আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ঊনবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৭

সমসাময়িক

অপুষ্টির ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ


শাইনিং ইন্ডিয়া, আত্মনির্ভর ভারত, নয়া ভারত, ইত্যাদি বহু নামে দেশকে অভিহিত করা বিজেপি-র রাজনৈতিক নেতাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই সব খেতাবের অন্তরালে থেকে যায় সাধারণ মানুষের আসল চিত্র। তবু, সরকারী পরিসংখ্যান ব্যবস্থার নানান সমীক্ষায় মাঝে মধ্যে উঠে আসে ভারতের প্রকৃত রূপ।

যেমন সদ্য প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা যা পাঁচ বছর পর পর করা হয়। ২০১৯-২০ সালের সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে সদ্য। এই রিপোর্টে আপাতত ২২টি রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। সমগ্র ভারতের তথ্য প্রকাশিত হতে আরো কিছু সময় লাগবে। তবু, এই অসম্পূর্ণ তথ্য থেকে যেই ছবি উঠে আসছে তা গভীর চিন্তার।

যেই ২২টি রাজ্যের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে ১৬টিতে ২০১৫-১৬ সালের তুলনায় অপুষ্টি বেড়েছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে কম ওজনের শিশুর অনুপাত বেড়েছে ১৬টি রাজ্যে। শিশু এবং নারীদের মধ্যে রক্তাল্পতা বেড়েছে অধিকাংশ রাজ্যে। এমনকি প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও অপুষ্টি যেমন বেড়েছে তেমনি স্থূলতার অনুপাতও বেড়েছে যা বাড়তি উদ্বেগের জন্ম দিতে বাধ্য।

দুটি কথা এই বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন। প্রথমত, এই সমীক্ষা করা হয়েছে এমন এক সময় যখন দেশের মসনদে আসীন নরেন্দ্র মোদী তথা ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার। এই সরকার আসার পর থেকে দেশের অর্থব্যবস্থা ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়েছে। একদিকে নোট বন্দী, অন্যদিকে জিএসটি এবং তদুপরি সামাজিক উন্নয়নে লাগাতার ব্যয় বরাদ্দ কমানো হয়েছে। ২০১৭-১৮ সালে ভোগ্যপণ্যের উপর ব্যয় সংক্রান্ত জাতীয় নমুনা সমীক্ষার রিপোর্ট সরকার বাতিল করে দেয়। কিন্তু এই রিপোর্টেই দেখা গিয়েছিল যে দেশে দারিদ্র বেড়েছে, খাদ্যের উপর প্রকৃত খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছে মানুষ। অতএব পুষ্টি যে জনগণের কমবে তার কিছুটা আন্দাজ এই অপ্রকাশিত রিপোর্ট ফাঁস হওয়ার পরেই বোঝা গিয়েছিল। নতুন স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্ট সেই আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণিত করেছে। দ্বিতীয়ত, ভারতের নীতি নির্ধারকরা এক অদ্ভুত তত্ত্বে নিজেদের নিমগ্ন রেখেছেন। তাঁরা মনে করেন যে আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়লেই বুঝি মানুষের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু ভারতের মতন গরীব দেশে দরিদ্র মানুষের কথা আলাদা করে না ভাবলে তাদের জীবনমান বাড়ানো যে সম্ভব নয়, এই সহজ কথাটি তারা বুঝতে চান না। ফলত, আমরা এমন এক লজ্জাজনক পরিস্থিতির শিকার হচ্ছি যেখানে একবিংশ শতাব্দীতেও সমস্ত প্রকরণ হাতের কাছে মজুত থাকলেও দেশে অপুষ্টির পরিমাণ বাড়ছে। অর্থনীতি বা সম্পদের অপ্রতুলতা এই লজ্জার কারণ নয়। এর প্রধান কারণ রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব যার প্রতিফলনে একের পর এক নীতি গৃহীত হয় খাদ্য, পুষ্টি ইত্যাদির কথা মাথায় না রেখে, শুধুমাত্র কর্পোরেটদের সেবা করার উদ্দেশ্যে। এই ধনী দরদী রাজনীতির শিকার আমাদের দেশের মহিলা ও শিশুরা যাদের অপুষ্টি অধিকাংশ রাজ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

এই বিষয়ে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আলাদা আলোচনা করতেই হয়। প্রথমত, পশ্চিমবঙ্গে কিছু উন্নতি অবশ্যই দেখা যাচ্ছে। যেমন পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার ২০১৫-১৬ সালে ছিল ৩১.৮, যা বর্তমানে কমে হয়েছে ২৫.৪। প্রসবের আগে গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ২০১৫-১৬ সালে ছিল ৫৪.৯ শতাংশ যা ২০১৯-২০ সালে বেড়ে হয়েছে ৭২.৬ শতাংশ। স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা যেকোনো স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে সন্তান প্রসব করার হার ২০১৫-১৬ সালে ছিল ৭৫.২ শতাংশ যা ২০১৯-২০ সালে বেড়ে হয়েছে ৯১.৭ শতাংশ। জন্মের সময় প্রতি হাজার পুরুষে নারীর সংখ্যা ২০১৫-১৬ সালে ছিল ৯৬০ যা ২০১৯-২০ সালে বেড়ে হয়েছে ৯৭৩। যেখানে এইরকম কিছু সূচকে পশ্চিমবঙ্গ অগ্রসর হয়েছে, সেখানে পুষ্টি সংক্রান্ত বহু গুরুত্বপূর্ণ সূচকে পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে পড়েছে যা খুবই উদ্বেগজনক।

