আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

প্রাক-প্রাথমিকে ছল-চাতুরী

প্রবুদ্ধ বাগচী


সদ্য প্রকাশিত যে জাতীয় শিক্ষানীতি দেশ জুড়ে প্রবর্তন করার জন্য কেন্দ্রের শাসকদল মরিয়া, তাকে ঘিরে বিতর্ক ও আপত্তির প্রতিবেদন বেশ দীর্ঘ। নানা ফোরামে নানাভাবে সেইসব দুর্বলতার জায়গা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চালানো হচ্ছে। যদিও এইসব আলোচনা বা সমালোচনার উদ্দেশ্য মহৎ হলেও কার্যত এগুলো ভস্মে ঘি ঢালার সামিল কারণ দেশের হর্তা-কর্তারা একরকম ঠিক করেই ফেলেছেন তাদের ওই ঘোষিত নীতি তারা যে কোনো মূল্যে চালু করবেনই করবেন। বিরোধীরা বা সত্যিকারের শিক্ষাবিদরা কী বলছেন তা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। সকলের কথা মন দিয়ে শোনার তেমন তাগিদ থাকলে তারা সংসদ এড়িয়ে বা বিস্তারিত মতপ্রকাশের মঞ্চগুলো উপেক্ষা করে এই অতিমারীর সময়ে শিক্ষানীতি নিয়ে বাড়তি সক্রিয়তা দেখাতেন না। কিন্তু তেমনটা ঘটছে না - দেখেশুনে মনে হয়, কোথাও কারোর কাছে যেন তাদের কথা দেওয়া আছে - সেই প্রতিশ্রুতি না রাখলেই নয়!

নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তাবে অনেক ধরনের চমকদার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। কারোর কারোর অবশ্য এইসব নিদান পড়তে পড়তে নোটবন্দির রাতে বা জিএসটি প্রচলনকালীন অধিবেশনে কিংবা একুশ দিনের লকডাউনের ঘোষণার টিভি-ভাষণের স্মৃতি উপচিয়ে পড়ছে বলে জনশ্রুতি। কিন্তু শিক্ষা নিয়ে রকমারি চমক তৈরির জন্য এই ষাট পৃষ্ঠার সরকারি বিজ্ঞপ্তিটিকে একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত বলে ধরা যেতেই পারে। এইরকমই একটা বিষয় হল দেশের প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা। নতুন শিক্ষানীতি অনুযায়ী আঠারো বছর অবধি শিক্ষা স্তরের মধ্যে তিন থেকে ছয় বছরের পড়ুয়াদের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এতদিন প্রাথমিক শিক্ষার ক্লাস বলতে ক্লাস ওয়ান থেকে ফোর বোঝানো হত, ক্লাস ফাইভ থেকে শুরু হত পরের মাধ্যমিক ধাপ। নতুন ভাবনার আলোয় শিশুদের তিন থেকে আট বছর বয়সকে ধরা হচ্ছে বুনিয়াদী বা ফাউন্ডেশনাল শিক্ষার স্তর - তার মধ্যে রয়েছে দুটো উপপর্ব। একটা তিন থেকে ছয় বছর অবধি প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা, অন্যটি ছয় থেকে আট বছরের মধ্যে ক্লাস ওয়ান ও টু। ক্লাস থ্রি থেকে ক্লাস ফাইভ কে বলা হয়েছে প্রিপারেটরি, ক্লাস সিক্স থেকে এইট হল মধ্যমস্তর আর ক্লাস এইটের পর থেকে টুয়েলভ অবধি ধরা হচ্ছে মাধ্যমিক স্তর।

