আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ঊনবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

ঠাকুরদাদা ও তাঁর বন্ধুরা

মালিনী ভট্টাচার্য


আমার ঠাকুরদাদা রমেশচরণ বসু মারা যান ১৯৬৬ সালে গড়িয়াতে আমাদের বাড়িতে, তখন তাঁর ৮৩ বছর বয়স। আরো পাঁচ দশক অতিক্রান্ত হবার পর ২০১৭ সালে তাঁর বড়ো ছেলের স্ত্রী আমার মায়েরও সেই বাড়িতেই মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুর পরে প্রয়োজন হল মায়ের ব্যবহার্য জিনিষগুলি যে আলমারিতে থাকত তা থেকে অদরকারি জিনিষ বাদ দিয়ে আলমারিটি গুছিয়ে রাখার। শেষের দিকে মায়ের স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাবার ফলে কোথায় কি আছে আমাদের তিনি কিছুই বলে যেতে পারেননি। আলমারির লকারটির পিছনদিকে সযত্নে-রাখা একটি প্লাস্টিকে-মোড়া পুঁটুলি একরকম আচমকাই আমাদের চোখে পড়ে । সেটি খুলে পাওয়া যায় বহু পুরোনো প্রায় একশোটি চিঠি - বেশির ভাগই রাজার মাথার ছাপ-দেওয়া ব্রিটিশ আমলের পোস্টকার্ডে - যা মোটামুটি ১৯১৮ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু নানা জায়গা থেকে লিখেছিলেন বন্ধু রমেশবাবুকে। বেশির ভাগ পোস্টকার্ডেরই এক পিঠে শাদা-কালোর আঁচড়ে ফোটানো পেন বা পেনসিলের স্কেচ বা রংতুলিতে আঁকা ছবি সেই বিশেষ জায়গাটির স্মৃতিবহন করছে। নন্দলাল বসু ব্যতীত এই সঞ্চয়ের মধ্যে খুঁজে পাই অবনীন্দ্রনাথ ও নন্দলালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী শিল্পী অসিতকুমার হালদারের কয়েকটি চিঠিও। লণ্ডন থেকে অসিতকুমার বা জাপান থেকে নন্দলাল খামের চিঠিও দু'একটি পাঠিয়েছিলেন। কলম্বো থেকে নন্দলালের চিঠি অবশ্য এসেছিল সেই পোস্টকার্ডেই কারণ তার শীর্ষে যাঁর মুকুট-পরা মাথার ছাপ তাঁর সাম্রাজ্য তো সেসময়ে সেই পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এছাড়া একটি ছেঁড়াখোঁড়া পাতলা কাগজে একটি স্কেচ পাওয়া যায়, যার ধারে পেনসিলে লেখা ‘ঋষিসিংহ’, পাশে সই অবনীন্দ্রনাথের।

এই গুপ্তধন পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে মা রক্ষা করছিলেন, কবে ঠাকুরদাদা তাঁকে এইসব অমূল্য সম্পদ রাখতে দিয়েছিলেন, কী করেই বা তাঁর আলমারির মধ্যে সবার অজান্তে এগুলি লুকিয়ে ছিল তার কোনোকিছুই যদিও আমাদের জানা নেই। ঠাকুরদাদা ছিলেন স্কুলশিক্ষক, ছিলেন শিল্পীও; বিধিবদ্ধ শিল্পশিক্ষার সুযোগ না পেলেও শান্তিনিকেতন এবং ক্যালকাটা স্কুল অফ আর্টস এন্ড ক্রাফটস-এ একদা তাঁর নিয়মিত যাতায়াত ছিল, এগ্‌জিবিশনে তাঁর ছবি যেত, মাসিক সাহিত্য পত্রিকার পাতায় ছাপাও হত, নন্দলালদের সঙ্গে তাঁর বহু বছরের ঘনিষ্ঠতা এবং অবনীন্দ্রনাথকে গুরু বলে মানার কাহিনি আমাদের পারিবারিক ইতিবৃত্তের অংশবিশেষ। ১৯৫২-৫৩ সালে নন্দলাল কলকাতায় এলে ঠাকুরদাদার সঙ্গে তাঁর বাড়িতে একবার তাঁকে দেখতে যাবার স্মৃতিও আমার আছে। আর ১৯৫৬ সালে আমার পিসতুতো বোনদের তিনি কার্ডে স্কেচ করে দিয়েছিলেন ঠাকুরদাদার ছবি, তলায় লেখা ‘তোমাদের দাদু রমেশবাবু, আমার বহুদিনের বন্ধু, ইনি কেবল মাস্টার নন, একজন শিল্পীও বটে’।

