আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

ইউরোপ - উত্তর বনাম দক্ষিণ

বাপ্পাদিত্য চক্রবর্তী


উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের মধ্যে কত তফাৎ? সবাই বলবেন, অনেক। ভাষায়, ব্যবহারে, খাবারে, সংস্কৃতিতে ইত্যাদি থেকে পূজা-পদ্ধতি পর্যন্ত সবেতেই উত্তর এবং দক্ষিণ অনেকটাই আলাদা। কিন্তু ইউরোপের সম্বন্ধেও যে এটা খাটে, সেটা অনেকে জানলেও - ঠিক মনের ভিতর থেকে বোধ করেন না।

এর একটা কারণ হয়ত এই, যে ইউরোপ সম্বন্ধে সম্যক ধারণা সাধারণ মানুষের নেই। যাঁরা বিদেশে যান বেড়াতে, তাঁদের হাতে সময় থাকে না এসব খুঁটিয়ে দেখার, যাঁরা ওখানে থাকেন, তাঁরা নিজের জীবন চালাতেই ব্যস্ত, আর যাঁরা কর্মসূত্রে দিন কয়েকের জন্য বিদেশ যান, তাঁদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। ইউরোপের বৈচিত্রের অনুধাবন করার সময় কারো নেই।

ইউরোপ সম্বন্ধে না জানার আরো দুটো কারণ হতে পারে। প্রথম, আমেরিকার প্রতি আমাদের বিশেষ মানসিক আকর্ষণ। কেন, তা আলোচনা করার জায়গা এটা নয়। কিন্তু আমেরিকার প্রতি আকর্ষণের ফলে ইউরোপ সম্বন্ধে জানার উৎসাহ প্রায় কখনোই ছিল না। প্যারিস? সেখানে তো লোকে যায় আঁকা শিখতে। সরবঁ যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা, তা লোকে ভুলেই যায়। এছাড়া আছে ভাষার ব্যাপারটা। ইউরোপ যাওয়া মানেই একটা নতুন ভাষা শিখতে হবে - কে আবার অত কষ্ট করে।

দ্বিতীয় কারণ, আমার মনে হয় - ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক ভাবধারার জন্য, যা আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে - বলতে পারেন - পেয়েছি। ইউরোপের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ইংরেজিতে অনুবাদ করা বই দিয়ে, এবং ইংরেজদের চোখ দিয়ে ইউরোপকে দেখে। ইংরেজরা যে চিরকাল প্রচন্ড পরিমাণে জাতিবিদ্বেষী সেটা এখন সবাই জেনে গেছে। ফরাসীদের ‘ফ্রগ’, ইতালিয়ানদের ‘ওয়গ’, জার্মানদের ‘হুণ’, ইত্যাদি নাম তো ইংরেজরাই দিয়েছে - আজ না হয় পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের জেরে, এই নামগুলোকে অতলান্তিকের অন্য পারে ঠেলে দিয়েছে। বহুকাল ধরে সমস্ত ইউরোপের খাবারকে ‘কন্টিনেন্টাল’ আখ্যা দিয়ে পুরো ব্যাপারটাকেই একটা লেবেল দিয়ে সেঁটে রেখেছিল। এই তো সবে গত তিন দশক ধরে খাবারের ব্যাপারে একটা নীরব বিপ্লবের ফলে ভারতীয়রা শিখেছে যে সত্যি কথা বলতে গেলে, ব্রিটেনের খাবার কোনো ক্যুইজিনই নয়, সে মার্কো হোয়াইট যা-ই বলুন না কেন।