এখন নতুন কথাটা হল, এই প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়টা এতদিন সরকারি শিক্ষানীতিতে উল্লেখ করা হত না। যাবতীয় চিন্তাভাবনা শুরু হত প্রাথমিক শিক্ষার স্তর থেকে। যদিও সারা দেশে শিশুদের পুষ্টি ও প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে সরকারি ভাবনা যেটুকু ছিল তা আইসিডিএস প্রকল্পকে কেন্দ্র করে। কিন্তু আইসিডিএস-এর পরিচালনাগত নিয়ন্ত্রণ সব রাজ্যেই নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্ততরের আওতায় যার সঙ্গে শিক্ষা দপ্তরের কোনো যোগাযোগ নেই। তবে এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে গিয়ে গত কয়েকবছরে দুটো জিনিস ঘটেছে। প্রথমত, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের দিক থেকে তার জীবনের প্রথম তিন বছর যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, নানা বিশেষজ্ঞ সংস্থার পরামর্শ ক্রমে সরকারিভাবে তা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। প্রচার করা হয়েছে শিশুর মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশের প্রায় ৮৫ শতাংশ ওই তিন বছরের মধ্যে ঘটে যায় তাই ওই সময়কাল শিশুর পক্ষে ভীষণ জরুরি। এমনকি, শিশুদের পুষ্টি নিয়ে কেন্দ্রীয় স্তরে যে সব গবেষণা করা হয় সেইসব সংস্থার প্রধান নিপসিড (National Institute of Public Cooperation & Child Development) গত দু তিন বছর আগে নতুন একটা কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল যার নাম ‘প্রথম একহাজার দিন’ - এই প্রকল্পে মাতৃগর্ভ থেকে প্রথম এক হাজার দিন অবধি শিশুর কী কী পরিচর্যা করতে হবে তার একটা বিস্তারিত রূপরেখা তৈরি করে বিভিন্ন স্তরে প্রচার করা হয়েছিল। অমিতাভ বচ্চন এই প্রকল্পের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার হিসেবে কিছুদিন এগুলি প্রচার করেছিলেন। গত বছর (২০১৯) সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কেন্দ্রীয় সরকারের খাদ্য ও পুষ্টি পর্ষদ দেশ জুড়ে যে ‘জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ’ আয়োজন করেছিলেন তার থিম ছিল এই এক হাজার দিনের পুষ্টি। এই কর্মসূচির পাশাপাশি গত ২০১১-১২ সাল থেকে যখন আইসিডিএস প্রকল্প স্কিম থেকে মিশন মোডে পরিবর্তিত হয় সেই পরিকল্পনার মধ্যে শিশুদের প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার বা ইসিসিই (Early Childhood Care & Education) দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতে থাকে। তৈরি হয় নতুন ধরনের প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার সিলেবাস, তার উপকরণ, কীভাবে সেই শিক্ষা দেওয়া হবে সেই বিষয়ে নানা স্তরে প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। পাশাপাশি সর্বশিক্ষা মিশন এর অধীনে প্রাথমিক স্কুলগুলিতে একটা করে ক্লাস রাখার কথা বলা হয় যেখানে প্রাক প্রাথমিকের শিশুরা আসতে পারে। কাজেই শিক্ষা নীতির মধ্যে সেইভাবে না এলেও বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা নিয়ে কিছু কিছু উদ্যোগ যে হয়নি তা নয়। বিশেষ করে ২০০৪এ ইউপিএ-১ সরকারের সময়কালে সারা দেশে আইসিডিএস প্রকল্পের সার্বজনীকরণ হওয়ার পর তার সূত্রেই এইসব চিন্তা শুরু হয়েছিল।

কিন্তু এইসব উদ্যোগ যা নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে সদিচ্ছা থাকলেও অনেক ধরনের পরিকাঠামোগত সমস্যা ছিল যা অস্বীকার করার কোনো রাস্তা নেই। গণ্ডগোল হল এইবারের শিক্ষানীতিতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হল ঠিকই কিন্তু বাকি বিষয়ের ওপর আর কোনো নজর দেওয়া হল না। ব্যাপারটা খানিকটা এইরকম, একজন বয়স্ক গুরুস্থানীয় কারোর কাছে আমি/আপনি পরামর্শ চাইতে গেলাম তিনি একটা উঁচু আসনে বসে বেশ কিছু ভাল ভাল পরামর্শ দিলেন কিন্তু আদৌ সেগুলো আমরা মেনে চলতে পারার জায়গায় আছি কি না তা আর বিচার করে দেখা হল না। হালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে ‘গুরুদেব’ কেন্দ্রীয় সরকার প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে ঠিক এই কাজটাই করে বসেছে। তবে সেটা বুঝতে গেল খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে তারা আসলে এই বিষয়ে কী কী বলেছে। তালিকাটা অনেক বড়, তবে তার মধ্যে একটা সার সংক্ষেপ করে মূল বিষয়গুলো একটু দেখা যেতে পারে।

