আরেক রকম ● নবম বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২১ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

প্রসঙ্গঃ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন


পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন হিসেবে নির্বাচনী নির্ঘন্ট প্রকাশিত হওয়ার আগেই রেখাঙ্কিত হয়েছিল। এর প্রধান কারণ হল ভারতীয় জনতা পার্টি রাজ্যে ক্ষমতা বৃদ্ধি করে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে কখনই দাগ কাটতে পারেনি। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসন এবং ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজেপি সমস্ত শক্তি নিয়ে ২০২১ সালের নির্বাচনকে পাখির চোখ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাজ্য রাজনীতির এই নতুন উপাদান গোটা দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

নির্বাচনের ফল ঘোষণা হওয়ার পরে দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী ও স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিদিন রাজ্যে এসে প্রচার করার পরেও, সমস্ত আর্থিক ক্ষমতা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সবরকম সাহায্য নেওয়ার পরেও, বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গের জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনের বিধানসভা-ওয়াড়ি হিসেবে যেখানে তারা ১২১টি আসনে এগিয়ে ছিল, সেখানে ২০২১ সালে তাদের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ৭৭, এবং তারা ভোট পেয়েছে ৩৮.১ শতাংশ। নিঃসন্দেহে বিজেপি-র এই পরাজয় দেশের মোদী সরকার বিরোধী আন্দোলন ও শক্তিকে বাড়তি অক্সিজেন জোগাবে। প্রমাণিত হল যে অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদী সর্বশক্তিমান নন। তাঁরা চাইলেই যেকোনো রাজ্যে নির্বাচন জিততে পারেন না। বরং বাংলার মানুষ প্রমাণ করলেন যে শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক তাস খেলে এবং বিভাজনের রাজনীতিকে ভর করে বাংলার মসনদ দখল করার চেষ্টা করলে মানুষ তার বিরুদ্ধে মত প্রদান করেন।

অন্যদিকে, শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস ২১৩টি আসনে জয়ী হয়েছে মোট ৪৭.৯ শতাংশ ভোট পেয়ে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তারা ১৬৪টি বিধানসভা আসনে এগিয়ে ছিল, প্রাপ্ত ভোট ছিল প্রায় ৪৩ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০১৯ এবং ২০২১ সালের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস তার জনভিত্তি বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। এই ফলাফল নিয়ে বহু আলোচনা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। আমরা কয়েকটি বিন্দুতে আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।

প্রথমত, তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মানুষের মনে বিভিন্ন কারণে ক্ষোভ ছিল। প্রধানত, বিভিন্ন সরকারী প্রকল্পে দুর্নীতি, স্থানীয় নেতাদের অগণতান্ত্রিক আচরণ, আমফান ঝড়ের ক্ষতিপূরণ নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষ বিভিন্ন জায়গায় মুখ খুলছিলেন। এই প্রবণতা অনেক সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের সমীক্ষায় ধরা পড়েছিল। তবু তৃণমূলের এই বিপুল জয় কীভাবে হল তা অনেকের কাছেই পরিষ্কার হয়নি। আমাদের মতে এই জয়ের নেপথ্যে চারটি রাজনৈতিক প্রবণতা স্পষ্টভাবে কাজ করেছে। প্রথমত, একদিকে যেমন তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের স্থানীয় কিছু ক্ষোভ ছিল, তেমনি মোদী সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধেও মানুষ কথা বলছিলেন। বিশেষ করে লকডাউনের প্রভাবে গরিব মানুষের উপর যে ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে, তার জন্য যে মোদী সরকার দায়ি এই কথা মানুষ বুঝেছিলেন। অন্যদিকে, পেট্রল-ডিজেল-রান্নার গ্যাসের লাগাতার মূল্যবৃদ্ধি, কৃষকের দুর্দশা, বেকারত্ব, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির একের পর এক বেসরকারীকরণ ইত্যাদি জনবিরোধী নীতির কারণে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ভোটের বাক্সে প্রতিফলিত হয়েছে। তাই বিজেপি-র ভোট শতাংশ ২০১৯ সালের তুলনায় কমেছে।