তার মানে পঞ্চাশের দশক পর্যন্তও তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল। আমরা সেসময়েও ঠাকুরদাদাকে বাড়িতে ছবি আঁকতে, বিশেষত পরিষ্কার জলের গামলায় ডুবিয়ে ছবি ‘ওয়াশ’ করতে দেখেছি। ছবি আঁকার সরঞ্জাম, নিজের স্কেচ ও ছবি এবং শিল্পীজীবনের স্মৃতিবাহী নানা জিনিষ রাখার জন্য তাঁর ছিল আড়াই ফুট বাই দু’ফুট আয়তনের একটি পালিশ-করা কাঠের বাক্‌সো যার ডালাটি পাশ থেকে টেনে খোলা যায়। ছোটোবেলায় রংতুলির লোভে আমরা প্রায়ই সে বাক্‌সো হাঁটকাতাম; একটি দুটি পরবর্তী সময়ের পোস্টকার্ড তার মধ্যেও ছিল; কিন্তু এই গুপ্তধনের পুঁটুলি তার মধ্যে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

ইতিমধ্যে ঠাকুরদাদা জায়গা বদল করেছেন অনেকবার। শিক্ষকতা করতেন সিলেট জেলার সুনামগঞ্জের জুবিলি স্কুলে, তারপর আমার বাবার সাময়িক কর্মস্থল শিলং, ঢাকা এবং মেজো ছেলের চাকুরিস্থল কোচবিহারে কাটিয়েছেন যুদ্ধ ও দেশভাগের সময়টা। সম্ভবত ১৯৪৯ সাল থেকে কলকাতায় আমাদের সঙ্গে থাকছেন। এত উথালপাথালের মধ্যেও কিন্তু কখনো বন্ধুদের কাছ থেকে আসা চিঠির গুচ্ছ হাতছাড়া করেননি। তিনি এবং পরে তাঁর বৌমা এত যত্নে তা রক্ষা করেছেন যে ন্যূনাধিক একশো বছর আগেকার পোস্টকার্ড কিছুটা পলকা হয়ে এলেও তাতে আঁকা ছবির রেখা ও রঙের জৌলুষ এখনো প্রায় অম্লান।

ঠাকুরদাদাকে যেটুকু মনে পড়ে তাঁর প্রতিটি কাজেই একধরনের শৃংখলা ও সৌন্দর্যবোধ ছিল, কিন্তু এই চিঠিগুলিকে নিজের জীবনের নানা বিবর্তনের মধ্যেও যেভাবে সংরক্ষণ করেছিলেন তাতে তাঁর এই স্বভাবটিই যে শুধু প্রকাশ পেয়েছে তা নয়, তাঁর কাছে এই চিঠিগুলির অন্য অপরিমেয় মূল্যেরও কিছুটা আভাস ফুটছে। আজ ঠাকুরদাদার বয়সের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে এই বন্ধুত্বের ইতিহাসটিকে আরেকটু জানার কৌতূহল চিঠিগুলি আবিষ্কার হবার পর থেকে আমাকে পেয়ে বসেছে।

