আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ঊনবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

বাংলা পেশাদার নাট্যের শেষ রাজকুমার - বিদায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়


সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো বড়ো মাপের সৃষ্টিশীল শিল্পীরা কালের নিয়মে অন্য সব মানুষের মতই পার্থিব জগৎ ছেড়ে চলে যান। থেকে যায় তাঁদের সৃষ্টি, অনাগত সময়ের কাছে যা হয়ে উঠবে অমূল্য সম্পদ, আগামী প্রজন্মের জন্য বিগত প্রজন্মের কাজকে জানার ও বোঝার প্রামাণ্য নিদর্শন হবে সেই সমস্ত কাজ। কিন্তু বড়ো প্রতিভার সদ্য প্রয়াণের পরে, সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর কাজকে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে দেখতে পারা ও বিশ্লেষণ করা খুব শক্ত হয়। বিশেষ করে নাটকের মতো শিল্প হলে, যেখানে গুণীজনের ভাষায় - দেহ পট সনে নট, সকলি হারায়...

তবু, যেহেতু শিল্পীর নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং যাঁর নাট্যকর্মের বিস্তার ছ’দশকেরও বেশি বিশাল সময়কাল জুড়ে, তাই সেই কাজ নিয়ে চর্চা করতে সমস্যা নেই। ভারাক্রান্ত মনে, আবেগের আতিশয্যে অতি কথনের ভয় থাকে না। কারণ, যাঁকে নিয়ে-যাঁর কাজ নিয়ে চর্চা, তিনি বাংলা তথা দেশের কাছে জীবদ্দশাতেই একটি প্রতিষ্ঠান। সুতরাং ,সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিশাল কর্ম জগতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাঁর নাটকের কাজ নিয়ে চর্চা ও বিশ্লেষণ আসলে তাঁর প্রতিভা, মেধা, মননজাত সেই ফসলকে চিনতে চেষ্টা করা যা সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালিদের হৃদয় স্পর্শ করতে পেরেছিল। তাই বলা যেতেই পারে গঙ্গাজলে এই গঙ্গাপুজো আসলে গঙ্গার স্রোতকে চেনার ও বোঝার চেষ্টা মাত্র।

কয়েকটি পর্বে যদি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাট্যজীবন ভাগ করে চর্চা করা হয় তাহলে দেখা যাবে ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর মধ্যে উপস্থিত ছিল একজন মননশীল, উচ্চমেধার রুচিশীল শিল্পী। শিশির কুমার ভাদুড়ি মহাশয়ের একনিষ্ঠ ভক্ত ও শিষ্য ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একথা সবাই জানেন। অধ্যাপনার চাকরি ত্যাগ করে সর্বক্ষণের জন্য নিজেকে থিয়েটার শিল্পে নিয়োগ করেন শিশিরকুমার। তাঁর হাত ধরেই আধুনিক নাট্যের পথ চলতে শুরু করে বাংলা নাটক। শিশির কুমারের উচ্চ-শিক্ষা ও উন্নত রুচির ছাপ অনিবার্য ভাবেই প্রভাব ফেলেছিল, কলেজ ছাত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মনে ও মননে। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে, দিল্লিতে; আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় নাটক প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে নিচ্ছে, কলকাতার নাটক, ‘মুখোশ’ (ডব্লিউ ডব্লিউ জেকবের- ‘মাঙ্কিস্ প’ নাটক অবলম্বনে)। এই নাটক নির্মাণের প্রধান কাণ্ডারীর ভূমিকায় আমরা দেখতে পাচ্ছি - সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। যত দূর জানা যায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে, ছাত্রাবস্থাতেই পশ্চিমের নাটককে আত্তীকরণের প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন সৌমিত্র। হেনরিক ইবসেনের ‘গোষ্টস’-এর বঙ্গায়ন করছেন - ‘বিদেহী’ নাম দিয়ে। নাট্যজীবনের শুরুর দিনগুলোতেই শিল্পের উৎকর্ষ ও সূক্ষ্ম রুচির প্রতি সৌমিত্রের ঝোঁক স্পষ্ট হয়ে যায় এই উদাহরণ গুলো থেকে। এই গভীর জীবন-বোধের সাধনাই জায়মান থাকবে তাঁর আজীবনের নাট্য সাধনায়।

