আরেক রকম ● নবম বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২১ ● ১-১৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮

সম্পাদকীয়

গণহত্যা অথবা মৃত্যুমিছিল


"দম বন্ধ হয়ে আসছে..."।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভেসে বেড়াচ্ছে এই আর্ত হাহাকার। এবং প্রশাসন নির্বিকার।
• সারা দেশে অক্সিজেনের অভাব।
• হাসপাতালে শয্যা নেই।
• ওষুধের আকাল।
• ভ্যাকসিন ফুরিয়ে গেছে।
• স্বাস্থ্য পরিষেবায় সর্বাত্মক সঙ্কট।

এবং

• শ্মশানে সৎকারের চুল্লি নেই।
• শববাহী শকটের অভাব।
• কাতারে কাতারে মৃতদেহ পড়ে আছে রাস্তায়।
• শব কুকুরে খুবলে খাচ্ছে।
• চিতা সাজানোর কাঠের আকাল।
• গঙ্গা যমুনায় শব ভেসে যাচ্ছে।
• পার্কিং লটে চিতা জ্বলছে।
• কবরস্থানে দাফন করার জায়গা ফুরিয়ে গেছে।
• পোষ্য প্রাণীর কবর দেওয়ার নির্ধারিত স্থানে মানুষের মৃতদেহের দাফন হচ্ছে।

অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলেও এটাই এখনকার ভারতবর্ষের বাস্তব পরিস্থিতি। সংক্রমণ দমনের কোনো জাতীয় পরিকল্পনা নেই। রাজ্যগুলির হাতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার হাত গুটিয়ে নিয়েছে। এবং অতি সম্প্রতি পঞ্চায়েত ও নাগরিকদের কাঁধে সংক্রমণ সংক্রান্ত যাবতীয় দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে ভারত সরকার নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। সংক্রমিত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মৃত্যুর সঠিক তথ্য নিশ্চিত করে বলা হচ্ছে না বলে দেশে তো বটেই বিদেশেও প্রশ্ন উঠেছে।

অথচ যথেষ্ট সময় ছিল। সংক্রমণের দ্বিতীয় তরঙ্গের পূর্বাভাস অনেক আগেই দেওয়া হয়েছে। প্রশাসক ও নীতিনির্ধারকরা তখন অন্য কাজে ব্যস্ত। কেউ দিল্লি থেকে অসম এবং পশ্চিমবঙ্গে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করছেন। এবং হাজারো মানুষের সভায় মাস্ক না পরেই ভাষণ দিচ্ছেন। তাঁরাই আবার ভার্চুয়াল বৈঠকে মুখের উপর মাস্ক এঁটে রাখছেন। নির্বাচন প্রক্রিয়া সংক্ষিপ্ত করার বদলে দীর্ঘ সময় ধরে আয়োজিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন শাসকের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর। এবং ততদিনে সংক্রমণের তীব্রতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

নাগরিকের জীবন রক্ষা করতে সরকারের ব্যর্থতার বিচার বিভিন্ন রাজ্যের হাই কোর্টে শুরু হয়েছে। রোগীকে বাঁচানোর জন্য কী করা উচিত থেকে শুরু করে সংক্রমণ প্রতিরোধের খুঁটিনাটি নির্দেশ এখন আদালত দিচ্ছে। বিচারকরা তীক্ষ্ণ ভাষায় মন্তব্য করছেন। কখনও বলা হচ্ছে যে এই গণ হত্যার দায় কে নেবে। অন্য আদালতে তখনই আবার এই পরিস্থিতিকে মৃত্যু মিছিল আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে আপৎকালে আদালত প্রশাসনকে পরিচালনা করছে। বিভিন্ন রাজ্যে অক্সিজেন সরবরাহ সংক্রান্ত বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট এক কমিটি গড়ে দিয়েছে। এর থেকে বড়ো ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? আগামী দিনে কোভিড মোকাবিলায় সরকারের সম্ভাব্য কর্মসূচি কী, বিচারপতিরা তা জানতে চাইলে সরকারি কৌঁসুলি আদালতের কাছেই জানতে চাইছেন, - আপনারাই বলুন কী করা উচিত।