হায়, এই ইতিহাসের শুরু কবে তার কালানুক্রমিক তথ্য আমার কাছে যথেষ্ট নেই। যাঁরা হদিশ দিতে পারতেন, নেই তাঁদেরও কেউ। এইটুকু জানি যে ঠাকুরদাদার বাবা গিরিশচরণ বসু মজুমদার একসময়ে পূর্ণিয়াতে অনেক বিষয়সম্পত্তি করেছিলেন। তাঁর অকালমৃত্যুর সময়ে ঠাকুরদাদার বয়স খুব কম ছিল; তাঁর দুই ভাই ছিলেন নেহাৎই বালক। বিষয়সম্পত্তি কিছুই রক্ষা করতে না পেরে মা ও ভাইদের নিয়ে তিনি তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ সাব-ডিভিশনে দেশের বাড়িতে ফিরে যান। অনুমান করছি, পরবর্তী সময়ে শিক্ষা তিনি সম্পূর্ণ করেছিলেন ঢাকা শহর থেকে। কিন্তু কতদূর পড়াশুনো করেছিলেন, ঢাকাতে কখনো কোনো কাজকর্ম করেছিলেন কিনা সে বিষয়ে আমার সংকলিত তথ্য নীরব।

তবে ছবি-আঁকার মতোই আরো অনেক বিষয়ে তিনি ছিলেন বিধিবদ্ধ চৌহদ্দির বাইরে এক স্বশিক্ষিত মানুষ। বাংলা এবং ইংরেজি ছাড়াও সংস্কৃত এবং পালি তিনি ভালো শিখেছিলেন। শেষজীবনে সংস্কৃত-ইংরেজি-সংস্কৃত একটি অভিধানের পাণ্ডুলিপি স্বহস্তে লিখে তৈরি করার উদ্যোগ আমার নিজের চোখে দেখা। আমার বাবা জানিয়েছেন, ব্রাহ্মী এবং খরোষ্ঠী লিপিও তিনি আয়ত্ত্ব করেছিলেন। এছাড়া কলকাতায় তাঁকে দেখেছি বই কিনে হিন্দি এবং উর্দুর চর্চা করতে। তাঁর লম্বা সরু আঙুলের আল্পনা অনবদ্য ছিল শুনেছি। কোজাগরীর রাত্রে নববধূর আগমন উপলক্ষ্যে সুনামগঞ্জের বাড়ির মাটির আঙিনায় সেই আল্পনার বিস্তার ছিল সূক্ষ্ম রুপোলি কাজ-করা বহুমূল্য শালের মত।

মাকে বিয়ের সময়ে তিনি উপহার দিয়েছিলেন বিশ্বভারতী-প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলীর প্রথম সংস্করণের সবকটি খণ্ড। ছোটোবেলায় যখন আমাদের তাক থেকে নামিয়ে সে বই পড়ার অনুমতি ছিল না, তখন কোলে বসিয়ে তা খুলে কবিতা পড়ে শোনাতেন তাঁর স্পষ্ট সছন্দ উচ্চারণে। ‘প্রভু বুদ্ধ লাগি আমি ভিক্ষা মাগি/ ওগো পুরবাসী, কে রয়েছো জাগি/ অনাথপিণ্ডদ কহিলা অম্বুদনিনাদে’ এখনো তাঁর গলাতেই আমি শুনতে পাই। রন্ধনকে শিল্পকলা মনে করতেন বলেই বাড়ির মেয়েদের কাছ থেকে রন্ধনপ্রণালী জেনে সেগুলি সংকলন করেন একটি রান্নার বইয়ের পাণ্ডুলিপিতে। আর গাছ-গাছালি গজিয়ে তোলা এবং তার পরিচর্যাতেও তাঁর ছিল স্বভাবদক্ষতা। সত্যিই তাঁর ছিল ‘সবুজ আঙুল’; সুনামগঞ্জে শিলং-এ বা কোচবিহারে বাড়ির সামনে ফুল-শাকসব্জির যে বাগান করেছিলেন তা পথের লোক দাঁড়িয়ে পড়ে দেখত। এমনকী, আমরা কলকাতায় প্রথম যে বাড়িতে থাকতাম সেখানে বাগান করার মতো জমি না থাকলেও অস্ট্রেলিয়ার আমদানি গুঁড়ো দুধের টিনে পাঁচিলের ওপর চীনাবাদাম এবং আনারস ফলাতে তাঁকে দেখেছি।