যেমন, ২০১৫-১৬ সালে ৫৪ শতাংশ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু রক্তাল্পতায় ভুগছিল, যা ২০১৯-২০ সালে বেড়ে হয়েছে ৬৯ শতাংশ। যে সমস্ত নারী গর্ভবতী নয়, তাদের মধ্যে ২০১৫-১৬ সালে ৬২.৮ শতাংশ রক্তাল্পতার শিকার ছিল যা ২০১৯-২০ সালে বেড়ে হয়েছে ৭১.৭ শতাংশ। এই হার গর্ভবতী নারীদের মধ্যে ২০১৫-১৬ সালে ছিল ৫৩.৬ শতাংশ যা ২০১৯-২০ সালে বেড়ে হয়েছে ৬২.৩ শতাংশ। নারী এবং শিশুদের মধ্যে এহেন উল্লেখযোগ্যভাবে রক্তাল্পতা বেড়ে যাওয়া অপুষ্টি এবং অস্বাস্থ্যের বার্তা বহন করছে। সোজা কথায় রাজ্যের নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো নয়।

অপুষ্টির সূচকগুলির দিকে সরাসরি তাকালে এই চিন্তার কারণ আরো পরিষ্কার হবে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ওজন কম শিশুর শতাংশ বেড়েছে, বয়স অনুযায়ী উচ্চতা কম এহেন শিশুর শতাংশ বেড়েছে এবং উচ্চতা অনুযায়ী ওজন কম এহেন শিশুর শতাংশও বেড়েছে। একই সঙ্গে বয়স অনুযায়ী বেশি ওজনের শিশুর শতাংশও বেড়েছে। সব মিলিয়ে তাই বলা যেতে পারে যে পশ্চিমবঙ্গে নারী ও শিশুদের মধ্যে পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের সমস্যা বিগত পাঁচ বছরে বেড়েছে।

যদিও এর প্রকৃত কারণ সম্পর্কে জানতে হলে বিস্তৃত গবেষণার প্রয়োজন। তবু কিছু কথা বলতেই হয়। প্রথমত, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বহু বার রাজ্যের খাদ্যসুরক্ষার কথা বলেছেন। কিন্তু তারপরেও স্বাস্থ্য সমীক্ষায় এই চিত্র উঠে আসা প্রমাণ করে যে যা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা যথেষ্ট নয়। বরং খাদ্যশস্য-সহ বাকি পুষ্টি নারী ও শিশুরা কতটা পাচ্ছে তা নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্য নিয়েও নানান প্রকল্প রাজ্যে চলছে। কিন্তু শিশু ও নারীদের মধ্যে রক্তাল্পতা এরপরেও কেন বাড়ছে? নিশ্চিতভাবেই রাজ্যের সমস্ত নারী ও শিশু পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টি পাচ্ছেন না, তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়মিতভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। দুয়ারে সরকার পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু পুষ্টি কেন পৌঁছয় না? এই নিয়ে সরকার ভাববে না?

তৃণমূল সরকারের নারী শিশু সংক্রান্ত প্রকল্প কন্যাশ্রী নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। নারী শিশুদের স্কুলে রাখার জন্য এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ বলে সরকার দাবি করে। এবং এই প্রকল্পের ফলে কম বয়সী মেয়েদের বিবাহ কমানো সম্ভব বলে মনে করা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্ট অন্য কথা বলছে। ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে বিয়ে হয়ে যাওয়া ২০-২৪ বছরের মহিলাদের শতাংশে ২০১৫-১৬ এবং ২০১৯-২০ সালের মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয়নি। গ্রামীণ বাংলায় ৪৮ শতাংশ মহিলার ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। কন্যাশ্রী প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পরেও কেন এত কম বয়সে মহিলাদের বিবাহ হয়ে যাচ্ছে? এর কারণ খোঁজা জরুরি। গবেষকদের মতে সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি না হলে মেয়েকে ‘ঘরে বসিয়ে রাখা’ এখনও অধিকাংশ মানুষের কাছে গ্রহণীয় নয়। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মহিলাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার চল আছে পশ্চিমবঙ্গে। এই নিয়ে গণমাধ্যম অথবা রাজনৈতিক পরিসরে কোনো আলোচনা নেই। রামমোহন বিদ্যাসাগরের রাজ্যে এখনও বেলাগামভাবে বাল্যবিবাহ হয়ে চলেছে। কিন্তু আমরা নির্বিকার হয়ে রয়েছি।

আগামীদিনে সম্পূর্ণভাবে স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশিত হলে ভারতের জনগণের, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের, পুষ্টি সংক্রান্ত ছবি আরো পরিষ্কার হবে। আপাতত বোঝা যাচ্ছে মোদীর নতুন ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে নারী ও শিশুদের অপুষ্টি বেড়েছে। এর দায় যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের তেমনি পশ্চিমবঙ্গ বা অন্যান্য রাজ্যের সরকারগুলি তাদের দায় এড়াতে পারে না।