আরেক রকম ● নবম বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২১ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

সমসাময়িক

পরাজিত বিজেপি, তবু...


পাঁচটি রাজ্য তথা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়েছে। অসমে বিজেপি সরকার তৈরি করেছে। কিন্তু কেরল, তামিলনাডু ও পশ্চিমবঙ্গে তারা পরাজিত। পুডুচেরীতে বিজেপি জোট করে সরকার গড়ার দিকে এগিয়েছে। এই নির্বাচনের ফলে কয়েকটি প্রবণতা ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাবে আগামীদিনে। তা নিয়েই এই নিবন্ধ।

প্রথমত, বিজেপি-র ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে তারা লোকসভা নির্বাচনে যত ভোট পায়, তার পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে তার থেকে কম জনসমর্থন তারা আদায় করতে পারে। এর অনেকগুলি কারণ রয়েছে। লোকসভা নির্বাচনে লোকে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের জন্য বা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করার জন্য ভোট দেয়। মোদীর মতন একজন শক্তিশালী নেতা থাকার ফলে মানুষের জনসমর্থন আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় বিজেপি। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের পরিধি স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয়। রাজ্য স্তরের নেতা, বা আরো গভীরে গেলে জেলা স্তরের নেতা ও সংগঠন না থাকলে সেখানে নির্বাচনে জেতা সহজ নয়। তদুপরি, রাজ্যগুলির স্থানিক বৈশিষ্ট্যকে শুধুমাত্র হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের স্লোগানে ধ্বস্ত করে 'এক-দেশ এক-পার্টি এক-নেতা' - এই একমাত্রিকতায় যে গড়ে তোলা খুব কঠিন, তাই এই নির্বাচনের মূল শিক্ষা।

বিজেপি সমস্ত রাজ্যেই প্রচার করে যে ‘ডবল ইঞ্জিনের সরকার’ থাকলে রাজ্যে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাবে। অর্থাৎ, কেন্দ্রে বিজেপি সরকার এবং রাজ্যেও যদি বিজেপি সরকার থাকে তাহলে উন্নয়নের সুফল ভোগ করবে রাজ্যের বাসিন্দারা। এই নির্বাচনে তিনটি বড় রাজ্যের নাগরিকেরা বিজেপি-র এই স্লোগানকে মেনে নেননি, তারা তার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। সিএসডিএস সংস্থার তরফে নির্বাচন পরবর্তী সমীক্ষায় প্রশ্ন করা হয়েছিল যে রাজ্যের উন্নয়নের জন্য কি রাজ্যে ও কেন্দ্রে একই সরকারের প্রয়োজন রয়েছে, আপনার কী মত? এর উত্তরে তামিলনাডুতে মাত্র ১১ শতাংশ সহমত পোষণ করেছেন, কেরলে ১৯ শতাংশ এবং পশ্চিমবঙ্গে ২৬ শতাংশ। একমাত্র অসমে ৪১ শতাংশ মানুষ এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। নির্বাচনের ফলেই স্পষ্ট এই প্রশ্নের গুরুত্ব। অসমে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে, বাকি রাজ্যগুলিতে তারা পরাজিত। কাজেই সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে যে ‘ডবল ইঞ্জিনের সরকার’-এর যেই তত্ত্ব মোদী ও বিজেপি রাজ্যের মানুষের কাছে বিলি করেছিলেন, অসম ব্যতিরেকে বাকি রাজ্যের মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

আরেকটি বিষয় যা গোটা ভারতের সামনে একটি জটিল রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্থাপন করে তা হল নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসি। এই দুই জোড়া ফলার মাধ্যমে বিজেপি তার কাঙ্ক্ষিত হিন্দু রাষ্ট্র বাস্তবায়িত করতে চায়। সিএসডিএস-এর নির্বাচন পরবর্তী সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে অসমে ৪৭ শতাংশ মানুষ সম্পূর্ণভাবে সিএএ-র বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন, কেরলে ৫৭ শতাংশ, তামিলনাডুতে ৩২ শতাংশ এবং পশ্চিমবঙ্গে ৩৩ শতাংশ। এনআরসি-র ক্ষেত্রে অদ্ভুত একটি ছবি দেখা যাচ্ছে। অসমে মাত্র ৭ শতাংশ ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে এনআরসি-র বিরুদ্ধে বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে। কেরলের ক্ষেত্রে ৫২ শতাংশ মানুষ, তামিলনাডুতে ১৭ শতাংশ এবং পশ্চিমবঙ্গে ৩৫ শতাংশ মানুষ সম্পূর্ণভাবে এনআরসি-র বিরুদ্ধে তাদের মতামত জানিয়েছেন। এই তথ্যের মাধ্যমেই আমাদের অসমের ফলাফলের দিকে তাকাতে হবে।