দ্বিতীয়ত, স্থানীয় স্তরে মানুষের তৃণমূলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ ছিল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়ের উপরে তার খুব বেশি আঁচ এসে পড়েনি। ‘দুয়ারে সরকার’, ‘পাড়ায় সমাধান’, ‘দিদিকে বলো’, ‘স্বাস্থ্যসাথী কার্ড’, 'কন্যাশ্রী' ইত্যাদি জনপ্রিয়তাবাদী প্রকল্পের মাধ্যমে তৃণমূল সরকার এবং শাসক দল গরিব মানুষের এক বিশাল অংশের মধ্যে নিজেদের উন্নয়নের বার্তা তুলে ধরতে সক্ষম হয়। গ্রামীণ পরিকাঠামো বিশেষ করে রাস্তা-ঘাটের উন্নতি, ১০০ দিনের কাজে বহু অংশের মানুষের হাতে কাজ পৌঁছে দেওয়া, গ্রামীণ হাসপাতালের উন্নতি এই সব কাজ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। উন্নয়নের এই ধারা কতটা মানুষের প্রকৃত উন্নতিসাধন করতে পারবে তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। কিন্তু মানুষ এই প্রক্রিয়াগুলির দ্বারা যে প্রভাবিত হয়েছেন এবং তাকে সমর্থন করেছেন তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। স্থানীয় স্তরে দুর্নীতি, এই উন্নয়নের টাকার উপরে শাসক দলের নেতাদের মাতব্বরি এবং তার থেকে ব্যক্তিগত ফায়দা তোলার উপায় হিসেবে মানুষ দেখেছেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য সরকারকে এর জন্য তাঁরা দায়ি বলে ভাবেননি। অন্যদিকে, বিজেপি বা বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ-এর কোনো নেতাই মুখ্যমন্ত্রীর সমকক্ষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। মানুষ তাই তৃণমূল কংগ্রেসকেই ভোট দিয়েছে।

তৃতীয়ত, রাজ্যের মহিলারা বিপুল সংখ্যায় তৃণমূল কংগ্রেস তথা মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়কে ভোট দিয়েছেন। দিল্লির সিএসডিএস সংস্থার নির্বাচন পরবর্তী সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ৫০ শতাংশ মহিলা তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন, বিজেপিকে দিয়েছেন ৩৭ শতাংশ মহিলা। যদিও ২০১৯ সালেও ৪৭ শতাংশ মহিলা তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছিলেন, ২০২১ সালের এই বাড়তি ভোট তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের পথ সুগম করেছে। আবার গরিব মহিলা বা নিম্ন আয়ের পরিবারের মহিলাদের মধ্যে ৫২ শতাংশ এবং ৫৫ শতাংশ তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছে। অর্থাৎ গরিব মহিলারা ধনী মহিলাদের তুলনায় বেশি সংখ্যায় তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। এর বেশ কয়েকটি কারণ আছে। একদিকে স্বাস্থসাথীর কার্ড পরিবারের মহিলার নামে বন্টন করা, কন্যাশ্রী-রূপশ্রীর মতন প্রকল্প, মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহিলাকেন্দ্রীক প্রচার, সবই মহিলাদের ভোটকে সংহত করতে সাহায্য করেছে। উলটোদিকে ‘দিদি ও... দিদি’ বলে প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি প্রচারসভায় যেভাবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে টিটকিরি দিয়েছেন তা রাজ্যের মহিলারা স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। একই সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট তৃণমূলের পিছনে সংহত হয়েছে। মালদা ও মুর্শিদাবাদের মতন কংগ্রেসের জনভিত্তি সম্পন্ন জেলাতেও তৃণমূল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করেছে। কংগ্রেসের ঝুলিতে কিছুই আসেনি। বিজেপি-র উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে রাজ্যের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ তৃণমূলের পক্ষে মতদান করেছেন।

চতুর্থত, নির্বাচন যত এগিয়েছে তত কোভিডের প্রকোপ গোটা দেশে তথা রাজ্যে বেড়েছে। একদিকে দিল্লি ও অন্যান্য শহরে অক্সিজেনের জন্য আর্তের চিৎকার আর অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বেপরোয়া রাজনৈতিক প্রচার মানুষ মেনে নেননি। শীতলকুচির গুলি চালানোর ঘটনা এবং তাকে কেন্দ্র করে বিজেপি নেতাদের উস্কানিমূলক বক্তব্য মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করেছে। মানুষ মনে করেছেন বিজেপি-র হাতে ক্ষমতা চলে গেলে তারা পশ্চিমবঙ্গে উত্তরপ্রদেশের মতন এনকাউন্টার ঘটাবে। অশান্তিও ছড়াবে। অতএব, ভোট যত এগিয়েছে, বিশেষ করে পঞ্চম দফা থেকে তৃণমূলের ভোট বাড়তে থেকেছে।