আসল কথা, ইউরোপের সম্বন্ধে আমাদের যেটুকু জ্ঞানগম্যি - স্বাধীনতার পরে বেশ কয়েক দশক পর্যন্তও - ইংরেজদের কাছ থেকেই পাওয়া। এবং স্বভাবতই, পাশ্চাত্ত্যের যা কিছু - আধুনিক কালে - তার উৎস যে ব্রিটেনই, সেটা তারা ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। তাদের হিসাবে, ইউরোপ তো আছেই (বীটোফেন বা মৎসার্টকে তো আর বাদ দেওয়া যায় না), কিন্তু ব্রিটেন হল গিয়ে, যাকে বলে 'লুনুস স্টেল্লা লুমিনারিস' অর্থাৎ 'আ মুন এমাং স্টারস্‌'। একমাত্র মুজতবা আলী সাহেব তখনকার দিনে বলেছিলেন (তাও নিজের জবানীতে নয়) - ব্রিটিশ? মানে যারা ইউরোপের উত্তরদিকে একটা ছোট দ্বীপে থাকে?

ইউরোপের কথায় আসি। ইউরোপীয়ানদের হিসাবে, ইউরোপ তিন ভাগে ভাগ করা। নর্ডিক ইউরোপ - অর্থাৎ উত্তর, সুডইউরোপা অর্থাৎ দক্ষিণ (এর মধ্যে পশ্চিম ইউরোপও ঢুকে বসে আছে), এবং পুর্ব । তবে বেশীর ভাগ ইউরোপীয়ানদের দেখেছি, পূর্ব ইউরোপকে ইউরোপ বলেই মানে না। জাতি বিদ্বেষ এখানেও চোখে পড়ার মতো। হাঙ্গেরিয়ানদের ইকনমিক্স আর ম্যাথেমেটিক্সে যা অবদান, পোল্যান্ডের সঙ্গীতে অবদান তার থেকে কিছু কম নয়। আর রাশিয়ানরা নিজেদের ইউরোপীয়ান বললেও, জাত ইউরোপীয়ানদের কাছে তারা - রাশিয়ান-ই।

জার্মানি এবং ফ্রান্স ঠিক নর্ডিক নয়, আবার, দক্ষিণ ফ্রান্স ছাড়া, পুরোপুরি দক্ষিণও নয়। তবে, জাতি এবং বর্ণবিদ্বেষ, এদেরও কোনোদিন কিছু কম ছিল না। তবে ফ্রান্স অনেকটাই কম, আর জার্মানি - সবাই জানেন - অনেকটাই বেশি ছিল, এখন অবশ্য কমে গেছে।

আমি উত্তর এবং দক্ষিণ ইউরোপ নিয়ে আপাততঃ লিখছি, সুতরাং পূর্ব ইউরোপের কথা বলব না। যদিও পূর্ব ইউরোপের ইতিহাস বর্ণ এবং বৈচিত্রময়। উত্তর এবং দক্ষিণ ইউরোপ - দুয়ের মধ্যেই পার্থক্য প্রচুর। যদি কারও উৎসাহ থাকে, তাহলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে 'বল্কান্‌ কোয়েশ্চেনের' ইতিহাস এবং পরে ১৯১৫ সালে নাউম্যানের 'মিট্টেলইউরোপা'-র ওপর বই পড়ে দেখতে পারেন। ব্রিটেন আর রাশিয়ার কথাও এখানে বলব না। কারণটা সহজেই অনুমেয়। উত্তর এবং দক্ষিণের প্রথম তফাৎ - ধর্ম। উত্তরের ক্যাল্ভিনিস্টিক অ্যাপ্রোচের কথা দিয়েই শুরু করা যাক। এই হিসাবে কর্মই ধর্ম। পৃথিবীতে আসা মানেই কাজ করা এবং কাজের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরের কাছে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা। সুতরাং, ক্যাল্ভিনিস্টদের যে সারা বছরে মাত্র চার দিন (ক্রিস্টমাস ছাড়া) ধর্মীয় ছুটি, এতে অবাক হবার কিছু নেই। ক্যাল্ভিনিস্ট এবং লুথেরান চার্চ একই রকম।

