আরেক রকম ● নবম বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২১ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

সমসাময়িক

ইজরায়েল নয়, প্যালেস্তাইনের পক্ষে


ঈদের আগে রমজানের শেষ জুম্মাবার। স্থান জেরুজালেমে অবস্থিত আল-আকসা মসজিদ। ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। সেখানে হ্যান্ড গ্রেনেড ও রবার বুলেট নিয়ে আক্রমণ করছে ইজরায়েলী পুলিশ। তারপরের দৃশ্য আল-আকসা মসজিদে আগুন। দেওয়ালের এপারে একদল উগ্র ইহুদী মানুষ গানের তালে তালে নাচছেন। কী সেই গান? প্যালেস্তাইন ধ্বংস হোক। গোটা পৃথিবীতে যখন মানুষ করোনা ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ চালাচ্ছে তখন ইজরায়েল সরকার আবারও হানা দিল প্যালেস্তাইনে। রকেট ছোঁড়া হল গাজায়। আল-জাজিরার দপ্তর বোমারু বিমানের হানায় গুড়িয়ে দেওয়া হল। ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের প্রাচীন বিরোধ আবার পরিণত হল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে।

ইজরায়েল পৃথিবীর সম্ভবত একমাত্র দেশ যার কোনো ঘোষিত মানচিত্র নেই। কারণ দেশটি ক্রমপ্রসারমান। লাগাতার প্যালেস্তাইনের জমি অধিগ্রহণ করে, সেখানকার বাসিন্দাদের তাড়িয়ে ইহুদী মানুষদের বসতি তৈরি করা হয়ে চলেছে কয়েক দশক ধরে। ফলত, প্যালেস্তাইনের মানুষ গাদাগাদি করে থাকেন গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে। কিছু মানুষ রয়ে গেছেন জেরুজালেমে। সেই ঐতিহাসিক জেরুজালেম যা ইহুদী-খ্রিস্টান-মুসলমানদের পূণ্যভূমি। সেখানে জোর করে ইজরায়েল নিজের রাজধানী ঘোষণা করেছে সমস্ত আন্তর্জাতিক নিয়ম উল্লঙ্ঘন করে। এখন সেখানে অবস্থিত বাকি যেকটি আরব পরিবার রয়েছে তাদের তাড়াতে চায় ইজরায়েল। প্রধানমন্ত্রী নেতানয়াহু নানান দুর্নীতির অভিযোগে কোণঠাসা। অতএব ফিরিয়ে আনা হল প্রাচীন দ্বন্দ্বকে। ইজরায়েল সেনা-পুলিশ-উগ্র ‘জাওন’বাদী যুবক তারা বিভিন্ন শহরে প্যালেস্তানি মানুষের বাড়ি বাড়ি হামলা চালাচ্ছে। তাদের জোর করে বিতাড়িত করা হচ্ছে।

অন্যদিকে, প্যালেস্টাইন শাসনরত সংগঠন বহু বছর ধরে মানুষের স্বাধীনতা ও মানবিক অধিকার সুরক্ষা করতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে ইজরায়েল যে কোনো সমাধানকে বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। অতএব প্যালেস্তিনি মানুষের মধ্যে জনসমর্থন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে উগ্রবাদী সংগঠন হামাস। এই পরিস্থিতিতে ইজরায়েলী আক্রমণের বিরুদ্ধে হামাস ইজরায়েলের দিকে রকেট ক্ষেপন করেছে, যাকে অজুহাত করে ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের মানুষের উপর অত্যাচার নামিয়ে এনেছে। হিংসার এই চক্র বহু মানুষের প্রাণহানী ঘটাবে। অবিলম্বে হানাহানি বন্ধ হওয়া উচিত। আল-আকসা মসজিদ ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। জেরুজালেম বা অন্যান্য শহর থেকে জোর করে আরবদের বিতাড়িত করা যাবে না। এই প্রক্রিয়া যদি আন্তর্জাতিক মহল শুরু করতে না পারে তবে করোনা আবহের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হতে পারে যা মানবজাতির অবিমৃশ্যকারিতা ও হিংসার জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে।

এই পরিস্থিতিতে ভারত সরকার বহুযুগের নীতি বদলে ইজরায়েলকে সমর্থন করেছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না তার কারণ। তীব্র মুসলমান বিদ্বেষ থেকে প্যালেস্তাইনের মুসলমান মানুষের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের হিংসাকে সমর্থন জানানোর সূত্রপাত। অথচ, আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকেই ভারত প্যালেস্তাইনের পাশে দাঁড়িয়েছে। স্বয়ং গান্ধীজি প্যালেস্তাইনের দাবিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। কিন্তু আজকের ভারতবর্ষে পূজিত হয় নাথুরাম, অতএব গান্ধীর সমর্থন আজ বাতিল।

কিন্তু এই সমর্থনের নেপথ্যে রয়ে গেছে ইতিহাসের এক নির্মম ঠাট্টা। ইহুদীদের বিরুদ্ধে হিটলারের দমনপীড়নকে সমর্থন করে আরএসএস ও তাদের গুরুরা - যেমন গোলওয়ালকার। নাজি পার্টির আদলে গড়ে তোলা হয়েছে আরএসএস সংগঠন। যে ইহুদীদের সংহারকে আরএসএসের গুরুরা সমর্থন করেছে এখন তাদের শিষ্যরা সেই ইহুদীদের হয়ে গলা ফাটাচ্ছে প্যালেস্তাইনের বিরুদ্ধে। ইজরায়েল সরকার যদি জানতে পারে যে বর্তমানের ভারতীয় সরকারের রাজনৈতিক গুরুরা ইহুদী নিধনের সমর্থক তাহলে তাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে?

প্যালেস্তাইনের লড়াই পৃথিবীর বুকে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্যালেস্তাইনের মুক্তি ছাড়া মানবমুক্তির পথ সুগম হতে পারে না। অতএব প্রগতিশীল ও বামপন্থী শক্তির অবশ্য কর্তব্য ইজরায়েলের বিরুদ্ধে এবং প্যালেস্তাইনের মানুষের স্বাধীনতার পক্ষে মুখর হওয়া। ভারত সরকারকে বাধ্য করতে হবে বহু দশক ধরে লালিত প্যালেস্তাইনের প্রতি সমর্থনের পথে আবার ফিরে আসতে হবে। রবীন্দ্রনাথ-নেহরু-গান্ধী ভারতের স্বাধীনতার যে সংকল্প করেছিলেন তা প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতা ব্যতিরেকে অসম্পূর্ণ।