এই রাজনৈতিক ফলাফল তৃণমূলের পক্ষে যতই ইতিবাচক হোক, দুটি কথা না মনে রাখলে অচিরেই তাদের বিরুদ্ধেও মতামত ঘুরে যাবে। প্রথমত, তৃণমূলের পক্ষে এমন বহু মানুষ ভোট দিয়েছেন যারা তৃণমূলের নীতি-উন্নয়ন ইত্যাদিতে প্রভাবিত হয়ে ভোট দেননি। দিয়েছেন শুধুমাত্র বিজেপি-কে ক্ষমতার বাইরে রাখতে। এই ধর্মনিরপেক্ষ মতকে উপেক্ষা করে তৃণমূলের ক্যাডারবাহিনী যদি সন্ত্রাস করতে থাকে তবে তার বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ হবে। মনে রাখতে হবে বিরোধীদের উপর লাগামহীন সন্ত্রাস করার লাইসেন্স রাজ্যের মানুষ তৃণমূলকে দেয়নি। দ্বিতীয়ত, বিজেপি রাজ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এবং লাগাতার সরকারের শপথগ্রহণ হওয়ার আগে থেকেই রাজনৈতিক উত্তেজনা তথা কেন্দ্রীয় সরকারের চাপ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এমতাবস্থায়, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে মনে রাখতে হবে যে বিজেপি-র বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত লড়াই যেন মুলতুবি না করা হয়। বিজেপি-কে রাজ্যের মাটিতে কোনো মতেই আর শক্তি বাড়াতে দেওয়া যাবে না। তৃতীয়ত, ভোট জিতেছে মানে এই নয় যে তৃণমূলের মাস্তানবাহিনীর দুর্নীতি, পঞ্চায়েত ও পুরসভা নির্বাচনে যে অবাধ রিগিং তারা করেছে, রাজ্যের মানুষ তাতে সিলমোহর লাগিয়েছে। রাজ্যে গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ হলে, নির্বাচনে রিগিং হলে তৃণমূলের বিরুদ্ধেও মানুষ প্রতিরোধে নামবেন। তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান কাজ হওয়া উচিত কোভিডের মোকাবিলা এবং রাজ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এর সঙ্গে কর্মসংস্থান, কৃষি ও শিল্প নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করাও তাঁর কর্তব্য। এই কাজগুলি না হলে অচিরেই মানুষের সমর্থন তিনি হারাবেন।

সব শেষে বামপন্থীদের নিয়ে কিছু কথা বলতেই হয়। পশ্চিমবঙ্গের ২০২১ সালের নির্বাচন আরো একটি কারণে ঐতিহাসিক-স্বাধীনতার আগে থেকেই যে রাজ্যে বাম প্রতিনিধিরা বিধানসভায় আসীন ছিলেন, সেই রাজ্যে বামেদের হাতে এসেছে শূন্য আসন। বামফ্রন্টের প্রাপ্ত ভোট ৫.৭ শতাংশ। ২০১১ সালে যে বছর বামফ্রন্ট হারে তখন তাদের মোট ছিল ১ কোটি ৮৫ লক্ষ, ২০১৬ সালে হয় ১ কোটি ৪০ লক্ষ, ২০১৯ সালের লোকসভায় ৪২ লক্ষ, ২০২১ সালে তা আরো কমে হয়েছে ৩৪ লক্ষ। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে বামেদের এই রাজ্যে লাগাতার শক্তিক্ষয় হয়েছে। বারংবার বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়েছে নেতৃত্বকে আপনারা সঠিক পর্যালোচনা করুন। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরে এত বড় ভুল হল কী করে? কেন জোর করে জমি অধিগ্রহণের পথে হাঁটতে হল? কেন বিকল্প শিল্পনীতি গ্রহণ করা গেল না? কেন শ্রমজীবি মানুষ, কৃষক, ক্ষেতমজুর বামফ্রন্টের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল? কেন তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে কোনো বড় গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা গেল না? কেন বামপন্থীদের পরিত্যাগ করে তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষ বিজেপিকে বেছে নিল? এই প্রশ্নগুলির কোনো নিরসন করতে বামফ্রন্ট ব্যর্থ হয়েছে, যার দায় নেতৃত্বকেই নিতে হবে।