একদিকে অসমের মানুষের অধিকাংশ সিএএ আইনের পক্ষে আবার খুবই কম সংখ্যক মানুষ এনআরসি-র বিপক্ষে তাদের মতামত জানিয়েছেন। এই মতামতকে পরস্পর বিরোধী বলে ভাবলে তা ভুল হবে। আসলে, অসমে দুটি জাতীয়তাবাদী ধারা বহুদিন ধরে রাজনৈতিক আঙিনায় বিদ্যমান। একদিকে অসমের খণ্ড জাতীয়তাবাদ যা অসমের মানুষের স্বাধীকারের কথা বলে, যারা মনে করে যে অসমে শুধুমাত্র অসমীয়ারা থাকতে পারেন, যারা এনআরসি করার মাধ্যমে তথাকথিত অ-অসমীয়াদের অসম থেকে বিতাড়িত করতে চায়। যারা আবার নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে ধর্মের নামে নাগরিকত্ব দেওয়ার বিরোধীতা করে এই কারণে নয় যে তা ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে যায়, এই কারণে যে তা অ-অসমীয়া মানুষকে অসমে বাস করার ছাড়পত্র দেয়। ধরুন কোনো বাঙালি হিন্দুর নাম এনআরসি থেকে বাদ গেছে এবং তিনি সিএএ-র মাধ্যমে আবার নাগরিকত্ব পাচ্ছেন। অসমের জাতীয়তাবাদ প্রথমটার পক্ষে এবং দ্বিতীয়টার বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান জানায়। কিন্তু বিজেপি-র হিন্দু জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে তা গ্রহণীয় নয়। বিজেপি-র মতানুযায়ী সেই হিন্দু ব্যক্তির নাম এনআরসি থেকে বাদ গেলেও তিনি সিএএ-র মাধ্যমে আবার নাগরিকত্ব ফিরে পেতে পারেন। অন্যদিকে, এনআরসি-র ফলে অসমে যাদের নাম বাদ গিয়েছে তাদের অধিকাংশই হিন্দু। তাই বিজেপি এই এনআরসি নিয়ে সন্তুষ্ট নয়, তারা আবার এনআরসি করতে চায়। তাই অসমের মানুষের একটি ছোট অংশ এনআরসি-র বিরুদ্ধে। এমনকি মুসলমান রাজনীতিবিদরাও মনে করেন যে এনআরসি-র মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে তাদেরকে যে বিদেশী তকমা দেওয়া হয়েছে, তা বন্ধ হবে। তাই আরো পোক্ত এনআরসি-র দাবি হিন্দুদের একটি বড়ো অংশ বিজেপিকে ভোট দিয়েছে।

সিএসডিএস-র সমীক্ষা অনুযায়ী অসমে ৬৭ শতাংশ হিন্দু বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। এদের মধ্যে অসমীয়া এবং বাঙালি উভয় ভাষার হিন্দুরাই রয়েছেন। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে যে হিন্দু পরিচিতি সত্ত্বা অসমীয়া পরিচিতি সত্ত্বাকে হারিয়ে দিয়েছে। তাই সিএএ অসমীয়া পরিচিতি সত্ত্বার বিরোধী এই কথা অসমীয়া জাতীয়তাবাদ জানা সত্ত্বেও তারা বিজেপিকে ভোট দিতে দ্বিধা করেনি। আসলে অন্য মানুষের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ খণ্ড জাতীয়তাবাদ বড় জাতীয়তাবাদেই বিলীন হয়ে যায়। অসম তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অসমে বিজেপি-র বিপুল জয় এই বার্তাই দেয় যে বিজেপি অন্যান্য রাজ্যে পরাজিত হলেও তাদের রাজনীতি ও মতাদর্শ যে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়েছে তা নয়, বরং তা নতুন নতুন সমীকরণে মাথাচাড়া দিচ্ছে।

এই নির্বাচনে বাম রাজনীতির দিক থেকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জিত এসেছে কেরলে। চার দশকের বেশি সময় ধরে কেরলে যে রাজনৈতিক প্রবণতা তৈরি হয়েছিল, যে পাঁচ বছর অন্তর অন্তর সরকার পরিবর্তন হয়, তা এবারের বাম জোট ভেঙে দিয়েছে। ২০১৬ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করার পরে ২০২১ সালে চার দশকের পরম্পরা মানলে কংগ্রেসের জয়ী হওয়ার কথা। কিন্তু ২০২১ সালে বাম গণতান্ত্রিক জোট ৯৯ আসন পেয়ে জয়ী হয়েছে। কেরল তথা দেশের বাম রাজনীতির জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।