অন্যদিকে ক্যাথলিসিজম্‌। বছরে বারো দিন ধর্মীয় ছুটি (এটা শুধু ভ্যাটিক্যানের হিসেবে, এছাড়া শহরে শহরে এবং গ্রামে গ্রামে, নানারকম সেইন্টদের নিজস্ব দিন থাকে, তাতে লোক্যাল ছুটি হয় - সব যোগ করলে বছরে ষাট দিন তো হবেই), ক্রিসমাস ছাড়া। সুতরাং কাজ করার প্রতি মনোভাব কীরকম হবে সেটা সহজেই বোঝা যায়। ক্যাথলিকরা একসময় যেরকম ধর্মীয় ব্যাপারে কড়া ছিল, এখন ততটাই ঢিলে। ধর্ম থেকে কী আসে? জীবনদর্শন এবং ধারা। এজন্যই ইংরেজিতে কথা আছে ‘ক্যাথলিক ওয়ে অফ্‌ লাইফ’, মানে জীবনকে খুব সহজ (সরল নয়) ভাবে নেওয়া। ক্যাথলিক ওয়ে অফ লাইফ-এ ‘চলতা হ্যায়’ প্রযোজ্য। সেখানে নর্ডিকরা এবং ইংরেজরা (এংলিকান চার্চ) জীবনকে অনেক সিরিয়াসলি নেয়।

উত্তর এবং দক্ষিণের বাকি তফাতের মধ্যে বেশিরভাগটাই এসেছে আবহাওয়া, প্রাকৃতিক পরিবেশ, জমির উর্বরতা, এবং ইতিহাস আর সমাজ-জীবনের বিবর্তন থেকে। এর মধ্যে অনেক তফাতই চোখে পড়ার মতো, আর সেই নিয়েই আজকের আলোচনা।

প্রথম, আবহাওয়া। উত্তর ঠান্ডা, এবং দক্ষিণ গরম। আমাদের দেশের মত গরম নয়, এ হল গিয়ে আপনার ছোটবেলার ভূগোলে পড়া ‘ভূমধ্যসাগরীয় আবহাওয়া’। দক্ষিণে গরমটা (একমাত্র স্পেনের দক্ষিণ ভাগ ছাড়া) সাধারণত ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরোয় না। বছর কুড়ি আগেও তিরিশ পেরোত না। এখন তো ক্লাইমেট চেঞ্জের ফলে সবই বদলে গেছে। নইলে কে কবে শুনেছিল যে প্যারিসে পারা চল্লিশ ছাড়িয়ে যাবে?

সে যাই হোক, উত্তরে পারা গরমকালেও পঁচিশ পেরয় না। নরওয়েতে তো নয়ই। স্যুইডেন এবং ডেনমার্কে হয়ত দু’ বা তিন দিন ছাব্বিশ হল। শীতকালে উত্তরে মাইনাস দশ তো থাকেই, কখনো তার থেকেও নিচে চলে যায়। দক্ষিণে খুব বেশি ঠান্ডা পড়লে মাইনাস তিন (স্যুইটজারল্যান্ড এবং অস্ট্রিয়া আর জার্মানির পাহাড়ী অঞ্চল বাদ দিয়ে বলছি) বা চার। তবে উত্তর স্পেন এবং উত্তর ইতালিতেও এরকমই টেম্পারেচার থাকে। অর্থাৎ বছরের বেশির ভাগ সময়টাই হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা, এবং তিন মাস ভাল তুষারপাত।

তবে এই যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে রাত আর দিনের হিসাবটা। উত্তর ইউরোপে বছরে প্রায় সাত মাস দিন থাকে পাঁচ থেকে আট ঘন্টা। সকাল ন’টার সময় ঘুটঘুটে অন্ধকারে লোকে অফিস যায়। সূর্য অর্ধেক দিন দেখাই যায় না। ফলত, উত্তরের লোকেরা দিনের আলো দেখে কাজের হিসাব করে না।

দক্ষিণের লোকেরা করে। তাদের দিন রাতের হিসাব আমাদেরই মতো, আর কাজও সেই হিসাবে। সাধে কি কোলারিজ লিখেছিলেন - “the Chinese don’t care to/the Japanese don’t dare to/the Hindoos and the Italians sleep soundly from twelve to one/only mad dogs and Englishmen go out in the sun”!