প্রথমেই বলা হয়েছে, উপযুক্ত গুণমানের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শিশুরা পাচ্ছে না তাই যথার্থ গুণসম্পন্ন শিক্ষার ব্যবস্থা করা আশু কর্তব্য যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে সকলের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য স্পর্শ করা যায়। এই বিষয়ে এনসিইআরটি-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যাতে তারা সারা দেশের জন্য একটি উন্নত মানের পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাগত কাঠামো তৈরি করেন যা অনুসরণ করে গড়ে উঠবে এই ব্যবস্থাটি। সেই কাঠামোর থাকবে দুটি উপবিভাগ - একটি তিন বছরের নীচে শিশুদের জন্য অন্যটি তিন থেকে আট বছরের শিশুদের জন্য। ইসিসিই-কে ধাপে ধাপে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্র, প্রাইমারি স্কুল ও আলাদা প্রাক-প্রাথমিক স্কুলগুলির ব্যাপক রদবদল ঘটিয়ে নিয়োগ করতে হবে প্রশিক্ষিত শিক্ষিকা। অঙ্গনওয়ারী কর্মীদের জন্য চালু হবে আলাদা ধরনের বিশেষ প্রশিক্ষণ যা দেওয়া হবে মূলত অনলাইন ও দূরশিক্ষা (ডিস্ট্যান্স লার্নিং) ব্যবস্থার মাধ্যমে। দেশের সব অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্রগুলির জন্য থাকবে শিশুদের উপযোগী ক্লাস ঘর, খেলার সরঞ্জাম, খেলার মাঠ ইত্যাদি। আশা করা হয়েছে, এর ফলে পাঁচ বছরের নীচে সব শিশুই প্রাইমারি স্কুলের প্রিপারেটরি ক্লাসের উপযোগী হয়ে উঠবে এবং একদম প্রস্তুত হয়ে তারা যোগ দেবে শিক্ষার দ্বিতীয় স্তরে। শুনতে এর কোনোটাই মন্দ নয় বরং কোনোটা কোনোটা তো বেশ ভাল। যদিও ভুলে যাওয়া সংগত হবে না বর্তমান আর্থিক বছরের (২০২০-২১) বাজেটে নারী ও শিশু উন্নয়নের খাতে কেন্দ্রের বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে তার আগের বছরের (২০১৯-২০) তুলনায় মাত্র ১৪ শতাংশ যা তার আগের বছরে (২০১৮-১৯) বেড়েছিল ১৭ শতাংশ - এর মধ্যে শুধুমাত্র অঙ্গনওয়ারী পরিষেবার জন্য বৃদ্ধির হার মাত্র ৩.৫১ শতাংশ!

