আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ঊনবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

মরমী করাত

প্রণব বিশ্বাস




মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দীপ নির্বাপনের খবর এসেছিল ১৭ নভেম্বরের রাতে। খবরটা খুব যে প্রত্যাশিত তা যেমন নয়, আবার একেবারে অপ্রত্যাশিত তাই বা বলি কী করে। শারীরিক অসুস্থতার কথা সহজে কবুল করতেন না। অথচ অন্যের সামান্য অসুস্থতা অসুবিধা নিয়ে সর্বদাই উদ্বেল তিনি। ভালো খবরের প্রত্যাশায় থাকা মানুষটিকে যখন এই দুর্দৈবে, কোনোদিনই ভালো খবর শোনানোর অবকাশ মিলত না, তখন তাঁর সহজ পরামর্শ ছিল ভালো খবর নেই তো কি হয়েছে, ভালো খবর তৈরি করো। মনে মনে ভালো খবর তৈরি করতে থাকো, দেখবে একদিন আমরা আমাদের প্রত্যাশিত ভালোতে পৌঁছে যাব। তাঁর এই দুরন্ত আশাসঞ্চারি বাক্য কোনোদিনই সেই ক্লিশে হয়ে যাওয়া আশাবাদ, রাত্রির অবসানে ঝলমলে দিনের স্তোক বাক্য ছিল না। অতলান্তিক এক বৌদ্ধিক-মানবিক বোধে জারিত থাকত তাঁর প্রতিটি শব্দ, তাঁর কথনের অনন্যতায়, উচ্চারণের ঐশ্বরিক সৌন্দর্যে তা গভীর মনকে স্পর্শ করে যেত, টোকা মেরে যেত আমাদের অভ্যাসলব্ধ বন্ধ দরজায়। ধারণের ক্ষমতা সীমায়িত বলে সেই অতুল বৈভব আবার নিত্যনৈমিত্তিকতায় আপ্তবাক্যে আত্মসমর্পণ করত। আমরা তাঁর মনের, মননের, বোধ ও বোধির তল খুঁজে দেখার সামর্থ্যই হয়তো রাখিনি।

কথাগুলো বলছিলাম অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তকে নিয়ে। ১৭ নভেম্বরের মধ্যরাতে হির্শবার্গে নিজের বাড়িতে তাঁর জীবনে যবনিকা নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতির বহুমুখী-ধারার প্রবহমান গতিশীলতায় একটা ছোট্ট যতি চিহ্ন আঁকা হয়ে গেল। প্রকৃত অর্থে বিশ্বনাগরিক হয়েও তিনি একান্তভাবেই ছিলেন এই ভাষা, এই দেশ, এই শহরে প্রোথিত এক মানুষ।

এই শহরে ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটলেও তার অনুপুঙ্খ বিবরণ এমনকি বিশ্লেষণও তার কাছে পাওয়া যেত হাতে গরমে। কতবার বিস্মিত হয়ে জানতে চেয়েছি, কি করে পারেন বলুন তো, রহস্যময় হাসি আর রসিকতায় এড়িয়ে গিয়েছেন সেই প্রশ্নের উত্তর। আসলে প্রবাসী বলে যতই চোখ ঠারো, জেনো তোমার চেয়েও অনেক বেশি করে আমি তোমার শহরের।

যার বোধির বৈভব গগনস্পর্শী, তিনি আসলে এক আশ্চর্য ঘরোয়া মানুষ। কী রান্না হলো আজ বাড়িতে, কেমন করে রাঁধলে, পরদিন ফোড়নে এই মশলাটা দিয়ে সাঁতলে দেখো অন্যস্বাদ পাবে। প্রায় সাতদশ দিন অন্তর ওঁর টেলিফোনে অন্য অনেক কথার সঙ্গে অবশ্যম্ভাবীভাবে থাকত এইসব কথা, আর কারো কারো সম্বন্ধে উদ্বেল জিজ্ঞাসা। তাঁদের খোঁজ খবর রাখার পরামর্শ আর ‘বন্ধু’ সম্পর্কে উদ্বেগ আর আকুলতা। এমন কন্ঠে তা প্রকাশ পেত যে হৃদয়ের গভীরে তা স্পর্শ করে যেত অনায়াসে। অথচ বহুভাষাবিদ এই মানুষটিই সাফল্যের শিখরে দাঁড়ানোর অনেক পরেও নিবিষ্ট ছাত্রের মতো মন দিয়েছিলেন ইতালিয় ভাষা শেখায়। নতুন শেখা ভাষা থেকে সরাসরি সনেট অনুবাদ করে মধ্যরাত্রিতে ‘বন্ধু’র ঘুম ভাঙিয়ে সেই অনুবাদ শোনানোর আনন্দ তাঁকে শিশুর সারল্যে পৌঁছে দিত। যাদবপুরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে বিদায় জানিয়ে তাঁর স্বস্তি হয়নি কখনো, ছোট্ট ফালি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যেসে তাঁর কখনো ক্লান্তি ছিল না।

