আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ঊনবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৭

সমসাময়িক

পূর্ব বনাম পশ্চিম


“ওরা নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। অবশ্যই ওদের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে”।
- কার্ল মার্কস, দি এইটিন্থ ব্রুমেয়ার অব লুইস বানাপার্ট

“পূর্ব হল উন্নতির এক পেশা”।
- বেনজামিন ডিজরাইলি, ট্যাঙ্কেড।

এই দুটি পংক্তি উদ্ধৃত করেছেন এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ তাঁর ‘ওরিয়েন্টালিজম’ গ্রন্থের শুরুতে। গো-বলয় এবং কর্পোরেট সংস্কৃতির বাংলায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যৌথ অভিযানকে বুঝতে সহায়ক হবে এই উদ্ধৃতি দুটি।

বাংলায় ২০২১ মনে করাচ্ছে ১৭৫৭কে। ১৭৫৭য় শুধু ক্ষমতার হস্তান্তর হয়নি, হয়েছিল বাংলার সংস্কৃতি অর্থনীতি রাজনীতি সমাজ ও জীবনের ওপর বিজয়। বাংলা ও বাঙালির সমূহ পরাভব। যে বাংলায় বাণিজ্য বিনিময়ের মুদ্রা ছিল সোনা অথবা রূপা, তামা বা ছাপা কাগজ নয় তা বাংলা বিজয়ের ১৩ বছরের মধ্যে পড়ে চরম দুর্ভিক্ষে। যে বাংলা তখন সারা পৃথিবীর জিডিপির ৬% তারা পরিচিত হলো কাঙালি নামে।

বাংলা ছিল ওদের কাছে ধনাগার - বিজয়ের জন্য। এখনও তাই উত্তর-পশ্চিম ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কাছে সবচেয়ে প্রলুব্ধকর পুরস্কার। বাংলার মাটি সোনা ফলায়, রূপালি শস্যের হাসিতে ভাসায় মনোআকাশ, বাংলা সেই মাটি যেখানে ছয়জন নোবেল বিজয়ীর জীবন ও বেড়ে ওঠা। কিন্তু এটাই তো সব নয়। বিবেকানন্দ আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থার জাঁতাকল নিয়ে লিখেছেনঃ

‘তোমরা মনে করো তোমরা উচ্চশিক্ষিত? কী হাবিজাবি (nonsense)শিখেছ তোমরা? বিদেশী ভাষায় অন্যের চিন্তা মুখস্থ করে মগজে ঐসব ঠেসে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নিয়ে মনে করো শিক্ষিত হয়েছ! ছি! এই কী শিক্ষা ? তোমাদের শিক্ষার লক্ষ্য কী? হয় একটা কেরানীগিরি, অথবা বজ্জাত উকিল (roguish lawyer) হওয়া, বা বড় জোর একটা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটগিরি, যেটা কেরানীগিরিরই আরেক রূপ - এই তো’?

এক চিঠিতে বিবেকানন্দ প্রশ্ন করেনঃ
“আচ্ছা সমুদ্রে কি যথেষ্ট জল নেই? তোমাদেরকে, বই, গাউন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমা সহ ডোবাতে পারে না”?

অন্যত্র লিখছেন -
‘ইস্কুল-কলেজে যে-শিক্ষা এখন পাচ্ছ, তাতে করে তোমরা অনিমান্দ্যে কাতর এক জাতিতে পরিণত হচ্ছে। মেশিনের মতন কাজ করছে, জেলিফিশের অস্তিত্ব যাপন করছ।’

আমাদের এই জেলিফিসের অস্তিত্বের বাইরে গিয়ে দাঁড়াতেই হবে। একদিকে কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী হচ্ছে পাঞ্জাবে, হরিয়ানায়, উত্তরপ্রদেশে, রাজস্থানে, আমরা করছি নিয়মরক্ষার আন্দোলন। আর সেই নিয়মরক্ষার আন্দোলনের দুর্বলতার সুযোগে বাংলায় বাড়ছে আধিপত্যবাদী আগ্রাসন। ভারতের সবচেয়ে বড়ো আগ্রাসী সঙ্ঘ পরিবার তার আগ্রাসী ও আধিপত্যবাদী রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং ধর্ম নাম অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাংলায়।

বিবেকানন্দ এই ধরনের আগ্রাসীদের দিকে তাকিয়েই সম্ভবত লিখেছিলেন, “ওদের ধর্ম কোথায়? তারা সেই পবিত্র নাম মুখে নেয়, বলে তারা অন্য মানুষকে ভালবাসে, ...কিন্তু তাদের অন্তরে আছে শুধু অনিষ্ট আর হিংস্রতা। ‘ভাই আমি তোমাকে ভালবাসি, ভালবাসি!’ আর একই সঙ্গে তারা মানুষের গলা কাটে। তাদের হাত রক্তে লাল”।