এবার তাহলে দেখতে হবে, স্বপ্নের বিরিয়ানি আসলে রান্না হবে কেমন করে? প্রথম বিষয় পরিকাঠামো। প্রতিটি অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্রকে উপযুক্ত ভাবে গড়ে তোলার কথা বলা যত সহজ, কাজটা ঠিক ততটাই কঠিন। এই মুহূর্তে সারা দেশে ১৩ লক্ষ ৭৭ হাজার অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্র রয়েছে (ডিসেম্বর ২০১৯ এর তথ্য) - সাধারণভাবে এই কেন্দ্রগুলিতে একটি ঘর থাকে যেখানে শিশুরা এসে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা নেয়, সঙ্গে আদর্শগত ভাবে থাকা উচিত একটি রান্নাঘর বা স্টোররুম, একটি শৌচালয় ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটা মোটেও তেমন নয়। নানা রাজ্যের মধ্যে এই চিত্রের তারতম্য থাকলেও মোটামুটিভাবে গ্রামীন প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে এই পরিকাঠামোগত ঘাটতি চোখে পড়ার মতো। কর্ণাটকের একটি সমীক্ষা (সেপ্টেম্বর ২০১৯) বলছে, সেই রাজ্যের ৮৫ শতাংশ গ্রামীণ প্রকল্পের কেন্দ্রের নিজস্ব বাড়ি আছে, এটা আশাব্যঞ্জক হলেও একই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে পঞ্জাবের ভাতিন্ডা জেলায় নিজস্ব বাড়ি না থাকায় অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্র খোলা জায়গায় গাছের তলায় চলছে। এই রাজ্যে করা একটি সমীক্ষা (সেপ্টেম্বর ২০১৬) জানাচ্ছে, রাজ্যের ৩৯ শতাংশ কেন্দ্রের নিজস্ব বাড়ি আছে, তার আগে (২০১০-১১) এই রাজ্যে উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, হুগলী, হাওড়া এইসব কলকাতা সংলগ্ন জেলাগুলিতেও প্রচুর অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্র খোলা জায়গায় চালানো হত। অবশ্য একদম সাম্প্রতিক কালে (সেপ্টেম্বর ২০২০) এই সংখ্যা বেড়েছে, সেই প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব। এখন একটি ক্লাস নেওয়ার ঘর এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করাটাই যেখানে অধরা রয়ে গেছে সেখানে এই প্রায় চোদ্দ লক্ষ কেন্দ্রে উপযুক্ত পরিকাঠামোর বন্দোবস্ত কেমন করে করা সম্ভব ? খেয়াল রাখতে হবে, কেন্দ্রের সরকার কিন্তু সারা দেশের অঙ্গনওয়ারীগুলির অবস্থা বিষয়ে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল - কারণ সরকারি তরফে গত ডিসেম্বরে (২০১৯) ঘোষণা করা হয়েছিল ‘সক্ষম অঙ্গনওয়ারী’ স্কিমের আওতায় তারা আগামী পাঁচ বছরে (অর্থাৎ ২০২৫ এর মধ্যে) আড়াই লক্ষ কেন্দ্রকে শিশুদের পক্ষে সব দিক থেকে উপযোগী করে গড়ে তুলবেন। তার অর্থ দাঁড়ায়, এই চোদ্দ লক্ষ কেন্দ্রকে আধুনিক মানের করে তুলতে সরকারের অন্তত পঁচিশ ছাব্বিশ বছর সময় লাগবে ! তাহলে জাতীয় শিক্ষানীতি কি ততদিন মুলতুবি থাকবে?

তা-ও নাহয় ধরে নেওয়া গেল সরকার এটুকু করে দিলেন। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে শিক্ষানীতির মধ্যে এনে ফেলার ফলে ঠিক যেভাবে ভাবা হচ্ছে তাতে কিন্তু তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের সঠিকভাবে গুণমানের শিক্ষা দিতে গেলে প্রতি কেন্দ্রে দরকার হবে অন্তত তিনটে ক্লাসরুম নাহলে বয়স অনুযায়ী আলাদা আলাদা করে শিশুদের পড়ানো যাবে না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে সারা দেশে যেসব প্রি স্কুল চলে সেখানে অন্তত তিনটে শ্রেণিতে ভাগ করে শিশুদের পড়ানোর ব্যবস্থা রাখা হয়্।একইভাবে সেই রকম ভাবলে এইবার একজন শিক্ষিকার বদলে প্রয়োজন হয়ে পড়বে তিনজন শিক্ষিকা - কারণ উপযুক্ত গুণগত শিক্ষার কথা যখন ভাবা হচ্ছে তখন একটাই ঘরের মধ্যে নানা বয়সের শিশুদের শিক্ষা দেওয়া বাস্তব কারণেই অসম্ভব। তার মানে এখনকার তথ্য অনুযায়ী সরকারকে বাড়তি নিয়োগ করতে হবে ২৫ লক্ষ ৬০ হাজার অঙ্গনওয়ারী কর্মী। নতুন কর্মী নিয়োগের কথা একবারের জন্যও উচ্চারিত হয়নি সরকারি প্রস্তাবে। বলা হয়েছে বর্তমান অঙ্গনওয়ারী দিদিমণিদের প্রশিক্ষণের কথা। সেই প্রশিক্ষণ হবে অনলাইন বা দূরসঞ্চার পদ্ধতিতে - শিশুদের একেবারে বুনিয়াদি শিক্ষা, যা নাকি খেলাধূলা, গান, নাচ, ছবি আঁকা ইত্যাদির মাধ্যমে শেখানোর কথা বলা হয়েছে সেগুলি অনলাইন মাধ্যমে কতদূর গ্রহণযোগ্য হবে এই নাছোড় প্রশ্ন কিন্তু পিছু ছাড়ে না। তাছাড়া প্রত্যন্ত এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ ও স্মার্ট ফোনের কার্যকারিতা না থাকায় অনলাইন মাধ্যম যে সকলের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাবে না এটা অন্তত আজ কোভিড পরিস্থিতির পরে সর্বস্তরেই প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। সেই প্রশ্নটাকে শিক্ষানীতির প্রবক্তারা সজোরে অস্বীকার করেছেন, তাদের বাস্তবরহিত ধারনায় সবকিছুই অনলাইনে হওয়া সম্ভব।