কিন্তু এতদিন পরে বুঝতে পারি তাঁর বহুবিধ দক্ষতার কোনোটির জন্যই প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির তিনি তেমন কোনো প্রয়োজন বোধ করেননি, নামযশের ব্যাপারও ভাল বুঝতেন না। আমার মনে হয়, তাঁর ছবি যে প্রদর্শনীতে পাঠানো হত তাও নন্দলাল বসুর মতো বন্ধুদের অকৃপণ উৎসাহেই। তাঁর জীবনচর্যার এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকেই হয়তো বোঝা যাবে নন্দলাল বসুর মতো শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতার চাবিকাঠিটি কোথায় ছিল। তিনি শুধু ছবি আঁকতেন বলে নয়, নানারকমভাবে সৌন্দর্যের সাধনা তাঁদের মতোই ঠাকুরদাদাও নিজের বাঁচার অঙ্গ করে তুলতে চেয়েছিলেন বলেই। এই সময়কাল জুড়ে জীবনের এই সৌন্দর্যের খোঁজে নন্দলাল বসুরা কোথায় কোথায় না ঘুরেছেন! একই ভ্রমণপিপাসা তাঁর মধ্যেও ছিল। কোন্‌ সময়ে কে জানে, বেশ কিছুদিন পাঞ্জাবে কাটিয়েছেন সম্পন্ন কৃষক পরিবারে ছেলেদের ‘মাস্টারজি’ হয়ে। ১৯৪৯ সালে তিনি যখন কলকাতায় পা ভেঙে শয্যাশায়ী তখন একবার তাঁদের কয়েকজন কলকাতায় এসে ‘মাস্টারজি’র খবর নিতে আমাদের বাড়িতে পৌঁছেছিলেন মনে পড়ে।

চিঠিগুলির শুরু যে কালপর্বে (১৯১৮র পোস্টকার্ড একটিই) অনুমান করছি তার অনেক আগে থেকেই তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। প্রথমদিকে রমেশচরণও নন্দলালদের ভ্রমণসঙ্গী হয়েছেন কখনো কখনো। ১৯০৯-১৯১১র মধ্যে লেডি হেরিংহ্যামের নেতৃত্বে যে শিল্পীদের দল অজন্তা গুহার ছবিগুলিকে কপি করে আনতে গিয়েছিলেন, ভগিনী নিবেদিতার মধ্যস্থতায় নন্দলাল বসু অসিত হালদারেরা যার মধ্যে স্থান পান - তাঁদের সম্মানার্থে ১৯১৫ সালে India Society সে ছবির এক বহুমূল্য সংকলন ‘Ajanta Frescoes’ নামে সীমিত সংস্করণে Oxford University Press থেকে প্রকাশ করে। সেই দলে যাঁরা ছিলেন তাঁরা সম্ভবত বইটি উপহার পান।আমার ঠাকুরদাদার পূর্বোল্লিখিত বাক্‌সোটিতে এই বইয়ের একটি কপি ছিল; তার মলাটের নীচের দিকে সোনার জলে ‘Ramesh Charan Bose’ নামটিও ছাপা আছে। মাঝারি পিঁড়ির সাইজের শক্ত সবুজ-সোনালি-কালো মলাটের এই ‘পাথুরে’ প্রমাণ বলছে সেই সফরের কোনো সময়ে তিনিও নন্দলালদের সঙ্গী ছিলেন। এই অনুমান সত্য হলে চিঠিগুলির আরো অন্তত দশ বছর আগে শুরু তাঁদের বন্ধুত্বের। আমাদের দুই বোনেরও মনে পড়ে ঠাকুরদাদার কাছে শোনা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে গোরুর গাড়ি চেপে গুহার সন্ধানে যাবার রোমহর্ষক গল্প।