এই দিন-রাতের হিসাবের আরেকটা দিক হল, উত্তরের লোকেরা সূর্যের আলোর কদর জানে, আর সেই হিসেবে ওদের বাড়ি ঘরদোর তৈরি হয়, এবং ঘরের আসবাবও সেটারই প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায়।

যত উত্তরে যাবেন, দেখবেন, জানলার সাইজ বড়ো হচ্ছে, এবং জানলার সংখ্যাও বাড়ছে। বাড়ির সামনে একচিলতে বারান্দা থাকলে সে বাড়ির দাম এবং ভাড়া প্রায় ডবল। একই কারণে সমস্ত বাড়ির সমস্ত ঘরের রঙ সাদা। একটু এদিক ওদিক হতে পারে, কিন্তু সাদা। যেহেতু বেশিরভাগ সময় দিনের বেলা (আমাদের হিসাবে) আলো জ্বলে, রঙ যদি অন্য কিছু হয় তাহলে পরিবেশ হতাশাব্যাঞ্জক হয়ে উঠবে। আবার, একইরকমভাবে, ভারি আসবাব দিয়ে ঘর সাজায় না কেউ। ঘরে যতটা সম্ভব ‘স্পেস’ তৈরি করার চেষ্টা করে। পর্দার ব্যবহার খুব কম। পর্দা তো কিছুটা আলো চেপে দেবে! সারা বছরে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বাড়িগুলোতে যত মোমবাতি পোড়ে, তত বোধহয় পৃথিবীর আর কোনো দেশে হয় না।

উল্টোদিকে, যত দক্ষিণে যাবেন, দেখবেন, জানলার সাইজ ছোটো, বারান্দা যতখানি ঢাকা দেওয়া যায় এবং ঘরের আসবাব ভারি এবং গাঢ় রঙের। ঘরের দেওয়ালের রঙও আমাদের দেশের মতোই। তবে, এটা মনে রাখতে হবে যে, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বাড়িঘরের ডিজাইন এমন হয় যে হাওয়া খেলতে পারে - অবশ্যই বাড়িতে ‘প্যাশিও’ থাকলে। ভাবটা - হাওয়া খেতে হলে বাইরে যাও - ঘরে থাকা কেন?

তাহলে কি দাঁড়াল? আমি দেখেছি, উত্তর ইউরোপে লোকেরা নিজের বাড়ি নিয়ে যত ভাবে, দক্ষিণের লোকেরা তত নয়। স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে স্বামী-স্ত্রী বাড়ির জন্য একটা জিনিস কেনার আগে দশবার ভাবে, কুড়িটা জিনিস্ যাচাই করে, পাঁচটা দোকান ঘোরে, তবে কেনে। স্পেন এবং অন্যান্য জায়গায় (প্রধাণতঃ স্পেনে এবং দক্ষিণ ইতালিতে) ভাবখানা - কিনতে হবে, তাই কেনা, এত পছন্দ করার কি আছে?

ডেনমার্ক বা স্যুইডেনে দেখেছি, বাড়িতে এককণা ধুলো বরদাস্ত করে না কেউ। এটা যেহেতু মজ্জাগত, এই ‘সিমপ্লিসিটি’ আর ‘নীটনেস’, সুতরাং এর প্রভাব কাজের ওপর পড়তে বাধ্য। উত্তর ইউরোপে দেখবেন, কন্ট্রাক্ট খুব সহজ এবং সরল ভাষায় লেখা, এবং কন্ট্রাক্টের দৈর্ঘ্য কখনোই তিন পাতার বেশী নয় - তাও আবার ডবল স্পেসে। কেউ কাজ ফেলে রাখে না, এবং কেউ ঘন্টার পর ঘন্টা মিটিংও করে না।

দক্ষিণে উলটো - ঘরদোর সপ্তাহে একদিন বা দু’দিন তো পরিষ্কার হবেই, রোজ করার কি দরকার? এটা একটা দিক, আবার, সহজ ব্যাপারকে ঘোরালো করে দেবার একটা প্রবণতা আছে। ওই উত্তর ইউরোপের তিনপাতার কন্ট্রাক্ট দক্ষিণে এসে পনেরো পাতা হয়ে যায়। কাজ পড়ে থাকে - ঘর পরিষ্কার রাখা আর অফিসের টেবিল ক্লিয়ার রাখার মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে বইকি!