বেশ তা-ও নয় প্রশিক্ষণ হল। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে প্রশিক্ষণের প্রশ্নে ধরে নেওয়া হল, বর্তমান কর্মীরা তাদের পরিষেবা বন্ধ না করে প্রশিক্ষণ নেবেন যার মানে, এই বিষয়ে কোনো ছুটি বা বাড়তি সময় দেওয়া হবে না। এখনকার যে নিয়ম আছে তাতে নিয়োগের পরে অঙ্গনওয়ারী কর্মীরা কোনো সরকার নির্ধারিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আবাসিক হিসেবে একমাসের প্রশিক্ষণ পান ও ওই সময়ের থাকা ও খাওয়ার ব্যয় সরকার বহন করেন, প্রশিক্ষণ চলাকালীন তারা নিয়মিত ভাতাও পান। প্রশিক্ষণ শেষে অল্পদিনের জন্য কোনো অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্রে তারা শিক্ষানবিশ হিসেবে যুক্ত থাকেন। যে উপযুক্ত গুণমানের শিক্ষা শিশুদের দেওয়ার জন্য সরকারের এত মাথাব্যথা তার ব্যবস্থা করার প্রশিক্ষণ পদ্ধতিটা বড্ড শর্টকাট বলে মনে হচ্ছে না ? তাছাড়া, সারা দেশেই অঙ্গনওয়ারী কর্মীরা সাম্মানিক ভাতা পান তাদের পক্ষে এটা স্থায়ী চাকরি নয়। ভাতার পরিমাণও বিরাট অঙ্কের নয়, ন্যূনতম আঠার হাজার টাকা ভাতার দাবিতে তারা দীর্ঘদিন ধরে সারা দেশে আন্দোলন করছেন। প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার গুরুভার দেশের আগামী নাগরিকের জন্য যাদের বহন করতে বলা হচ্ছে তারা নিজেরাই যদি বঞ্চিত থেকে যান তাহলে সেটাও কি সামগ্রিক ভাবে মানব সম্পদের প্রতি সুবিচার হবে? কিন্তু জাতীয় শিক্ষানীতির পাতায় পাতায় অনেক ভাল ভাল কথা থাকলেও এইসব নিয়ে তারা রা কাড়েননি, উপরন্তু দফতরের শিরোনাম থেকে ‘মানব সম্পদ’ শব্দটা তারা ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দিয়েছেন।

এইবার দেখা যাক খরচের হিসেবনিকেশ। সারা দেশ নয়, এই রাজ্যের নিরিখে এই হিসেবটাকে একটা মডেল ধরা যায়। পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে চালু অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্রের সংখ্যা ১,১৬,৭৬১ (সেপ্টেম্বর ২০২০) এবং অনুমোদিত আছে ১,১৯,৪৮১ - অর্থাৎ প্রায় তিন হাজার কেন্দ্র এখনো চালু হয়নি। গত ২০১২ সাল থেকে রাজ্যের নারী ও শিশুবিকাশ দফতর এখানকার অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্রগুলোকে শিশুদের উপযোগী করার জন্য একটা পরিকল্পনা নেন (যা আসলে ২০১১ সালের এই বিষয়ক কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্পের অনুসারী) এবং নতুন কেন্দ্রগুলির নাম দেওয়া হয় ‘শিশু আলয়’। ‘শিশু আলয়’ প্রকল্পের আওতায় এই মুহূর্তে রাজ্যের প্রায় ৫৪০০০ কেন্দ্রকে উন্নতমানের স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং ইসিসিই বিষয়ক যে জাতীয় কর্মসূচি আছে সেই অনুযায়ী এখানে পঠনপাঠন চলছে। এইসব কেন্দ্রগুলিতে আছে একটি বড় ঘর, রান্না ঘর, স্টোর রুম, শৌচালয়, সামনে কিছুটা খোলা জায়গা সেখানে শিশুদের খেলার উপকরণ, কিচেন গার্ডেন, প্রিস্কুল এর নানা সরঞ্জাম ইত্যাদি। এগুলি বেশিরভাগই গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত, কারণ এইগুলি তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রধান যেটা দরকার অর্থাৎ খাস জমি বা দান করা জমি তা শহরে পাওয়া সম্ভব নয়। কার্যত সারা রাজ্যেই শহরাঞ্চলের বেশির ভাগ অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্রগুলির মান খুবই খারাপ যেগুলি মূলত পরিচালিত হয় ক্লাবঘর ভাড়া নিয়ে। শহরের বস্তি অঞ্চলে খোলা জায়গা পাওয়া যায় না ফলে সবটাই খুব সঙ্কীর্ণ পরিসরে চলে।