কিন্তু আবার বাবার লেখায় দেখছি ১৯২০ সালে শান্তিনিকেতনের যে অসমসাহসী শিল্পীরা মধ্যপ্রদেশের অগম্য বাঘ-গুহায় ছবি ও ভাস্কর্যের সন্ধানে অভিযান করেছিলেন তার মধ্যেও ছিলেন ঠাকুরদাদা। আমরা কি তাহলে পরবর্তী কালে বাঘ- গুহার গল্পই শুনেছি? আমাদের পাওয়া ১৯২১ সালের পোস্টকার্ডগুলির মধ্যে দু'একটিতে নন্দলাল বাঘ-ভ্রমণের বর্ণনা দিয়েছেন, গুহার দেওয়ালচিত্রে বাঘের ছবি এবং সেখানকার একমাত্র বাসিন্দা ভীলদের কাঁটাগাছে ঘেরা কুটিরের স্কেচও সেখানে রয়েছে। স্পষ্টতই এই পোস্টকার্ড যখন পাঠানো হয়েছে তার আগেই রমেশচরণ ফিরে এসেছেন। এই রহস্যের কোনো কিনারা আমরা করতে পারিনি। সবটা মিলিয়ে অনুমান করছি, হয়তো ১৯০৯-১১-র মধ্যে অজন্তা এবং ১৯২০তে বাঘ এই দুই সফরেরই কোনো একটি পর্বে রমেশচরণ তাঁদের সঙ্গী হয়েছিলেন। তবে ১৯০৯-১০ সালের আগেই নিশ্চয়ই তিনি চাকরিতে ঢুকে পড়েছিলেন, প্রথম থেকেই সুনামগঞ্জে কিনা আমাদের জানা নেই। এই সময়ে তাঁর বিয়ে হয়েছে ঢাকার হেমনলিনী রায়ের সঙ্গে, ১৯১১তে জন্মেছেন তাঁদের প্রথম সন্তান। এইসব ঘটনার মধ্য থেকে সময় বার করে যদি রমেশচরণ দূর-ভ্রমণে অংশ নিয়ে থাকেন তবে এব্যাপারে তাঁর আগ্রহের পরিমাপ আমরা সহজেই করতে পারি।

বাবার লেখা থেকে জানতে পারছি, জন্মের পরে তিন বছর পর্যন্ত তিনি ঢাকা শহরে মামাবাড়িতে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। ছোটো বোনের জন্মের পর মা তাঁদের নিয়ে সুনামগঞ্জে চলে যান এবং সেখানে ভাইদের বিশাল জমিদারবাড়ির পাশে আলাদা একটি বাড়িতে নিজের ছোট্টো সংসার গড়ে তোলেন। কিন্তু সংসারের ভার স্ত্রীর হাতে ছেড়ে দিয়ে রমেশচরণ মধ্যে মধ্যেই বেশ কিছুদিনের জন্য উধাও হয়ে যেতেন কলকাতার আর্ট স্কুলে বা শান্তিনিকেতনে। ১৯১৭ এবং ১৯১৯ সালে তাঁদের আরো দুটি পুত্রসন্তান হয়। ঘর সামলানো ছাড়াও সন্তানদের প্রথম লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব হেমনলিনীই নিয়েছিলেন। আমার অশেষগুণশালিনী ঠাকুরমা বাড়িতেই সংস্কৃত শিখেছিলেন, নিয়মিত সাহিত্যপাঠ করতেন, বাংলায় কবিতা লিখতেন, পাখির মতো সুরেলা গলা ছিল তাঁর এবং এস্রাজের হাতটি ছিল অসাধারণ। ১৯২০র আশেপাশে তাঁর হৃদ্‌যন্ত্রের অসুখ ধরা পড়ে; ক্রমে এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েন যে চিকিৎসা ও শুশ্রূষার জন্য পাকাপাকি ঢাকায় ভাইদের বাড়িতে গিয়েই তাঁকে থাকতে হয়। বাবা অবশ্য সাড়ে দশ বছর বয়সে সুনামগঞ্জে ফিরে গিয়ে তাঁর বাবার হেপাজতে জুবিলি স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করেন।