২০১৬ সালে পার্টির কেন্দ্রীয় লাইনের বিরুদ্ধে গিয়ে রাজ্য নেতৃত্ব কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করল। ফল হল এই যে কংগ্রেস বেশি আসন পেয়ে বিরোধী দলের মর্যাদা পেল আর বামফ্রন্টের ভোট আরো কমলো। তবু ২০১৬ সালের বিপর্যয়ের পরে এই জোট নিয়ে কোনো পর্যালোচনা হল না। অন্যদিকে তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, কর্মী-সমর্থকদের পক্ষে ঋজুভাবে দাঁড়িয়ে দলকে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হলেন নেতারা। সঙ্গে বিজেপি-র প্রবল সাম্প্রদায়িক প্রচারের মাধ্যমে রাজ্যের রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র বিজেপি-তৃণমূলের দিকে হেলে গেল। তবুও, বামপন্থীরা নিজেদের ঘরে উঁকি মারলেন না। ইতিমধ্যে ২০১৯ সালে আবারও বামপন্থীরা শূন্য হলেন, তাদের ভোটের একটা বড়ো অংশ বিজেপিতে চলে গেল। তবু হেলদোল নেই। সব শেষে ২০২১ সালে এক ‘মহান’ জোট করা হল, যেখানে এক ধর্মগুরুকে সামনে রেখে মনে করা হল যে এবারে বোধহয় বামেদের হাল ফিরবে। কিন্তু কংগ্রেসের সঙ্গে জোট যেখানে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন, সেখানে এক ধর্মগুরু, যিনি রাজনীতিতে আসার আগে লাগাতার মৌলবাদী কথা বলেছেন, তাঁকে মানুষ মেনে নেবেন এই ধারণাটাই ভুল ছিল। তাই আশ্চর্যের নয়, যে এই সুবিধাবাদী জোটকে মানুষ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কংগ্রেসের আসনও শূন্য। জিতেছেন শুধু একজন প্রতিনিধি আইএসএফ-এর তরফে। এই পত্রিকার সম্পাদকীয়তে এই ধর্মগুরুর দলের সঙ্গে জোট করলে সমূহ ক্ষতি হয়ে যাবে বলে মতামত প্রকাশ করা হয়েছিল। অনেক বামপন্থী নেতা-কর্মী হয়ত দুঃখ পেয়েছিলেন। কিন্তু মানুষের মতামতে স্পষ্ট যে আমাদের আশঙ্কা সত্যি ছিল। পরিস্থিতি এমন পর্যায় গেছে যে কংগ্রেস নেতৃত্ব পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে এই নব্যগঠিত দলের সঙ্গে তাঁরা আর জোটে থাকবেন না। তবু, বাম নেতৃত্বকে টলায় কার সাধ্য? তাঁরা নিজেদের আত্মহননের পথ থেকে বিন্দুমাত্র সরে আসতে নারাজ।

২০১৯ সালে রাজ্য নেতারা ‘বিজেমূল’, ‘দিদিভাই-মোদীভাই-সেটিং’ তত্ত্বের আমদানি করলেন। বলা হল যে বিজেপি আর তৃণমূলের মধ্যে নাকি কোনো প্রভেদ নেই! ২০১৯ সালে পার্টি শূন্য আসন পেল। বামপন্থীদের ‘বিজেমূল’ তত্ত্বকে উপেক্ষা করে রাজ্যের মানুষ তৃণমূল ও বিজেপি-কেই ভোট দিলেন। ২০১৯-এর থেকে কোনো শিক্ষাগ্রহণ করা হল না। তবু, আবারও ২০২১ সালে সেই প্রত্যাখ্যাত ‘বিজেমূল’ তত্ত্বকেই সামনে নিয়ে আসা হল। পরিণাম? আবার শূন্য!