উত্তরের লোকেদের কাছে বাড়ি হল অভয়াশ্রয়, বাইরে ঠান্ডা আর বরফ, বাড়ি গিয়ে শান্তি। দক্ষিণে, সারাদিন অফিস নয়ত বাড়ির পর, বাইরে বেরিয়ে ফূর্তি, আনন্দ। আর দুপুরে দিবানিদ্রা (সিয়েস্তা) দিয়ে সন্ধ্যা হলেই ক্যাফেতে বসে অন্যরকম জীবনযাত্রা, পেয়ার-মোহব্বত, আড্ডা-ইয়ারী, শরাব-কাবাব। পুরো ভূমধ্যসাগরের উত্তর দিকটা ঘুরে আসুন, একই চালচিত্র।

মোটেও ভাববেন না যে আমি দক্ষিণ ইউরোপের কদর করছি না। দুটো জীবনধারা কত আলাদা, সেটা বোঝাবার চেষ্টা করছি। সেই কবে ১০০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে পাশ্চাত্ত্যের ইতিহাস তো দক্ষিণ ইউরোপেরই ইতিহাস। গ্রিক আর রোমানদের কথা না হয় বাদই দিলাম। সে তো কারো অজানা নয়। তবে এই ব্যাপারটাও দেখার মতো যে ষোড়শ শতাব্দীর পর থেকে উত্তর ইউরোপ এগিয়েছে সমাজ-গঠনে, আর দক্ষিণ ইউরোপ দিয়েছে থিওরি, সমাজ ব্যবস্থার উন্নতি না করেই। সুসংবদ্ধতা উত্তর ইউরোপীয়ানদের রক্তে আছে, আর সেটা লক্ষ্য করার মতো।

এই ভাবধারার বিভিন্নতার প্রভাব ইউরোপীয়ানদের জীবনের ওপর খুব স্পষ্ট। উত্তরের লোকেরা বন্ধুত্ব করে দেখেশুনে, জেনেবুঝে। এবং বন্ধুত্ব করে মানুষ বুঝে, তার টাকা বা সামাজিক পদ বুঝে নয়। আর বন্ধুত্ব থাকেও চিরকালের জন্য। দক্ষিণের লোকেরা অনেকটা বসুধৈব কুটুম্বুকম্‌ হিসাবে চলে। বন্ধুত্ব সহজেই করে, আবার বন্ধুত্ব ভেঙেও যায়।

দক্ষিণে দুর্নীতি বেশী, উত্তরে নেই বললেই হয়। কেন, বলতে পারব না। আমার নিজের ধারণা, দুর্নীতি শুরু হয় ধর্ম ব্যবস্থা থেকে। আমাদের দেশে লোকেরা ভগবানকে ঘুষ দেয় মন্দিরে, সেটা ঘুষ হিসাবে গ্রাহ্য হয় না। তেমনি ক্যাথলিকরাও চার্চে ঘুষ দেয়, স্বর্গে নাম কামানোর জন্য। চিরকালই দিত। তা, মানুষ তো ভগবানেরই রূপ, তাই মানুষকে ঘুষ দেওয়াটা - নিজের কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য - সহজেই আসে। সিস্টেম তো সিস্টেমই হয়! উত্তর ইউরোপের লোকেরা জানে, ভগবান খুশি হন একমাত্র কাজ এবং কর্তব্যপরায়ণতা দেখে। তাই, চার্চে যাক বা না-ই যাক, ওই দুটো ব্যাপারই রক্তে ঢুকে গেছে। লুথার আর ক্যাল্ভিন ভাল করেই বুঝিয়ে গেছেন যে ভগবানকে ঘুষ দেওয়া যায় না।