সত্যজিৎ রায়ের সান্নিধ্যই শুধু নয় একেবারে তাঁর ছবির নায়ক হয়ে উঠতে খুব বেশি দিন প্রতীক্ষা করতে হয়নি সৌমিত্রকে। শিশিরকুমারের ছত্রছায়ায় যে শিল্পী বৃক্ষের চারাটি রোপণ হয়েছিল, তা ধীরে-ধীরে মহীরুহে পরিণত হলো সত্যজিৎ-এর সঙ্গ-সান্নিধ্যে। অবধারিত ভাবে এর প্রভাব পড়তে শুরু করবে সৌমিত্রের নাট্যকর্মের মধ্যে।

চলচ্চিত্রের নায়কের জীবন ও সংঘাত নিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাট্য নির্মাণ করলেন - ‘রাজকুমার’। এই নাটকে নির্দেশক সৌমিত্র প্রয়োগ করলেন চলচ্চিত্রের অনবদ্য প্রয়োগ যা আজও আলোচিত হয়, সেই সময়কার দর্শক ও নাট্যমোদী মানুষদের মধ্যে। এখানেও সেই সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ পরিচালিত, সৌমিত্র অভিনীত ‘অপুর সংসার’ ছায়াছবির দৃশ্য ব্যবহারের মধ্যে বাংলা নাটকে চলচ্চিত্রের প্রয়োগ করলেন সৌমিত্র, যা সেই সময়ের নিরিখে খুবই আধুনিক এবং যার খুব বেশি দৃষ্টান্ত তখনও পর্যন্ত ছিল না।

এরপরে পেশাদার রঙ্গালয়ে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অনবদ্য নাট্য প্রযোজনা - ‘নামজীবন’। এই নাটকই পেশাদার বঙ্গরঙ্গমঞ্চের হৃতগৌরব আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে। শুধু তাই নয়,এই নাটকের মধ্যে দিয়ে উচ্চ রুচির আধুনিক নাট্য-নির্মাতা প্রতিষ্ঠিত হলেন বঙ্গ রঙ্গালয়ে। নামজীবন - নাটকের মধ্যে সর্বত্র আধুনিকতার ব্যতিক্রমী ছাপ দেখা গিয়েছিল। মঞ্চপরিকল্পনা, আলো, অভিনয় তো বটেই, সঙ্গীত-আবহের প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে অনন্য নজির তিনি সৃষ্টি করেছিলেন তা ছিল সেই যুগের পেশাদারী নাট্যমঞ্চের সম্পুর্ণ বিপ্রতীপ অবস্থানে। এই মার্জিত, সংযত রুচির নাট্য প্রযোজনা, পশ্চিমের নাটকের আত্তীকরণের বা বঙ্গায়ণের মাধ্যমে এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্বাভাবিক অভিনয়ের মাধ্যমে, যে নিয়মনিষ্ঠ, পরিশিলীত থিয়েটারের ঘরানা তৈরি করেছিল পেশাদার রঙ্গালয়ে তা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একেবারে নিজস্ব অবদান। নামজীবনের পরে ‘নীলকন্ঠ’ বা ‘ফেরা’ নাটকেও সেই ঘরানাই বর্তমান ছিল, শিল্পগত দিক থেকে নামজীবন-এর উচ্চতায় সব নাটক না পৌঁছলেও, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর নিজস্বতা বজায় রাখতে সদা-সচেষ্ট ছিলেন।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, পেশাদার রঙ্গালয়ের শেষ যুগে, অর্থাৎ ষাট-সত্তর-আশির দশকে, বহু প্রযোজক তারকাদের নাটকে অভিনয় করতে নিয়ে যেতেন, মোটা টাকার চুক্তিতে। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল পরিস্কার, মঞ্চে তারকার মুখ দেখিয়ে, দর্শক টানা ও আর্থিক লাভের মুখ দেখা। তারকাদের কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, অধিকাংশের কাছেই পেশাদার রঙ্গালয় একটা বিকল্প রোজগারের পথ ব্যতীত আর কিছু ছিল না। সেটা তাঁদের নাটকের মান, প্রযোজনা ইত্যাদি দেখলেই বোঝা যেত। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেখানে একজন প্রকৃত ব্যতিক্রমী নাট্যশিল্পী, নাট্য প্রযোজনার গুণগত মান নিয়ে, শিল্পগত উৎকর্ষ নিয়ে যিনি সদা সচেতন, থিয়েটার তাঁর কাছে শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের আরেকটা বিকল্প উপায় ছিল না। এই কারণেই হয়ত কালের নিয়মে পেশাদার রঙ্গালয় অবলুপ্ত হলেও আমরা তাঁকে থিয়েটার চর্চা থেকে থেমে যেতে দেখিনা, দেখতে পাই গ্রুপ থিয়েটারের আঙিনায়। যদিও গ্রুপ থিয়েটারে নিয়মিত অভিনয়ের আগেই আগেই, তাঁকে আমরা দেখেছি মনোজ মিত্রর নাটক, বিভাস চক্রবর্তীর নির্দেশনায় (নরক গুলজার) কাজ করতে কিম্বা পরবর্তী সময়ে মনোজ মিত্র রচিত ‘দর্পনে শরৎশশী”-র মতো নাটক প্রযোজনা ও অভিনয় করতে। বিভাস চক্রবর্তীর মতে, নরক গুলজার আগেই মঞ্চসফল ছিল, কিন্তু তার অন্যতম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতে এসে (ব্রহ্মার চরিত্রে) সম্পূর্ণ নতুন রূপদান করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