পার্টির কর্মসূচিতেই বলা রয়েছে যে বিজেপি অন্য সমস্ত বুর্জোয়া দলের থেকে আলাদা কারণ তা আরএসএস দ্বারা পরিচালিত যারা দেশে চরম সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিস্ত হিন্দুরাষ্ট্র গঠন করতে চায়। অথচ রাজ্যের নেতারা মানুষকে বলতে লাগলেন যে তৃণমূল ও বিজেপি নাকি আদতে এক। তৃণমূল যথেষ্ট স্বৈরাতান্ত্রিক ও জনবিরোধী নীতি নিয়েছে, সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপোসও করেছে। তৃণমূল দেশের অন্যান্য রাজ্যে অবস্থিত যে কোনো আঞ্চলিক দলের মতই, আপোসকামী ও আঞ্চলিক পুঁজির পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু তা বিজেপি কখনই নয়। এই সরল সত্যটা না বুঝে তাঁরা মানুষকে বোঝাতে লাগলেন দুটি দল এক - বিজেমূল! একদিকে মোদী ও মমতা রোজ একে অপরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আক্রমণ করছে। আর বামপন্থীরা বলছেন সবটাই নাকি ‘সেটিং’। এই শিশুসুলভ তত্ত্ব মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ শিশুরা ভোট দেয় না, রাজনীতি একটি প্রাপ্তবয়স্কদের বিষয়। অথচ, এই শোচনীয় পরাজয়ের পরে, পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিবৃতি দিচ্ছে যে বিজেপিকে রাজ্যের মানুষ প্রতিহত করেছে। সাধারণ সম্পাদক বলছেন বিজেপিকে হারানোর জন্য বিকল্প খুঁজছিলেন মানুষ, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সেই বিকল্প হয়েছে (ডেকান হেরাল্ড পত্রিকা, ৪ মে ২০২১)। তাহলে বিজেমূল তত্ত্ব যে ভুল ছিল সেটাও স্বীকার করতে হয়। সাম্প্রদায়িক বিজেপি-র বিরুদ্ধে মানুষ কেন বামপন্থীদের গ্রহণযোগ্য বিকল্প বলে মনে করল না, তৃণমূলকে করল? এর উত্তর কে দেবে? একটি ভুল লাইনকে মান্যতা দিয়ে বামেরা জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে। তৃণমূল অথবা বিজেপি কোনো সরকারের বিরুদ্ধেই গ্রহণযোগ্য বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

বর্তমানে রাজ্যের বাম নেতারা সম্পূর্ণভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। বারবার ভুল রাজনৈতিক লাইনের প্রয়োগ, ভুল স্বীকার না করা, আত্মম্ভরিতা, সুবিধাবাদী জোট করা এবং পার্টির ভিতর গণতান্ত্রিক উপায়ে আলাপ-আলোচনা না করা এই প্রবণতাকে আরও বাড়িয়েছে। একদল বাম যুবক-যুবতী রাস্তায় কোভিডের মধ্যে মানুষের সহায়তায় রেড ভলান্টিয়ার্স-এর পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এই যুবক-যুবতীদের সঠিক রাজনৈতিক দিশা না দেখালে এই অসাধারণ প্রয়াস আগামীদিনের বাম আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবে না, রাজনীতি ব্যতিরেকে শুধুমাত্র ত্রাণকার্য কখনই কোনো রাজনৈতিক দলকে সফলতা দিতে পারে না। অতএব, রেড ভলান্টিয়ার্সদের আগামীকে সুরক্ষিত করার জন্য আশু কর্তব্য রাজনৈতিক লাইন পরিবর্তন। এবং লাইন পরিবর্তন করতে হলে বর্তমান নেতৃত্বকে নতুনদের জায়গা করে দিতে হবে। নতুন মুখ ও নতুন জনমুখী লাইন বাদ দিয়ে আর কোনো বিকল্প নেই।

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বামেদের মাত্র দুটি আসন জেতার পর, আমাদের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, অশোক মিত্র, 'আরেক রকম'-এর সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন,
“দলের নেতাদের টিকিয়ে রাখার চেয়ে দলের আদর্শকে টিকিয়ে রাখা, আন্দোলনকে সতেজ করা, গরিব মানুষের স্বার্থে নিরন্তর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া অনেক বেশি জরুরি। দেশের শোষিত দরিদ্রদের স্বার্থে পশ্চিমবাংলার বাম আন্দোলনকে ফের বাঁচিয়ে তুলতে হবে। দলীয় নেতৃবৃন্দের কাছে সবিনয় অনুরোধ করব, ঢের হয়েছে, এবার সরে দাঁড়ান, এবার অন্যদের সুযোগ দিন দলটিকে, আদর্শকে, আন্দোলনকে বাঁচাবার। আপনারা প্রস্থান করলে নেতৃত্বে ও নীতি নির্ধারণে শূন্যতার সৃষ্টি হবে এমন ধারণার কারণ নেই। সংগ্রামের মধ্য দিয়েই নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠবে”।

সাত বছর কাটল, কেউ কথা শোনেনি।