০২০-র ডিসেম্বরে মার্কিন কোম্পানি ফাইজার ভারতে ভ্যাকসিন পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। ভারত সরকার তখন জানিয়েছিল যে রপ্তানি চুক্তির থেকেডিসক্লেমারবা বিধিসম্মত সতর্কীকরণ শর্ত বাদ দিতে হবে। ফাইজার রাজি হয়নি। চুক্তির বিধিসম্মত সতর্কীকরণ অংশে বলা ছিল যে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর শরীরে কোনো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ফাইজার দায়ী হবে না। দেশবাসীর শরীরের কথা চিন্তা করে ভারত সরকার আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পাশাপাশি উচ্চনাদে ঘোষিত হয়েছিল আত্মনির্ভরতার কথা। দেশের দুটি বেসরকারি ফার্মা কোম্পানি সেরাম ও ভারত বায়োটেক উৎপাদিত ভ্যাকসিন ১৩৮ কোটি ভারতবাসীর সম্পূর্ণ টিকাকরণে সক্ষম বলে তখন দাবি করে ভারত সরকার ফাইজারের প্রস্তাব খারিজ করে। এখন কোন চুক্তির কোন শর্ত মেনে নিয়ে এবং কত দামে ফাইজার থেকে ভ্যাকসিন কেনা হবে তা নিয়ে ভারত সরকারের কোনো বিবৃতি প্রকাশিত হয়নি।

দেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী জানিয়েছেন যে এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই সমগ্র ভারতীয়র টিকাকরণ সম্পূর্ণ হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও একই দাবি করা হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী তখন অ-বিজ্ঞানের কারবারিকে পাশে বসিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি। কিন্তু কোত্থেকে আসবে এত ভ্যাকসিন? সকলেই নিরুত্তর। অথচ ভারত সরকার কেরল হাই কোর্টে সম্প্রতি হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে যে এখন মাসে সাড়ে ৮ কোটি ভ্যাকসিন উৎপাদন হচ্ছে ভারতে। দৈনিক হিসেব করলে বলা যায়, গড়ে ২৮ লক্ষ ৩৩ হাজার ভ্যাকসিন প্রতিদিন তৈরি করছে ভারত। অথচ দেশে দৈনিক টিকাকরণ হচ্ছে ১২-১৩ লক্ষ। সরকারি বয়ানে আরও বলা হয়েছে যে দেশে রোজ যত টিকা উৎপাদন হয়, তার মাত্র ৫৭ শতাংশ পৌঁছয় দেশের মানুষের কাছে। তবে বাকি টিকা কোথায় যাচ্ছে? রাজ্যগুলিকে টিকা সরবরাহে তাহলে সমস্যা কোথায়? এই প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রের তরফে বলা হয়েছে, টিকা সরবরাহ নিয়ে এখনও কোনো বিশেষ নীতি নির্ধারণ করেনি কেন্দ্র। তবে টিকা সরবরাহের প্রক্রিয়া আগামী দু’মাসে কিছুটা উন্নত হবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় সরকার।

হাসপাতালে জায়গা নেই। রয়েছে অক্সিজেনের অভাব। ভ্যাকসিন পাওয়া যাচ্ছে না। ভ্যাকসিন পাওয়া এবং না পাওয়া নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। স্বাস্থ্য পরিষেবায় সামগ্রিক হাহাকার দেখা যাওয়ার সময় ভ্যাকসিন জোগাড়ের দায় রাজ্যগুলির হাতে তুলে দিয়ে ভারত সরকার দায়মুক্ত হয়ে গেছে। স্বভাবতই ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য চলছে অলিখিত প্রতিযোগিতা। ভ্যাকসিনের দামের উপর কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কালোবাজারির সম্ভাবনা রয়েছে। হয়তো হচ্ছেও। দেশের দুটি ভ্যাকসিন উৎপাদক বেসরকারি সংস্থা হওয়ায় তারা বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন দামে ভ্যাকসিন সরবরাহ করছে। ফার্মা কোম্পানি এবং বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে একটা অস্বচ্ছ সংযোগ তৈরি হয়েছে। কলকাতার তিনটি খ্যাতনামা বেসরকারি হাসপাতালে ভ্যাকসিন বিভিন্ন দামে পাওয়া যাচ্ছে। অথচ সরকারি পরিষেবায় ভ্যাকসিন অমিল। অর্থাৎ খোলা বাজারে ভ্যাকসিন নিয়ে অবাধ কালোবাজারি চলছে।

সরকারি তথ্য অনুসারে ২৭ মে পর্যন্ত ভারত বায়োটেক উৎপাদিত কোভ্যাক্সিনের ২ কোটি ১০ লক্ষ ডোজ ব্যবহার করা হয়েছে দেশে। কিন্তু এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট বলছে, এই সময়ে উৎপাদনের পরিমাণ অন্তত ৬ কোটি। তা হলে বাকি ৪ কোটি গেল কোথায়?