এবার আসি খাওয়ার ব্যাপারে। স্পেনের সবথেকে প্রিয় ক্যুইজিন হল ‘তাপাস’। তাপাস কি? অনেক রকম খাবার - চীজ্‌ থেকে শুরু করে নানারকম সসেজ, হ্যাম, আল্বুন্দিগাস্ (টম্যাটো গ্রেভিতে ছোটো ছোটো মাংসের কোফ্তা) ইত্যাদি। কোনোটাই বেশি পরিমাণে নয়। আপনি একটা বা দুটো তাপাস নিলেন, দু’গ্লাস ওয়াইন খেয়ে একদল বন্ধুর সঙ্গে গল্প করে চলে গেলেন আর একটা ক্যাফেতে, সেখান আর এক রাউন্ড। এইভাবে সন্ধ্যা কেটে গেল। ইতালিতে আপনি আন্তিপাস্তি নিলেন। এক প্লেটে চার জন দু’টুকরো করে মুখে পুরলেন, আবার অন্য কোথাও, অন্য বন্ধুদের আড্ডায় থানা গাড়লেন। গ্রীসেও তাই। দেশে দেশে তফাৎ - কোথাও রেড ওয়াইন, কোথাও উজো্‌, কোথাও হোয়াইট, কোথাও শেরী, যা আপনার অভিরুচি।

এই পুরো অঙ্কটাই উত্তরে নেই। বাচ্চারা সন্ধ্যার মধ্যে খাবে, সেজন্য পুরো পরিবারকেই সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টার মধ্যে খেয়ে নিতে হবে। অতিথিদের জন্যও একই ব্যবস্থা। কোনোভাবেই বাচ্চাদের আলাদা খাওয়ানো চলবে না।

দক্ষিণে যান, কলকাতার কথা মনে পড়ে যাবে। রাত সাড়ে দশটা এগারোটার আগে কেউ খায় না। বাচ্চারা যখন খুশি খাক, খেলেই হল।

দক্ষিণে খাবারের কতরকম বৈচিত্র, আর ওরা উত্তরের লোকেদের বলে ‘মীট এন্ড পটাটো পীপ্‌ল’। বস্তুতঃ, উত্তরে শাক-সব্জি কমই হয় (অন্তত হত, বিশ্বায়নের ফলে আজকাল ঠিক সে অবস্থা নেই। দশ বছর আগে ডেনমার্কে গিয়ে কাঁচা লংকা খুঁজতে গলদ্‌ঘর্ম হয়ে গিয়েছিলাম, এখন দেখি আকচার পাওয়া যাচ্ছে), এবং লোকেরা মাংস এবং আলু দিয়েই যা বানাবার, বানায়। আর দুধ আর চীজ্‌ তো আছেই। তবে চীজের ব্যাপারে দক্ষিণকে পাল্লা দেওয়া শক্ত। পানীয়ের ব্যাপারেও এটা প্রযোজ্য। পনেরো বছর আগেও উত্তর ইউরোপে দেখেছি ভাল রেড ওয়াইন পাওয়া দুঃসাধ্য ছিল। এখনো যে খুব একটা পাওয়া যায় তা নয়। আর দাম বড্ডো বেশি। দক্ষিণে - পান করুন না, কত করবেন।