ঠিক সময়ে কেবল অক্সিজেন না পাওয়ার জন্য খাবি খেতে খেতে মানুষ মারা যাচ্ছে। তখনই রেল মন্ত্রী বলছেন যে একটু কম করে শ্বাস নিলেই তো হয়! কতখানি মানবিকতাবিহীন হলে মুমূর্ষু মানুষকে এমন উপদেশ দেওয়া যায়!

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অক্সিজেনের অভাবে কাতরাচ্ছে অসংখ্য আক্রান্ত। অক্সিজেন জুটলেও তা রোগীর শরীরে প্রবেশ করানোর যন্ত্র নেই। আর হাসপাতালের বিছানা না পেয়ে রাস্তায় পড়ে আছে আরও অনেক, বেশি সংখ্যক সংক্রমিত মানুষ। অথচ গত পাঁচ মাসে আমাদের দেশ থেকে রেকর্ড পরিমাণ অক্সিজেন রফতানি হয়েছে। দেশে উৎপাদিত ৬৫ শতাংশ ভ্যাকসিন বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছে যার বেশিরভাগটাই অনুদান। যে ৯৩টি দেশে ৬ কোটি ৬০ লক্ষ ডোজ ভ্যাকসিন পাঠানো হয়েছে তাদের সত্যি সত্যিই এত জরুরি প্রয়োজন ছিল কি? ২১টি দেশে প্রতি ১ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১০০ জনের সংক্রমণ হয়েছে। ১৪টি দেশে প্রতি ১ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১ জন সংক্রমণের জন্য মারা গেছে। ৬১টি দেশে সংক্রমণের হার ভারতের তুলনায় অনেক কম। অথচ এই ৬ কোটি ৬০ লক্ষ ডোজ ভ্যাকসিন দিয়ে দিল্লি ও মুম্বাইয়ের সমস্ত প্রবীণ নাগরিকের টিকাকরণ সম্পন্ন করা যেত। বিদেশে পাঠানো এক কোটি ভ্যাকসিন অনুদান হিসেবে পাঠানো হয়েছে। আর দুই কোটি ডোজ ডব্লিউএইচও বা হু'র প্রকল্পের আওতায় দেওয়া হয়েছে। বাদবাকি ৩ কোটি ৬০ লক্ষ ডোজ ভ্যাকসিন সরাসরি বিদেশে বিক্রির জন্য রপ্তানি করা হয়েছে।

ভ্যাকসিন উৎপাদক দুটি বেসরকারি সংস্থা কী দামে ভ্যাকসিন রপ্তানি করেছে তার কোনো খবর নেই। অথবা সরকারের তরফে খবর নেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি। এদিকে পয়লা মে থেকে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের জন্য টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক বলে ঘোষণা করেছে। আবার একই দিন থেকে ভ্যাকসিন বন্টন ব্যবস্থা থেকে কেন্দ্রীয় সরকার প্রকারান্তরে হাত গুটিয়ে নেওয়ায় দুই বেসরকারি উৎপাদক সংস্থা এখন বেপরোয়া। তারা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের জন্য দুই রকমের দাম ধার্য করেছে। আর খোলা বাজারে বেসরকারি হাসপাতালের জন্য আরও অনেক বেশি দাম। সরকারের তরফে কোনো পদক্ষেপ তো দূরের কথা কোনো মন্তব্যও করা হয়নি। সরকার তো হামেশাই বলে থাকে সরকারের কাজ ব্যাবসা করা নয়। নিয়ন্ত্রণ করা কিন্তু সরকারের কাজ। বর্তমান সরকারের বোধ হয় তা জানা নেই অথবা জেনেশুনেই এইসব প্রশ্নের সামনেউত্তরে থাকো মৌন নীতি গ্রহণ করেছে।

ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়ে দেশের সাতটি সরকারি ল্যাবরেটরি প্রস্তাব দিয়েছিল। সেইসব প্রস্তাবে সম্মতি না দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার হৃষিকেশে অবস্থিত এইমস্ হাসপাতালে বিশেষ আর্থিক অনুদান দিয়ে গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের উপর গবেষণা শুরু করতে নির্দেশ দিয়েছে। গুজরাটের বনসকন্থা জেলার একটি গ্রামে শুরু হয়েছে গোচোনা দিয়ে সংক্রমণ নিরাময়ের উদ্যোগ। গুজরাটে আবার ডাবল ইঞ্জিনের সরকার। আরেক ডাবল ইঞ্জিনের সরকার উত্তরাখন্ড। সেখানে রমরমিয়ে উদযাপিত হল কুম্ভ স্নান। একদিন দু'দিন নয়, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল। কত লক্ষ স্নানার্থী এসেছিলেন তার হিসাব পাওয়া মুশকিল। তবে মধ্যপ্রদেশের একটি গ্রামে ফিরে আসা ৬১ জন স্নানার্থীর মধ্যে ৬০ জনই সংক্রমিত। কর্ণাটকের এক প্রত্যন্ত গ্রামের এক বৃদ্ধা কুম্ভ স্নান সেরে ঘরে ফিরে তেত্রিশ জনকে সংক্রমিত করেছেন। এইরকম কত লক্ষ সংক্রমিত স্নানার্থী পূণ্য অর্জন করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন তার হিসাব কে রাখে? তার ফলে আরও কত লক্ষ মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন তা-ও নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তবে একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে হরিদ্বারের কুম্ভ স্নান উপলক্ষে যে জমায়েত হয়েছিল সেখানে নিঃসন্দেহে সংক্রমণ অতিরিক্ত বিস্তার লাভ করে। কুম্ভমেলার উপর রাশ টানার অভিপ্রায় প্রকাশের ‘দুঃসাহস’ দেখানোর জন্য রাতারাতি কুর্সি খুইয়েছেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী। অন্য দিকে, যে নেতা তথা রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে আর মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই, তিনিই হয়ে গেলেন অসমের নতুন মুখ্যমন্ত্রী।

ভ্যাকসিন নিয়ে বাণিজ্য করা যায়। ভ্যাকসিন নিয়ে রাজনীতি থেকে কূটনীতি সবই করা সম্ভব। কিন্তু ভ্যাকসিন দেশের মানুষের কাজে না লাগলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। দুটি বেসরকারি উৎপাদক সংস্থা ভ্যাকসিন উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গেই ডাভোস্-এ আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম-এর ভার্চুয়াল সম্মেলনে বুক চিতিয়ে গলা ফুলিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে আত্মনির্ভরতার প্রচার করা যায়। এমনকি বিদেশে সেই ভ্যাকসিন পাঠানোর খবর দিয়ে আত্মম্ভীরতাও প্রকাশ করা যায়। কিন্তু তাতে দেশবাসীর কী লাভ? ডাভোসের ভাষণের দেড় মাসের মধ্যেই ধরা পড়ে গেছে দেশেরস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উপর কোনো নজর দেওয়া হয়নি। ফলে আত্মনির্ভরতা প্রচারে ব্যস্ত ভারত এখন বিশ্বের দানগ্রহীতার তালিকায় শীর্ষে পৌঁছে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইয়োরোপের প্রায় সব দেশের থেকে নানারকমের সাহায্য আসছে। বাদ নেই আরব দুনিয়ায় দেশগুলি। আরব দুনিয়া থেকে আসা অক্সিজেন নিয়ে প্রাণ বাঁচলে কত শতাংশ হিন্দুত্ব হ্রাস পাবে সেই তর্ক করা এখন উচিত নয়। তবে ছবিতে দেখা গেছে যে বিদেশ থেকে আসা চিকিৎসা সরঞ্জামকে পূজার্চনা করা হচ্ছে। এমনকি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দেশও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। রীতিমতো যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ফৌজি বিমানে অক্সিজেন প্ল্যান্ট সহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি, ওষুধের কাঁচামাল ইত্যাদি ভারতে এসে পৌঁছেছে। এমনকি সাম্প্রতিক অতীতে যে দেশের সঙ্গে সমস্ত রকমের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে আত্মনির্ভরতার ধ্বজা ওড়ানো হয়েছিল সেই চিন থেকেও ওষুধের কাঁচামাল, চিকিৎসার সরঞ্জাম আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমদানির পরিমাণের উপর কোনো উর্ধ্বসীমা রাখা হচ্ছে না। ২০০ কোটি টাকার কমে লেনদেনেও ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।