২০ এপ্রিল ভারত বায়োটেক জানিয়েছিল যে তারা মার্চে দেড় কোটি এবং এপ্রিলের শেষে ২ কোটি ভ্যাকসিন উৎপাদন করেছে। আরও জানানো হয়েছিল যে মে মাসে ৩ কোটি ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হবে। গত ২৪ মে কেন্দ্র আদালতে এক হলফনামায় জানানো হয়েছিল প্রতি মাসে ২ কোটি টিকা তৈরি করছে কোভ্যাক্সিন।

মে মাসে যদি ভারত বায়োটেক ৩ কোটির লক্ষ্যমাত্রায় না-ও পৌঁছতে পারে, তা হলেও হিসাব অনুযায়ী ২ কোটি টিকা উৎপাদন হয়েছেই। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে মে মাসের শেষ পর্যন্ত মোট সাড়ে ৫ কোটি ভ্যাকসিন উৎপাদন হওয়ার কথা।

আবার দেশে টিকাকরণ কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগে ভারত বায়োটেক ৫ জানুয়ারি জানিয়েছিল যে তাদের হাতে ২ কোটি ভ্যাকসিন মজুত আছে। অর্থাৎ টিকাকরণ শুরু হওয়ার আগে মজুত থাকা ২ কোটি ভ্যাকসিন এবং মে-র শেষ পর্যন্ত উৎপাদিত সাড়ে ৫ কোটি ভ্যাকসিন মিলিয়ে সাড়ে ৭ কোটি ভ্যাকসিন থাকার কথা। এর সঙ্গে জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারির উৎপাদনের হিসেব যদি জুড়ে দেওয়া হয়, তাহলে ভ্যাকসিনের মোট ডোজের সংখ্যা দাঁড়ায় অন্তত ৮ কোটিতে।

এর মধ্যে কিছু ভ্যাকসিন কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে রফতানি হয়েছে। দেশে উৎপাদিত সব সংস্থার ভ্যাকসিন যদি একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়, তা হলে দেখা যাচ্ছে ৬ কোটি ৬০ লক্ষ ভ্যাকসিন রফতানি করা হয়েছে। তার মধ্যে বেশির ভাগই আবার সেরাম উৎপাদিত কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন। তার মধ্যে ২ কোটি কোভ্যাক্সিন ভ্যাকসিন থাকলেও, হাতে ৬ কোটি তা হলে থাকার কথা। তার মধ্যে ২৭মে পর্যন্ত যদি ২ কোটি কোভ্যাক্সিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে (সরকারি হিসেব অনুযায়ী), তাহলেও হাতে আরও ৪ কোটি ভ্যাকসিন থাকার কথা। সবমিলিয়ে কেন্দ্রীয় স্তরে ভ্যাকসিন সংগ্ৰহ করে বন্টন ব্যবস্থা গড়ে না তোলায় ফার্মা কোম্পানি দুটি অবাধে মুনাফা অর্জন করে চলেছে। দেশের মানুষের প্রতি তাদের কোনো দায়িত্ব নেই।

দেশের মানুষের প্রতি রাষ্ট্রেরই বা দায়িত্ব কোথায়? কোভিডের প্রতিষেধক এবং চিকিৎসার জন্য ওষুধের উপরেও ৫ শতাংশ হারে জিএসটি আদায় করতে চায় কেন্দ্র। পিপিই-কিটেও তাই। ভেন্টিলেটরে জিএসটি ১২ শতাংশ থেকে কমাতেও কেন্দ্র নারাজ। প্রধানমন্ত্রী মাস্ক পরতে বলছেন। কিন্তু তাঁর সরকার এন-৯৫ বা তিন স্তরের মাস্কের উপর জিএসটি ৫ শতাংশ থেকে কমাতে রাজি নয়। হাত ধোয়ার স্যানিটাইজার থেকে শরীরের তাপমাত্রা মাপার যন্ত্রেও ১৮ শতাংশ হারে কেন্দ্র জিএসটি চাপাতে চায়।