যারা লালঝাণ্ডা নিয়ে রাজনীতি করেন তাদের সবচেয়ে বেশি করে মনে রাখতে হবে বাংলাকে দখল করে ওরা মানুষের রক্তের বন্যায় রাজ্য ও দেশ ডুবিয়ে দেবে। বাংলা ফ্যাসিবাদীদের সামনে শেষ দুর্গ। এর পতন ঘটাতে পারলেই হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা সময়ের অপেক্ষা। মিরজাফর জগৎশেঠ রায়দুর্লভরা ১৭৫৭র মতো ভিড় করেছে আগ্রাসী শক্তির পক্ষে।

বিজেপির আসল এজেন্ডা প্রথমে ছোটোরা বলে, পরে বড়োরা করে। আর এস এস প্রতিষ্ঠাতা গোলওয়ালকর যা লিখেছেন, ওরা তাই বলে। আমি পড়ি না বলে ভাবি নতুন কথা। সাধ্বী প্রজ্ঞা ১৩ ডিসেম্বর বলেছে, বাংলায় ‘হিন্দুরাজ’ প্রতিষ্ঠা করবে। বলেছে, শূদ্রদের শূদ্র বললে তারা রাগ করে কেন? আদিবাসী দলিত সংখ্যালঘু গরিববিরোধী এই দল।‌ কিন্তু বাংলায় তৃণমূলের ভুল পদক্ষেপ, ছোটো বড়ো নেতাদের অত্যাচার, দুর্নীতি ও বামপন্থীদের সাংগঠনিক দুর্বলতায় ফ্যাসিবাদীদের মিথ্যা প্রচারে আকৃষ্ট হচ্ছেন আদিবাসী দলিত এমনকী সংখ্যালঘুদেরও ক্ষীণ অংশ।

বিজেপির বর্তমান সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, বাংলা দেশদ্রোহীদের গড়। আরেক দুর্বৃত্ত সায়ন্তন বসু গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বা এনকাউন্টার করে মানুষ খুন করার কথা বলে হাততালি কুড়োচ্ছেন। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি বলছেন, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীতে জন্মেছিলেন।

বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্যের বিরোধী এই সব কথা। বাঙালি-অবাঙালি লড়াই নয়, দুটি সাংস্কৃতিক ধারণার লড়াই এখন সামনে। একদিকে মানবতা, অন্যদিকে অসভ্যতা। একদিকে শিষ্টাচার, অন্যদিকে কদর্য মিথ্যাচার। একদিকে সংস্কৃতি অন্যদিকে অপসংস্কৃতি। একদিকে গণতন্ত্র অন্যদিকে ফ্যাসিবাদ।

একদিকে শিক্ষা অন্যদিকে কুশিক্ষা ও গোয়েবলসিয় কায়দায় প্রচার।

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। কৃষি আইন রাজ্যের বিষয়। কেন্দ্র আইন করছে। কৃষকদের আদালতে যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ। কর্পোরেট আর আমলাতন্ত্রের যোগসাজশে মরবে কৃষক।যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ত্রিভাষা সূত্র মানা উচিত। অথচ হিন্দিতে বড়ো করে লেখা হচ্ছে বাংলার রেলস্টেশনের নাম। প্রতিবাদ নেই।

বামফ্রন্টের কিছুটা হলেও ভূমিসংস্কার, পঞ্চায়েতিরাজ, অপারেশন বর্গা, খেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধি; সরকারি, আধাসরকারি স্বশাসিত, অধিগৃহীত, সরকার পোষিত সংস্থার কর্মীদের বেতন ও পেনশন দানের নীতি, মমতার আমলে তাকে কিছুটা বজায় রাখা ও নানা ভাতা ও উন্নয়নপ্রকল্পে এখনও বাংলা অর্থনীতিতে মুখ থুবড়ে পড়েনি সর্বভারতীয় হারে। জিএসটি ৬% আদায় হয়েছে। না খেয়ে মরার মিছিল‌ শুরু হয় নি। এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কম বেশি সোচ্চার। সেজন্য এই দুর্গের পতন ওদের দরকার। তাই জেপি নাড্ডা অমিত শাহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সান্ত্রীদের ক্রমাগত বাংলা আগমন। অচিরেই আসবেন নরেন্দ্র মোদী।

আমাদের প্রতিনিধি হতে চাইবে। কারণ ওরা জানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘লুক ইস্ট’ নীতি ও বঙ্গ বিজয়ের কাহিনি। পশ্চিমের কাছে পূর্ব যেন মাথা নত না করে আর - এটাই ইতিহাস ও সময়ের দাবি। তাই চাই ঐক্যবদ্ধ আদর্শগত ও রণকৌশলগত লড়াই।