দাতারা তড়িঘড়ি করলে কী হবে, দেশের সরকারের তৎপরতা নেই। বিদেশ থেকে আসা এইসব চিকিৎসা সামগ্রীর উপর শুল্ক ছাড় দেওয়া হবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত নিতে সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। দেশের মধ্যে বিক্রি হওয়া ভ্যাকসিন এবং অন্যান্য জরুরি ওষুধের উপর এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে জিএসটি মকুব করতেও রাজি নয় কেন্দ্রীয় সরকার। উলটে অর্থমন্ত্রী সাফাই গাইছেন যে জিএসটি আদায় হলে রাজ্যগুলির কোষাগার সমৃদ্ধ হবে। তাঁর মতে প্রতি একশো টাকা জিএসটি থেকে রাজ্যগুলির প্রাপ্য সত্তর টাকা পঞ্চাশ পয়সা। এঁদের মানবিকতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।

ভ্যাকসিনের মেধা সত্ত্ব বাইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সোচ্চার। তাঁর মতে ভ্যাকসিনের উপর থেকে মেধা সত্ত্ব তুলে না দিয়ে বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কারণ, মেধা সত্ত্ব বজায় থাকলে উৎপাদকের সংখ্যা বাড়বে না। এবং ভ্যাকসিনের দাম নিয়ন্ত্রণ করবে গুটিকয়েক উৎপাদক সংস্থা। জার্মানি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। আর সবচেয়ে জোরদার বিরোধিতা করেছেন তথাকথিত ভারতবন্ধু বিল গেটস্। ভারত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে আপাত সম্মতি দিলেও দেশের দুই বেসরকারি উৎপাদকের উপর নির্দেশ জারি করেনি। বরং অদূর ভবিষ্যতে যে কয়েকটি ভারতীয় সংস্থায় বিদেশি সহযোগিতায় ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু হতে চলেছে তাদের কাছেও মেধা সত্ত্ব তুলে দেওয়ার নির্দেশ পাঠানো হয়নি।মেধা সত্ত্ব তুলে দিলে অন্যান্য অনেক উৎপাদক ভ্যাকসিন তৈরিতে উদ্যোগী হতে পারে। ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা আসবে। চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি হলে ভ্যাকসিনের দাম কমতে পারে। বন্ধ হবে ভ্যাকসিন নিয়ে দানবীয় বাণিজ্য। জীবনদায়ী ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামের প্রকাশ্যে কালোবাজারি বন্ধ করতেও কেন্দ্রীয় ও বেশিরভাগ রাজ্য সরকার চূড়ান্ত ব্যর্থ। সরকার যথারীতি নির্বিকার।