অথচ দেশে ভ্যাকসিনের আকাল। বিদেশি ভ্যাকসিন আমদানির জন্য স্বয়ং বিদেশমন্ত্রী হন্যে হয়ে দুয়ারে দুয়ারে হানা দিচ্ছেন। রাশিয়ার স্পুটনিক ভ্যাকসিন যা এখনও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুমোদন পায়নি তা আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমেরিকার চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা পত্রিকা ‘জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন'-এ চিনের ফার্মা কোম্পানি সিনোফার্ম-এর তৈরি দুটি ভ্যাকসিন সম্পর্কে আশাব্যঞ্জক মন্তব্য করায় অদূর ভবিষ্যতে হয়তো চিনের থেকেও ভ্যাকসিন আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে দেশে যখন সংক্রমণের ভয়াবহ পরিস্থিতি চলছে, রাজ্যগুলোতে ভ্যাকসিনের আকাল দেখা দিচ্ছে, বহু জায়গায় পর্যাপ্ত ভ্যাকসিনের অভাবে টিকাকরণ বন্ধ রাখার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে ৪ কোটি কোভ্যাক্সিন কোথায় ‘উধাও’ হয়ে গেল!

আত্মম্ভীরতা সর্বস্ব ঔদ্ধত্যকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্যই শুধুমাত্র ভ্যাকসিন নয় সামগ্রিক চিকিৎসা পরিষেবার দুর্দশা এখন প্রকট হয়ে গেছে। বিজ্ঞানী-বিশেষজ্ঞ-গবেষকরা ছাড়াও স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গত নভেম্বরে নিজেদের রিপোর্টে কেন্দ্রীয় সরকারকে একাধিক সুপারিশ করেছিল। হাসপাতালগুলিতে অক্সিজেনযুক্ত শয্যা, আইসিইউ শয্যা, ভেন্টিলেটরের সংখ্যা বাড়ানোর উপরে জোর দেওয়া হয়েছিল। সে জন্য স্বাস্থ্য খাতে জিডিপি-র প্রায় ২.৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়েছিল। বড়ো হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলিতে নিজস্ব অক্সিজেন প্লান্ট গড়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।

গত বছর দেশে করোনার সংক্রমণ কমে আসার পরে বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠীর বৈঠকও কমে যায়। এই বছরের গোড়ায় বিজ্ঞানীদের করোনা সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের একটি মাত্র বৈঠক হয়েছে। এর পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, সরকারের কোভিড সংক্রান্ত পরামর্শদাতা গোষ্ঠীর অনেকেই প্রবীণদের প্রতিষেধকের আওতায় আনার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন যাতে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু কমে যায়। অন্য দিকে অপেক্ষাকৃত তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিজের গতিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে সংক্রমণ প্রতিরোধের 'হার্ড ইমিউনিটি' গড়ে উঠুক, এমন ভাবা হয়েছিল। এই নীতি কিন্তু সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল ব্রিটেন ও সুইডেনে। তা সত্ত্বেও একই নীতিতে ভরসা রেখেছিল সরকার। এইসব কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে আবারও প্রমাণিত হয় যে দেশের সরকার শুধুমাত্র সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যর্থতার পাশপাশি দেশবাসীর জীবন রক্ষা করতে আগ্রহী নয়। একই সঙ্গে বেসরকারি ফার্মা কোম্পানি, হাসপাতাল, চিকিৎসার জন্য অত্যাবশ্যক যন্ত্রপাতি সাজসরঞ্জাম নির্মাতাদের জন্য কোনো নিয়ম-নিয়ন্ত্রণে উৎসাহী নয়। মানুষের জীবনের থেকে বেসরকারি সংস্থাগুলির মুনাফা বৃদ্ধি দেশের সরকারের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

এর সঙ্গে রয়েছে টিকা নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতির অভাব। অনেকেই মনে করছেন, ভাঁড়ারে যথেষ্ট প্রতিষেধক না-থাকা সত্ত্বেও বিদেশে প্রচুর টিকা রফতানির ফলে দেশে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। উপরন্তু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দু’টি মাত্র সংস্থার ভরসায় ভারতের মতো বিশাল জনসংখ্যার দেশে টিকাকরণ শুরুর পরিকল্পনা যথেষ্ট ঝুঁকির ছিল। ফলে এখন যথেষ্ট পরীক্ষামূলক প্রয়োগ না-করেই বিদেশি প্রতিষেধককে ছাড়পত্র দিতে হচ্ছে। গত ১৫ জানুয়ারি দেশে গণ-টিকাকরণ শুরু হয়েছে। আর কোভিড রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে। অর্থাৎ হাতে এক মাসও পাওয়া যায়নি। অনেকেই দ্বিতীয় ডোজ় পাওয়ার আগে আক্রান্ত হয়েছেন।