মনে রাখতে হবে কেরলে বিগত পাঁচ বছরে বহু সংকট এসেছে। নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ, বিধ্বংসী বন্যা, করোনা ভাইরাসের ভয়ানক সংক্রমণ এবং সবরীমালাকে কেন্দ্র করে বিজেপি তথা আরএসএস-এর বাম বিরোধী সাম্প্রদায়িক প্রচার। এই সমস্ত বাধাকে জয় করে কেরলে বামপন্থীরা মানুষের সমর্থন আদায় করেছেন। কেরলে বিজেপি শূন্য আসন পেয়েছে। কীভাবে এই জয় সম্ভব হল।

বামপন্থী সরকার যে বিকল্প নীতি প্রণয়ন করবে এই কথা কেরলের সরকার প্রমাণ করেছে। নিপা ভাইরাসকে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা, বন্যার পরে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, ঘরবাড়ি-সম্পত্তি নতুন করে তৈরি করা, করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করা সবটাই করা হয়েছে বাম মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে, বিকল্প পথে হেঁটে। গোটা দেশে লকডাউন। পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা দেখছে গোটা দেশ। তার মধ্যেই কেরলে অন্য ছবি। বলা হল এরা আমাদের অতিথি। সেই অতিথিদের দায়িত্ব নিল সরকার। বাড়ি বাড়ি রেশন পৌঁছে দেওয়া হল। বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হল করোনা রোগীর। এমনকি দ্বিতীয় ঢেউ আসার আগে অক্সিজেনের উৎপাদন বাড়ানো হল। গোটা দেশে অক্সিজেনের জন্য হাহাকার। কিন্তু কেরলে অক্সিজেন উদ্বৃত্ত। একই সঙ্গে সরকারী স্কুল ও হাসপাতালের প্রভূত উন্নতি, ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিতকরণ, ছোট শিল্পের উপরে জোর দেওয়া, সবটাই করা হয়েছে সম্পূর্ণভাবে দেশের অর্থনৈতিক মডেলের বিকল্প হিসেবে। এই পরিমাণ জনদরদী সরকারের পাশে কেরলের মানুষ দাঁড়িয়েছেন, পিনারাই বিজয়নকে পুনরায় নির্বাচিত করেছেন।

রাজনৈতিকভাবে বিজেপি-র বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ শানিয়ে গেছেন মুখ্যমন্ত্রী। লড়ছেন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের তাঁর কমরেডদের মতন প্রধান শত্রুকে চিহ্নিত করতে তাঁর কোনো সমস্যা হয়নি। এনআরসি-সিএএ-র বিরুদ্ধে লাগাতার রাজনৈতিক প্রচার চালিয়েছে পার্টি ও সরকার। চ্যালেঞ্জ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী বিজেপিকে যে একটি আসনও তারা জিতবে না। ভোটের ফলাফল বলছে বিজেপি কেরলে শূন্য। আবার সবরীমালাতে সুপ্রিম কোর্ট মহিলাদের প্রবেশাধিকার দেওয়ার পরে বিন্দুমাত্র কুন্ঠা না করে বাম সরকার জানায় যে তারা এই রায়ের পক্ষে থাকবে এবং মহিলারা এই মন্দিরে যাতে ঢুকতে পারে তার ব্যবস্থা করবে। কংগ্রেস ও বিজেপি রাস্তায় খণ্ডযুদ্ধে নামে। কিন্তু বাম সরকারকে টলানো যায়নি। পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে বলে। বাম সরকার তাতেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বলা যেতে পারে গোটা দেশের সামনে বিকল্প রাজনীতি ও নীতি কেমন হওয়া উচিত তার উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট পরিচালিত কেরল সরকার। তারা গোটা দেশের বাম আন্দোলনকে অনুপ্রেরণা দেবে, বিশেষ করে রাজ্যের বাম নেতারা কেরল থেকে শিখবেন যে কীভাবে বাম পথে অটল থেকেও মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা যায়, এই আশা অমূলক নয়।

কিন্তু কেরলেও বিজেপি ১১.৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে, যা তাদের রেকর্ড ভোট। তামিলনাডুতে সেখানে বিজেপি পেয়েছে মাত্র ২.৬২ শতাংশ ভোট। অসম এবং পশ্চিমবঙ্গকে এর পাশে রাখলে বোঝা যাবে যে পাঁচ বছর আগের তুলনায় প্রায় প্রত্যেকটি রাজ্যেই বিজেপি তাদের ভোট বা আসন সংখ্যা বাড়িয়েছে। বিজেপি এই নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে এটাও যেমন সত্যি। তেমনি বিজেপি-র শক্তিক্ষয় খুব বেশি হয়নি। তাই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তিদের আত্মতৃপ্তির কোনো জায়গা নেই। নিরন্তর মানুষের মধ্যে থেকে, বিজেপি-র সাম্প্রদায়িক এবং গরিব বিরোধী রাজনীতিকে প্রতিহত করতে হবে। তারা একটি লড়াই হেরেছে ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়নি।