শরণার্থী ভাবনা তাঁর অন্তর্গত হৃদয়ের আর এক প্রস্রবণ স্রোত। সভ্যতার আদিযুগ থেকে কত রকম ভাবেই না মানুষ তার ভূমি থেকে উৎখাত হচ্ছে। শুধু জন্মভূমি বা বাসস্থান থেকে নয় সেই উৎপাটন। আরো কতরকম ভাবেই না গোটা বিশ্বজুড়ে সেই শরণার্থীর চলমান মিছিল, যুগ থেকে যুগান্তরে। অলোকরঞ্জনের মনন জুড়ে সেই শরণার্থী মানুষের গভীর অন্তর বেদনার আন্দোলন। শুধু লেখায় বা বলায় নয়, আক্ষরিক অর্থে ব্যক্তিস্তরেও অলোকরঞ্জনের শুশ্রূষার হাত সদা প্রসারিত।

৪৫টির মত কাব্যগ্রন্থ, গদ্যের বই ২৫টি, ইংরেজি বইয়ের সংখ্যা ৬, জার্মান বই ১৬, অনূদিত বই ২৪, এছাড়া রয়েছে সম্পাদিত বই, ছড়া ও গল্পের বই। এই বিপুল পরিমাণ লেখালেখির আন্দাজ সংখ্যা দিয়ে ধরা যায় কী? তাঁর প্রথম বই ‘যৌবন বাউল’ বেরিয়েছিল ১৯৫৯এ। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীকে। বই প্রকাশের ৫৪ বছর পর অলোকরঞ্জন তাঁর প্রথম বই সম্পর্কে লিখতে বসে এক জায়গায় বলেছিলেন -

‘‘রিখিয়া থেকে, আমার দশ-এগারো বছর বয়সের মুখে,শান্তিনিকেতনের পাঠভবনের শিক্ষার্থী হয়ে যাত্রা অবশ্যই আর একটি পর্বন্যাস। এই আনপড়ুয়াকে আম্রকুঞ্জের মুক্ত অঙ্গনে ক্লাস নিতে নিতে নির্মলদা (বিশ্বসাহিত্যের ভিতরবাসী মানুষ নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) আমার কাছে beautiful শব্দটার সঠিক বানান জানতে চাইলে আমি সেই দৈবক্রমে নির্ভুল উত্তর জ্ঞাপন করি, সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমায় ক্লাস সিক্সে উন্নীত করে নেন। তখন থেকেই আমি সেই সুন্দরের অন্ধ ভক্ত, যিনি এই জন্মে আমার জন্মজন্মান্তর ঘটিয়ে দিয়েছেন। কে এই সুন্দর? আর যিনিই হোন, মসৃণ কোন সংঘটন নন। শান্তিনিকেতনে ছাত্রদশাতেই মার্কসবাদে অকাল দীক্ষিত হয়ে পড়ি, ঘনঘন কলকাতায় যাওয়া-আসা সূচিত হয়, সেই সুবাদে বীরভূমের গ্রামে-গঞ্জেও শুরু হয়ে যায় আমার ঘুরে বেড়ানো। কার্ল মার্কসের সৌন্দর্যতত্ত্ব নিয়ে একটি লেখায় হাত দিয়েছি শুনে ছাত্র ফেডারেশনের কর্মীরা আমায় এই বলে ধিক্কার দেয় যে, নন্দনতত্ত্ব কাল মার্কসের এলাকা-বহির্ভূত। অতএব আমি যেন অনধিকার চর্চা থেকে বিরত হই। এইসব বিতর্ক-ভাবনার ভিতরদ্যোতনা - এককথায় বন্ধুদের সঙ্গে আমার এই মেঘ এই রৌদ্র - যৌবনবাউলেই বীজাঙ্কুরিত হয়ে দশ বছর পরে প্রকাশিত ‘রক্তাক্ত ঝরোখা’য় (১৯৬৯) স্পষ্টতর আকার নিয়েছে বলে আমার ধারণা। সব মিলিয়ে রিখিয়া-শান্তিনিকেতন-কলকাতার ত্রিমুখী আবর্ত ‘যৌবন বাউল’ শীর্ষাঙ্কিত গ্রন্থের গহন গ্রন্থি হয়তো।’’

আর যে পারিবারিকতার কথা একটু আগে তুলেছিলাম, সেই সম্পর্কে মা নীহারিকা দেবীর কথা স্মরণ করা বোধহয় অনাবশ্যক হবে না, ‘‘প্রেসিডেন্সি পর্বে রামতনু লাহিড়ী সহযোগী গবেষক যখন হল তারপর থেকেই ওরই দায়িত্বে আমাদের সংসারের ভিত্তি।’’ আর বন্ধু শঙ্খ ঘোষের কথায়, ‘মাসিমার কথায় মনে পড়ে যায় অলোকের আদ্যন্ত পারিবারিক ছবি। চূড়ান্ত এই বিচ্ছিন্নতার দিনে এক-একজন মানুষকে খুব আল্গা করে দেখবারই অভ্যাস হয়ে গেছে আমাদের, কিন্তু অলোকের চারপাশে যেন অদৃশ্যভাবে প্রতিমুহূর্তে ভাসতে থাকে তার প্রবহমান ঐতিহ্য, তার দেশ, তার পরিবার। ...এই পারিবারিকতায় খুব সহজেই সঙ্গী হয়ে যেত তার বন্ধুরা অথবা অনুরাগী অনুজেরা।’ এই হলেন অলোকরঞ্জন, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, আমাদের অলোকদা।


সৌজন্যেঃ আকাশবাণী, কলকাতা।