আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ঊনবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ পৌষ, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

‘‘...যুদ্ধ এখন আর ঘোষিত হয় না। চলতেই থাকে।...’’


লড়াই চলছে। সমানে অসমানে চলছে লড়াই। প্রবল পরাক্রমশালী শাসকের চোখে চোখ রেখে শীতের তীব্রতাকে তোয়াক্কা না করে সড়কে দাঁড়িয়ে কৃষকের লড়াই চলছে। সরকারের সঙ্গে বৈঠকেও গভীর প্রতীতি নিয়ে লড়াই চলছে। কৃষকের শক্তি জনসমাবেশ, গণ অবস্থান, অনশন। সরকারের হাতিয়ার তারকাঁটা সিমেন্টের বেড়া, কাঁদানে গ্যাস, জলকামান। তারপরেও কৃষকের একটাই প্রশ্ন - বাতিল না বহাল?

প্রথমে অধ্যাদেশ। তারপর জবরদস্তি আইন প্রণয়ন। গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বালাই নেই। সংখ্যাধিক্যের দাপটে হারিয়ে যায় সমস্ত যুক্তি বিশ্লেষণ। বিকল্প চিন্তা, ভিন্ন ভাবনার অবকাশ নেই। শাসকের প্রস্তাব মাথানত করে মানতে অস্বীকার করলেই নানানরকমের তকমায় দাগিয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিস্পর্ধার পরিসরটিই বিনষ্ট করার বহুবিধ প্রয়াস নিরন্তর চলছে।

কৃষি ক্ষেত্রে সংস্কারের অজুহাতে তিনটি আইন প্রণীত হয়েছে। অধ্যাদেশ জারির সময় থেকে শুরু করে আইন প্রণয়নের পর্ব পর্যন্ত বারেবারেই বলা হয়েছে যে কৃষকের ভালো করার জন্য এই আইন প্রয়োগ করা হবে। যাদের জন্য এই আইনের প্রবর্তন সেই কৃষক কিন্তু শুরুতেই জীবিকার সঙ্কটের সঙ্কেত বুঝতে পেরেছেন। ফলে অধ্যাদেশ জারির সময় থেকেই বিভিন্ন কৃষক সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়ে পথে নেমেছে। প্রতিবাদে ভ্রুক্ষেপ না করে অধ্যাদেশ আইনে রূপান্তরিত হয়েছে। শরিক দলের প্রতিনিধি মন্ত্রিসভা ত্যাগ করে বিপদজনক প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে সতর্ক হওয়ার ইঙ্গিত দিলেও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের হয়নি পরিবর্তন। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে চলতে থাকা স্বতঃস্ফূর্ত ও সংগঠিত আন্দোলনের উন্মাদনায় উজ্জীবিত কৃষকদের উদ্দেশ্যে দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন -‘‘গত শতাব্দীর আইন দিয়ে বর্তমান শতাব্দীর নির্মাণ সম্ভব নয়। সংস্কার ছাড়া উন্নয়ন অসম্ভব। সরকার সেই পথেই হাঁটছে।’’ অতীতের তুলনায় বর্তমান সময়ে কেন সংস্কার কার্যকর হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা করে বলা হচ্ছে আগে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্র, কিছু বিভাগকে মাথায় রেখে সংস্কার হত। এখন সার্বিক বিষয়কে মাথায় রেখেই নাকি সংস্কারের পথে হাঁটা হচ্ছে।

সড়কে অবস্থানরত কৃষক এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। জীবনের অভিজ্ঞতায় কৃষক আজ বুঝতে পারছেন নতুন আইনে তাঁর জীবিকা বিপন্ন। কঠোর পরিশ্রমে উৎপাদিত ফসল নিয়ে বণিকের ধূর্ত বাণিজ্যে কৃষকের প্রবল আপত্তি। নিজের জমিতে অন্যের নির্দেশে চাষ করতে কৃষক নারাজ। খোলা বাজারে বণিকের মর্জিমাফিক দামে ফসল বিক্রিতে কৃষকের আপত্তি। কৃষক দামের ব্যাপারে সরকারের রক্ষাকবচ চাইছেন। সরকারের বাজার বা মাণ্ডিতে সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি-র ভিত্তিতে কৃষক ফসল বিক্রি করতে চাইছেন। সর্বোপরি নিজের ইচ্ছায় ফসল উৎপাদনে কৃষক আগ্রহী। দাদন নিয়ে চুক্তিচাষের দলিলে স্বাক্ষর করতে কৃষক কোনোমতেই রাজি নয়। কাজেই সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রয়েছে।

পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। সড়কে অবস্থানরত কৃষকের সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। প্রতিকূল আবহাওয়ায় কৃষক অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অনেক মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। সরকার বিব্রত। বিরক্ত ও বিধ্বস্ত। তবুও আগ্রাসী আচরণে পরিবর্তন আসেনি। সরকারি ও দলীয় প্রচারে অনবরত চলছে আন্দোলনের আগ্রাসী বিরোধিতা। আইনের গুরুত্ব বোঝাতে ঝাঁকে ঝাঁকে মাঠে নেমেছে সরকার স্বীকৃত দেশভক্ত বাহিনী। বিপ্রতীপে লাখে লাখে কৃষক সমবেত হয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন এই সর্বগ্রাসী আইন বাতিল না করা পর্যন্ত লড়াই জারি থাকবে।

বাধ্য হয়ে সরকার নতুন আইনের কিঞ্চিত পরিমার্জনের প্রস্তাব দিয়েছে। যে কৃষক সমাবেশের উপর বিভিন্ন ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী, সন্ত্রাসবাদী তকমা লাগানো হচ্ছে তাদের কাছে সরকারের প্রস্তাব - কর্পোরেট সংস্থার বিরুদ্ধে কৃষকের নালিশ জানানোর জন্য বিচারবিভাগীয় ট্রাইবুনাল তৈরি হবে। কৃষিপণ্য বাজার কমিটি (এপিএমসি)-র আওতায় থাকা মাণ্ডির মতো বেসরকারি মাণ্ডিতেও একইরকম কর বসানো হবে। এবং এপিএমসি-র বাইরে ফসল কিনতে হলে ব্যবসায়ী, কর্পোরেট সংস্থাকে নামধাম নথিভুক্ত করতে হবে। এমনকি ফসলের ন্যূনতম দাম বা এমএসপি ও সরকার কর্তৃক ফসল কেনার বিষয়ে লিখিত গ্যারান্টি দিতে সরকার তৈরি। দিল্লিতে দূষণ রুখতে আশপাশের রাজ্যে নাড়া পোড়ানোর জন্য কৃষকদের বিরুদ্ধে কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করে যে অধ্যাদেশ জারি হয়েছে, তাতে সংশোধন করা হবে। বিদ্যুৎ আইন সংশোধনী বিলের খসড়ায় কৃষিক্ষেত্রের ভর্তুকি তুলে দেওয়ার যে প্রস্তাব রয়েছে তাও সংশোধনের কথা বলা হচ্ছে। কৃষক নতুন আইনের কোনো সংশোধনী বা কসমেটিক সার্জারিতে রাজি নন। কৃষকের একটাই দাবি - কৃষক বিরোধী আইন প্রত্যাহার করতে হবে। সরকারের তরফে কিন্তু আইন প্রত্যাহারের ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য নেই।

কৃষক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছেন যে এই সরকারের কোনও কথার উপরই ভরসা করা যায় না। প্রতিটি দেশবাসীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল। তারপর হয়েছে নোট বাতিল। ফলে বিপর্যস্ত দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি সরকারের এখন মূল লক্ষ্য। সাম্প্রদায়িকতা সম্প্রসারণ থেকে শুরু করে দেশকে বিরোধী শূন্য করার ব্যাপারে আধিপত্যবাদের বিস্তারে মনোযোগী বলে শুরু হয়েছে উদ্ধত আগ্রাসী আচরণ। কাজেই কৃষক, এবং শুধু কৃষক কেন কোনো গণতান্ত্রিক মানুষ এই সরকারের প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করেন না। দেশের সরকারের উপর থেকে দেশবাসীর আস্থা চলে গেলে দেশের অগ্রগতি সম্ভব?

কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে সমাজের অন্যান্য অংশের মুখর হওয়া শাসকের পছন্দ নয়। আন্দোলনরত কৃষক সংগঠনগুলির আহ্বানে ২৬শে নভেম্বরের ভারত বন্‌ধের সমর্থনে রাস্তায় নামা আন্দোলনকারীদের দমনের চেষ্টা করেছে উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, কর্ণাটক সরকার। এই রাজ্যগুলিতে যে পুলিশি তৎপরতা দেখা গেল, তা অভূতপূর্ব। বিরোধী দল ও কৃষক নেতা ও সমাজকর্মীদের ‘গৃহবন্দি’ করে দেওয়া হয়। বন্‌ধের আগের রাতেই থেকেই স্থানীয় নেতাদের বাড়ির বাইরে পুলিশ পৌঁছে যায়। এত করেও কোনো লাভ হয়নি। নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমে বন্‌ধের সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। বন্‌ধের সাফল্যে অবস্থানরত কৃষক উজ্জীবিত।