আসলে বর্তমান সরকারের কোনো তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা নেই। বিপদ আসন্ন অনুমান করতে পারার পরেও আগাম প্রতিকারের ব্যবস্থা করবার পথটি উপেক্ষা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার ও বেশিরভাগ রাজ্য সরকার। অথচ সেটাই যে কার্যকর পথ, মহারাষ্ট্রের একটি প্রান্তিক, আদিবাসী-অধ্যুষিত জেলা নন্দুরবার দেখিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের অনিবার্যতা আন্দাজ করেই জেলাশাসক তড়িঘড়ি অক্সিজেন উৎপাদনের তিনটি কারখানা নির্মাণ করিয়েছেন। যথেষ্ট শয্যা ও অ্যাম্বুল্যান্স, পর্যাপ্ত ঔষধের ব্যবস্থা করেছিলেন। ফলে মুম্বই-সহ মহারাষ্ট্রের সকল জনপদ কোভিডে বিধ্বস্ত হলেও, এই জেলায় সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুহার, উভয়েই দ্রুত নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত আধিকারিককে যুদ্ধকালীন তৎপরতার সঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে বলে দিয়েছেন যে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের এই যুদ্ধে সাফল্যলাভ করলে তার জন্য তিনি কৃতিত্ব দাবি করবেন না; কিন্তু কোথাও ব্যর্থ হলে তিনি দায়ভার নেবেন। এটাই তো প্রকৃত নেতৃত্ব। গত বছর কেরল সরকার একইভাবে প্রস্তুতি এবং তৎপরতা দেখিয়ে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করেছিল, বহু মৃত্যু এড়ানো গেছিল। কেবল ভারতে নয়, সারা বিশ্বে কেরল সরকারের উদ্যোগ-নেতৃত্ব-ক্ষমতা প্রশংসিত হয়েছিল। আক্ষেপ, দ্বিতীয় ঢেউ প্রবল হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী ‘প্রতিষেধক কূটনীতি’র সাফল্য প্রচারে যত উৎসাহ দেখিয়েছেন, সকল ভারতবাসীর জন্য প্রতিষেধকের ব্যবস্থা করতে অত তৎপর হননি। ফলাফল, - আত্মনির্ভরতার মোড়কে জড়ানো আত্মম্ভীরতা এখন সারা বিশ্বে নিন্দিত ও ধিকৃত হচ্ছে। এর পরেও সরকারের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বিদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সমালোচনার উত্তর দেওয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন সরকারের প্রাথমিক কাজ। টুইটার এবং ফেসবুক থেকে সরকারের সমালোচনা মুছতে ব্যস্ত ভক্তবৃন্দ।

পরিস্থিতি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে প্রথম ডোজ টিকা নেওয়ার পর যথাসময়ে দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার মতো ভ্যাকসিন মজুত নেই। ফলে প্রথম ডোজ নেওয়া নাগরিক চূড়ান্ত আতঙ্কের শিকার। দিল্লি হাই কোর্ট তো সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারকে তিরস্কার করে বলেছে যে যখনই ফোন করা হচ্ছে তখনই বিরক্তিকর মেসেজ শুনিয়ে লোককে টিকা নিতে বলা হচ্ছে। অথচ প্রতিষেধক নেই! কাজেই টিকা দেওয়া যাচ্ছে না।

এমনিতেই সংক্রমণ সমস্ত বিশ্বে আতঙ্ক মেশানো অবসাদের আবহ তৈরি করেছে। তার মধ্যে, দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে এমন অব্যবস্থাপনার ফলে মানুষের উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। সারারাত, প্রয়োজনে আগের দিন বিকেলে লাইন দিয়ে বয়স্ক নাগরিকদের দ্বিতীয় ডোজ নিতে হচ্ছে। চতুর্দিকের চাপে পড়ে দ্বিতীয় টিকাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য রাজ্যগুলিকে সুপারিশ করেছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে হঠাৎ করে প্রশাসনিক নির্দেশ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছে যে প্রথম এবং দ্বিতীয় ডোজের মধ্যে ব্যবধান ১২ থেকে ১৬ সপ্তাহের মধ্যে থাকলেই চলবে। টিকাকরণ শুরুর সময় বলা হয়েছিল যে প্রথম ডোজের ৪ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া বাধ্যতামূলক। কোন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে সেই ব্যবধান ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ করে দেওয়া হয়েছিল তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ভাঁড়ার বাড়ন্ত হতে না হতেই ব্যবধান আরও বাড়িয়ে দেওয়া হল। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে যে এর ফলে প্রতিষেধকের গুণমানে ফারাক হবে না তো? বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন যে পর্যাপ্ত জোগান নেই বলেই, ২টি টিকার মধ্যেকার সময়ের ব্যবধান বাড়ানো ছাড়া গতি নেই। কাজেই সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের টিকাকরণ এখন বাধ্য হয়ে মুলতুবি রাখতে হয়েছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকলে মানুষের জীবন নিয়ে এমন পরীক্ষা নিরীক্ষার দরকার হত না।