একই সঙ্গে নজরে আসছে ভারতে ভ্যাকসিন উৎপাদনে সক্ষম সাতটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে ভ্যাকসিন তৈরির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে না। হিমাচল প্রদেশের দ্য সেন্ট্রাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট, তামিল নাডুর বিসিজি ভ্যাকসিন ল্যাবরেটরি, পাস্তুর ইনস্টিটিউট অফ ইণ্ডিয়া আরএইচএলএল বাওটেক, উত্তর প্রদেশের ভারত ইমিউনোলজিক্যাল অ্যাণ্ড বায়োলজিক্যাল কর্পোরেশন লিমিটেড, মহারাষ্ট্রের হ্যাফকিন বায়ো-ফার্মাসিউটিকালস্ আর তেলেঙ্গানার হিউম্যানস্ বায়োলজিকালস্ ইন্সটিটিউটকে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কেন? কেউ জানে না। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলিও এই প্রশ্ন উত্থাপন না করায় স্বৈরাচারী আচরণ আরও আগ্রাসী হয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

আত্মপ্রচার সর্বস্ব শাসক টিকাকরণ পদ্ধতিতে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়ে মানুষের সামনে প্রতিদিন অন্য কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে জল ঘোলা করার চেষ্টা করে চলেছে। ভ্যাকসিন বা টিকাকরণ সংক্রান্ত সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়ার জন্য কখনো লাক্ষাদ্বীপে অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা হচ্ছে। কোথাও আবার ১৯৫৫-র নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী মুষ্টিমেয় অমুসলিম বিদেশিকে নাগরিক স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। অসমে সমস্ত মাদ্রাসা স্কুলের অনুমোদন রাতারাতি বাতিল করে দেওয়া হল। সমাজমাধ্যমে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় নিয়ন্ত্রণ আনারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে একটাই লক্ষ্য মানুষ যেন ভ্যাকসিন ছাড়া অন্যান্য বিষয় নিয়ে শঙ্কিত থাকে।

প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত প্রিয় অনুষ্ঠান 'মন কী বাত'-এ তাঁর সরকারের প্রথম সংস্করণের সপ্তম বর্ষ পূর্তি অথবা দ্বিতীয় সংস্করণের দ্বিতীয় বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে তিনি হঠাৎ করেই জানালেন যে তাঁর নেতৃত্বে দেশের যা কিছু সাফল্য অর্জিত হয়েছে তা নাকি সামগ্রিকভাবে দেশবাসীর কৃতিত্ব। এখানেই সন্দেহ সৃষ্টি হয়। এই সেদিন পর্যন্ত যাবতীয় কৃতিত্ব-সাফল্য নিজের, শুধুমাত্র তাঁর নেতৃত্বের বলে দাবি করতে থাকার পর তিনি হঠাৎ করে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেশবাসীর ভূমিকার স্বীকৃতি কেন দিতে চাইছেন। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে তাঁর ব্যর্থতার জন্য দেশবাসী দায়ি নয়। দেশের মানুষ সেই ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব কেন নেবে? এ যেন সেই পুরোনো প্রবাদ,- জিতলে নিজের জয় আর হেরে গেলে সকলের ব্যর্থতা। পরিবার পরিজন দস্যু রত্নাকরের অপরাধের দায়িত্ব নিতে রাজি না হওয়ায় তিনি দস্যুবৃত্তি ত্যাগ করে রামায়ণ রচনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। রাম তথা রামায়ণ নিয়ে যাঁরা সর্বদা মাতামাতি করতে অভ্যস্ত তাঁদের নিশ্চয়ই রামায়ণ রচনার প্রাক্-পর্বর এই কাহিনী মনে আছে। তাঁরা জেনে রাখুন যে সংক্রমণ মোকাবিলায় তাঁদের ব্যর্থতার দায়ভার দেশের মানুষ বহন করতে রাজি নয়। জীবন ও জীবিকা রক্ষার কাজ দেশের মানুষ নিজেরাই যা হোক করে সামলে নিতে পারবে। হয়তো আরও কিছু প্রাণ যাবে। আর্থিক অবস্থা তলানিতে পৌঁছবে। কিন্তু দিনের শেষে সংক্রমণ মুক্ত যে সমাজ গড়ে উঠবে সেখানে কোনো আত্মপ্রচার সর্বস্ব অহঙ্কারী ঔদ্ধত্যপূর্ণ স্বৈরাচারী এবং তাঁর ভক্তবৃন্দের ঠাঁই হবে না।