‘স্বপ্নসন্ধানী’ বা ‘মুখোমুখি’-র মতো বর্তমান সময়ের বিখ্যাত নাট্যদলগুলো তাদের পথ চলার শুরুর দিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়য়ের উপস্থিতিতে, নিজেদের চলার পথকে মসৃণ করতে পেরেছিল, শক্ত হয়েছিল তাদের পায়ের নিচের মাটি। ‘টিকটিকি’, ‘প্রাণতপস্যা’ বা ‘আত্মকথা’-র মতো ব্যতিক্রমী ভাবনার মতো নাটক ও প্রযোজনা আমরা দেখি জনপ্রিয় হতে, পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ, প্রবল জনপ্রিয়তা। মনন, বুদ্ধিদীপ্ত প্রযোজনা ও জনপ্রিয়তার এই মেলবন্ধন সচরাচর কমই দেখা যায়।

সরকারি উদ্যোগে মিনার্ভা রেপার্টারি তৈরি হওয়ার পরে, একদল প্রতিভাবান তরুণের সঙ্গে আশি স্পর্শ করতে চলা তরুণ সৌমিত্রকে আমরা পেলাম রাজা লীয়রের চরিত্রে, সুমন মুখোপাধ্যায়-এর নির্দেশনায়। প্রায় আশি স্পর্শ করতে চলা থেস্পীয়ানের শেক্সপীয়ারের নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠার সাধনা, পরিশ্রম, নিষ্ঠা শুধু দর্শকদের মুগ্ধই করেনা, নবীন অভিনয় শিল্পীদের কাছে হয়ে ওঠে অভিনয়ের আদর্শ মডেল।

শেক্সপীয়ারের নাটকে অভিনয় করা হলেও কোনো বড়ো রবীন্দ্রনাট্যে বা রবীন্দ্র-সাহিত্যের মঞ্চায়নে আমরা পাইনি আজীবন রবীন্দ্রনাথ স্নাত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। কারণ অজানা, হয়তো প্রকৃত প্রযোজক, নির্দেশক বা অভিনেতার মধ্যে সংযোগ গড়ে ওঠেনি। হয়তো অন্য কোনো কারণ! শেষের দিকে, ফেরা - নাটকের পুনঃপ্রযোজনা মঞ্চসফল হলেও তাঁর একাধিক পুরনো প্রযোজিত নাটকের নতুন প্রযোজনা দেখতে-দেখতে সংশয় হচ্ছিল নাট্যকার সৌমিত্রর অনুরাগীদের মধ্যে। তবে কি, নতুন কথা কিছু বলার নেই আর? সেই সময়েই চমকে দিয়ে তিনি মহামারি কালেও লিখেছেন নতুন নাটক, যা আর প্রযোজিত হলো না, থেকে গেলো কিছু অধরা মাধুরী। মহাকালের নিয়মে চলে যেতে হলো, প্রাণতপস্যা শেষ করে ফেরা হলো না মঞ্চের রাজকুমারের। কিন্তু তিনি বিদেহী হবেন না কোনোদিন। বাংলা নাট্য যতদিন থাকবে, তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।