দেশে-বিদেশে ধারাবাহিক সমালোচনার দাপটে ৫০ লক্ষ করোনা টিকার রফতানি আটকাতে কেন্দ্রীয় সরকার এখন বাধ্য হয়েছে। দেশে টিকার ঘাটতির কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত, বলে জানানো হয়েছে। ভাবখানা এমন যে আগে এই ঘাটতির কথা জানাই ছিল না। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, এর আগে ছ’কোটি ষাট লক্ষ ডোজ টিকা বিদেশে রফতানি করার আগে কেন্দ্রের এই বোধোদয় হয়নি কেন?

সকলের জন্য টিকাকরণ ভারতবর্ষে কোনও নতুন কর্মকাণ্ড নয়। দীর্ঘদিন ধরেই ভারতে যক্ষ্মা, ট্রিপল অ্যান্টিজেন (হুপিং কাশি, টিটেনাস, ডিপথেরিয়া) স্মল পক্স, পোলিও ইত্যাদি রোগের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য জাতীয় টিকাকরণ প্রকল্প চালু আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সহায়তায় রাজ্যে রাজ্যে ভ্যাকসিন সরবরাহের সুষ্ঠু বন্দোবস্ত রয়েছে। রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত কর্মীরা নীরবে টিকাকরণ করে চলেছেন। কোনো হৈ চৈ নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এই পদ্ধতিতে ধাপে ধাপে দেশের সমস্ত নাগরিকের টিকাকরণ সম্পন্ন করা যেত। প্রাথমিক পর্যায়ে জনকল্যাণমূলক কাজের ইচ্ছার অভাবেই এমন হুলুস্থুল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য। তা না হলে এই দুরাবস্থার মধ্যে কী করে কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে মোট উৎপাদিত ভ্যাকসিনের ৫০ শতাংশ খোলা বাজারে বিক্রি করা যাবে। বাদবাকি ৫০ শতাংশের অর্ধেক সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকার কিনে নেবে। আর রাজ্য সরকারগুলির জন্য বরাদ্দ মাত্র ২৫ শতাংশ। বাধ্য হয়েই বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার বিদেশ থেকে টিকা আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে।

দেশবাসী চূড়ান্ত আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো নির্দিষ্ট ধ্যানধারণা নেই। রাজ্য সরকারগুলি নিজেদের মতো করে কোথাও কারফিউ, কোথাও আংশিক এবং অন্য কোথাও সম্পূর্ণ লকডাউন করে পরিস্থিতির সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। তার ফলে সংক্রমণের হার কমবে কিনা কেউ জানে না। গবেষণাগারের গিনিপিগের মতো এখন ভারতবাসীর অবস্থা। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু হয়েছে। গত বছরের তালি বাজিয়ে, থালি পিটিয়ে এবং অবশেষে দিয়া জ্বালিয়ে সংক্রমণের বিরুদ্ধে শুরু করা লড়াই কি এবার দেশব্যাপী চিতা জ্বালিয়ে শেষ হবে? সেই আগুনের লেলিহান শিখায় গণ হত্যার কারিগরদের ঔদ্ধত্য ও স্বেচ্ছাচারিতা জ্বলেপুড়ে ছাড়খার হয়ে গেলে ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতা নিষ্কৃতি পেতে পারে।