এখন একটি কেন্দ্রকে ‘শিশু আলয়’ পর্যায়ে উন্নীত করতে সরকারি স্তরে গড় ব্যয় হয়েছে কেন্দ্র পিছু বারো লক্ষ টাকা। এর জন্য কোনো আলাদা খাতে বরাদ্দ ধরা ছিল না।ব্লক স্তরে পঞ্চায়েত সমিতির কাছে যেসব নানা ধরনের উন্নয়ন বিষয়ক অর্থ আসে তার থেকেই এই ব্যয় করা হয়েছে। অর্থাৎ শুধুমাত্র ৫৪০০০ শিশু আলয় তৈরি করতে ইতিমধ্যে খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে ছহাজার কোটি টাকা। সরল পাটিগণিত বলে, বাকি কেন্দ্রগুলিকে অনুরূপ ভাবে উন্নীত করার খরচ আরো অন্ততপক্ষে সাত হাজার কোটি টাকা। আবার বলি, এই অর্থ খরচ করে যে পরিকাঠামো তৈরি হচ্ছে তা একটিমাত্র ক্লাস ঘরের জন্য, আদপে শিক্ষানীতির প্রস্তাব মোতাবেক লাগবে তিনটে ক্লাস ঘর। এবার রাজ্যের হিসেবটাকে ছড়িয়ে ধরা যাক সারা দেশের ওপর। এই বিষয়ে দেশের প্রথম আধুনিকতম অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্রটির কথা ভাবা যেতে পারে। পাঁচ বছর আগে (জুন ২০১৫) হরিয়ানার সোনপতে সাতশো আশি স্কোয়ার ফুটের অতি উন্নত মানের এই কেন্দ্র তৈরিতে খরচ হয়েছিল বারো লক্ষ টাকা। মূল্যবৃদ্ধির হার ধরে নিলে আগামী কয়েক বছরে এই ধরনের কেন্দ্র তৈরি করতে কেন্দ্রীয় সরকারের খরচ হবে প্রায় এক লক্ষ সত্তর হাজার কোটি টাকা। কোথা থেকে আসবে এই অর্থ ? সারা দেশে শিক্ষা খাতে যে ব্যয় করা হয় তার মধ্যে এই বিপুল ব্যয়ের কথা কি কোথাও বলা হয়েছে এখনো অবধি? তাহলে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতির যে সব মোহময় ‘বাতচিতের’ ছড়াছড়ি তার কি সবটাই ঢক্কানিনাদ নয়? নাকি এইসব যাবতীয় অর্থের দায় এড়িয়ে আসলে তারা জিইয়ে রাখতে চান সেই এক ম্লান চিত্রটাই, বাকিটা সবটুকুই একটা লোক দেখানো নাটক ছাড়া আর কিছু নয়! কার কাছে তাদের কী কথা দেওয়া আছে, তারাই জানেন। কিন্তু উচ্চ গুণমানের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের যে মহতী প্রয়াসের কথা উচ্চ গ্রামে প্রচারিত হচ্ছে আসলে তা একটা মস্ত ভাঁওতা ছাড়া কিছু নয়।