এই যে সব কথা বললাম, তার অর্থনৈতিক দিক তো আছেই। রাজনৈতিক দিকও আছে। ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের মতে, নর্ডিকরা হল কৃপণ - ফ্রুগাল পীপল্‌ - স্যুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, হল্যান্ড। পয়সাওলা হল জার্মানি আর ফ্রান্স। বাকিরা সব এদের পয়সাতেই চলছে। গ্রীসের কথা তো সবাই জানেন, নতুন করে কিছু বলার নেই, ইতালির অবস্থা ভালো নয়, স্পেন তথৈবচ। আর পুর্ব ইউরোপ তো ই.ইউ-এর পয়সাতেই প্রায় চলে, আর বাকিটা ধার করে চীন থেকে (এই নিয়ে ভীষণ ঝগড়া চলছে)। রাজনীতির দিক থেকে উত্তর হচ্ছে সমাজতন্ত্র-সমাজকল্যাণের পথিক। স্পেন, গ্রিস, ইতালির রাজনীতি যে কি, সেটা ওরা এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি। এই তো ক’দিন আগে ই.ইউ-তে ঝগড়া হল কোভিড নিয়ে। ইতালি আর স্পেন বললে, আমাদের টাকা চাই। নর্ডিকরা বললে, দেব, কিন্তু শর্ত থাকবে - কোনো এক ভাবে, কোনো একসময়ে টাকা ফেরত দিতে হবে, নইলে বাজেট শর্ট পড়বে। সাতদিন ধরে দিবারাত্র সাতাশটা দেশের প্রধানমন্ত্রীরা মিলে তর্ক করে তবে এঙ্গেলা মার্কেলের মধ্যস্থতায় একটা সমঝোতায় এল। এরকম প্রায়ই হয়ে থাকে।

ম্যানেজমেন্টের লোকেদের পক্ষে এই উত্তর এবং দক্ষিণের তফাতগুলো জানা বিশেষ প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। তার কারণ, আজকের বিশ্বায়নের দিনে বিভিন্ন দেশের লোকেদের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়, দরদস্তুর করতে হয়, সমঝোতা করতে হয়। অবশ্যই আমি যেটুকু বলেছি সেটা যথেষ্ট নয়, তবে একটু আন্দাজ নিশ্চয়ই পাবেন। একটা কথা মনে রাখবার মত - দক্ষিণ ইউরোপে সমঝোতা যত চলে, উত্তরে তা নয়। আর আইনের ব্যাপারে তো উত্তর ইউরোপে কোনো কম্প্রমাইজ হয় না। ওদের কাছে (আর এটা বিশেষ করে জার্মানদের পক্ষে খাটে) সরকার যা বলে দেবে, তাই শিরোধার্য। নিয়ম ছাড়া সমাজ চলে নাকি? স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে দেখবেন, রাত বারোটার সময়, চতুর্দিকে একটাও লোক বা গাড়ি নেই - পেডেস্ট্রিয়ান রেড লাইটে দাঁড়িয়ে আছে - নিয়ম ভাঙ্গা যাবে না। দক্ষিণে তা নয়। সরকার আবার কি মশয়? সেটা তো চোরেদের জায়গা। আমরা ভোট দিয়েছি বলে তারা সাধু পুরুষ হয়ে গেছে নাকি? তারা আবার আইন বানাবে, আর তাই মেনে চলতে হবে? উত্তরের লোকেদের সঙ্গে ব্যবসা করতে গেলে মনে রাখতে হবে যে কড়ারের letter আর spirit এর মধ্যে কোন তফাৎ নেই। একচুল নড়াচড়া হবে না কোথাও। একটা কথা বলে রাখি এই সূত্রে। ইউরোপের বেশিরভাগ ভাষাই ফোনেটিক, এবং একটা শব্দের বেশি মানে হয় না। চাইনীজের মতো নয়। চাইনীজরা ইচ্ছে করে এমন শব্দ ব্যবহার করে যার মানে, দুনিয়ার কাছে যা, চাইনীজদের কাছে ঠিক বিপরীত না হলেও, প্রচ্ছন্ন মানেটা থেকে অনেকটাই দূরে। ইউরোপীয়ানদের সঙ্গে কথা বলা অনেক সহজ। তবে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলা সহজ নয়। যেহেতু ব্যবসা করার জন্য সেটা অত প্রয়োজন নেই, সুতরাং ওদের চিন্তাধারা, পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদির সঙ্গে কিছুটা পরিচিতি থাকলে সুবিধা হবে বইকি।

উত্তর এবং দক্ষিণ ইউরোপের মধ্যে তফাৎ আরো আছে, সব এখুনি আলোচনা করা যাবে না। আভাসমাত্র দিলাম। পাঠক যদি প্রশ্ন করেন, উত্তর দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করব।