১৯২০ সাল থেকে মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে চিঠিগুলি শান্তিনিকেতন বা নন্দলালদের অন্য গন্তব্যস্থলের খবর দিচ্ছে। রমেশচরণের জীবনের ছেঁড়াখোঁড়া যেসব তথ্য পাই তা ইঙ্গিত দেয় এই সময় থেকে কীভাবে সংসার ও চাকরির দায়িত্ব তাঁকে জড়িয়ে ধরছে। প্রথমজীবনে বাবার মৃত্যুতে মা ও ভাইদের ভার পড়েছিল তাঁর ওপরেই; পরে শিক্ষকতা করতে করতে বিবাহ, সন্তানদের জন্ম, সর্বোপরি স্ত্রীর দীর্ঘ অসুস্থতা এবং ১৯৩২ সালে ৩৯ বছর বয়সে তাঁর অকালমৃত্যু এমন অবাধ ভ্রমণে যে অনেকখানিই লাগাম পরিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। বড়ো ছেলে তখন সদ্য এম এস সি পরীক্ষা দিয়েছেন, অন্যেরা আরো ছোটো। যদিও তাঁরা খুব আদরেই মামাবাড়িতে মানুষ হয়েছেন তবু তাঁদের প্রতি পিতার দায়িত্ব ফুরোয়নি। চাকরি ছেড়ে পুরো শিল্পীজীবনে প্রবেশ করার কিছু সুযোগ এসেছিল তার আভাস দু'একটি চিঠিতে থাকলেও সে সুযোগ তিনি নিতে পারেননি। কিছুটা খাঁচার পাখির অবস্থা হয়েছে তাঁর। নন্দলাল বসুর প্রতিটি পোস্টকার্ড যেন এই বার্তাই দেয় যে তাঁদের সঙ্গে উড়াল দিতে না পারলেও বন্ধুকে তাঁরা ভুলে যাননি।

আড়াই দশক ধরে পত্রবিনিময় চলেছে। নন্দলালের চিঠিতে শান্তিনিকেতনের এবং কলাভবনের সংবাদ ছাড়াও পারিবারিক খবরের বিনিময় হচ্ছে। হেমনলিনীর অসুখের বাড়াবাড়িতে উদবেগ, রমেশচরণের বড়ো দুই ছেলেমেয়ের কথা, মেয়ে বীণাকে শান্তিনিকেতনে দেখে খুশি হবার কথা, এমনকী রমেশবাবুর পাঠানো দেড় মণ চালের (কলাভবনের জন্য?) প্রাপ্তিসংবাদ সবই রয়েছে পোস্টকার্ডে। রয়েছে নন্দলালের কন্যা গৌরী দেবীর বিবাহের হাতে আঁকা নিমন্ত্রণপত্র। কী করে যেন এরই মধ্যে রমেশচরণের মুক্তোর মতো হস্তাক্ষর-সহ একটি পোস্টকার্ডের আধখানা রয়ে গেছে যেখানে মন দিয়ে পড়াশুনো করার পুরস্কারস্বরূপ ঢাকায় মেজোছেলেকে দোপাটিফুলের ছবি এঁকে পাঠাচ্ছেন। এসব ব্যক্তিগত আদানপ্রদানের মধ্যে আবার মিশে রয়েছে এমন অনেককিছু যার তাৎপর্য বুঝতে হলে এই আড়াই দশকে তাঁদের চারপাশে যা কিছু ঘটছিল সেসবকে বাদ দেওয়া যাবে না।