রাজধানী দিল্লি এখন কার্যত অবরুদ্ধ। হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের প্রতিটি সীমান্ত বন্ধ। ফলে অন্যান্য রাজ্য থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে যে কৃষকরা আন্দোলনে যোগ দিতে আসছেন তাঁদের দিল্লির অনেক আগেই আটকে থাকতে হচ্ছে। দেশের কৃষক অবিশ্যি এখন একজোট হয়ে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। আইন বাতিল না করা পর্যন্ত তাঁরা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করতে রাজি নন। ফলে যেখানেই পথরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে কৃষক সেখানেই গোরু-মহিষ, ট্রাক-ট্রাক্টর নিয়ে অবস্থান শুরু করে দিচ্ছেন।

ভারতবর্ষে বহুদিন পর এমন একটি সর্বব্যাপী কৃষক আন্দোলন শুরু হয়েছে। এই পরিসরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। কৃষক আন্দোলন বিরোধী রাজনৈতিক ঐক্যের অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে কিনা সে কথা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিক্ষোভ নিঃসন্দেহে শাসকের প্রতিস্পর্ধী রাজনীতিকে একটি যৌথমঞ্চ তৈরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মঞ্চটি জোরদার এবং সম্ভাবনাময় হলেও সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের কীর্তিকলাপ এহেন সন্দেহের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। দল হিসেবে নতুন কৃষি আইনের বিরোধিতা করে বন্‌ধের দিন সরকারের সমস্ত পরিষেবা চালু রাখা হয়েছে। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমবঙ্গের সরকার ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে ‘পার্টিসিপেটরি ফার্মিং’ বা অংশগ্রহণমূলক চাষ বলে রাজ্যে একধরনের চুক্তি চাষ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। রাজ্য মন্ত্রীসভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল -

এলাকা ভিত্তিক তৈরি হবে কৃষকদের উৎপাদক সংস্থা।

তাদের সঙ্গে চুক্তি করবে বেসরকারি কোম্পানি।

কোম্পানিই বীজ, সার, কীটনাশক দেবে।

বিনিময়ে তারাই সব ফসল কিনে নেবে।

চাষ শুরুর আগেই ফসলের দাম ঠিক হয়ে যাবে।

জমির মালিকানা কৃষকদের কাছেই থাকবে।

কোম্পানিকে জমি লিজও দেওয়া যাবে না।

এ যেন বর্তমান কেন্দ্রীয় আইনের প্রথম সংস্করণ। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের এখনকার বক্তব্য কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। হয়তো এই কারণেই কৃষকদের সপক্ষে সমবেত বিরোধী দলগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল অনুপস্থিত। এই অনুপস্থিতি আরো বেশি সন্দেহের উদ্রেক করে যখন রাজ্য সরকারের শীর্ষ মন্ত্রী কৃষক সংগঠনের দাবি যে রাজ্যে কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরুদ্ধে রাজ্য স্তরের আইন প্রণয়ন করা হোক, তার প্রতি অনীহা প্রকাশ করেন!

কৃষকদের সপক্ষে সমবেত বিরোধী দলগুলির নানা বিষয়ে মতানৈক্য, এমনকি বৈপরীত্যও আছে। কিন্তু কৃষি আইন সংক্রান্ত এই বিশেষ প্রশ্নটিতে তাদের মধ্যে কোনো অনৈক্য দেখা যায়নি। আন্দোলনরত কৃষকরাও বিরোধীদের সমর্থনকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে আন্দোলনের মঞ্চে রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি কৃষকদের পছন্দ নয়। রাজনৈতিক দলগুলিও এই প্রস্তাবে আপত্তি করেনি।

এই অবসরে বিভিন্ন মতের বিরোধী রাজনীতিতে সমন্বয় গড়ে উঠছে। এক দেশ, এক জাতি, এক নেতা সর্বস্ব আগ্রাসী ঔদ্ধত্যমূলক স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা, যে গণতন্ত্র বহু স্বার্থ এবং বহু স্বরকে সম্মান জানায় তাদের মধ্যে প্রতিস্পর্ধী সমন্বয় সাধন করতে পারে। শাসকের সর্বগ্রাসী আধিপত্য থেকে গণতান্ত্রিক পরিসরটিকে রক্ষা করার দায় বিরোধীদেরই পালন করতে হবে।

অষ্টপ্রহর ভক্তমণ্ডলীর বৃন্দগান চলতে থাকুক। কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠুক। অন্যথায় আধিপত্যবাদী আগ্রাসন উৎখাত করা যাবে না। সমান্তরাল ভাবে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ অর্থাৎ আইন ‘বহাল’ এবং ‘বাতিল’ নিয়ে চলতে থাকা যুদ্ধে থেমে থাকার অবকাশ নেই। সদ্যপ্রয়াত কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ভাষ্য অনুযায়ী - ‘‘...যুদ্ধ এখন আর ঘোষিত হয় না। চলতেই থাকে।...’’