রমেশচরণ জন্মেছিলেন নন্দলালের পরের বছর। বিশ শতকের শুরুতে তাঁরা সদ্যতরুণ এবং পরের দশকগুলি জুড়ে জাতির চেতনায় বিপুল আলোড়নের অভিঘাত তাঁদের মনকেও তৈরি করেছিল। নন্দলালের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের যোগের কথা আমরা সবাই জানি। ফৈজপুর কংগ্রেস অধিবেশন থেকে(১৯৩৬) পাঠানো নন্দলালের উদ্ভাবিত রানি ঝাঁসি দরওয়াজার স্কেচ সেই বার্তা বহন করে। ঠাকুরদাদার এমন কোনো রাজনৈতিক সংযোগ ছিল বলে আমরা জানিনা। কিন্তু এই আলোড়ন তো শুধু রাজনৈতিক ছিল না। তার তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা, শিক্ষাচিন্তা, সাহিত্য, শিল্প এবং মননের সমস্ত প্রাঙ্গণ জুড়েই। শিল্পের ক্ষেত্রে প্রকৃতির সৌন্দর্য বা মানুষের সৃজনশীলতাকে চিনবার যে চোখ অবনীন্দ্রনাথ খুলে দিয়েছিলেন, তা নিয়ে এই ঐতিহাসিক সময়ে যেখানেই তাঁর শিষ্যরা গেছেন সেখানে ভারতবর্ষকেই পুনরাবিষ্কার করেছেন তাঁরা। তাঁদের চমৎকৃত করেছে স্বদেশের বিস্তীর্ণ পাহাড়-জল-জঙ্গল-সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত শুধু নয়, অধিবাসী মানুষদের বিচিত্র জীবনচর্যা। বাঘ-গুহাচিত্রের কপির পরের পোস্টকার্ডেই তাই থাকে স্থানীয় ভীল রমণীর স্কেচ যাদের পূর্বপুরুষেরাই হয়তো এসব এঁকেছিল; থাকে তাদের তৈরি খেলনার ছবিও। সাসারামে (পোস্টকার্ডে ‘সহস্রম্‌’) শেরশাহের সমাধির অসাধারণ স্কেচটির পিঠে মুগ্ধ নন্দলাল লিখছেন, এর জন্য শুধু আমাদের দেশের মানুষ নয়, গর্ববোধ করতে পারে সারা দুনিয়াই। তাঁদের এইসব নতুন শিল্পচিন্তার আলোচনা আছে অসিতকুমার হালদারের চিঠিতেও। অন্যদেশে গিয়েও সৌন্দর্যরসেরই সন্ধান করেছেন তাঁরা।

ঠাকুরদাদা সারাক্ষণের শিল্পী ছিলেন না, শিক্ষক হিসাবে মারধোরের বিরোধী হলেও খুব কড়া ছিলেন। ছাত্রের বিন্দুমাত্র ফাঁকি ক্ষমা করতেন না, নিজেকেও ক্ষমা করতেন না। ব্যক্তিত্বের এই দুই দিককে হয়তো কখনোই তিনি মেলাতে পারেননি। আবার এই শৃংখলাবোধই সম্ভবত তাঁকে সাহায্য করেছিল নিজের গুণগুলিকে ধরে রাখতে। এত গুণের অধিকারিণী হয়েও স্ত্রীর অসুস্থতা ও অকালমৃত্যুতে তাঁর যন্ত্রণার কথা কখনো তিনি আমাদের বলেননি; কিন্তু ছোটো মেয়েদের ঘোমটা দিয়ে রান্নাবাটি খেলা তাঁর মোটেই পছন্দ ছিল না, এই শৈশবস্মৃতি থেকে আবছা মনে হয় সংসার যে মেয়েদের তথা সব মানুষেরই অনেক সৃজনশীলতা শুষে নেয়, তা তিনি অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছিলেন। নন্দলালদের ছবি-সহ চিঠি হয়তো তাঁকে এই বার্তাই দিত যে, সংসারের কারণে আমাদের সঙ্গে যেতে পারছ না তাতে কী? এই নাও আমার চোখ, আমি যা দেখছি তুমিও তা দেখে আনন্দ পাও। কিন্তু চিঠিগুলির বার্তা কেবল ব্যক্তিগতই নয়, তা আরো ব্যাপক। পেশায় নন, নেশায় শিল্পী এমন আপনজনকে রসাস্বাদনের জগতে সমান অংশীদারিত্ব দিয়ে চিঠিগুলি জাতীয় ইতিহাসের বহুরকম বেড়া-ভাঙ্গার এক পর্বকেই চিহ্নিত করছে।


[এই যৌথ সম্পদ কিছুদিন আগে রমেশচরণ বসুর সমস্ত নাতি-নাতনীর সম্মতিক্রমে Centre for Studies in Social Sciences Calcutta-র হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে তাঁদের অভিলেখাগারে সংরক্ষণের জন্য, কারণ এ সম্পদে দেশের সাধারণের অধিকার আমরা স্বীকার করি। আমরা আনন্দিত যে Victoria Memorial ও Delhi Art Gallery-র সহযোগিতায় তাঁরা এগুলি নিয়ে ৩ ডিসেম্বর’২০ - ৫ জানুয়ারি’২১ একটি অনলাইন প্রদর্শনী করছেন।]

ছবি সৌজন্যঃ jbmrc.org